ম্যামো টেক্সিস

পরদিন ইমতিয়াজ ময়নাতদন্তের কাগজটা নিয়ে গুম হয়ে বসে আছে। সবই ঠিকঠাক আছে, ময়নাতদন্তের রিপোর্ট যেমন হয়, তেমনই; নতুন কিছু নেই

ঢাকা শহরের আশপাশে যে এখনো এত বড় একটা জঙ্গল আছে, কে বিশ্বাস করবে। এবং সেই জঙ্গলের প্রায় সবচেয়ে বড় গাছটার নিচে একটা খুন হতে পারে, তাই–বা কে বিশ্বাস করবে। আর লাশটা সপ্তাহ ধরে পড়ে আছে, ফুলেফেঁপে উঠেছে, বিশ্রী গন্ধও ছুটেছে। হোমিসাইড ইন্সপেক্টর ইমতিয়াজ প্যাকেটের শেষ সিগারেটটা ধরাল। তার খুবই বিরক্ত লাগছে ফরেনসিকের লোকজন এখনো এসে পৌঁছায়নি। জায়গাটা কর্ডন করা হয়েছে...এই সময় তার ফোন বেজে উঠল, চিফের ফোন।

ইমতিয়াজ?

স্যার।

অবস্থা কী? লোকটার পরিচয় পেয়েছ?

কিছুটা পেয়েছি, লোকটা স্যার কাঠ ব্যবসায়ী। এই জঙ্গলে প্রায়ই আসত।

কেন আসত?

যদ্দুর বুঝেছি এই জঙ্গলে ইকো টেররিজমের একটা ব্যাপার আছে, লোকটা এর সঙ্গে জড়িত, তাই...

বুঝলাম না।

স্যার, এখানে কিছু বেশ বড় গাছ আছে, ওই সব গাছের কাণ্ডে একটু পরপর বড় পেরেক ঢোকানো আছে, এটাই ইকো টেররিজম!

কিন্তু কেন?

এটা স্যার আমিও ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি। তবে বোঝার চেষ্টা করছি। যদ্দুর বুঝেছি, পেরেক ঢোকানো থাকলে গাছচোরেরা যখন গাছ চুরি করে করাতকলে কাটতে নিয়ে যায়, তখন মেশিনের চলন্ত করাত পেরেকে লেগে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে। দুর্ঘটনা ঘটুক এটাই এরা চায়, যাতে গাছ চুরি করতে পরবর্তী সময়ে ভয় পায় গাছচোরেরা; এটাই স্যার, ইকো টেররিজম।

বলে কী! জায়গাটা কর্ডন করেছ?

জি, স্যার।

তোমার সঙ্গে কতজন আছে?

স্যার, চারজন কনস্টেবল, ফরেনসিকের লোকজন আসছে। স্যার কি আসবেন?

বুঝতে পারছি না হোম মিনিস্ট্রি থেকে আবার ডেকে পাঠিয়েছে। তুমি ইনভেস্টিগেশন চালিয়ে যাও। পারলে আসব।

আচ্ছা স্যার। ও পাশে হোমিসাইড ডিপার্টমেন্টের চিফ, ইমতিয়াজের ডাইরেক্ট বস ফোন রেখে দিলেন। ফরেনসিকের লোকজন চলে এসেছে। ছবি তোলা হচ্ছে, আশপাশ থেকে ছোটখাটো সন্দেহজনক জিনিসপত্র প্লাস্টিকের ব্যাগে ঢোকানো হচ্ছে, সিল করা হচ্ছে। লোকটাকে গুলিটা করা হয়েছে মাথার ঠিক পেছন দিকে, পয়েন্ট রেঞ্জ মার্ডার। এবং খুব সম্ভবত গুলি করে এই গাছের গোড়ায় তাকে কবর দেওয়ার প্রস্তুতি চলছিল...তখন কেউ এসে পড়ায় তাকে ওইভাবে রেখে পালিয়েছে। একটু দূরে বেলচা পাওয়া গেছে একটা, তাতে সন্দেহটা পাকাপোক্ত হয়েছে আরও। তবে লাশটা যে এত দিনেও শিয়ালে খায়নি, এটাই আশ্চর্য।

স্যার, ভিকটিমের মাথায় গুলির ফুটো দিয়ে গাছের বেশ কয়েকটা শিকড় ঢুকে আছে। মাথাটার ক্লোজ শট নেওয়া যাচ্ছে না। মাথাটা নড়ানোই যাচ্ছে না। ফরেনসিকের মেয়েটা বলল।

মানে?

স্যার, বুঝতে পারছি না। লাশটা সরালে বোঝা যেত।

সরাই তাহলে আমরা।

জি, স্যার।

সবাই মিলে বহু কষ্টে লাশটাকে গর্ত থেকে টেনে ওপরে তোলা হলো। তখনই বোঝা গেল ব্যাপারটা। লাশ গুম করার জন্য যে গর্ত করা হয়েছিল, সেখানে গাছের গোড়ার কিছু ছোট ছোট শিকড় ওপেন হয়ে গেছে; তারই কিছু শাখা-প্রশাখা শিকড়-বাকড় লোকটার গুলিতে ফুটো হওয়া খুলি দিয়ে একদম মগজের ভেতরে ঢুকে গিয়েছিল, এটা হতেই পারে।

অবশেষে জোন প্যাকআপ করে সবাই লাশ নিয়ে শহরে ফিরে চলল।

খুন হওয়া লোকটা বিয়ে করেনি, অ্যাডপ্ট চাইল্ড হিসেবে বড় হয়েছে, সে জন্য কোনো আত্মীয়স্বজন এল না লাশ বুঝে নিতে। ময়নাতদন্তের পর লাশ চলে গেল আঞ্জুমান মুফিদুলের কাছে।

পরদিন ইমতিয়াজ ময়নাতদন্তের কাগজটা নিয়ে গুম হয়ে বসে আছে। সবই ঠিকঠাক আছে, ময়নাতদন্তের রিপোর্ট যেমন হয়, তেমনই; নতুন কিছু নেই। শুধু এক জায়গায় একটা লাইন এ রকম, ইংরেজিতে লেখা...যার বাংলা করলে দাঁড়ায় এমন...

‘লোকটার মস্তিষ্কের নিউরনের সিনাপসে কিছু প্ল্যান্ট সিগন্যাল পাওয়া গেছে...যেটা অসম্ভব একটা ব্যাপার।’

মানে কী? ইমতিয়াজ বিষয়টা বোঝার চেষ্টা করেও বুঝতে পারল না। ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলা দরকার সরাসরি। বিকেলের দিকে ইমতিয়াজ গিয়ে হাজির হলো। ডাক্তার ভদ্রলোক নেই। এক সপ্তাহের জন্য সিঙ্গাপুরে গেছেন। তাঁর অ্যাসিস্ট্যান্ট বসে আছে। লোকটা একটু বেশি কথা বলা টাইপের।

স্যার, সালামালিকুম।

ওয়ালাইকুম, ডাক্তার সাহেবকে একটু দরকার ছিল।

স্যার, ওই যে জঙ্গলে খুন হইছে লোকটার ব্যাপারে?

হুঁ।

‘স্যারে হঠাৎ কইরা একটা টেরনিংয়ে সিঙ্গাপুর গেছে। আপনেরে এই কাগজ দুইটা পৌঁছায়া দিতে বলছে, আর আপনে আয়া পড়ছেন।’ বলে সে স্ট্যাপল করা কয়েকটা কাগজ দিল। তারপর গলা নামিয়ে বলল, ‘স্যার, ওই লোকের বেরেন ওই গাছে খায়া দিছে!’

মানে?

মানে ডাক্তার স্যার যখন ওই লাশটা কাটে, তখন বেরেনের ভেতর গাছের অনেক শিকড়-বাকড় পাইছে...আমার মনে হয়, স্যার, ওই গাছে ওই লোকের বেরেন খায়া লওয়ার তাল করছিল। যে গাছে স্যার ভূত–পেতনি থাকে, ওই গাছের শিকড় স্যার ডেঞ্জারাস! স্যার, গাছটা কি তেঁতুলগাছ ছিল?

না।

স্যার, চা খান...চা আনি?

না, পরে আসব।

পরদিন ইমতিয়াজ আবার গেল জায়গাটায়, মানে জঙ্গলটায়; তখনো জায়গাটা কর্ডন করা। গর্তটার কাছে গিয়ে দাঁড়াল ইমতিয়াজ। একটা মিনিমাম ক্লু দরকার, আজ তিন দিন হয়ে গেছে, কোনো ক্লু পাচ্ছে না। ঠিক তখনই তার কানের কাছে একটা কেমন শব্দ হলো ‘আরাফ’ ‘আরাফ’।

ইমতিয়াজ এদিক–ওদিক তাকাল। শব্দটা আর নেই। গাছের চারদিকে ঘুরে একটু দূরে গেল; সে বোঝার চেষ্টা করছে গুলিটা যে করেছে তার একটা মিনিমাম এভিডেন্স থাকার কথা, যেটা ফরেনসিকের লোকজন মিস করে গেছে; প্রতিবারই এমন হয়। তখনই কানের কাছে শব্দটা আবার হলো...‘আরাফ’ ‘আরাফ’, এবার বেশ একটু আস্তে। খুব শিগগির ইমতিয়াজ আবিষ্কার করল, এই ‘আরাফ’ শব্দটা দূরে গেলে আস্তে হয়, গাছের কাছাকাছি থাকলে একটু যেন জোরে এবং স্পষ্ট শোনা যায়। শব্দটা যে সে কান দিয়ে শুনছে, ঠিক তা–ও নয়। শব্দটা যেন তার মাথার ভেতরে হচ্ছে...‘আরাফ’ ‘আরাফ’... প্রতিধ্বনির মতো!

সেদিন সন্ধ্যায় ইমতিয়াজ তার এক বন্ধুর বাসায় গেল। বন্ধুটি একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের বোটানির অধ্যাপক।

আরে, ডিটেকটিভ, তুই হঠাৎ?

একটা কাজে আসছি তোর কাছে।

কাজ ছাড়া তুই কবে আসলি? চা খাবি তো? টা কিন্তু দিতে পারব না, বাসায় তোর ভাবি নেই।

চা পরে, আগে আমার এই কাগজগুলো একটু দেখ তো, বলে ময়নাতদন্তের রিপোর্ট আর স্ট্যাপল করা অ্যাডিশনাল দু–তিনটা কাগজ এগিয়ে দিল।

কাগজগুলো পড়তে পড়তে দু–তিনবার অস্ফুটভাবে বলল, আশ্চর্য! আশ্চর্য! তারপর কাগজগুলো রেখে গম্ভীরভাবে উঠে গেল, সম্ভবত চা আনতে। ইমতিয়াজ বুঝতে পারল, বন্ধুর মাথায় গভীর কোনো চিন্তা চলছে। কিছু একটা ইন্টারেস্টিং পেয়েছে সে নিশ্চয়ই। যেটা সে বুঝতে পারেনি।

চা নিয়ে ফিরে এল।

কিছু বুঝলি?

চা খা, তারপর বলছি।

চা শেষ করে দুই বন্ধু দুটি সিগারেট ধরাল। বোটানির অধ্যাপক এবার মুখ খুলল,

ব্যাপারটা খুব অদ্ভুত মনে হচ্ছে রে। আচ্ছা, ওই জঙ্গলে তুই কি ভিন্ন ধরনের কিছু পেয়েছিস বা টের পেয়েছিস...মানে অন্য ধরনের কোনো ফিলিংস হয়েছে তোর? ইমতিয়াজ ‘আরাফ’ শব্দটার ব্যাপারে খুলে বলল।

বলিস কী! তুই কি একটা গাছের আশপাশেই এই শব্দটা পেয়েছিস?

হ্যাঁ, যে গাছটার নিচে লোকটা খুন হয়েছে।

আমার মনে হয়, শিগগির তুই সব কটি গাছের কাছে থেকে এই শব্দটা পাবি।

মানে কী? কেন?

মানে হচ্ছে, আমি যতটুকু বুঝেছি...আমি সহজ করে বোঝানোর চেষ্টা করি তোকে। সাবসিডিয়ারিতে তো তোর বোটানি ছিল, তুই বুঝবি। মৃত লোকটার মাথার খুলির ভেতর গাছের শিকড় ঢুকে ছিল, তা–ই তো? মানুষের ব্রেনের একটা নিউরন থেকে আরেকটা নিউরনে ইনফরমেশন যায় এক্সন দিয়ে। ধরে নে, নিউরনের একটা লোজ হচ্ছে এক্সন। কিন্তু আরেকটা নিউরনের কাছে যখন এক্সনটা যায়, তখন ছোট্ট একটা গ্যাপ থাকে, এটাকে বলে সিনপস। ওই গ্যাপের ভেতর দিয়ে নিউরন ইনফরমেশন পাস করে, সিগন্যাল দেয়। মজার ব্যাপার হচ্ছে, সাম হাউ ওই গাছটা কিছু সিগন্যাল ভিকটিমের ব্রেনের নিউরনের সিনপস থেকে নিয়ে নিয়েছে তার ম্যামো টেক্সিস দিয়ে...একটা অসম্ভব ব্যাপার!

কিন্তু ম্যামো টেক্সিসটা কী?

গাছের ডালপালা যখন আলোর দিকে যায়, সেটাকে আমরা বলি ফটো টেক্সিস, যখন তার শিকড় মাটির নিচে কোনো কেমিক্যালের দিকে যায়, তখন বলি ক্যামো টেক্সিস। আর যখন কোনো মেমোরি বা ইনফরমেশনের দিকে যায়, তখন বলতে পারি ম্যামো টেক্সিস...যদিও এটা এখানো একটা হাইপোথিসিস, কিন্তু তোর ‘আরাফ’ শব্দের ঘটনাটা কিন্তু প্রমাণ করছে ব্যাপারটা সত্যি হতে পারে। গাছ হয়তো মানুষের মেমোরি সিগন্যাল নিতে পারে। মানুষের মস্তিষ্ক হচ্ছে একটা নিউট্রাল নেটওয়ার্ক...আর জানিস তো গাছ কিন্তু মাটির নিচে শিকড়ে শিকড়ে নিজের এবং অন্যান্য গাছের সঙ্গে একটা বিশাল নেটওয়ার্ক তৈরি করে রাখে সব সময়। আমার মনে হয়, ভিকটিমের মেমোরির কিছু সিগন্যাল গাছটা সাম হাউ নিয়ে নিয়েছে...তার ব্রেনের নিউরন থেকে সেটাই বলার চেষ্টা করছে...!

বলিস কী! এটা কি সম্ভব?

সম্ভব নয়, কিন্তু সব সময় অসম্ভবের ভেতর দিয়েই সম্ভাবনাগুলো আসে...

ইমতিয়াজ পরদিন আবার গেল জঙ্গলে। কী আশ্চর্য! সমস্ত জঙ্গলেই তার মাথার ভেতর কেউ ফিসফিস করে বলছে, ‘আরাফ আরাফ আরাফ...!’ তার মানে কি সব গাছ কিছু বলার চেষ্টা করছে? কোনো ইনফরমেশন দেওয়ার চেষ্টা করছে? তখনই ফোনটা বেজে উঠল। চিফের ফোন—

ইমতিয়াজ, তুমি কোথায়?

স্যার, আমি ওই জঙ্গলটায় একটু এসেছি।

উফ...জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরলে চলবে?...তুমি আজই একটা চার্জশিট দাও তো। এই কেস শেষ করো জলদি। আর সময় নষ্ট করা যাবে না।

স্যার, একটা দিন সময় দিন।

না, এক দিনও না।

স্যার, আধা বেলা সময় দেন...১২ ঘণ্টা।

আচ্ছা, ১২ ঘণ্টা...এক মিনিট বেশিও না কমও না। কট করে লাইন কেটে গেল ওপাশে।

ভিকটিমের কাঠ চেরাইয়ের দোকানটায় তার অ্যাসিস্ট্যান্টকে পাওয়া গেল। তার চেহারায় একটা দিশেহারা ভাব। মালিক মারা যাওয়ার পর কী করবে, এখনো বুঝে উঠতে পারছে না। ইমতিয়াজকে দেখে উঠে দাঁড়াল।

স্যার, স্লামালাইকুম।

ওয়ালাইকুম...আচ্ছা, আরাফকে চেনো?

আরাফ? আরাফউদ্দীন? হ, মালিকের পার্টনার ছিল একসময়। মালিক তারে আরাফ ডাকত।

তাকে কোথায় পাব?

ওই তো স্যার, টংয়ের দোকানে লাল শার্ট পরা, চা খাইতাছে।

লাল শার্টের পেছনে দাঁড়িয়ে ইমতিয়াজ বলল, ‘আপনি আরাফ, আরাফউদ্দিন?’ লোকটা ঘুরে তাকাল, হ্যাঁ–না কিছু বলল না। ইমতিয়াজকে একনজর দেখল, তার কোমরের বেল্টে গোঁজা চায়নিজ পিস্তলটার দিকে তাকাল...তারপর আধা খাওয়া চায়ের কাপটা আস্তে করে রেখে হঠাৎ লাফিয়ে উঠে জীবনের শ্রেষ্ঠ দৌড়টা দেওয়ার চেষ্টা করল।

লাল শার্টের আরাফউদ্দিনকে লকআপে ঢুকিয়ে। চার্জশিট লিখতে বসল ইমতিয়াজ।

এর তিন মাস পর। আরেকটা খুনের কেসের দায়িত্ব পেল ইমতিয়াজ । খুনির মোটিফ বোঝা যাচ্ছে না। কী মনে হলো ইমতিয়াজের, হঠাৎ করে ওই জঙ্গলে গিয়ে হাজির হলো একদিন। এমন না যে এই খুনির নামটাও গাছ তাকে বলে দেবে। কিন্তু গাছেরা তো শিকড়ে শিকড়ে ইনফরমেশন চালাচালি করে, তাদের নেটওয়ার্ক বিশাল...ম্যামো টেক্সিসও এখন আর হাইপোথিসিস নয়। আর তাদের ইনফরমেশনে এখন আছে একজন মানুষের নিউরনের কিছু সিগন্যাল। ইমতিয়াজ তার মস্তিষ্কের ভেতরে কিছু শোনার জন্য অপেক্ষা করে।