রাত দুইটার মতো বাজে। শান্ত নিরিবিলি একটা গ্রাম, কী নাম এ গ্রামের? এ গল্পের জন্য গ্রামের নাম জরুরি নয়। এ গ্রামে মানুষজন ঘুমিয়ে পড়ে আটটার দিকেই। কাজেই রাত দুইটা ওদের জন্য গভীর রাত তো বটেই। ঝিঁঝি পোকার অবিশ্রান্ত শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই এখানে। তবে কান পাতলে গাছের পাতার ঝিরঝির শব্দ শোনা যায়। মন খারাপ করা একটা অবিরাম শব্দ।
হঠাৎ অদ্ভুত একটা কাণ্ড হলো। ঝিঁঝি পোকার শব্দ বন্ধ হয়ে গেল। শুধু গাছের পাতার ঝিরঝির শব্দটা রইল। একটু পর দ্বিতীয় দফায় আবার ঝিঁঝি পোকার শব্দ শুরু হলো, কিন্তু এটা যেন ঠিক ঝিঁঝি পোকার শব্দ নয়। তাহলে কিসের শব্দ!...এই মুহূর্তে এই গ্রামের কেউ জেগে নেই। যদি জেগে থাকত, তাহলে টের পেত, শুক্লপক্ষের আলোঝলমলে চাঁদের নরম আলোটা হঠাৎ ঢেকে গেছে কোনো কারণে...কারণটা কী? কারণ, একটা বিশাল গোল চাকতি সমস্ত আকাশটা ঢেকে স্থির হয়ে থেমে আছে; ছোট্ট গ্রামের ওপর অনেকটা বিশাল একটা ছাতার মতো। হঠাৎ বিশাল চাকতির ঠিক নিচে দরজা খোলার মতো কিছু একটা গোলমতো খুলল। এবার আরেকটা ছোট চাকতি বের হয়ে এল...সেটা খুব ধীরে উপবৃত্তাকারে ঘুরে এসে থামল সেই গ্রামের ভেজা মাটিতে, প্রায় নিঃশব্দে। রাতে আজ একপশলা বৃষ্টি হয়েছে।
ছোট চাকতিটা থেকে মানুষের মতো দুজন নেমে এল, ছোটখাটো...মাথাটা একটু বড়। তারা কিছু একটা বলাবলি করছিল, তাদের ভাষা বোঝা মুশকিল। তবে এ গল্পটি বোঝার জন্য আমাদের তাদের ভাষা বুঝতে হবে। তারা ঠিক কী বলছিল!
—তাদের ধ্বংস করা কি খুব জরুরি ছিল?
—হ্যাঁ ছিল। ওপরের নির্দেশ বলতে পারো, আমরা তাদের সবাইকে হত্যা করব।
—কাজটা আমরা কীভাবে করব? আমি কিন্তু কিছুই জানি না। আমাকে জানানো হচ্ছে না।
—এই মিশনে তোমার খুব বেশি জানার দরকার নেই। তুমি শুধু আমাকে সাহায্য করবে; কোনো প্রশ্ন করবে না। এভাবেই এই পাইলট প্রোগ্রাম সাজানো হয়েছে।
—বুঝলাম। কিন্তু ওদের হত্যা করব কীভাবে?
—আমি সঙ্গে করে বিশেষ ধরনের একটা গ্যাস এনেছি, সেটা ওদের দিকে ছুড়ে দেব। এই গ্রহের অক্সিজেনের সঙ্গে এই বিশেষ গ্যাস বিক্রিয়া করে পরিবেশটা এক সেকেন্ডের এক হাজার ভাগের এক ভাগ সময়ের মধ্যে বিষাক্ত করে তুলবে, ওরা আর কেউ বেঁচে থাকবে না। ওদের শরীরের ভেতরের সাদা হাড়গুলো ফুটে উঠবে মুহূর্তে!
—মানে ওদের শরীরের বাইরে মাংসল আস্তরণ পুড়ে যাবে?
—অনেকটা তা–ই।
—আমরা এমনটা কেন করছি?
—এটা ডি ফোর সিভিলাইজেশনের সিদ্ধান্ত।
—কিন্তু কেন?
—অন্য কেউ নয়, এই মহাবিশ্বে শুধু আমরা থাকব। আমরা...
ওরা এবার তৃতীয় একটি ঘরের সামনে দাঁড়াল। এখানেও তারা আগের মতো জানালা দিয়ে উঁকি দিল। এবারও ওরা অস্ফুটভাবে বলল, আশ্চর্য! আশ্চর্য!!
ওরা গ্রামের প্রথম একটা বাড়ির সামনে দাঁড়াল। মাটির দেয়াল দিয়ে তৈরি বাড়ির কাঠের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ, কিন্তু জানালা খোলা। দুজনই ভেতরে উঁকি দিল এক এক করে। সাহায্যকারী ফিসফিস করল, ‘তোমার বিশেষ গ্যাস কি এখনই ছুড়বে?’
—আগে দেখে নিই। ওদের পজিশন...আশ্চর্য!
—কী হলো?
—দেখো।
—আশ্চর্য!! দ্বিতীয়জনও একইভাবে বলল।
ওরা দ্বিতীয় একটি ঘরের সামনে দাঁড়াল। এবারও তারা জানালা দিয়ে উঁকি দিল এবং দুজন পরপর বলল, আশ্চর্য! আশ্চর্য!
ওরা এবার তৃতীয় একটি ঘরের সামনে দাঁড়াল। এখানেও তারা আগের মতো জানালা দিয়ে উঁকি দিল। এবারও ওরা অস্ফুটভাবে বলল, আশ্চর্য! আশ্চর্য!!
আরও কয়েকটা ঘরে উঁকি দিল এবং একইভাবে আশ্চর্য! আশ্চর্য!! বলল। এবং বলতেই থাকল।
—বুঝতে পারছ বিষয়টা?
—হ্যাঁ, ওরা কেউ বেঁচে নেই। সম্ভবত বহু আগেই সবাই মারা গেছে। যার যার বিছানায় মরে পড়ে আছে। তাদের সাদা হাড়হাড্ডি বের হয়ে আছে।
—কঙ্কাল
—হ্যাঁ, ওদের সবার কঙ্কাল আমরা দেখতে পাচ্ছি। তারা বহু আগে থেকেই মৃত।
—কিন্তু কেন? কীভাবে?
—তারা আত্মধ্বংসী প্রজাতি...নিজেদের নিজেরাই ধ্বংস করেছে কোনোভাবে। আমাদের ধারণা ছিল, কিন্তু এত আগেই ওরা নিজেদের ধ্বংস করবে ভাবিনি।
—এখন আমরা কী করব?
—চলো ফিরে যাই। এ গ্রহে কোনো জীবিত প্রাণী নেই। তারা ভেজা মাটির ওপর দিয়ে হেঁটে গিয়ে তাদের ছোট্ট চাকতি মতো জিনিসটার ভেতরে ঢুকে গেল। তারপর সেটা নিঃশব্দে উপবৃত্তাকারে ঘুরে ওপরে উঠে বিশাল বড় চাকতিটার সঙ্গে মিশে গেল। তারপর হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে গেল মহাকাশে।
ওই গ্রামের ঝিঁঝি পোকারা আবার ডাকতে শুরু করল। গাছগাছালির পাতায় ঝিরঝির শব্দ হতে থাকল। সেই মন খারাপ করা শব্দ। শব্দটা শুনলে মনে হয় আহা আমার পৃথিবী, তোমাকে একদিন ছেড়ে যেতে হবে আমাদের। এটাই কি মন খারাপ হওয়ার কারণ? কে জানে!
ইয়ে...বিশাল চাকতির এলিয়েনরা কিন্তু একটা ছোট্ট ভুল করেছিল। তাদের বড় বেঢপ মাথাটায় কোনাকুনি চোখ দুটির ভিশন কিন্তু পৃথিবীর মানুষের মতো ছিল না। তাদের ভিশন ছিল এক্স–রে ভিশন। সেটা কি তারা জানত না? কে জানে। অনেক সময় একটা বড় কারণ একটা ছোট্ট কারণের আড়ালে ঢাকা পড়ে যায়!
পরদিন গ্রামটা আবার জেগে উঠল। সবাই যার যার গার্হস্থ্য কাজ শুরু করল, পুরুষেরা ছুটল খেতখামারে; কেউ পাশের নদীতে মাছ ধরতে। আর শিশুরা ছুটল তাদের পাঠশালায়। তবে তারা কেউ জানল না একটা বিশাল চাকতি এসেছিল তাদের গ্রামে, গভীর রাতে।