মেমোরি ট্রান্সফিউশন

অলংকরণ: রাকিব

পাহাড়ের ওপাশে সূর্য ডুববে বলে ঝুলে আছে। শীতের শেষ বিকেলের সূর্য যতটা নরম হওয়ার কথা, ততটা নরম বোধ হচ্ছে না। সূর্যের কমলা রশ্মি ছড়িয়ে পড়েছে চারপাশে। তার কিছু আলো সবুজ পাহাড়ের ওপরটা আলাদাভাবে আলোকিত করে রেখেছে।

ওয়াসিফ হাসান বিষণ্ন চোখে জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছেন। মাথার ভেতর অনেকক্ষণ হলো দাঁড়কাক ঠোকরানোর মতো অনুভূতি হচ্ছে। ওয়াসিফ হাসানের বয়স ৬৮ বছর। কয়েক দিন আগে রাস্তা পার হতে গিয়ে প্রচণ্ডভাবে আহত হয়েছেন। রাস্তা পারাপারের হলুদ বাতি দেখে তিনি হাঁটা শুরু করেছিলেন। সময় খেয়াল করেননি। সাফকাত নূর ভিডিও কল করেছিলেন। ওয়াসিফ কবজিতে আটকানো কন্ট্রোল বাটনে চাপ দিলেন। চোখে লাগানো চশমার দুই পাশ থেকে ৮ ইঞ্চি মাপের দুটি স্টিক বেরিয়ে এল। তাঁর সামনে আয়তাকার মনিটর। সাফকাতের হাসিমুখ দেখা যাচ্ছে। হাসিমাখা মুখে বললেন, ‘দোস্ত, প্রপোজাল অ্যাপ্রুভ হয়েছে। আমাদের স্পেস শাটলের চাঁদে যাতায়াতে আর কোনো বাধা নেই।’

পথচারী পারাপারের হলুদ আলো লাল হয়েছে, ওয়াসিফ খেয়াল করলেন না। তিনি তখন রাস্তার মাঝখানে। দ্রুতগতির একটি গাড়ি তাঁকে উড়িয়ে নিয়ে গিয়ে রাস্তার এক পাশে ফেলে রেখে চলে গেল। ওয়াসিফ জ্ঞান হারালেন। তিনি এখন আছেন কেন্দ্রীয় নিউরোসায়েন্স হাসপাতালের সপ্তম তলায় পাহাড়ঘেঁষা রুমে।

শীত অনুভব করছেন ওয়াসিফ। ঘরের তাপমাত্রা সহনীয় পর্যায়ে। বাইরের আবহাওয়া ঘরের ভেতর অনুভব করার কথা নয়।

ওয়াসিফের সামনে নিউরোসার্জন ডাক্তার কালিম এলাহী বসে আছেন। তিনি বিশাল হাঁ করে দুবার হাই তুলে মুখ বন্ধ করেছেন। ওয়াসিফকে ছোট ছোট কয়েকটা ভিডিও ক্লিপস দেখানো হয়েছে। ১৬–১৭ বছর বয়সের এক কিশোর বন্ধুর সঙ্গে বসে আড্ডা দিচ্ছে, গিটার বাজাচ্ছে। স্টিল ফটোগ্রাফও আছে। সেই কিশোর সাইকেল নিয়ে বাসায় ঢুকছে। আরও ছোট বয়সের এক শিশু বাগানে ট্রাইসাইকেল চালাচ্ছে।

ডাক্তার কালিম বলেছেন, এগুলো ওয়াসিফের ছোটবেলার ছবি। তিনি কিছু মনে করতে পারছেন না। অথচ অ্যাকসিডেন্টের আগে রাস্তা পার হওয়ার সময় সাফকাত যে ভিডিও কল করেছিলেন, তা স্পষ্ট মনে আছে।

ডাক্তার কালিম বললেন, ‘মনে করার চেষ্টা করুন। আপনার ছেলেবেলা। নিজেকে চিনতে পারছেন না!’

শীত অনুভব করছেন ওয়াসিফ। ঘরের তাপমাত্রা সহনীয় পর্যায়ে। বাইরের আবহাওয়া ঘরের ভেতর অনুভব করার কথা নয়। পাহাড়ের গায়ে শীতল আবহাওয়া। ওয়াসিফ শীতে খানিক জবুথবু হয়ে বললেন, ‘তাকে চিনতে পারছি না।’

স্ত্রী নাঈমা ফেরদৌস পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি খানিক হাসিমুখে ভেজা গলায় বললেন, ‘এই ছবিগুলো দেখিয়ে তুমি আমাকে তোমার ছোটবেলার কত গল্প শুনিয়েছ! সেই যে সাইকেল চালিয়ে নদী দেখতে গিয়েছিলে। জাহাজ যাচ্ছিল নদী দিয়ে। তোমার ইচ্ছা হলো জাহাজে চড়ে দূরদেশে চলে যেতে। সাইকেল কোথায় রেখে যাবে, বুঝতে পারলে না বলে তুমি যাওয়ার সিদ্ধান্ত বাতিল করে দিলে।’

ওয়াসিফ কিছু মনে করতে পারছেন না। মনে করতে গেলে তাঁর মাথার বাঁ পাশে কানের ওপর দাঁড়কাক ঠোকরানোর মতো অনুভূতি হচ্ছে।

ডাক্তার কালিম বললেন, ‘মিসেস নাঈমা, ওনার মেমোরি লস ডেনসিটি বেশ হাই। এমএলডি টেস্ট রিপোর্টে সে রকম পেয়েছি। তবু প্র্যাকটিক্যালি নিশ্চিত হতে চাইছিলাম। অ্যাকসিডেন্টে মিস্টার ওয়াসিফের ব্রেনের হিপোক্যাম্পাস অঞ্চলের খানিকটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেখানে বড় রকমের আনপ্রেজেন্ট শক দেখা গেছে। তিনি তাঁর ৪ বছর বয়স থেকে ১৭–১৮ বছর বয়স পর্যন্ত কিছু মনে করতে পারছেন না। বাদবাকি স্মৃতি ঠিক আছে।’

নাঈমা বললেন, ‘উনি কি তাঁর জন্মের পর থেকে চার বছর বয়স পর্যন্ত স্মৃতি মনে করতে পারছেন?’

ডাক্তার কালিম বললেন, ‘সে সময়ের স্মৃতি এমনিতেই কেউ মনে করতে পারে না।’

নাঈমা কিছু ভাবছেন। খানিকক্ষণ থেমে বললেন, ‘ছোটবেলার স্মৃতি তো তাঁর জন্য এখন খুব ইমপর্ট্যান্ট নয়, তাই না? বর্তমান সময়ের সব স্মৃতি তাঁর আছে। তিনি স্বাভাবিক। তাহলে আপনাকে এত চিন্তিত দেখাচ্ছে কেন?’

ডাক্তার কালিম হাসলেন। ম্লান হাসি। তিনি বললেন, ‘মিস্টার ওয়াসিফের ছোটবেলার স্মৃতি হচ্ছে, বলতে পারেন ফাউন্ডেশন। যেসব ঘটনার শুরু তাঁর ছোটবেলায়, সেসব ঘটনার শুরু তিনি মনে করতে পারবেন না। তাঁর কাছে মনে হবে, আচমকা যেন কোনো ঘটনা ঘটেছে। তিনি সেই ঘটনার পক্ষে যুক্তি খুঁজে পাবেন না। অস্থির হবেন। মা–বাবা, আত্মীয়স্বজনকে সম্পর্কের পরিচয়ে ডাকছেন, কিন্তু অনুভব করছেন না। কারণ, সেসব সম্পর্কের শুরুর কোনো আবেগ তাঁর স্মৃতিতে নেই।’

ওয়াসিফ বিছানা থেকে নামলেন। তিনি নেমেছেন ধীরে। সূর্য তার রশ্মি গুটিয়ে নিয়েছে। নরম দেখাচ্ছে সূর্যকে। পুরোপুরি কমলা হয়ে পাহাড়ের ওপাশে হারিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।

নাঈমা এগিয়ে এসেছেন। ওয়াসিফ হাসানের পিঠে আলতোভাবে হাত রাখলেন। শান্ত গলায় বললেন, ‘সূর্য ডোবার আগে তোমাদের বাসায় ফিরতে হতো। তোমার বাবার রাগ ছিল প্রচণ্ড। সন্ধ্যার পর বাসায় ফিরলে তিনি ভীষণ রাগ করতেন। তোমাকে একদিন মেরেছিলেন। তখন থেকে তুমি প্রতিদিন সন্ধ্যার আগে বাসায় ফিরতে।’

ওয়াসিফ মাথা ঝুঁকিয়ে বললেন, ‘আমার কিছু মনে পড়ছে না, নাঈমা। মাথার ভেতর দাঁড়কাক অনবরত ঠোকর দিচ্ছে।’

ডাক্তার কালিম বললেন, ‘মেমোট্রান্সফিউশন করলে মিস্টার ওয়াসিফ আবার আগের মতো স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে পেতে পারেন।’

চিকিৎসকেরা এ ক্ষেত্রে আত্মীয় কিংবা অতি কাছের মানুষ ছাড়া অন্যদের স্মৃতি ট্রান্সফিউশনের জন্য নেন না।

নাঈমা বুকের ভেতর আটকে থাকা বাতাস গোপনে বের করে দিলেন। এমন কিছুর আশঙ্কাই তিনি করছিলেন। মেমোট্রান্সফিউশন স্মৃতি ফিরে পাওয়ার কার্যকর ব্যবস্থা। তবে নিজ স্মৃতির সঙ্গে মিলিয়ে অন্য কারও স্মৃতি পাওয়া বড্ড মুশকিলের ব্যাপার। তা ছাড়া যাঁর কাছ থেকে স্মৃতি নেওয়া হয়, তাঁর ব্রেন থেকে সেই স্মৃতি পুরোপুরি মুছে যায়। তাই খুব আপন না হলে কেউ স্মৃতি দিতে চান না। চিকিৎসকেরা এ ক্ষেত্রে আত্মীয় কিংবা অতি কাছের মানুষ ছাড়া অন্যদের স্মৃতি ট্রান্সফিউশনের জন্য নেন না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ডাক্তারদের ফাঁকি দিয়ে দীর্ঘদিন কাছাকাছি থাকা কাউকে আত্মীয় সাজিয়ে নিয়ে আসে। বিপুল অর্থের বিনিময়ে তার স্মৃতি নেওয়া হয়। নাঈমা বুঝতে পারছেন না, কে দেবেন ওয়াসিফকে তাঁর ছোটবেলার স্মৃতি!

নিউরোসায়েন্টিস্ট আসমান ঘটক ভুরু কুঁচকে সামনের মনিটরের দিকে তাকিয়ে আছেন। ওয়াসিফকে নিজ স্মৃতি দান করবেন, এমন তৃতীয়জনকে তিনি পরীক্ষা করছেন। যে তিনজনকে আনা হয়েছে, তাঁরা ওয়াসিফের নিকটাত্মীয় বলা হয়েছে। তাঁদের বয়স ৭০ বছর ও তার বেশি। প্রত্যেকের ছোটবেলার স্মৃতি অত্যন্ত ঝাপসা। সেখান থেকে স্মৃতি নিয়ে ওয়াসিফের স্মৃতির সঙ্গে ন্যূনতম সাইন্যাপ্টিক সংযোগ তৈরি করা সম্ভব হবে না।

মেমোরি ট্রান্সফিউশন চিকিৎসাবিজ্ঞানে অভাবনীয় সাফল্য নিয়ে এসেছে। এর নাম দেওয়া হয়েছে মেমোট্রান্সফিউশন। এখানে নিউরোসাইন্যাপ্টিক ম্যাপিং করে দাতা ও গ্রহীতার স্মৃতির মধ্যে সাইন্যাপ্টিক সংযোগ তৈরি করা হয়। নিউরোসায়েন্টিস্টরা স্মৃতিদাতার ব্রেন থেকে প্রথমে স্মৃতির ডিজিটাল কপি বানান। এটা কোড তৈরি করতে সহায়তা করে। ডিজিটালাইজড স্মৃতিকোড নিউরোসাইন্যাপ্টিক ইন্টারফেস দিয়ে গ্রহীতার ব্রেনের মেমোরি সেলে সঞ্চালন করা হয়। মেমোট্রান্সফিউশনের মাধ্যমে কেবল ডেটা ট্রান্সফার করা হয় না। ব্রেনে ইলেকট্রিক্যাল ইম্পালস আর সাইন্যাপ্টিক প্যাটার্নের ব্যালান্সড অবস্থা তৈরি করা হয়।

গ্রাহক যখন স্মৃতি অনুভব করতে পারেন, তার সঙ্গে একাত্মবোধ করেন, তখন পরীক্ষা করে দেখা হয় চিন্তাভাবনা, দৃষ্টিভঙ্গি, আচরণ, সহানুভূতির অবস্থা স্মৃতিদাতার সঙ্গে মিলেছে কি না। যদি মিলে যায়, তাহলে কোয়ান্টাম লিপিড ওয়েভের মাধ্যমে স্মৃতিগ্রহীতার ব্রেনে স্মৃতিদাতার স্মৃতি স্থাপন করা হয়।

আসমান ঘটক উঠে পড়েছেন। তিনি বললেন, ‘অন্য কাউকে দেখুন। এঁদের স্মৃতি অধিক দুর্বল।’

নাঈমা বললেন, ‘ওয়াসিফের আপন ফুফু এসেছেন।’

আসমান ঘটক বললেন, ‘তাঁকে পুরো আয়োজন বুঝিয়ে বলুন। প্রয়োজন হলে আমাকে ডাকবেন।’

ফুফু দুই হাত বাড়িয়ে ওয়াসিফের মুখে আদর করছেন। তাঁর পেছনে দাঁড়িয়ে আছে মারুফ হাসান। সে আছে বিপুল আনন্দের ভেতর। কিসে সে এত আনন্দিত হয়েছে, বোঝা যাচ্ছে না। ওয়াসিফের ছোট ভাই মারুফ। তাঁরা দুই ভাই। মারুফ বিয়ে করেনি। একা থাকে। ভাই অসুস্থ শুনে এসেছে। এখন তার প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে বড় ভাইয়ের জন্য স্মৃতিদাতা খুঁজে নিয়ে আসা। অত্যধিক আগ্রহ নিয়ে সে এই কাজ করে যাচ্ছে। এই কাজের বিচিত্র অভিজ্ঞতায় হতাশ হয়ে পড়ার কথা ছিল। মারুফ হতাশ হয়নি। বিপুল উৎসাহ নিয়ে আনন্দের সঙ্গে স্মৃতিদাতার সন্ধান করে যাচ্ছে।

ফুফুর বয়স ৮৬ বছর। চোখে স্পষ্ট দেখেন না এবং কানে কম শোনেন। ওয়াসিফের মুখে হাত বুলিয়ে ফুফু বললেন, ‘ছোটবেলার কথা কিছু মনে করতে পারিস না, বাপ? সেই যে একবার সাপের বাচ্চা ধরে নিয়ে এসে আমাকে ভয় দেখাচ্ছিলি। আমি দৌড়ে ঘরে ঢুকে গিয়ে দরজা আটকে দিলাম। সকাল গড়িয়ে দুপুর হলো, দুপুর থেকে বিকেল হলো। তুই সাপ নিয়ে ঘরের দরজার সামনে বসে থাকলি, মনে আছে? তোর বয়স তখন ১৪ বছর।’

ওয়াসিফের কিছু মনে পড়ছে না। তিনি তাঁর সামনে বসে থাকা ভদ্রমহিলাকে চিনতে পারছেন। তাঁকে ফুফু বলে ডাকেন। তবে তিনি যে তাঁর আপন ফুফু, এমন কিছু মনে করতে পারছেন না।

নাঈমা বললেন, ‘ফুফু, আপনার স্মৃতি পেলে সে আবার সব মনে করতে পারবে।’

ফুফু বেঁকে বসেছেন। তিনি বললেন, ‘স্মৃতি দিতে হয়, তুমি দাও। আমাকে বলছ কেন?’

নাঈমা বললেন, ‘তার ছোটবেলার স্মৃতি দরকার। আপনার সঙ্গে তার ছোটবেলার স্মৃতি আছে। আমার সঙ্গে নেই।’

ফুফু বললেন, ‘তাহলে কুটুস তার স্মৃতি দিক। বিয়েথা করেনি, একলা মানুষ। সে স্মৃতি দিয়ে কী করবে!’

মারুফকে বাড়ির সবাই আদর করে কুটুস নামে ডাকে। সে ঘরের এক পাশে বসে আছে। সেখান থেকে উঠে এসে বলল, ‘ফুফু, আমার জন্মের সময় ভাইয়ার বয়স ১৭ বছর। ভাইয়ার মেমোরিতে এখন হয়তো আমিই নেই। আমার স্মৃতি নিয়ে ভাইয়ার কোনো লাভ হবে না।’

ফুফু বললেন, ‘তুই তোর বাপের বুড়ো বয়সের ছেলে।’

অলংকরণ: রাকিব
তাঁর বয়স যখন ২৩ বছর, তখন তিনি ওয়াসিফদের বাড়ি থেকে চলে যান। কোথায় চলে গেছেন, কেউ জানে না।

মারুফ বলল, ‘বাবা-মা বেঁচে থাকলে নিশ্চয় তাঁরা তাঁদের স্মৃতি দিয়ে ভাইয়াকে সুস্থ করে তুলতেন। আজ বাবা-মা বেঁচে নেই বলেই তোমার ওপর দায়িত্ব পড়েছে ভাইয়াকে সুস্থ করে তোলার।’

বসা থেকে ফুফু উঠে দাঁড়িয়েছেন। তিনি বললেন, ‘আমার চোখ নেই, কান নেই। ভালো দেখতে পাই না, শুনতেও পাই না। বড় বয়সের সব স্মৃতিই হচ্ছে অশান্তি আর যন্ত্রণার। কষ্ট থেকে দূরে থাকতে মাঝেমধ্যে ছোটবেলার স্মৃতি নাড়াচাড়া করি। আর কদিন বাঁচব জানি না। এ কদিন ছোটবেলার আনন্দের স্মৃতি হারিয়ে বাঁচতে পারব না। তোরা অন্য কাউকে দেখ।’

এই প্রথম মারুফকে হতাশ মনে হলো। তবে সে হতাশা প্রকাশ করল না। এক হাতের করতল দিয়ে আরেক হাতের করতলে চাপড় দিয়ে বলল, ‘ভাবি, চিন্তা কোরো না। ব্যবস্থা করছি।’

মারুফ অতি দ্রুত ব্যবস্থা করে ফেলেছে। সে আয়াত আলীকে খুঁজে বের করেছে।

ওয়াসিফদের বাড়িতে আয়াত আলী এসেছিলেন পাঁচ বছর বয়সে। তাঁর বাবার নাম ছিল জব্বর আলী। তিনি ওয়াসিফ হাসানের বাবার গাড়ি চালাতেন। জব্বর আলীর স্ত্রী মারা গেলে তিনি একমাত্র পুত্র আয়াত আলীকে নিয়ে এসে ওয়াসিফদের বাড়িতে রেখে দেন। ওয়াসিফ আর আয়াত একই স্কুলে এক ক্লাসে পড়তেন। তাঁরা সমবয়সী। পরে আয়াত আর পড়াশোনা করেননি। তাঁর বয়স যখন ২৩ বছর, তখন তিনি ওয়াসিফদের বাড়ি থেকে চলে যান। কোথায় চলে গেছেন, কেউ জানে না। মারুফের বয়স তখন কম। ছোটবেলায় আয়াতকে দেখার স্মৃতি মনে করতে পারেন না। তবে বাবা বেঁচে থাকা পর্যন্ত আয়াত বাবার সঙ্গে দেখা করতে আসতেন। মারুফ তখন তাঁকে দেখেছে। মারুফ তাঁকে আয়াত ভাই বলে ডাকে। বাবার সঙ্গে দেখা করতে এসে কোনো এক বিচিত্র কারণে আয়াত ভাই কখনো বড় ভাইয়া, মানে ওয়াসিফের সঙ্গে দেখা করতেন না। যদিও বাবা ভাইয়ার সঙ্গে একই বাড়িতে থাকতেন। আয়াত ভাই সেখানে আসতেন।

আরও পড়ুন

আয়াত তাঁর ছোটবেলার স্মৃতি ওয়াসিফকে দিতে রাজি হয়েছেন। মারুফ ভেবেছিল, এ জন্য হয়তো আয়াত ভাই মোটা অঙ্কের অর্থ দাবি করবেন। আয়াত কিছুই চাননি।

ওয়াসিফের মুখোমুখি বসে আছেন আয়াত। ওয়াসিফ তাঁকে চিনতে পারছেন না। আয়াত বললেন, ‘ওয়াসিফ, কেমন আছ?’

ওয়াসিফ প্রশ্নের উত্তর দিলেন না। তাঁর ব্রেনে আবার দাঁড়কাক ঠোকর দেওয়ার অনুভূতি হচ্ছে। অস্পষ্ট অবয়ব এসে মিলিয়ে যাচ্ছে। ডাক্তার বললেন, ‘ব্রেনের ওপর চাপ দেবেন না।’

মেমোরি ট্রান্সফিউশনের পর। আয়াত বসে আছেন ওয়াসিফের সামনে। তাঁর বসার ভেতর জড়সড় ভাব। ওয়াসিফ গম্ভীর গলায় বললেন, ‘কী রে আয়াত, কোথায় থাকিস? কী করিস এখন! বিয়ে করেছিস? বউ-বাচ্চা কোথায়?’

 আয়াত কোনো কথা বলছেন না। ওয়াসিফ তাঁর অতি পরিচিত। তবে কীভাবে পরিচিত, মনে করতে পারছেন না। অদ্ভুত এক দৃশ্য মনে পড়েছে ওয়াসিফের। তিনি তাঁদের ডুপ্লেক্স বাড়ির দোতলা থেকে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছেন। সোফার ওপর বাবা বসে আছেন। তাঁর সামনে বসেছিলেন আয়াত। তাঁকে নামতে দেখে আয়াত সোফা থেকে উঠে দরজার পর্দার আড়ালে চলে গেলেন। তিনি চলে যাওয়ার পর আয়াত এসে আবার বাবার সামনে বসেছেন। এই ঘটনার সাক্ষী তিনি নন। পুরোটা আয়াতের স্মৃতি।

ডাক্তারের মুখে সাফল্যের হাসি। তিনি নিশ্চিত হয়েছেন, আয়াত আলীর মেমোরি যথাযথভাবে ওয়াসিফ হাসানের ব্রেনে প্রতিস্থাপন করা সম্ভব হয়েছে।

ওয়াসিফ হাসানের মনে পড়ছে ইশকুল থেকে তিনি আর আয়াত একসঙ্গে ফিরেছেন। বাড়ি ফিরেই ওয়াসিফ চলে গেছেন বাবার কাছে। আয়াত অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র। স্কুলে সবাই তাঁকে ভীষণ পছন্দ করে। এটা ওয়াসিফের ভালো লাগেনি। তিনি তাঁর বাবাকে গিয়ে বললেন, ‘আয়াত যদি ইশকুলে যায়, তাহলে আমি ইশকুলে যাব না।’

বাবা জিজ্ঞেস করলেন, ‘আয়াত বেয়াদবি করেছে?’

ওয়াসিফ বললেন, ‘সে কী করেছে না করেছে, তা বিবেচনা করার দরকার নেই। আয়াত ইশকুলে যাক, তা আমি চাইছি না।’

বাবা কিছু অনুমান করলেন। তিনি বললেন, ‘মানুষকে কখনো ভাগ করবে না। ড্রাইভারের ছেলে বলে তাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করবে না।’

ওয়াসিফ রাজি হননি। আয়াত স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিলেন।

আরও পড়ুন
পা পিছলে পড়ে যাওয়ার ভান করে আমার খাবারের ওপর পড়ে গেলি। খাবার বদলে আমাকে নতুন খাবার দেওয়া হলো।

আয়াত হাসপাতাল থেকে সুস্থ হয়ে চলে যেতে চেয়েছিলেন। নাঈমা তাঁকে যেতে দেননি। বলেছেন, ‘আর কয়েকটা দিন থেকে যান।’ মারুফও জোর করে তাঁকে থেকে যেতে বলেছে।

আয়াতের মনে হচ্ছে, তাঁরা খুব আন্তরিক। তিনি এ বাড়িতে আগেও এসেছেন। এ বাড়ির সবাইকে চেনেন। কিন্তু তাঁদের সঙ্গে তাঁর কী সম্পর্ক, তা মনে করতে পারছেন না। মনে করতে গেলে মনে পড়ছে না, কষ্ট হচ্ছে আর অনুভব করছেন মাথার ভেতর যেন দাঁড়কাক ঠোকর দিচ্ছে।

বাসার সামনে দেয়ালঘেরা বিশাল সবুজ লন। শীতের সকালের ঝকঝকে নরম রোদ ছড়িয়ে আছে। সেখানে চেয়ারে মুখোমুখি বসে আছেন ওয়াসিফ আর আয়াত। ওয়াসিফ বললেন, ‘আয়াত, তোকে না খেতে দিয়ে ছোটবেলায় একবার সারা দিন স্টোররুমে আটকে রেখেছিলাম, মনে আছে?’

আয়াত ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছেন। তাঁর দৃষ্টি শূন্য। ওয়াসিফ বললেন, ‘তুই আমার ওপর রেগে গেলি। কবিরাজের কাছ থেকে করবী ফুলের বীজ নিয়ে এসেছিলি আমার খাবারে মিশিয়ে আমাকে মেরে ফেলবি বলে। সেই খাবার যখন খেতে যাব, তোর মনে হলো অন্যায় করছিস। পা পিছলে পড়ে যাওয়ার ভান করে আমার খাবারের ওপর পড়ে গেলি। খাবার বদলে আমাকে নতুন খাবার দেওয়া হলো। আমি বেঁচে গেলাম। তোর বাবা তোকে খুব মেরেছিলেন সেদিন আমার খাবারের ওপর পড়ে গিয়েছিলি বলে।’

আয়াতের মনে পড়ছে না। তাঁর মাথার ভেতর দাঁড়কাক অনবরত ঠোকর দিয়ে যাচ্ছে।

ওয়াসিফ বললেন, ‘কাউকে কোনো দিন কষ্ট দেব না। তুই আমার পরম আত্মীয় হয়ে আমার কাছে থেকে যা।’

আয়াত কিছু বললেন না। ওয়াসিফ বললেন, ‘কোনো দিন যদি মনে পড়ে ছোটবেলায় তোকে ভীষণ নির্যাতন করেছি, তখন কী করবি?’

আয়াত স্পষ্ট চোখে তাকালেন। বললেন, ‘বিশ্বাসই করব না। তুমি কোনো দিন আমাকে কষ্ট দিতে পারো না।’

ওয়াসিফের চোখ ভরে পানি চলে এসেছে। তিনি কাঁদছেন। পরম ভালোবাসা ছুঁয়ে যাওয়া কান্না।