অন্য জগৎ

আজ আকাশটা বেশ গোলাপি মনে হচ্ছে। নিজের বাড়ির আঙিনায় পাতা একটা দোলনায় শুয়েছিল সে। একসময় আধো ঘুমে চোখ বুজে গিয়েছিল। চোখ খুলেই তার মনে হলো আকাশের রং পাল্টে গেছে। সে তাড়াতাড়ি উঠে বসে। চারদিকে খুব সতর্কতার সঙ্গে তাকায়। নাহ! ওরা তো আসেনি। তাহলে এমন অদ্ভুত লাগছে কেন?

আজ থেকে ঠিক ১৫ বছর আগে ঠিক এমনটাই দেখেছিল ওর বাবা। এমন ঘটনার ঠিক তিন দিন পর হঠাৎ নিরুদ্দেশ হয়ে যায় লোকটা। তিনি একজন নামকরা বিজ্ঞানী ছিলেন। জনিরা অনেক খোঁজাখুঁজি করেছিল। পায়নি। অনেক দিন পর জনি ওর বাবার রিসার্চ সেন্টারে একটা নোট পেয়েছিল। সেই বক্তব্যটা হলো— ‘ওরা আছে। ওদের জগত্টাতে আমি পৌঁছাতে পেরেছি। ওদের দেখা পাইনি। তবে ওরা আমাকে আবার ফিরে আসতে দিয়েছে। আমি বুঝতে পেরেছি ওদের সময় আর আমাদের সময় পাশাপাশি চলছে। তবে ওদের জগতের বেশ কিছু জিনিসের রং আলাদা। এই যেমন, আকাশটার কথা বলা যায়।

এই কথা জনির হঠাৎ মনে পড়ে। সে আরও সূক্ষ্ম চোখে তাকায়। বুঝতে চেষ্টা করে কেউ আছে কি না আশপাশে। জনির মনে পড়ে, ওর বাবার শেষ বক্তব্যের কথাটা, যেটা নিরুদ্দেশ হওয়ার কয়েক ঘণ্টা আগেই লেখা হয়েছিল। বক্তব্যটা হলো—

‘জানি না আমার কথা ঠিক কি না। তবে এই “সময়” একটা বিভ্রম ছাড়া কিছুই নয়। হ্যাঁ, ওরা এটা জানে। ওরা আমাকে নিয়ে যেতে চায়। কেন জানি না। তবে এখন আমি চোখ বন্ধ করলেই ওদের জগতে চলে যাই। ও জগতে যাওয়ার পর চোখ খুলি। গোলাপি আকাশ! হলুদ গাছ! লালচে মাটি! আমি জানি না। আর কতটা সময় পৃথিবীতে থাকব। ওরা চায় না, ওদের সম্পর্কে অন্য কেউ জানুক। তাই ওরা আমাকে নিয়ে যাবে। আমি ওদের জগৎ নিয়ে গবেষণা করেছি। জগত্টা চতুর্মাত্রিক, আমাদের পাশাপাশি আছে। ওই জগতে নেই কোনো অতীত বা না আছে কোনো ভবিষ্যৎ। শুধুই বর্তমান। ওরা আমাদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলছে। আমি নিশ্চয়তা দিতে পারব না, ঠিক কবে নাগাদ ওরা আমাদের জগতে আসবে। তবে অনুমান করছি খুব তাড়াতাড়িই আসবে ওরা। এটাই হয়তো আমার শেষ বক্তব্য।’

জনি এবার খুব সতর্ক। সে মনে হয় বুঝতে পারছে, সে এখন কোথায় আছে। যদিও সে এখনো ওর দোলনাতেই বসে আছে। ঠিক ওর পাশেই হলুদ গাছ। তাতে ফুটে আছে খুব সুন্দর একটা ফুল। তবে অদ্ভুত আকৃতির। হঠাৎ কী মনে করে একটা ফুল ছিঁড়ে নিল জনি। একটু দূরেই আরেকটা গাছ। তাতে খুব সুন্দর একটা ফল। জনির খুব পছন্দ হলো ফলটা। এই ফুল–ফলগুলো দোলনায় বসার আগে ছিল না। তাহলে কি অন্য কোনো জগতে এসে পড়েছে সে? দোলনা থেকে ওঠার সময় জনির ভয় হলো। যদি ও সময়ের স্রোতে হারিয়ে যায়। দোলনাটা ছাড়লে যদি জনি হারিয়ে ফেলে পৃথিবীর রাস্তা। দুই জগতের মধ্যে যদি আটকে যায়? হঠাৎ তার মনে হলো কেউ একজন ওকে ডাকছে। কে ডাকছে? ও বুঝতে পারে না। বহুদূর থেকে আসছে মায়াবী ডাক, ‘জ...নি...’। শব্দটা অনেকটা ঢেউয়ের মতো শোনাচ্ছে। জনির চোখের পাতা ভারী হয়ে আসে। কারও একজনের স্পর্শে সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হয়ে যায় জনির চোখ।

‘কী হলো জনি? কখন থেকে ডাকছি তোকে! এসে নাশতা করে নে।’ চোখ খুলেই চিরচেনা মাকে দেখতে পেল। এতক্ষণের সব স্মৃতি স্বপ্ন মনে করে স্বস্তিবোধ করছে।

‘জনি! কী হলো, খেতে আয়।’

‘আসছি মা।’ দোলনায় শুয়ে মায়ের চলে যাওয়া দেখতে দেখতে উঠে বসল জনি। বেশিক্ষণ বসতে পারল না। একটু পরই উঠে এল, তবে জনি খেয়াল করল না দোলনার ওপর ওর পাশেই সেই অদ্ভুত ফুলটা এখনো রয়ে গেছে। বাতাসে ফুলটি পড়ে গেল মাটিতে। যেন সজাগ হয়ে উঠল ফুলের পাপড়িগুলো। একটু পরই সেগুলো গেঁথে গেল মাটিতে। জনির অজান্তেই ওদের পদার্পণ হলো এই পৃথিবীতে।

নাসিমবাগ, মিরপুর, ঢাকা থেকে