তারা বসে থাকে, পাখি উড়ে যায়।
তাতে কী হয়?
তারা নিরাশ হয়?
না। চিন্তিত হয়।
পাখি উড়ে যায়, তারা যায় না। কেন নয়? ডানা নেই তাদের।
আর কী কী চিন্তা করে তারা?
চিন্তা করে পাখিরা উড়ে আরেক দ্বীপে যায়, অন্তরীপে যায়, মরূদ্যানে যায়। পুরোনো গ্রন্থে তারা এই বিবরণ পড়েছে। না হলে অন্তরীপ বা মরূদ্যানের ধারণা তাদের মস্তিষ্কে থাকত না হয়তো। আর কোনোখানে উড়ে যাওয়ার কথাও তারা চিন্তা করত না।
কোনো দ্বীপে।
অন্তরীপে।
মরূদ্যানে।
কবে থেকে তারা আছে এই দ্বীপে?
তারা জানে না। বিবরণ নেই পুরোনো গ্রন্থে।
১৯ শ ১৯ জন। তারা জানে তারা এই দ্বীপে সব সময় ধরে আছে। ছিল, আছে এবং থাকবে। সব সময় তারা ১৯ শ ১৯ জন। একজন কম নয়, একজন বেশিও নয়। কেন?
দ্বীপে তাদের সব দিন এক রকম যায়। প্রচ্ছন্ন, প্রহেলিকাময়। সব রাত যায় পরাবাস্তব। সকালে ঘুম থেকে উঠে তারা যে যার মতো গন্তব্য ধরে বাথানের। অন্তহীন বাথানের প্রকাণ্ড পাথরের গেট নির্দিষ্ট ক্ষণে বন্ধ হয়ে যায়। ১৯ শ ১৯ জন, বাথানে ঢোকার পর থেকে তাদের কারও সঙ্গে আর কারও দেখা হয় না। তারা জানে না, এটা ঘটে কীভাবে। রহস্যময় জায়গা বাথান। প্রহেলিকাময়। তারা যতক্ষণ কাজ করে, ততক্ষণ জানে, তারা কী করছে। বাথান থেকে বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভুলে যায়। অদ্ভুত।
পুরোনো গ্রন্থে এক হলুদ টিউনিকা গ্রহের বিবরণ আছে। সেই গ্রহের সেরা পানীয় যোকো। উষ্ণতাদায়ক ও পরাবাস্তব পানীয়। চুমুক দেওয়ামাত্র বাস্তবকে পরাবাস্তব করে দেয়। পুরোনো গ্রন্থের ত্রয়োদশ পরিচ্ছদে আছে, এটা রেডিকুলাস। বাস্তবমাত্র মায়া যদিও।
এই দ্বীপে কিছু যোকো পাব আছে।
সমুদ্রের তলদেশ দিয়ে আসে টিউনিকানরা। যোকো রেখে যায়। যদিও তাদের কেউ কখনো দেখেনি, তবু তারা যে আসে, সেটা জানে দ্বীপের ১৯ শ ১৯ জন। না হলে যোকো চাষ হয় না দ্বীপে, তা–ও পাবে যোকোর মজুত কেউ কখনো নিঃশেষ হতে শুনেছে? কোনো দিনও?
যোকো পান করে উষ্ণ হয় তারা। পরাবাস্তবতায় যায়। পরাবাস্তব গল্পগাছা করে।
‘হেই, উড়ে কোথায় যায় দেখা পাখিরা?’
‘রিবা অন্তরীপে।’
‘রিবা অন্তরীপে মানুষ থাকে?’
‘না। প্রকৃত পাখিরা মানুষের “নিকটে” যায় না।’
‘নিকটে যায় না? আমরা কি মানুষ?’
‘পাখিরা আমাদের নিকটে থাকে? মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যায় শুধু। মুশকিল হলো তুমি কিছু পড়ো না, হিউপ। না পুরোনো গ্রন্থ, না ফিকশন, না কবিতা।’
পুরোনো গ্রন্থ বা ফিকশন নয়, হিউপ কবিতা নিয়ে পড়ল, ‘কবিতা! ডাউন টাউনের হতচ্ছাড়াটার কবিতার কথা যদি বলো, আমি নাচার, ট্যাট। ও হতচ্ছাড়াকে দেখলেই আমার সর্বাঙ্গ জ্বালা করে ওঠে। রাগে কপালের রগ দপদপ করে, মাথা ধরে যায়।’
‘সেটা তার কবিতার কারণে নয়, হিউপ। সেটা আমি জানি, তুমিও জানো।’
‘জানো। ভালো। হতচ্ছাড়াকে দেখলেই একমাত্র আমার পাখি হয়ে উড়ে যেতে ইচ্ছা করে।’
‘ধন্যবাদ, হিউপ। কী নিয়ে কথা বলতে যাচ্ছিলাম, তুমি ভুলিয়ে দিয়েছিলে, তুমিই মনে করিয়ে দিয়েছ। আবার ধন্যবাদ। শোনো, মহাজাগতিক এক কবির একটা কবিতার লাইন শোনো, “মানুষ নিকটে গেলে প্রকৃত সারস উড়ে যায়।”’
‘সারস কি পাখি?’
‘পুরোনো গ্রন্থ তা–ই বলছে।’
‘প্রকৃত সারস?’
‘প্রকৃত সারস।’
‘তা তো বুঝলাম, কিন্তু এর মানে কী? তুমি কি ট্যাট না, প্রকৃত ট্যাট?’
‘হা হা হা! এটা মহাজাগতিক এক কবি লিখেছেন, হিউম। কবিরা সর্বজ্ঞ ও শ্রেষ্ঠ।’
‘মানে কী, ট্যাট? তুমি আসলে কী বলতে চাচ্ছ? ডাউন টাউনের ওই হতচ্ছাড়া সর্বজ্ঞ ও শ্রেষ্ঠ?’
ডাউন টাউনের ওই হতচ্ছাড়া অরকু। কবি অরকু। ডাউন টাউনের একমাত্র কবি সে। কবিতা বানায়। এখন ২৩ নম্বর সড়কের ক্যানোপি ব্লু পাবে আছে। ছয়জন এক টেবিলে। দুই মগ করে যোকো তারা খেয়েছে। আরেক মগ করে দিতে বলেছে।
টোরো বলল, ‘যোকো টিউনিকা থেকে আসে সত্যি?’
কবি অরকু বলল, ‘যোকোগাছ তুমি দেখেছ, টোরো?’
টোরো বলল, ‘না। কী রকম দেখতে?’
‘এই দ্বীপের কেউ দেখেনি। পুরোনো গ্রন্থে এই গাছের বিবরণ রাখা হয়নি। আমি মনে করি, যোকো জলজ উদ্ভিদ। সমুদ্রের গভীর তলদেশে হয়।’
‘মনে করো? নাকি জানো?’
‘মনে করি।’
‘বিশ্বাস করো?’
‘মনে করি, টোরো।’
‘অ। তুমি আর কী মনে করো? পাখিরা কি সমুদ্রের তলদেশে যায়?’
‘পুরোনো গ্রন্থে সে রকম বিবরণ পড়িনি। তবে তারা পাখি।’
‘সমুদ্রের তলদেশেও যেতে পারে বলছ?’
দার্শনিক কায়াকো। উত্তরের রেইনউডে থাকেন। একা। পাখিচিন্তা করেন। ধোঁয়া ওড়া যোকোর মগে চুমুক দিতে দিতে। পরাবাস্তবতার অন্তর্গত হয়ে।
‘পারে। এই দ্বীপে পাখিরা থাকে না। তবে কোত্থেকে তারা আসে? সমুদ্রের তলদেশ থেকে হয়তো।’
‘পাতাল হতে পারে?’
‘হতে পারে। যেসব পাখি আর পাতালে ফেরে না।’
‘পাতাল সম্পর্কে পুরোনো গ্রন্থে কী বিবরণ আছে, অরকু?’
কবি অরকু বলল, ‘পাতালে পাখির ডাক শোনা যায়।’
‘আমি একটা কথা বলব?’
শ্যাড বলল। শ্যাড পেইন্টার। কথা কম বলে।
‘অবশ্যই, শ্যাড।’
কবি অরকু ও টোরো একসঙ্গে বলল।
শ্যাড বলল, ‘কায়াকোকে তুমি কী মনে করো, অরকু?’
কবি অরকু বলল, ‘আলোকসত্তা।’
‘পাখি মনে করো?’ ইভ বলল।
‘পাখি মনে করো?’ ত্রুফো বলল।
‘পাখি মনে করো?’ ডজার বলল।
কবি অরকু বলল, ‘মনে করি। কায়াকো আলোকসত্তা। কায়াকো পাখি।’
কবি অরকুর বয়স ৪৮। সব সময় ৪৮।
কায়াকোর বয়স ৮৪। সব সময় ৮৪। কবি অরকু ‘কায়াকো ব্যালাড’ লিখেছে। ১৪টা সনেটে প্রশস্তি কায়াকোর।
দার্শনিক কায়াকো। উত্তরের রেইনউডে থাকেন। একা। পাখিচিন্তা করেন। ধোঁয়া ওড়া যোকোর মগে চুমুক দিতে দিতে। পরাবাস্তবতার অন্তর্গত হয়ে।
পাখিচিন্তা কী?
চিরকালীন।
কোত্থেকে আসে পাখিরা? যায় কোথায়?
পাখিরা কি পাতালে জন্ম নেয়?
মানুষের সঙ্গে কী সম্পর্ক পাখির?
পাখিরা মানুষের ‘নিকটে’ থাকে না। কেন?
বহু সভ্যতা আগে মানুষ কী করেছিল? পাখিদের সঙ্গে?
পুরোনো গ্রন্থে সে রকম কোনো বিবরণ লিপিবদ্ধ করা হয়নি। কেন?
মানুষ কারা?
১৯ শ ১৯ জন দ্বীপের, তারা কি মানুষ? কখনো কখনো মানুষ?
ঊনকোটি পাখিচিন্তা এ রকম।
দার্শনিক কায়াকোর কিছু ব্যক্তিগত বইপত্র আছে। ‘পাখিশাস্ত্র’ দেখেন বারবার। মানুষ কত পাখিকে মেরেছে, তার বিবরণ আছে এই গ্রন্থে। মহাজাগতিক এক কবি কেন লিখলেন, মানুষ নিকটে গেলে প্রকৃত সারস উড়ে যায়।
প্রকৃত সারস?
দার্শনিক কায়াকোকে পবিত্র মনে করে হিউম। পবিত্র দার্শনিক।
দার্শনিক কায়াকো কি মানুষ? না পাখি? ১৯ শ ১৯ জন? পরাবাস্তব উষ্ণতায় তারা খেই হারায় চিন্তার। পাখি দেখে। কেন?
তারা বসে থাকে, পরাবাস্তব। পরাবাস্তব পাখি উড়ে যায়।
দ্বীপে রাত হয়। রাত বাড়ে। তারা ফোটে। তারার জন্ম হয়, তারা মরে যায়।
রাত্রি নিশীথে পরাবাস্তব কয়োট ডাক দেয়—উ! উ-উ-উ। দ্বীপবাসী ১৯ শ ১৯ জন ঘুম যায়। আবার ঘুম থেকে ওঠে সকালে। বাথানে যায়।
কী করে তারা বাথানে?
একজন হয়।
১৯ শ ১৯ জন একজন হয়ে যায়।
একা একজন। সে কী করে?
গ্রহ, নক্ষত্র, উপগ্রহ, নীহারিকা, ছায়াপথ বানায়।
‘সম্প্রসারণ করো।’
আজ্ঞাবহ সে।
সম্প্রসারণ ক্রিয়াশীল থাকে।
সে আবার ১৯ শ ১৯ জন হয়ে যায়। এর মানে কী?
আবার ১৯ শ ১৯ জন কেন?
মহাজাগতিক অবস্থান কী তাদের এই দ্বীপের? বিবরণ নেই পুরোনো গ্রন্থে। দ্বীপ, অন্তরীপ, মরূদ্যান বিষয় না, তারা অবস্থান করে আরেক মাত্রায়।
তারা ছাড়া কেউ তাদের কখনো দেখেনি।
১৯ শ ১৯ জন।
সন্ধ্যার আগে আগে বাথান থেকে বের হয় তারা। বেমালুম সব ভুল মেরে দিয়ে। তাদের আর মনে থাকে না সবিশেষ কোনো পাখিকে। তারা যোকোর মগ নিয়ে বসে থাকে এবং উড়ে যেতে দেখে পাখিদের।
সব সময়?
সব সময়। তারা বসে থাকে, পাখি উড়ে যায়।
সব সময় একটামাত্র পাখি উড়ে যায়।
তারা বসে থাকে।