ইপো

সাহস করে বাক্সটায় হাত দিতেই আঁতকে ওঠে ইমা। সে ভেবেছিল, এটা কাগজের বাক্স। কিন্তু ইমার ধারণা ভুল প্রমাণ করে দেখা গেল বাক্সটা ধাতুর তৈরি। বাক্সটির যে পাশ থেকে আলো বের হচ্ছে, সে পাশটা খুলতে লাগল ইমা।

ইমা পড়ার টেবিলে বসে অঙ্ক করছিল। রাত জেগে পড়তে বেশি পছন্দ করে সে। আলাদা রুম আছে। তাই মা-বাবাও তেমন কিছু বলেন না। হঠাৎ টেবিলের পাশের জানালায় ধাক্কা লাগার শব্দ পেল। সঙ্গে সঙ্গে পাশের রুম থেকে রাত বারোটা বাজার ঘন্টা বাজতে শুরু করে। কে? কে? বলে ইমা বারান্দার দিকে এগিয়ে যায়। নিজেই নিজের মনকে সান্ত্বনা দিচ্ছে। ভূত বলে কিছু নেই। তাই ভয় পাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।

তখনই আবার হঠাৎ মৃদু একটা বিস্ফোরণের শব্দ পাওয়া গেল। ইমা আঁতকে উঠল। দৌড়ে মায়ের ঘরে ঢুকবে, এমন সময় আবার থেমেও গেল। মা যদি তাকে ভীতু ভাবে? তাই সাহস করে একাই দরজা খুলে বের হলো। অন্ধকারে প্রায় কিছুই ভালোভাবে দেখা যাচ্ছে না। তবু অন্ধকারের ভেতর থেকে যেন আলো বের হচ্ছে। হ্যাঁ, একটা বাক্সের মতো কিছু থেকে বের হচ্ছে আলো। ইমা ধীরে ধীরে বাক্সটার দিকে এগিয়ে যায়।

সাহস করে বাক্সটায় হাত দিতেই আঁতকে ওঠে ইমা। সে ভেবেছিল, এটা কাগজের বাক্স। কিন্তু ইমার ধারণা ভুল প্রমাণ করে দেখা গেল বাক্সটা ধাতুর তৈরি। বাক্সটির যে পাশ থেকে আলো বের হচ্ছে, সে পাশটা খুলতে লাগল ইমা। হঠাৎ যেন বাক্স থেকে কিছু একটা বেরিয়ে আসতে চাইল। ইমা আর্তচিৎকার করে উঠল। চিৎকারের শব্দ বাবা-মায়ের কানে পৌঁছানোর আগেই বাক্স থেকে একটা হাত বেরিয়ে এল। চেপে ধরল ইমার মুখ। হঠাৎ করেই ইমার চিৎকার বন্ধ হয়ে গেল।

ইমা একটু শান্ত হয়েছে। অন্তত এতটুকু বিশ্বাস হয়েছে যে বাক্সটা থেকে যে প্রাণীটা বের হলো, সেটা তার কোনো ক্ষতি করবে না। ইমা বারান্দায় বাইরের দিকে পা ঝুলিয়ে বসেছে। নতুন প্রাণীটির দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার নাম কী?

আমার নাম ইপো। আমি অনেক দূর থেকে এসেছি। তোমাদের সূর্যের মতো অন্য এক নক্ষত্রের একটা গ্রহ থেকে।

ইমা বলে, ‘তুমি দেখতে অনেকটা কাঁঠালের মতো। যেন কাঁঠালের হাত-পা, চোখ-কান আছে। হা হা হা…।’

ইপো গাল ফুলিয়ে বলে, ‘আমি মোটেও এরকম না ইমা। তোমাদের পৃথিবীর কাঁঠাল দেখতে কুৎসিত। আমি মোটেও সেরকম নয়।’

‘আচ্ছা, তুমি পৃথিবীর এত মানুষ থাকতে আমার কাছে কেন এলে? আমি তো তোমার তেমন কোনো উপকার করতে পারব না। বিজ্ঞানীদের কাছে গেলে বরং তুমি ভালো করতে।’

‘আমি যে সমস্যাটা নিয়ে পৃথিবীতে এসেছি, সেটার সমাধান শুধু তুমি করতে পারবে। আমার কাছে একটা যন্ত্র আছে, সেটা দিয়ে খুঁজে দেখেছি। সিগন্যালটা শুধু তোমাকেই দেখিয়েছে।’

‘কী এমন সমস্যা?’

‘শুধু একটা ইকুয়েশন সমাধান করে দিতে হবে।’

ইমা চিৎকার করে পেছনের দিকে সরে যায়। তারপর বলে, ‘তুমি কি জানো আমি কী পরিমাণ বোকা? আমার সব ভাইবোনদের মধ্যে আমি সবার চেয়ে বোকা। আমাদের স্কুলে যে মেয়েটি ভালো রেজাল্ট করতে পারে না, আমি সেই মেয়ে। আর তুমি এসেছ আমার কাছে ইকুয়েশনের সমাধান করতে।’

‘আমি সবই জানি ইমা। তবে আমি এটাও জানি যে তুমি গণিতে কতটা ভালো। তুমি আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে যাওয়ার সুযোগ পেয়েও যাওনি।’

‘স্কুলের সার্টিফিকেট ছাড়া এই গ্রহে দাম নেই। তাই আমার পরিবার বলেছে, এসব গণিত অলিম্পিয়াড-টলিম্পিয়াড বাদ দাও।’

‘গুরুত্ব অবশ্যই আছে। এখন তুমি কি পারবে আমাকে সাহায্য করতে?’ 

ইপোর চেহারার দিকে না তাকিয়েই ইমা বলে, ‘আচ্ছা দেখি, দেখাও তোমার ইকুয়েশন।’

‘আরে, এমন ইকুয়েশন আমি আমার জীবনেও দেখিনি। অক্ষরগুলোই তো সব বুঝতে পারছি না!’

ইপো চোখ বন্ধ করে কী একটা যেন করল। সম্ভবত কোনো মহাজাগতিক অনুবাদ যন্ত্র চালু করে দিয়েছে। তারপর বলল, ‘এখন বুঝতে পারবে।’

‘হা! হা! এটা তো খুব সোজা।’

‘তাহলে আমাকে সমাধান করে করে বলো, আর আমি কাজ করি।’

রাত ৩টা বেজে গেল। ইমা এখনো একটানা ইকুয়েশনের সমাধান করেই যাচ্ছে।

ইপো বললো, ‘সূ্র্য উঠতে আর ১ ঘন্টা ৪৫ মিনিট বাকি। দ্রুত করো। নইলে তোমার গ্রহবাসী আমাকে হয়তো আটকে দেবে।’

ইমা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ‘নাও তোমার ইকুয়েশনের সমাধান শেষ।’

‘দাঁড়াও, ইঞ্জিনটা চালু হয় কি না দেখি।’

ইপো লাল বাটনে চাপ দিতেই গরগর করে বাক্সটি একটা মহাকাশযানে পরিণত হলো। ইপো ইমার কোলে উঠে ইমাকে ধন্যবাদ জানাল। আসলে ইপো একটা ছোট্ট বাচ্চার মতো।

‘ইমা, তুমি আমার সঙ্গে আমাদের গ্রহে চলো। তোমার জ্ঞান আমাদের গ্রহের বৈজ্ঞানিকদের চেয়ে বেশি।’

‘তা হয় না, ইপো। আমি এই গ্রহ ছেড়ে যেতে পারব না।’

ইপোর মন খারাপ হয়। তারপর বলে, ‘তোমার সারা রাতের পারিশ্রমিক হিসেবে আমি কী দিতে পারি, বলো?’

ইমা মুচকি হেসে বলে, ‘তোমরাও পারিশ্রমিক দাও, বাহ! কিন্তু আমার কোনো পারিশ্রমিক লাগবে না। তুমি আমার কাছে সাহায্যের জন্য এসেছ, আর আমি তোমাকে সাহায্য করতে পেরেছি, এটাই আমার কাছে অনেক মূল্যবান।

‘তুমি অনেক ভালো মনের মানুষ ইমা। চলো, তোমাকে তোমাদের শহরটা একটু ঘুরিয়ে দেখাই।’

রাত ৩.৪৫টা। একটি ষোল বছরের মেয়ে আর একটি ভিন গ্রহের প্রাণী শহরের ওপরে উড়ছে। ইপো ইমাকে তাদের বারান্দায় নামিয়ে দিল। তারপর ইমার হাতে একটি পাথর দিয়ে বলে, ‘যখনই আমার কথা মনে পড়বে, এটার সঙ্গে কথা বলবে। পাথরটি জ্বললেই বুঝবে আমি তোমার কথা শুনছি।’

পাথরটি দেখতে বেগুনি হীরার মতো। ইমা ইপোকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘তোমার মতো একজন বন্ধুর সঙ্গে পরিচয় হয়ে অনেক ভালো লাগল। আবার দেখা হবে আমাদের, ইপো।’

ইপো তার কানে কানে বলল, ‘তুমি এই পৃথিবীর মহামূল্যবান সম্পদ। মানুষের কথা না শুনে নিজের মনের কথা শোনো। আমি আবার আসার চেষ্টা করব। আমার এখন যাবার সময় হয়েছে।’

তাদের দুজনের চোখের কোনায় জমে ওঠে একবিন্দু পানি। হঠাৎ আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে যায়।

ইমা ঘুম থেকে উঠে দেখে সে তার বিছানায় শুয়ে আছে। তাহলে রাতের ঘটনাটা কী স্বপ্ন? সে তার হাতের মুঠোয় কিছু অনুভব করছে। মুঠি খুলে দেখে, একটা বেগুনি পাথর। ইমা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘ভালো থেকো ইপো।’ সঙ্গে সঙ্গে পাথরটি জ্বলে ওঠে। ইমা পাথরটি গলায় ঝুলিয়ে রাখার ব্যবস্থা করে। তারপর শুরু করে গণিত অলিম্পিয়াডের প্রস্তুতি। তাকে যে এখন নিজের মনের কথাও শুনতে হবে।

লেখক: দশম শ্রেণি, বিজ্ঞান বিভাগ