৭. অদৃশ্য ফাঁস
২০ জুলাই। ডায়েরির সূত্র আবার ছিন্ন।
বোঝা গেল, অনেক দূরে চলে গেছে হাতির দল। ছাউনি ফেলে হাতির পথ ধরে বেশ কয়েক দিন এগিয়ে যাওয়ার পর কিছু তাজা চিহ্ন চোখে পড়ল। তার দুই দিন পরে হাতির জল খাওয়ার জায়গাটা আবিষ্কার করল দেশীয় লোকেরা। হাতি শিকারে ফানেরা ওস্তাদ, হাতি ধরার নানা পদ্ধতি আছে তাদের। কিন্তু নিজের মৌলিক পদ্ধতিই ভাগের পছন্দ। সঙ্গে তিনি একটা বাক্স আনার হুকুম দিয়েছিলেন, সেই বাক্স থেকে এবার তিনি অদৃশ্য কী সব জিনিস বের করলেন। হাওয়ার মতো অদৃশ্য এই সব জিনিস তুলে তুলে সাজিয়ে রাখার সময় ভাগের হাত যেভাবে নাড়াচাড়া করছিল, তার দিকে একটা সংস্কারাচ্ছন্ন আতঙ্কে চেয়ে চেয়ে দেখল ফানেরা। বোধ হয় ভাবছিল, ভাগ সম্ভবত খুব উঁচু দরের একজন ওঝা।
ভাগ আমাকে কিছু বলেননি, কিন্তু আন্দাজ করলাম, হাতি ধরার কোনো ফাঁদ বের করে রাখছেন তিনি এবং গোলকটির মতো এগুলোও সেই একই অদৃশ্য বস্তু দিয়ে তৈরি। কৌতূহলে মরছি দেখে ভাগ বললেন, ‘এসে পরখ করে দেখুন।’
শূন্যে হাতড়ে হাতড়ে শেষ পর্যন্ত ১ সেন্টিমিটার পর, একটা দড়ি হাতে ঠেকল।
‘এটা কি রাবার?’
‘হ্যাঁ, রাবারের নানা রকমফেরের একটা। এই বিশেষ কাজের জন্য এটাকে আমি দড়ির মতো নমনীয় করেছি, কিন্তু ওই গোলকের মতোই স্বচ্ছ আর ইস্পাতের মতোই শক্ত। এই অদৃশ্য দড়ির ফাঁস তৈরি করে হাতির পথে পেতে রাখব। এই ফাঁসে জড়িয়ে গিয়ে হাতি আমাদের হাতে পড়বে।’
মাটির ওপর অদৃশ্য দড়ি বিছিয়ে ফাঁদ পাতাটা বিশেষ সহজ কাজ ছিল না। বারবারই নিজেরাই পা বেঁধে উল্টে পড়ছিলাম। যা–ই হোক, সন্ধ্যা নাগাদ কাজটা শেষ হলো, এবার হাতির জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনো কাজ নেই।
চমৎকার গ্রীষ্মমণ্ডলীয় রাত। জঙ্গল ভরে কেবল মৃদু শনশন, হাঁসফাঁস শব্দ। একবার একটা কান্নার মতো শোনা গেল, কোনো একটা ছোট জানোয়ার হয়তো শেষ বিদায় নিল জীবনের কাছে। মাঝেমধ্যে যেন শোনা গেল কেমন উদ্দাম হাসির আওয়াজ, তা শুনে আরও জড়সড় হয়ে বসল দেশীয় লোকেরা, ঠান্ডা বাতাসে লোকে যেমন ঘন হয়ে বসে।
হাতিরা এল অলক্ষ্যে। দল ছাড়িয়ে একটু আগে আগে চলেছে সরদার হাতিটি, প্রকাণ্ড তার শরীর, শুঁড়টা বাড়িয়ে ক্রমাগত দোলাচ্ছে। রাতের হাজার রকমের গন্ধ শুঁকছে সে শুঁড়ে, বাছাই করছে, মনে মনে হিসাব করছে, কোন গন্ধটা বিপৎসূচক। ঠিক আমাদের অদৃশ্য ফাঁসগুলোর সামনে হঠাৎ থমকে দাঁড়াল হাতিটি, শুঁড়টা এমন সোজাসুজি বাড়িয়ে দিল, যা আমি আগে কখনো দেখিনি। কোনো একটা গন্ধ ঠাহর করার চেষ্টা করছিল সে। হয়তো আমাদের শরীরেরই গন্ধ, যদিও দেশীয় লোকেদের পরামর্শমতো আমরা সবাই সূর্য ডোবার আগে জলায় স্নান সেরে জামাকাপড় পরিষ্কার করে কেচে নিয়েছিলাম। বিষ্ণুমণ্ডলে সারা দিন ধরে লোকে ঘামে কিনা।
‘ব্যাপার খারাপ,’ ফিসফিসিয়ে বললেন ভাগ, ‘হাতিটা আমাদের গন্ধ পেয়েছে। আমার ধারণা, গন্ধটা রাবারের, আমাদের গায়ের গন্ধ নয়। ও কথাটা আমার খেয়াল হয়নি।’
স্পষ্টতই ইতস্তত করছিল হাতিটা। বোঝা যায়, অপরিচিত একটা গন্ধের সাক্ষাৎ পেয়েছে সে। কী ধরনের বিপদ জড়িয়ে আছে এ অজানা গন্ধের সঙ্গে, দ্বিধাগ্রস্তভাবে একটু এগোল হাতিটা, ওই অদ্ভুত গন্ধ কোথা থেকে আসছে, সম্ভবত তা দেখার জন্য। এগোল কয়েক পা, তারপরই আটকে গেল প্রথম ফাঁসটায়। সামনের পা দিয়ে টান মারল সে, কিন্তু অদৃশ্য বাঁধন খসল না। আরও জোরে টান মারল হাতিটা। পায়ের ঠিক ওপরে চামড়ার ওপর যে কিছু একটা কষে বসছে, তা বেশ দেখলাম আমরা। এরপর পুরো দেহের ভর দিয়ে প্রকাণ্ড জন্তুটা এমনভাবে পেছনে টান মারল যে তার পেছনটা প্রায় এসে ঠেকল মাটির সঙ্গে। দড়ির বাঁধন হাতির মোটা চামড়া ভেদ করে কেটে বসল, থকথকে ঘন রক্ত পড়তে লাগল পা বেয়ে।
বোঝাই যায়, অসম্ভব টান সইতে পারে ভাগের এই দড়ি।
বিজয় উৎসব শুরু করতে যাব, এমন সময় অপ্রত্যাশিত একটা ব্যাপার ঘটল। যে মোটা গাছের গুঁড়ির সঙ্গে দড়িটা বাঁধা ছিল, সেটা কুড়ালে কাটার মতো করে ভেঙে পড়ল। আচমকা পড়ে গেল হাতিটা, তারপর হুড়মুড়িয়ে খাড়া হয়ে পেছন ফিরে বিপদের ডাক ছেড়ে পালাল।
ভাগনার বললেন, ‘সব মাটি হলো। যেখানে ওই অদৃশ্য ফাঁদগুলো পেতেছিলাম, তার ধারেকাছেও আর হাতিরা আসবে না। গন্ধ শুঁকেই ওগুলো টের পেয়ে যাবে। গন্ধনাশক কোনো একটা রাসায়নিক ব্যবহার করতে হচ্ছে...হ...গন্ধ...মানে…’ কী একটা চিন্তায় ডুবে গেলেন ভাগনার, তারপর বললেন। ‘কেন, চলবে না? আমি কী ভাবছি শোনেন, হাতি ধরার রাসায়নিক পদ্ধতি ব্যবহার করব আমরা, যেমন ধরুন, গ্যাস আক্রমণ। হাতিটাকে মেরে ফেলার দরকার নেই, সেটা খুব সোজা। তাকে অজ্ঞান করে ফেলতে হবে। গ্যাস মুখোশ পরে এক ড্রাম গ্যাস নিয়ে এই বনের পথে ছাড়ব। চারদিকের গাছপালা খুব ঘন, প্রায় গাছের একটা টানেল বললেই হয়। এর ভেতরে গ্যাস বেশ টিকে থাকবে...কিন্তু আরও সহজ একটা পথই তো রয়েছে।’
হঠাৎ হাসতে শুরু করলেন ভাগনার। কী একটা কথা ভেবে যেন ভারি মজা লেগেছে তার। ‘আমাদের এখন শুধু বের করতে হবে, কোথায় জল খেতে যায় হাতিগুলো। এ জায়গায় সেগুলো আর আসবে না বলেই মনে হয়।’
৮. হস্তী-সূরা
২১ জুলাই। আরেকটা জল খাওয়ার জায়গা পেয়েছে দেশীয় লোকেরা, ছোট্ট একটা বুনো হ্রদের মতো। জল খেয়ে হাতিগুলো যখন চলে গেল, তখন লোকজন সঙ্গে নিয়ে কাজ শুরু করে দিলাম আমরা। জামাকাপড় খুলে জলে নামা গেল, তারপর গায়ে–গায়ে এক সারি খুঁটি পুঁতে হ্রদের একটা জায়গা বেষ্টন করে ফেলা হলো। এরপর জলতলের এই দেয়ালের গায়ে মাটি লেপা হলো পুরু করে। ফলে সেটা দাঁড়াল একটা আলাদা চৌবাচ্চার মতো। এটা ঠিক সেই জায়গা, যেখানে হাতিগুলোকে জল খেতে দেখা গেছে।
‘চমৎকার হয়েছে,’ বললেন ভাগ, ‘এবার এই জলকে একটু “বিষাক্ত” করতে হবে। তার একটা চমৎকার, একেবারেই অক্ষতিকর পদ্ধতি আমার আছে। তার ক্রিয়াটা অ্যালকোহলের চেয়েও কড়া।’
কয়েক ঘণ্টা তার ল্যাবরেটরিতে কাটালেন ভাগ; শেষ পর্যন্ত বালতিভরা যে জিনিস নিয়ে তিনি বের হলেন, সেটার নাম তার মতে হস্তী-সূরা। পুকুরে ঢালা হলো জিনিসটা। আর আমরা সবাই গিয়ে গাছে উঠে বসলাম পর্যবেক্ষণের জন্য।
ছায়ার এতটুকু রোদ গলে ঢুকতে দেয় না তা। গাছের ডালগুলো থেকে ঝুরি নেমে শিকড় গজিয়েছে সেখানে। ঝাপসা অন্ধকার, এখানে বাতাস ঠান্ডা। এসব অতিকায় গাছের তলে বট, রাবারগাছ আর ভারতীয় ডুমুরগাছের তলে প্রায়ই বিশ্রাম নিয়েছি আমরা।
এমনই একটা বিরাট গাছের ডালেই এখন আশ্রয় নিয়েছি, গাছটা হ্রদের খুব কাছেই এবং হাতির পথ ধরে তার পর্যন্ত যেতে হলে প্রতিটি জন্তুকেই আমাদের এই মল্লভূমির মধ্য দিয়ে যেতে হবে। এ ভূমিতে বহু আরণ্য-নাটকের অভিনয় যে হয়ে গেছে, তা বোঝা যায়। এখানে–ওখানে হরিণ, মহিষ আর বুনো শূকরের হাড় পড়ে আছে। তৃণভূমি এখান থেকে খুব বেশি দূরে নয়, তাই প্রায়ই তৃণভূমির জীবজন্তু জল খেতে আসে এখানে।
মল্লভূমি পেরিয়ে গেল একটা বুনো শূকর, তার পেছনে মা আর আটটি বাচ্চা। গোটা পরিবার এগোল জলের দিকে। এক মুহূর্ত পরেই আরও পাঁচটি মা-টাকে দেখা গেল, বোঝা যায় একই পরিবারভুক্ত। শূকরটা জলের কাছে এসে খেতে শুরু করল। কিন্তু পরমুহূর্তেই নাক তুলে বিরক্তিভরে ঘোঁত ঘোঁত করল। তারপর সরে গেল আরেকটা জায়গায়। সেখানকার জলটা পরখ করে ভালো লাগল না। মাথা ঝাঁকাল।
‘খাবে না,’ ভাগকে বললাম ফিসফিস করে। ‘স্বাদ নিতে দিন একটু।’ তেমনি আস্তে করেই বললেন ভাগ।
দেখা গেল, ভাগের কথাই সত্যি। অচিরেই মাথা ঝাঁকানো বন্ধ করে একনাগাড়ে জল খেতে শুরু করলে শূকরটা। মা শুকরটো কিন্তু বিব্রত বোধ করছিল, মনে হলো যেন চেঁচিয়ে বাচ্চাগুলোকে জল খেতে নিষেধ করছে। কিন্তু শিগগিরই স্বাদ পেয়ে গেল সে–ও। অনেকক্ষণ ধরে, সাধারণত যা স্বাভাবিক, তার চেয়ে বেশিক্ষণ ধরে জল খেতে লাগল শূকরগুলো। প্রতিক্রিয়াটা প্রথমে ঘটল বাচ্চাগুলোর ওপর। চেঁচামেচি করে সেগুলো এর–ওর গায়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে ছুটতে লাগল মল্লভূমিটায়। তারপর মা শুকরের সব কটিই মাতাল হয়ে উঠল: ঘোঁত ঘোঁত করে অদ্ভুত সব কাণ্ড করতে লাগল সেগুলো—লাফালাফি করল, পেছনের পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াতে লাগল, গড়াগড়ি দিল মাটিতে, এমনকি মাটিতে মাথা দিয়ে ডিগবাজিও খেতে লাগল। তারপর টলে পড়ে বাচ্চাকাচ্চাসমেত ঘুমাতে শুরু করে দিলে সবাই। বাবা শুকরটা কিন্তু খেপে উঠল নেশায়।
ভয়ানক ঘোঁত ঘোঁত করে সে মল্লভূমির মাঝখানকার একটা গাছের গুঁড়ির দিকে ধেয়ে গেল বেগে: এমন জোরে দাঁত বসিয়ে দিলে যে পরে তা ছাড়াতে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল তাকে।
মাতাল শূকরের কাণ্ডে আমরা এমন নিমগ্ন হয়েছিলাম যে হাতিগুলোর আসা খেয়াল করিনি। সবুজ পথটা থেকে ধীরে ধীরে এগিয়ে এল সেগুলো, মাপা পা ফেলে ফেলে আসছিল একের পর এক সারি বেঁধে। গাছের গুঁড়িটার চারপাশের এলাকাটা তখন ঠিক এক সার্কাসের রঙ্গভূমির মতো। এত বেশিসংখ্যক চতুষ্পদ খেলোয়াড়ের সার্কাস কখনো দেখেনি। স্বীকার করব যে এতগুলো হাতি দেখে সত্যিই ভয় লেগেছিল। সেগুলোকে দেখাচ্ছিল যেন অতিকায় সব ইঁদুরের মতো—সংখ্যায় গোটা কুড়ির বেশি।
কিন্তু কী যে ভীমরতি ধরল মাতাল শূকরটার! ভালোয় ভালোয় পালিয়ে বাঁচার বদলে সে সরোষ গর্জন করে তিরের মতো ছুটে গেল হাতির দঙ্গলটার দিকে। সরদার হাতিটা স্পষ্টতই থতমত খেয়ে গেল। কেননা, কৌতূহলী দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে দেখছিল ধেয়ে আসা জন্তুটার দিকে। শূকর এসে দাঁত বসাল তার পায়ে। হাতিটা তার শুঁড় গুটিয়ে মাথা নামিয়ে দাঁত দিয়ে এমনভাবে ছুড়ে ফেলে দিল শূকরটাকে, সেটা একেবারে উড়ে গিয়ে পড়ল ঠিক জলার জলে।
ঘোঁত ঘোঁত করে শূকরটা হুড়মুড়িয়ে ফের উঠল তীরে, সেই সঙ্গে যেন একটু সাহস সঞ্চয়ের জন্য দু–এক ঢোঁক জলও খেয়ে নিল, তারপর আবার ছুটে এল হাতিটার দিকে। কিন্তু এবার সতর্ক ছিল হাতিটা। শূকরটা ছুটে আসতেই একেবারে বিঁধে গেল হাতির দাঁতে। মুমূর্ষু জন্তুটাকে দাঁত থেকে ঝেড়ে ফেলে তার ওপর একটি পা চাপিয়ে দিলে হাতিটা। দেহ বলতে অবশিষ্ট রইল শুধু শূকরের মাথা আর লেজটুকু। পায়ের চাপে চিড়ে–চ্যাপ্টা হয়ে গেল মূল দেহটা।
ধীর ও নিয়মিত পদক্ষেপে সরদার হাতিটা মল্লভূমির মধ্য দিয়ে এগিয়ে গেল এমনভাবে যেন কিছুই ঘটেনি। মাদি আর বাচ্চাগুলো মাটির ওপর বেঘোরে ঘুমাচ্ছিল। সাবধানে সেগুলোকে পাশ কাটিয়ে হ্রদের কাছে গিয়ে হাতিটা শুঁড় নামাল জলে। অসীম কৌতূহলে চেয়ে রইলাম আমরা, কী হয় এবার!
জল খেতে শুরু করল হাতিটা, তারপর শুঁড় উঠিয়ে এখানে–ওখানে জল শুঁকতে লাগল। বোঝা গেল, বিভিন্ন জায়গার জল পরখ করে দেখছে। তারপর কয়েক পা এগিয়ে যেখানে মুখ নামাল, সেটা আমাদের বেড় দেওয়া জায়গাটা পেরিয়ে। সেখানে মাদক দিয়ে পানি বিষাক্ত করা হয়নি।
ফিসফিসিয়ে বললাম, ‘আমাদের খেল খতম!’ কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই বিস্ময়ে চিৎকার করে উঠেছিলাম আরকি। হাতিটা তার প্রথম জায়গায় এসে হস্তী–সূরা খেতে শুরু করেছে। বোঝা গেল, পানীয়টা তার ভালোই লাগছে। পালের গোদার পেছন পেছন গোটা পাল এসে জুটল। আমাদের ঘেরা জায়গাটা কিন্তু খুব বেশি বড় ছিল না, তাই দলের বেশ কিছু হাতিকে বিশুদ্ধ তাজা জলই খেতে হলো।
মনে হচ্ছিল যেন ওগুলোর জল খাওয়া শেষ হবে না। দেখছিলাম পালের গোদাটার পেট ঢিপি হয়ে ফুলে উঠছে জল খেয়ে। আধঘণ্টার মধ্যেই আমাদের পুকুরের জল নেমে গেল অর্ধেকে। এক ঘণ্টার মধ্যে পালের গোদা ও তার সহচরগুলো মিলে তলানিটুকুও শেষ করতে লাগল। কিন্তু শেষ করতে না করতেই টলতে শুরু করে দিল সেগুলো। একটা হাতি তো ভয়ানক শোরগোল তুলে জলের মধ্যেই টলে পড়ল। ডাক ছেড়ে ফের উঠে দাঁড়াল বটে, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই নেতিয়ে পড়ল। তীরে শুঁড় রেখে এমন জোরে সে নাক ডাকাতে লাগল যে ভয় পেয়ে পাখি সব উড়ে গেল একেবারে গাছের ডগায়।
সজোরে ঘোঁত ঘোঁত করে গোদা হাতিটা হ্রদ থেকে উঠে এল, শুঁড় তার একেবারে ন্যাতার মতো ঝুলছে। একবার কান খাড়া করল, তারপরই নিস্তেজ হয়ে আবার ঝুলে গেল কান। ধীরে ধীরে তালে তালে আগেপিছে দুলতে লাগল হাতিটা, তার চারপাশে দুলতে দুলতে ধরাশায়ী হয়ে পড়ে যাচ্ছিল তার সঙ্গীরা। যেসব হাতির হস্তী-সূরা জোটেনি, সেগুলো দলের এই ‘মড়ক’ দেখতে লাগল অবাক হয়ে। হুঁশিয়ারি ডাক ছাড়ল সেগুলো, মাতাল হাতিগুলোর চারপাশে পাক খেতে লাগল, এমনকি ঠেলে তোলারও চেষ্টা করল। একটা মস্ত মাদি হাতি পালের গোদার কাছে গিয়ে তার মাথায় শুঁড় বুলিয়ে উদ্বেগ জানাল। এই দরদের জবাবে গোদাটা তার লেজটা নাড়াল দুর্বলভাবে, কিন্তু নিয়মিত দুলুনিটা বন্ধ হলো না। তারপর হঠাৎ মাথা তুলে প্রচণ্ড জোরে নাক ডাকিয়ে ধড়াম করে পড়ে গেল মাটিতে। সুস্থ হাতিগুলো বিব্রতের মতো ঘিরে দাঁড়াল তার চারপাশে। গোদাকে ফেলে যেতে সাহস হচ্ছিল না সেগুলোর।
ক্রমাগত শুঁড় নাড়াল। বেশ কিছুক্ষণ চলল তা। তারপর নতুন একটা গোদা নির্বাচন করে সেগুলো যখন সঙ্গীদের ‘শবাকীর্ণ মল্লভূমিতে’ ছেড়ে একে একে সার বেঁধে চলে গেল, তখন অস্তমিত সূর্যের আভায় লাল হয়ে উঠেছে আকাশটা।
৯. রিংয়ের হস্তিদেহ লাভ
এবার গাছ থেকে নেমে আসার পালা। শঙ্কিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখলাম মল্লভূমির দিকে, চেহারাটা তার যুদ্ধক্ষেত্রের মতো। কাত হয়ে পড়ে আছে অতিকায় হাতিগুলো, মাঝে মাঝে বুনো শূকরগুলো। এই নেশার ঘোর থাকবে কতক্ষণ? মস্তিষ্ক স্থানান্তর অপারেশন শেষ হওয়ার আগেই যদি হাতিগুলোর নেশা কেটে যায়? আমার শঙ্কা বাড়িয়ে তোলার জন্যই যেন হাতিগুলো ঘুমের মধ্যেই থেকে থেকে শুঁড় নাড়াচ্ছিল আর কোঁ কোঁ করছিল।
কিন্তু সেদিকে ভ্রুক্ষেপই করলেন না ভাগ। দ্রুত গাছ থেকে নেমে কাজে লেগে গেলেন। দেশীয় লোকেরা ওদিকে ঘুমন্ত শূকরগুলোকে জবাই করতে শুরু করল। ভাগ আর আমি অপারেশন চালালাম। আগে থেকেই সব তৈরি ছিল। বিশেষ একধরনের ডাক্তারি অস্ত্র নিয়ে এসেছিলেন ভাগ, শক্ত আইভরির ওপরেও যাতে কাজ চলবে। হাতির কাছে গিয়ে তিনি একটা বাক্স থেকে স্টেরিলাইজড ছুরি বের করে চালিয়ে দিলেন হাতির মাথায়। তারপর চামড়া তুলে ধরে ভেতরের খুলিতে করাত চালাতে লাগলেন। হাতির শুঁড়টা কেঁপে কেঁপে উঠল দু–একবার। আমি ভারি নার্ভাস বোধ করছিলাম, কিন্তু ভাগ আশ্বস্ত করে বললেন, ‘ভয়ের কারণ নেই। আমার মাদকটার গুণ সম্বন্ধে গ্যারান্টি দিতে পারি। তিন ঘণ্টা ঘুমিয়ে থাকবে হাতিটা, তার ভেতরেই মস্তিষ্কটা বের করে আনতে পারব। তখন আর কোনো ভয় থাকবে না।’
খুলির ভেতর দিয়ে সমানতালে করাত চালাতে লাগলেন ভাগ। যন্ত্রপাতিগুলো সত্যিই চমৎকার। কিছুক্ষণের মধ্যেই করোটির একটা অংশ তিনি উঠিয়ে ফেললেন। বললেন,
‘কখনো যদি হাতি শিকারে যান, তাহলে এটা মনে রাখবেন: এই ছোট্ট জায়গায় আঘাত করতে পারলেই তবে হাতি মারা সম্ভব।’ যে জায়গা ভাগ দেখালেন, সেটা চোখ আর কানের মাঝখানে বিঘতখানেক জায়গা। ‘রিংয়ের মস্তিষ্ককে আগেই বলে রেখেছি, এই জায়গা যেন সে বাঁচায়।’
হাতির মাথা থেকে মস্তিষ্কটা ভাগ শিগগিরই বের করে নিলেন। তখন একটা অপ্রত্যাশিত ব্যাপার ঘটল। মস্তিষ্কহীন হাতিটা একটু সরে গিয়ে তার প্রকাণ্ড দেহটা দিয়ে গা ঝাড়া দিল, তারপর আমাদের সবাইকে ভয়ানক চমকে দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে হেঁটে গেল কয়েক পা। চোখ খোলা থাকলেও স্পষ্টতই কিছুই দেখতে পাচ্ছিল না হাতিটা, পথে তার যে সঙ্গীটি পড়েছিল, তাকে এড়িয়ে যাওয়ার কোনো চেষ্টাই সে করল না, ফলে হোঁচট খেয়ে পড়ল মাটিতে। শুঁড় আর পায়ে কেমন খিঁচুনি হতে লাগল। ভাবলাম, ‘মরছে নাকি?’ আফসোস হচ্ছিল, সব মেহনত বৃথা গেল।
ভাগ চুপ করে অপেক্ষা করলেন শুধু, তারপর হাতির নড়নচড়ন থেমে গেলে আবার অপারেশন শুরু করলেন।
বললেন, ‘হাতিটা এখন মরা, মস্তিষ্কহীন যেকোনো প্রাণীর মতোই। কিন্তু বাঁচিয়ে তুলব ওকে। সেটা কঠিন নয়। চট করে রিংয়ের মস্তিষ্কটা এবার দিন...কোনো রকম সংক্রমণ ঘটেনি আশা করি!’
সাবধানে হাত ধুয়ে হাতির মাথার যে খোলটা আমরা সঙ্গে নিয়ে এসেছিলাম, তা থেকে রিংয়ের মস্তিষ্ক বের করে এগিয়ে দিলাম ভাগের দিকে। ‘মাপ সই হয়েছে?’ আমি জিজ্ঞাসা করলাম।
‘এ্যা-এ্যাই...’ খুলির মধ্যে মস্তিষ্কটা বসালেন তিনি।
‘অল্প একটু ছোট, কিন্তু তাতে কিছু এসে যাবে না। মস্তিষ্ক কক্ষের চেয়ে বেশি বড় হলেই বরং মুশকিল হতো। এবার সবচেয়ে কঠিন কাজ, নার্ভের ডগাগুলো সেলাই করা। একেকটা নার্ভ জুড়ব আর রিংয়ের মস্তিষ্কের সঙ্গে হাতির দেহের যোগাযোগ ঘটতে থাকবে। আপনি এখন একটু জিরিয়ে নিতে পারেন। বসে বসে দেখুন কিন্তু আমার কাজে ব্যাঘাত করবেন না।’
অতি সাবধানে ও দ্রুতগতিতে কাজ করে চললেন ভাগ। বলতে কি, তাঁকে মনে হচ্ছিল এক শিল্পী, আঙুলগুলো তাঁর পিয়ানোর জটিল একটা গৎ তোলার মতো করে দ্রুত নড়ে যাচ্ছিল। মুখের ভাব নিমগ্ন, দুই চোখের দৃষ্টিই একই লক্ষ্যে নিবদ্ধ, এটা তার হয় যখন একান্ত মনোযোগ দেন কোনো কাজে। স্পষ্টতই তার মস্তিষ্কের দুই অংশ দিয়েই একই কাজ করে যাচ্ছিলেন, দুই অংশই যেন পরস্পরের ওপর চোখ রেখে চলেছে। শেষ পর্যন্ত মস্তিষ্কের ওপর খুলি চাপানো হলো, ধাতুর ক্লিপ দিয়ে আটকে দিলেন সে খুলি, ফের যথাস্থানে চামড়া বসিয়ে সেলাই করে দিলেন।
‘চমৎকার! এবার ঠিক ঠিক সেরে উঠলে চামড়ার ওপর এই দাগগুলো ছাড়া কিছুই থাকবে না। আশা করি, রিং সেটা আমায় মাফ করে দেবে।’
রিং মাফ করে দেবে! তা বটে, এখন তো আর এটা হাতি নয়, রিং, অথবা রিং হয়ে উঠেছে হাতি। মাথায় মানুষের মস্তিষ্কওয়ালা হাতিটার কাছে এগিয়ে গেলাম আমি। কৌতূহলে তাকিয়ে দেখলাম তার খোলা চোখের দিকে। সে চোখ ঠিক আগের মতোই সমান নিষ্প্রাণ।
জিজ্ঞাসা করলাম, ‘এর কারণ কী? রিংয়ের মস্তিষ্ক নিশ্চয়, পুরোপরি সচেতন অথচ চোখ তো...তার (হাতির না রিংয়ের, কী বলব, বুঝে পেলাম না) দেখছি কেমন কাচের মতো।’ ‘খুবই সোজা,’ ভাগ বললেন, ‘মস্তিষ্কের স্নায়ুগুলো সেলাই করা হয়েছে
বটে, কিন্তু এখনো এক হয়ে জুড়ে যায়নি। রিংকে আমি সাবধান করে দিয়েছি, স্নায়ুতন্তুগুলো জুড়ে না যাওয়া পর্যন্ত যেন সে কোনো নড়াচড়া না করে।
জুড়ে যেতে যাতে দেরি না হয়, তার জন্য যা করার সব আমি করেছি।’
সূর্য অস্ত যাচ্ছিল। হ্রদের তীরে বসে দেশীয় লোকেরা আগুন জ্বেলে শূকরের মাংস পুড়িয়ে খাচ্ছিল পরিতৃপ্তির সঙ্গে। কারও কারও কাঁচা খেতেই বেশি ভালো লাগছে। হঠাৎ মাতাল হাতির একটা ডাকতে শুরু করে দিল। তার ডাকে অন্যরাও জেগে গিয়ে উঠে দাঁড়াতে শুরু করল। ভাগ আর আমি ছুটে গিয়ে লুকোলাম ঝোপের আড়ালে, দেশীয় লোকেরাও এল আমাদের পিছু পিছু। হাতিগুলো তখনো টলছিল। তারা গিয়ে দাঁড়াল গোদা হাতিটার কাছে। সে হাতি অপারেশনের পর তখনো ঘুমিয়ে। শুঁড় দিয়ে তারা পরখ করে দেখল তাদের ভূতপূর্ব সরদারকে, শুঁকল, নিজেদের জান্তব ভাষায় কী সব আলাপ করল। চোখে দেখতে এবং কানে শুনতে পেলে রিংয়ের তখন যে কী অবস্থা দাঁড়াত, বেশ কল্পনা করা যায়। শেষ পর্যন্ত চলে গেল হাতিগুলো, আমরাও ফিরে এলাম রোগীর কাছে।
‘চুপ করে থাকবেন, কোনো জবাব দেবেন না,’ হাতির উদ্দেশে ভাগ এমনভাবে বললেন যেন হাতিও কথা বলতে পারে, ‘যদি সক্ষম বোধ করেন, তাহলে কেবল চোখ মিটমিট করা চলতে পারে। এবার আমার কথা যদি বুঝতে পেরে থাকেন, তাহলে দুবার চোখ মিটমিট করুন।’
চোখ মিটমিট করল হাতিটা।
‘খাসা!’ ভাগ বললেন, ‘আজ আপনাকে চুপচাপ শুয়ে থাকতে হবে, তবে কাল হয়তো ওঠার অনুমতি দিতে পারব। আমরা হাতি চলার এই পথ বেড় দিয়ে দেব। রাতে আগুন জ্বালিয়ে রাখব। ফলে কোনো হাতি বা বুনো জানোয়ার আপনাকে বিরক্ত করবে না।’
২৪ জুলাই। আজ প্রথম উঠে দাঁড়াল হাতিটা।
‘অভিনন্দন!’ সংবর্ধনা জানালেন ভাগ, ‘এবার আপনাকে কী বলে ডাকব? আপনার গুপ্তরহস্য এখনই প্রচার করা চলবে না। বরং আপনাকে সেপিয়েন্স বলে ডাকা যাবে, রাজি?’
মাথা নাড়ল হাতি।
‘আমরা ইশারায় কথা বলব, মানে মোর্স কোডে।’ বলে চললেন ভাগ, ‘আপনি শুঁড় নাড়িয়ে বলবেন: ওপরে শুঁড় উঠলে টরে, পাশে নড়লে টক্কা। কিংবা এতে অসুবিধা হলে শব্দের সংকেত করতে পারেন। এবার আপনার শুঁড় নাড়ার চেষ্টা করল হাতি কিন্তু খুবই আনাড়ির মতো। একটা ভাঙা অঙ্গের মতো এদিক–ওদিক দুলতে লাগল শুঁড়টা।
‘এখনো আপনার অভ্যাস হয়নি। মানে আপনার তো আগে কখনো শুঁড় ছিল না। আচ্ছা, এবার দেখা যাক হাঁটতে পারেন কী রকম।’ হাঁটতে শুরু করল হাতি। সামনের পায়ের চেয়ে পেছনের পা দুটো যেন বেশি সচল বলে মনে হলো।
‘দেখছি, আপনার হাতি হওয়া অভ্যাস করে নিতে হবে,’ মন্তব্য করলেন ভাগ, ‘হাতির মস্তিষ্কে যা থাকে, আপনার মস্তিষ্কে সে জিনিস বেশি নেই। কিন্তু শিগগির পা, শুঁড়, কান নাড়াতে শিখে যাবেন। অবশ্য হাতির সহজ প্রবৃত্তি হলো সহজাত। লাখ লাখ পুরুষ হাতির অভিজ্ঞতার সার সেটা। আসল হাতি জানে কোনটা ভয়ের, বিভিন্ন ধরনের শত্রুর হাত থেকে কী করে আত্মরক্ষা করতে হয়, কোথায় মিলবে খাদ্য আর জল। এসবের কোনো জ্ঞান আপনার নেই। এ আপনাকে শিখতে হবে অভিজ্ঞতা দিয়ে, বহু হাতি যে অভিজ্ঞতার মূল্য দিয়েছে প্রাণ দিয়ে। কিন্তু বিব্রত হবেন না, ভয় পাবেন না সেপিয়েন্স। আমরা আপনার সঙ্গে থাকব। আপনি বেশ ভালো হয়ে উঠলেই আমরা সবাই রওনা দেব ইউরোপের উদ্দেশে। ইচ্ছা করলে আপনি আপনার স্বদেশ জার্মানিতে ফিরতে পারেন, নয়তো আমাদের সঙ্গে থাকতে পারেন সোভিয়েত ইউনিয়নে। সেখানে আমাদের চিড়িয়াখানায় থাকবেন। কিন্তু এবার বলনে, কী রকম বোধ করছেন?’
দেখা গেল, শুঁড় নাড়ানোর চেয়ে ফোঁস ফোঁস শব্দ করে সংকেত করা সেপিয়েন্স-রিংয়ের কাছে বেশি সহজ বোধ হচ্ছে। শুঁড় দিয়ে দীর্ঘ হ্রস্ব শব্দ করতে লাগল হাতি। ভাগ শুনে আমায় অনুবাদ করে দিলেন (সে সময় মোর্স কোড আমি জানতাম না):
‘আমার দৃষ্টিশক্তি আগে যেমন ছিল, তেমন বোধ হচ্ছে না। অবশ্য অনেক দূর পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছি। কেননা, মাথায় আমি লম্বা, কিন্তু দৃষ্টির পরিধি যেন সংকীর্ণ। শ্রবণ ও ঘ্রাণশক্তি কিন্তু আশ্চর্য রকমের সক্ষম ও প্রখর। জগতে অত হাজার হাজার অদ্ভুত নতুন সব গন্ধ আছে, আগে কল্পনাও করতে পারিনি। অসংখ্য এমন সব শব্দ শুনতে পাচ্ছি, যার জন্য মানুষের ভাষায় সম্ভবত কোনো উপযুক্ত শব্দ নেই। শন শন, ক্যাঁচ ক্যাঁচ, কিচিরমিচির, চিঁ চিঁ, গোঁ গোঁ, ঘেউ ঘেউ, হাঁকডাক, গরগর, খচমচ, ঝনঝন, চটাং চটাং, ফট ফট বা এই ধরনের আরও দু–এক গণ্ডা শব্দতেই ধ্বনি প্রকাশের ভাষা ফুরিয়ে যাবে। কিন্তু যেমন ধরুন, ওই যে পোকা গাছের ছাল কাটছে। আমি বেশ শুনতে পাচ্ছি, সেটা বোঝাব কী ভাষা দিয়ে? আর ওই যে নানা ধরনের গোলমাল!’
‘আপনার উন্নতি হচ্ছে সেপিয়েন্স!’ বললেন ভাগ।
‘তা ছাড়া ওই সব গন্ধ!’ নিজের নতুন অনুভূতির কথা বলে চলল রিং, ‘এখানে আমি একেবারে বেসামাল, কী যে অনুভব করছি, তার একটা কাছাকাছি ধারণা দিতেও আমি অক্ষম। শুধু এটুকু আপনারা বুঝতে পারবেন, প্রতিটি গাছ, প্রতিটি জিনিসের নিজস্ব একেকটা গন্ধ আছে।’ হাতি তার শুঁড় নামিয়ে মাটির গন্ধ নিল, বলল, ‘এই দেখেন, মাটিরও গন্ধ আছে, আর ঘাসের গন্ধ, সম্ভবত কোনো তৃণভোজী জীব জল খেতে যাওয়ার সময় সে ঘাস ফেলে গেছে। বুনো শূকর, মহিষ, তামার গন্ধ, তামার এ গন্ধ আসছে কোথা থেকে কে জানে। ওহো, এই তো এক খণ্ড তামার তার, সম্ভবত আপনার হাত থেকেই পড়ে গিয়ে থাকবে ভাগনার।’
‘সে কী করে হয়?’ জিজ্ঞাসা করলাম আমি, ‘বোধশক্তির এই সক্ষমতা, সে তো শুধু ইন্দ্রিয় প্রান্তের গ্রহণযন্ত্রের সক্ষমতার ওপর নির্ভর করে না, তদনুযায়ী মস্তিষ্ক গঠনও থাকা চাই।’
‘তা ঠিক,’ বললেন ভাগ, রিংয়ের মস্তিষ্ক যখন পুরোপুরি অভ্যস্ত হয়ে যাবে, তখন ঠিক হাতির মতোই সক্ষম বোধশক্তি হবে তার। এখন ওর বোধশক্তি সম্ভবত খাঁটি হাতির চেয়ে বহুগুণ কম তীক্ষ্ণ, তবে তার সক্ষম শ্রবণ ও ঘ্রাণেন্দ্রিয়ের ফলে আমাদের চেয়ে তার এখন অনেক সুবিধা।’ তারপর হাতির উদ্দেশে বললেন, ‘আমরা যদি আপনার পিঠে চেপে আমাদের পাহাড়ের ছাউনিতে যাই, তাহলে আশা করি খুব ভালো বোধ করবেন না সেপিয়েন্স?’
সেপিয়েন্স প্রস্তাবে রাজি হয়ে অমায়িকভাবে মাথা নাড়ল। আমাদের মোটঘাটের একাংশ আমরা চাপালাম তার পিঠে, শুঁড় দিয়ে সে আমাকে আর ভাগনারকে তুলে নিলে। রওনা দিলাম আমরা, দেশীয় লোকেরা হেঁটে চলল আমাদের পিছু পিছু।
আমার ধারণা, সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যেই সেপিয়েন্স পুরোপরি ঠিক হয়ে যাবে। তারপর তার পিঠে চেপে আমরা যাব বম্-এ সেখান থেকে জাহাজ ধরে বাড়িতে।’ পাহাড়ের ওপর ছাউনি ফেলা হলো।
‘এখানে আপনার খাদ্য অঢেল,’ ভাগ বললেন সেপিয়েন্সকে, ‘কিন্তু ছাউনি ছেড়ে খুব বেশি দূরে যাবেন না যেন, বিশেষ করে রাতে। কত রকমের বিপদ ঘটতে পারে আপনার, খাঁটি হাতি হলে অবশ্য কোনো ভাবনা ছিল না।’
পাহাড়ের ওপর ছাউনি ফেলা হলো। মাথা নেড়ে হাতি তার শুঁড় দিয়ে আশপাশের গাছপালার ডাল ভাঙতে লাগল। কিন্তু হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠে শুঁড় গুটিয়ে সে ছুটে এল ভাগের কাছে। ‘কী হয়েছে?’ ভাগ জিজ্ঞাসা করলেন। হাতিটা তার শুঁড়টা এগিয়ে দিল একেবারে ভাগের মুখের কাছে।
‘ইশ্, দেখো দেখি!’ ভর্ৎসনার সুরে বলে উঠলেন ভাগ, তারপর আমাকে ডেকে শুঁড়ের ডগাটা দেখালেন। ঠিক একটা আঙুলের মতো ডগাটা। ‘অন্ধ লোকের আঙুলের চেয়েও এর এ আঙুলটায় বেশি বোধ। হাতির সবচেয়ে নরম জায়গা এটি। দেখুন, সেপিয়েন্স তার এ আঙুলে কাঁটা ফুটিয়ে বসেছে।’
সন্তর্পণে কাঁটাটি তুলে ভাগ সাবধান করে দিলেন:
‘সাবধানে চলবেন কিন্তু। যে হাতির শুঁড় জখম, সে পঙ্গু। জল পর্যন্ত খেতে পারবেন না। হাতিরা শুঁড় দিয়ে জল টেনে মুখের মধ্যে ঢেলে দেয়। কিন্তু তেষ্টা পেলে আপনাকে তখন জলের মধ্যে নেমে মুখে ডুবিয়ে জল খেতে হবে। এখানে কাঁটা গাছ আছে অনেক রকম। আরও একটু এগিয়ে গিয়ে খোঁজ করে দেখুন। বিভিন্ন জাত চিনে ফেলাটা শিখে নিন।’
দীর্ঘশ্বাস ফেলে শুঁড় দুলিয়ে হাতি চলে গেল বনের দিকে।
২৭ জুলাই। সবকিছুই বেশ চলছে। হাতিটা খায় কত। প্রথম প্রথম খুব বাছবিচার ছিল খাওয়া সম্পর্কে, মুখে তুলত কেবল ঘাস, পাতা আর নরম কচি ডাল। কিন্তু খিদে যেন ওর কিছুতেই মেটে না, তাই শিগগির খাঁটি হাতির মতো মোটা মোটা, প্রায় হাতের মতো চওড়া ডালপালা ভেঙে মুখে পুরতে লাগল।
ছাউনির চারপাশের গাছগুলোর চেহারা হয়েছে শোচনীয়! মনে হবে বুঝি উল্কাপাত হয়েছে, নয়তোবা এক সর্বভুক পঙ্গপালের ঝাঁক উড়ে গেছে সেখান দিয়ে। ঝোপঝাড়ের একটি পাতাও নেই, উঁচু উঁচু গাছগুলোর নিচের দিকের শাখাগুলোও তথৈবচ। ডগাগুলো ভাঙা, ছেঁড়া, ছাল উঠে গেছে, মাটির ওপর ছড়িয়ে আছে বিষ্ঠা, দু–একটা ডাল, ছোট ছোট গাছের কাণ্ড। এই সব ধ্বংসকাণ্ডের জন্য সেপিয়েন্স ক্রমাগত মাফ চাইছে, ‘কিন্তু অবস্থা চক্রে বাধ্য হচ্ছি’ সংকেতে এই কথা সে জানিয়েছে ভাগকে।
১ আগস্ট। আজ সকালে সেপিয়েন্সকে দেখা গেল না। ভাগনার প্রথমে বিচলিত হননি। বললেন:
‘ও তো আর হারিয়ে যাওয়ার মতো একটা সুচ নয়। পাওয়া যাবে ঠিকই। কী আর হবে ওর? ওকে আক্রমণ করার সাহস কোনো জানোয়ারের হবে না। সম্ভবত রাতে কিছুটা দূরে চলে গিয়ে থাকবে।’
কিন্তু ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে গেল, সেপিয়েন্সের কোনো পাত্তা নেই। শেষ পর্যন্ত ওর খোঁজে যাব, ঠিক হলো। পায়ের চিহ্ন খুঁজে বের করতে দেশীয় লোকেরা ওস্তাদ, অচিরেই হাতির পথ আবিষ্কার করল তারা। আমরা তাদের পিছু নিলাম। একজন বুড়ো দেশীয় লোক হাতির পথ দেখেই বলে যেতে লাগল কী হয়েছিল।
‘এখানে হাতিটা কিছু ঘাস খেয়েছিল, ওইখানে কাঁচা ঝোপটা খেতে শুরু করে। তারপর এগিয়ে গিয়েছিল। এখানে বোধ হয় লাফ দেয়, কিছুতে ভয় পেয়েছিল নিশ্চয়, একটা চিতা বাঘের দাগ। আবার লাফায়, এখান থেকে হাতিটা দৌড়াতে শুরু করে, পথের সবকিছু দলে পিষে যায়। আর চিতাটা? সেটাও পালায় হাতির কাছ থেকে, ঠিক উল্টো দিকে।’
হাতির পথ ধরে এগোতে গিয়ে ছাউনি ছেড়ে অনেক দূরে গিয়ে পড়লাম। একটা জলা মাঠের মধ্যে দিয়ে ছুটে গেছে সে। পায়ের ছাপগুলোতে জল জমেছে। কাদার মধ্যে পা ডুবে গিয়েছিল, কিন্তু বহু কষ্টে পা টেনে টেনে তুলে ছুটে গেছে। শেষ পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছালাম কঙ্গো নদীতে। হাতিটা জলে নেমেছিল, অপর তীরে ওঠার জন্য।
একটা দেশি গাঁয়ের খোঁজে গেল আমাদের লোকেরা। সেখান থেকে একটা নৌকা জোগাড় করে আমরা নদী পেরোলাম, কিন্তু ওপারে হাতির পায়ের কোনো ছাপ দেখা গেল না। ডুবে গেল নাকি? হাতিরা সাঁতরাতে পারে কিন্তু রিং পেরেছিল কি? হাতির মতো করে সাঁতার দেওয়ার নৈপুণ্য অর্জন করতে পেরেছে কি? সঙ্গের লোকেরা বলল, ‘হাতি নিশ্চয় স্রোতের সঙ্গে ভেসে গিয়ে থাকবে।’
কয়েক মাইল আমরা ভাটিতে নৌকা চালিয়ে দেখলাম। কিন্তু হাতির কোনো লক্ষণ দেখা গেল না। ভাগ বিষণ্ন হয়ে উঠলেন। আমাদের সব মেহনত বৃথা গেল। কী হলো হাতিটার? বেঁচে থাকলেও বনের জন্তু–জানোয়ারের মাঝে দিন কাটাবে কী করে?
৮ আগস্ট। হাতির সন্ধানে এক সপ্তাহ কাটালাম, সবই ব্যর্থ হলো। কোনো চিহ্ন না রেখে উধাও হয়ে গেছে সে। লোকগুলোকে টাকা মিটিয়ে দিয়ে দেশে ফেরা ছাড়া আর কিছু করার নেই।