জুনিয়র পিকাসো

মাইদুল মন খারাপ করে বসে আছে। কিছুই ভালো লাগছে না ওর। ছবি আঁকতে খুব ভালবাসে সে। কিন্তু আজ কী যে হলো! মাথায় কিছু আসছে না। একটি আঁচড়ও কাটতে পারছে না আর্ট পেপারে। পেন্সিলটা টেবিলে ছুড়ে মারে। এক ছুটে চলে যায় বারান্দায়। ঝলম0লে আকাশ, পড়ন্ত বিকেল—সবমিলিয়ে অসাধারণ পরিবেশ। দেখতে দেখতে নিজের অজান্তেই মাইদুলের মন ভালো হয়ে যায়। প্রকৃতির এক অসীম ক্ষমতা!

ঘরে ঢুকে টেবিলের কাছে যায় আবার। কিন্তু চোখ তখন ছানাবড়া। একী কাণ্ড! এখানে ছবি এঁকেছে কে! সে বারান্দায় দাঁড়িয়ে যে দৃশ্যটা দেখেছিল, ঠিক সেই দৃশ্যটাই পেপারে আঁকা! কী অসাধারণ হাতের কাজ! সাদা কাগজের ওপরে পেন্সিলের ধূসর রঙে আঁকা। সাদাকালো। তবুও ছবিটাকে একেবারে জীবন্ত লাগছে। মাইদুল অবাক হয়ে ভাবে, এত সুন্দর ছবিটা এঁকেছে কে?

হঠাৎ কে যেন বলে, ‘পছন্দ হয়েছে?’

খুব চিকন স্বর। মানুষের কণ্ঠ এতো চিকন হতে পারে না। সন্ধ্যা নেমেছে, ঘরে আবছা আলো। মাইদুল বাতি জ্বালে। কিন্ত কাউকে দেখতে পায় না। চারপাশটা ভালো করে দেখে নেয়। কিন্তু কোথাও কেউ নেই। তাহলে ছবি আঁকল কে! কথা বলে কে! আরেকবার ভয় পায় মাইদুল। ধপাস করে বসে পড়ে চেয়ারে ।

তখন চোখে পড়ে, ছোট্ট শিশুর মতো দেখতে একটা প্রাণী টেবিলের ওপর এসে বসে। গায়ের রং নীল। চোখগুলো লাল রঙের। মাইদুল আবারও ভয় পায়। দাঁড়িয়ে যায় চেয়ার ছেড়ে। প্রাণীটা বলে, ‘আরে, ভয় পাচ্ছ কেন? তোমার কোনো ক্ষতি আমি করব না। আগে বলো, আমার আঁকা ছবিটা কেমন হয়েছে?’

মাইদুল ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলে, ‘খু-ব সু-ন্দ-র হ-য়ে-ছে। কি-ন্তু তু-মি কে?’

প্রাণীটি বলে, ‘বলছি। আগে বসো, শান্ত হও।’

মাইদুল কিছুটা সাহস পায়। চেয়ার টেনে বসে।

‘জানো, ছোটবেলা থেকেই আমি ভালো ছবি আঁকতে পারি।’ বলে প্রাণীটা।

মাইদুল ক্ষীণ স্বরে বলল, ‘খুব ভালো। কিন্তু তুমি আমার নাম জানলে কী করে?’

প্রাণীটা হেসে ফেলে। বলে, ‘তোমার মা ডাকছিল নাম ধরে। শুনেছি আমি।’

‘তুমি এখানে কেন এসেছ?’ অনেকটাই সাহস ফিরে পেয়েছে মাইদুল।

‘হুট করেই চলে এসেছি পৃথিবীতে।’ বলে প্রাণীটা।

‘মানে?’ মাইদুল অবাক হয়। ‘ তুমি পৃথিবীর কেউ নও। কোত্থেকে এসেছ তুমি?’

‘ইউরেনাস গ্রহের জুলিয়েট উপগ্রহে ছিল আমাদের বসবাস,’ গম্ভীর কণ্ঠে বলে প্রাণীটা। মাইদুল অবাক, ভারী অবাক! বলে কী বাচ্চাটা! ‘ জুলিয়েট তো অনেক দূরের পথ। এত দূর থেকে কীভাবে এলে?’

‘সে এক ভয়াবহ ঘটনা। হঠাৎ এক মহাজাগতিক সংঘর্ষে জুলিয়েট ভেঙে পড়ে। সেখান পালিয়ে আসি আমি। এখানে কীভাবে এলাম কিছুই মনে পড়ছে না।’

বাচ্চাটির প্রতি মাইদুলের খুব মায়া হয়। বলে, ‘তোমার নামটা তো জানা হলো না।’

‘আমার কোন নাম নেই। তুমি যে নামে খুশি ডাকতে পারো।’

কিছুক্ষণ ভেবে নেয় মাইদুল। তারপর বলে, ‘আমার প্রিয় চিত্রশিল্পীর নাম পাবলো পিকাসো। তুমি খুব ভালো ছবি আঁকো। তাই তোমার নাম হবে জুনিয়র পিকাসো। তবে তোমার ডাকনাম হবে জুপি। নাম পছন্দ হয়েছে তোমার?’

জুপি বলল, ‘হ্যাঁ, খুউব।’

‘আচ্ছা জুপি,’ মাইদুল বলে, ‘তোমাদের উপগ্রহটা দেখতে কেমন ছিল?’

জুপি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘আমাদের জুলিয়েট এমন সবুজে ঘেরা নয়, ধুসর রঙের। মরুভূমির মতো খোলা চারপাশ, বরফের ঘেরা। কোনো উদ্ভিদ নেই। প্রাণী বলতে শুধুমাত্র আমাদের গোত্রটাই। তাপমাত্রা সারা বছর মাইনাস ২০৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সূর্যের আলো থেকে খাদ্য পাই আমরা। পৃথিবীর ১২ দিনের সমান ছিল আমাদের এক বছর।’

মাইদুল ইন্টারনেট ঘেঁটে নিশ্চিত হয়, জুলিয়েট সম্পর্কিত সব তথ্যই ঠিকঠাক বলেছে জুপি। আহারে বেচারা! একটা সংঘর্ষে সবাইকে হারিয়ে এখন আশ্রয় নিয়েছে ওর কাছে। থাকুক ও। কিন্ত থাকল আর কই। হঠাৎ যন্ত্রণায় কাতরে উঠল প্রাণীটা। ‘কী হলো জুপি? এমন করছ কেন?’

জুপি কাঁদো কাঁদো গলায় বলে, ‘আমার সময় শেষ, মাইদুল। ভালো থেকো তুমি। হতাশ হয়ো না কখনো। দেখো, একদিন তুমিও আমার মতো ভালো ছবি আঁকতে পারবে।’

কথাগুলো শুনে মাইদুলের খুব কান্না পায়। ‘হঠাৎ কী হলো তোমার? কী করলে তুমি সুস্থ হবে জুপি?’

জুপি বড় বড় শ্বাস নেয়। অস্পষ্ট কণ্ঠে বলে, ‘মাইদুল তোমাকে অনেক ধন্যবাদ। আমরা শীতল পরিবেশের প্রাণী। পৃথিবীটা অনেক উষ্ণ। এখানে আমাদের বেশিক্ষণ টিকে থাকা সম্ভব নয়। ভাল থেকো তোমরা। মাইদুল... মাইদুল...।’

জুপির কণ্ঠ ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়। এক সময় থেমে যায় সামান্য নড়াচড়াও।

‘জুপি... কথা বলো জুপি...।’ বলে মাইদুল। চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ে অশ্রু। মাইদুল ধপাস করে চেয়ারে বসে পড়ে। হঠাৎই যেন শূন্য হয়ে যায় মাইদুলের জগৎটা।

লেখক: কেশাইরকান্দি, ছেংগারচর, মতলব উত্তর, চাঁদপুর থেকে