অভিনেতা

লিরা বলল, ‘এখন থেকে তুমি যেকোনো সময় স্বেচ্ছা মৃত্যুবরণ করতে পারো!’

লিরা তরুণী, তার ওপর সুন্দরী। হাসলে তার গালে টোল পড়ে। এর আগেও দেখেছে জাফরান জাফি। কিন্তু লিরা এখন হাসছে না। মুখ অত্যন্ত গম্ভীর। বোঝাই যাচ্ছে বিষয়টা তার পছন্দ হয়নি। এই সময়ে এসেও একজন আইনজীবী ব্যক্তিগত এমন বিষয় নিয়ে মেজাজ হারাতে পারে? জাফি বিস্মিত। তার বিস্ময়ের প্রকাশ ঘটল মুখে এক টুকরো হাসি টেনে।

‘তুমি হাসছ নাকি?’

‘না তো। কাল রাত্রে মিল্যাক্সি নিয়েছি, হয়তো তারই প্রভাব।’

‘জানো না...উত্তেজনাকর হলেও মিল্যাক্সি আসলে একধরনের খারাপ ড্রাগ। খুব দ্রুত তোমাকে হতাশ করে ফেলবে ড্রাগটা...অবশ্য তোমাকে বলেই কী লাভ! তুমি এমনিতেই আছ হতাশার ভেতর!’

‘তোমাকে দেখে আমার সব হতাশা কেটে যায় লিরা।’

‘বিশ শতকের সিনেমার নায়কের মতো সংলাপ দিয়ো না। শুনতে খুব খারাপ লাগে। তুমি আমাদের আইডল। এই সময়ের সুপারস্টার।’

‘হাহ! সুপারস্টার!’

লিরা তাকিয়ে থাকল জাফির দিকে। বোঝাই যাচ্ছে জাফিকে নিয়ে সে উদ্বিগ্ন। বলল, ‘ইউনিয়ন অনুমতি দিয়েছে, তার মানে এই নয়, তুমি এখনই স্কোয়াডে দাঁড়াতে পারবে। অনেকগুলো নিয়ম-নীতি রয়েছে। আশা করি সেগুলো তুমি জানো?’

‘আমার সম্পদের সুষম বণ্টন, আমার স্থায়ী-অস্থায়ী আবাসের উইল, এগুলো তো?’

‘তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ তোমার ইমেজ। চাইলেই তুমি খুন হতে পারো না, তাই না? তুমি পাবলিক ফিগার। পাবলিকের কাছে কী খবর যাবে, তুমি মারা গেছ? তাহলে সিনেমার কী হবে?’

সিনেমা শব্দটা শুনেই একটা অশ্লীল গালি বেরিয়ে এল জাফির মুখ থেকে। থুতু জমল মুখে। লিরা বলল, ‘একটু এগিয়ে গিয়ে বাঁয়ে ওয়াশরুম। তুমি থুতু ফেলে আসতে পারো!’

জাফি আরেকটা গালি দিল, মনে হলো লিরাকেই।

দুই

খুন হতে পারার এই অনুমতি নেওয়া খুব সহজ ছিল না।

নিজের অ্যাপার্টমেন্টে যেতে যেতে ভাবে জাফি। প্রায় তেত্রিশ মাস থেকে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল সে। বিশেষ করে আ ওয়ান্ডার বয় ইন নেপচুন রিলিজের পর তা বিশ্বজুড়ে ব্যাপক সমাদৃত হওয়ার পর থেকেই। আরও নিখুঁত করে বললে বলা যায়, যেদিন সে ওই সিনেমাটার জন্য আন্তর্জাতিক পুরস্কারটা হাতে পেল, সেদিনই জাফি ঠিক করেছিল, এবার তাকে স্বেচ্ছামৃত্যু বেছে নিতে হবে।

মরে হতে হবে, কারণ বেঁচে থাকাটা খুব কষ্টকর। এতটাই যে বারবার মনে হয় সে এক অন্য কোনো ব্যক্তির জীবন বয়ে নিয়ে চলেছে, যে জীবন কোনোভাবেই সুখের নয়।

ফ্ল্যাটে ঢুকতেই চারটা ভয়েস মেইল স্বয়ংক্রিয়ভাবে চালু হয়ে যায়। এর ভেতর দুইটা তার ম্যানেজারের। সে ধাতব কণ্ঠে বলে, আগামী সপ্তাহে তিনটা অনুষ্ঠান আছে জাফির। তিনটা থেকেই পর্যাপ্ত ক্রেডিট আসবে, ফলে নো চিন্তা। প্রথমটি একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ৫০ বছর পূর্তি। সেখানে জাফি গিয়ে শুধু শুভকামনা জানাবে এবং সবার সঙ্গে হেসে কথা বলবে পঁয়তাল্লিশ মিনিট। দ্বিতীয়টা একটা ঘরোয়া গেট টুগেদার। সেখানে ঘণ্টা দুয়েক কাটাতে হবে জাফিকে। তার বিখ্যাত হয়ে ওঠা সিনেমাগুলো থেকে মোট নয়টি সংলাপ অভিনয় করে শোনাতে হবে। সঙ্গে একটা গান গাইবে জাফি। সবার সঙ্গে কেক কাটবে এবং অনুষ্ঠান নিয়ে সাত মিনিটের সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত থাকবে। এটা হবে দারুণ একটা ডিল। কারণ প্রচুর মুনাফা আসবে এটা থেকে। আর সব শেষেরটা একটু অলাভজনক। কেন্দ্রীয় শিশুসদনে গিয়ে সেখানকার বাচ্চাদের সঙ্গে কিছুক্ষণ খেলাধুলা-লাফঝাঁপ করতে হবে। এখান থেকে আয় বেশ কম। কিন্তু যেহেতু জাফি শিশুদের পছন্দ করে, তাই ম্যানেজার এটাকেও না বলেনি।

দিনের তৃতীয়বারের মতো জাফি অশ্লীল গালিটা দিয়ে বিছানায় লুটিয়ে পড়ে।

ম্যানেজার ধাতব কণ্ঠে বারবার জানতে চায়, ‘আমি কি তোমার সম্মতি ধরে নেব? আমি কি তোমার সম্মতি ধরে নেব?’

মিলাক্সির একটা পিল মুখে চুষতে চুষতে জাফি চিৎকার করে বলে, ‘চুপ যা, শালা রোবট! চুপ কর!’

ধাতব কণ্ঠটা একটা অদ্ভুত শব্দ তুলে থেমে যায়। জাফি তলিয়ে যায় বিছানায়।

তিন

একটা কমলা ঘরের অনেকগুলো দরজা। দরজার সামনে সামনে দৌড়াচ্ছে চারটা সবুজ কুকুর। কুকুরগুলো হাঁপাচ্ছে। হাঁপাচ্ছে আর এগোচ্ছে। এগোচ্ছে আর একটার পর একটা দরজা খুলে যাচ্ছে। কুকুরগুলো ছুটে যাচ্ছে। বেশ কিছুক্ষণ পর জাফির মনে হয় তিনটা কুকুরের একটা কুকুর সে। কুকুরটা এবার থমকে দাঁড়ায়। হাঁপাচ্ছে কুকুর। তার মুখ দিয়ে লালা ঝরছে। একটা মিহি কণ্ঠ ভেসে আসছে—জাফি? জাফি? জাফি ওঠো...

জাফি চোখ মেলে তাকাল। ঘরের ভেতর কটকটে হলুদ আলো। এই আলো কে জ্বেলেছে? পরক্ষণেই মনে হলো এটা আসলে তার ঘর নয়। তাহলে কি স্বর্গ সত্যি আছে? সে কি তাহলে এর মধ্যেই মারা গেছে? আচ্ছা এটা কি নরক?

কিন্তু পরক্ষণেই তার সামনে এসে যে দাঁড়াল, তাকে দেখে ভ্রম কাটল জাফির।

রু। প্রডিউসার। জাফি কিছুদিন তার সঙ্গে ছিল। ভীষণ কড়া আর খসখসে স্বভাবের। কিন্তু কণ্ঠটা ভারী মোলায়েম।

‘তুমি আমাকে কোথায় নিয়ে এসেছ?’

‘এই জায়গাটা তোমার চেনা জাফি। আমাদের স্টুডিও জাফি।’

‘স্টুডিও? স্টুডিওতে এখনো আমার কাজ বাকি আছে?’

রু ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসল। বলল, ‘তুমি জাত অভিনেতা। তোমার কাজ কি কখনো শেষ হয়?’

‘কী চাও তোমরা, পশু?’

‘তুমি নাকি মারা যাচ্ছ? স্বেচ্ছা মৃত্যুবরণ করার অনুমতি নাকি তোমাকে দিয়ে ফেলেছে ইউনিয়ন?’

‘তাতে তোমার কী, ডাইনি?’

‘কিচ্ছু না। আবার অনেক কিছু। আমাদের স্টুডিওতে তোমার তিন–তিনটা প্রজেক্ট, তুমি জানো না?’

‘তাতে কী? আমি মারা গেলেও তোমাদের কোনো অসুবিধা হবে না। আমার পাঁচ শ রকমের অভিব্যক্তি আর হাজার রকমের অঙ্গভঙ্গি তোমাদের কাছে বিক্রি করা আছে। আমার কণ্ঠ জমা আছে তোমাদের কাছে। আমি থাকলেই কী আর না থাকলেই কী! তোমাদের প্রজেক্ট কে আটকাবে? পাঁচ বছর ধরে তো তোমরা এভাবেই সিনেমা বানাচ্ছ, আমাকে ছাড়া, আমার সিনেমা!’

‘টেকনোলজির এই বিকাশে তো তোমার আনন্দিত হওয়ার কথা জাফি। শারীরিকভাবে উপস্থিত না থেকেও তুমি অভিনয় করছ। তুমি মানুষের নায়ক হয়ে উঠছ। সবাই তোমাকে সুপারস্টার বলে, তোমার অভিনয়ের প্রশংসা করে। প্রত্যেক মাসে তোমার ক্রেডিটে মোটা অঙ্ক ঢোকে, আর কী চাও?’

‘তুমি কখনো কবিতা পড়েছ?’

‘সেটা আবার কী?’

‘তোমার মতো নিরেট মানুষদের জন্য যা নয়, তা–ই। তুমি জানো আমার রোবট ম্যানেজারটা তোমার চেয়ে অধিক মানুষ!’

রু একটু থমকে তাকাল। তারপরই হাসল। বলল, মানুষ হওয়াই এখন গালি, জানো তো? যেমন তুমি। কয়েক বছর ধরে হতাশায় ভুগছ শুধু মানুষ থেকে গেছ বলে। মানুষ থেকে গেছ বলেই কড়া ড্রাগস নিচ্ছ, আর এখন ইউনিয়নের কাছ থেকে স্বেচ্ছামৃত্যু বরণ করার অনুমতি জোগাড় করেছ। তোমার এই মনুষ্য-জীবনের দাম কী?

‘অনেক হয়েছে। আমাকে এখন যেতে দাও।’

‘তোমাদের সাথে আমার কোম্পানির আগামী ১০ বছরের চুক্তি, ভুলে গেছ?’

‘আমার মরে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সে চুক্তিও হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে। আরেকবার চুক্তিপত্রটা পড়ে নিতে পারো।’

‘এবং সে চুক্তি দেখিয়ে আমরা ইউনিয়নের কাছ থেকে তোমার স্বেচ্ছামৃত্যু রদও করতে পারি, পারি না?’

জাফি একটা শ্বাস ফেলল। রু যা বলল, তা সত্যি! ওরা যদি আবেদন করে, ইউনিয়ন ওর স্বেচ্ছামৃত্যুর অনুমতি খারিজ করে দেবে।

‘কী চাও তুমি, রু?’

‘তুমি মারা যেতে পারো। কিন্তু তার আগে দুইটা চুক্তিতে আসতে হবে তোমাকে। এক, তোমার মৃত্যুর কথা কেউ জানবে না। মানে আমজনতা জানবে না। তাদের কাছে তুমি বেঁচে থাকা সুপারস্টার জাফরান জাফি হয়েই থাকবে। আর...’

‘আর...?’

‘তোমার একটা রেপ্লিকা রোবট তৈরি করে রেখেছি আমরা। যেদিন তুমি মারা যাওয়ার জন্য আবেদন করেছিলে, সেদিনই আমরা রোবটটা তৈরি করতে শুরু করেছিলাম। তুমি মরলে এই রোবটটাই জাফরান জাফির পাবলিক জীবন সামলাবে। সাংবাদিক সামলাবে। অনুষ্ঠানে যাবে। তুমি মরতে চাইলে ওকে ব্যবহারের অনুমতি দাও জাফি!’

জাফির মনে হলো দম আটকে আসবে। বেশ কিছুক্ষণ রুর দিকে তাকিয়ে থাকার পর বলল, ‘তুমি একটা ডাইনি!’

চার

বাইরে থেকে দেখলে স্কোয়াডটা দেখতে ক্রিস্টালের পিরামিডের মতো। সম্ভবত মিসরের পিরামিডের আদলেই তৈরি করা হয়। সেই পিরামিডগুলোর মতো এই স্কোয়াডগুলোও তো আসলে একেকটা কবরই। অনুমতিপত্র দেখিয়ে ভেতরে ঢোকার পরই জাফিকে একটা নম্বর দেওয়া হয়। চলমান লিফটে সেই নম্বরে চাপ দেওয়ামাত্র প্রায় বিদ্যুৎগতিতে একটা ক্যাপসুলের ভেতর ঢুকে পড়ে জাফি।

সুন্দরী এক রোবট এগিয়ে আসে।

‘মৃত্যুর জন্য আজকের দিনটা খুব সুন্দর, স্যার।’

‘হ্যাঁ। আজকের দিনেই আমি জন্মেছিলাম আমাদের কেন্দ্রীয় শিশু সদনে।’

‘অভিনন্দন স্যার। সবার ভাগ্য আপনার মতো হয় না। আপনি কি ধীর মৃত্যু চান, নাকি দ্রুত?’

জাফি উত্তর দিতে পারে না।

‘ধীর মৃত্যুর ক্ষেত্রে স্যার আমরা একটা ট্র্যাংকুলাইজার পুশ করব। আপনি ধীরে ধীরে ঘুমিয়ে পড়বেন। এবং লম্বা একটা ঘুমের ভেতর আপনি মারা যাবেন।’

‘এটা বোধ হয় খুব খারাপ নয়, তাই না?’

‘কিছুটা খারাপ স্যার। কেউ কেউ ঘুমের ভেতর থেকে জীবনে ফেরত আসতে চায়, কিন্তু আসতে পারে না। তখন তার কষ্ট হয়। আমি শুনেছি কষ্ট মানুষকে খুব যন্ত্রণা দেয়। এটা কি সত্যি স্যার?’

‘তোমাদের আরেকটা উপায় কী?’

‘দ্রুত পদ্ধতি স্যার। আমরা একটা বিষাক্ত পিল খেতে দিই। তিন সেকেন্ডের মধ্যে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়ে আপনার সব ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাবে স্যার।’

‘তাহলে তো এটাই ভালো, তাই না?’

‘দ্রুত স্যার। কিন্তু ভালো কি না জানি না। চোখ-মুখ-নাক-কান দিয়ে হঠাৎ খুব রক্ত বের হয়। সাবজেক্ট খুব চিৎকার করে। খুবই চিৎকার করে।’

‘তোমার কী মনে হয়, আমার কীভাবে মরা উচিত?’

‘আমার কাছে তথ্য আছে স্যার, সমাধান নেই। আপনার কি কোনো শেষ ইচ্ছা আছে স্যার?’

পাঁচ

কেন্দ্রীয় শিশু সদনের ছেলেমেয়েদের অবস্থা আজকে দেখার মতো হয়েছে।

প্রতিবছর তাদের বার্ষিক অনুষ্ঠানে একজন করে বিখ্যাত ব্যক্তি আসেন। আজ আসার কথা ছিল সুপারস্টার জাফরান জাফির। জাফরান জাফির সিনেমা বলতে সবাই পাগল। সবাই ছবি তোলানোর জন্য আর একসঙ্গে ভিডিও করে রাখার জন্য নানা রকম পরিকল্পনা করে রেখেছিল। তবে সবারই আশঙ্কা ছিল এত অল্প সময়ের মধ্যে ওরা সবাই জাফির কাছে পৌঁছাতে পারবে কি না। এখন দেখে ঘটনা ভিন্ন। জাফি একা আসেনি। সঙ্গে আরেকজন জাফিকে নিয়ে এসেছে। তাদের সদনে এখন দুই–দুইটা জাফি। বোঝাই যাচ্ছে একটা জাফি আসল, একটা জাফি রোবট। কিন্তু কোনটা রোবট কোনটা আসল, সেই পার্থক্য তারা করতে পারছে না। অবশ্য তা নিয়ে যে কারও খুব বেশি মাথাব্যথা আছে, তা–ও নয়। তারা জাফিকে পেয়েই খুশি।

সুপারস্টার অভিনেতা জাফরান জাফি!