আগন্তুক

রাত যায় দিন আসে। গোলাবারুদের শব্দে সবার ঘুম ভাঙে। কত মায়ের চোখে আঁধার নেমে আসে। আর বুঝি তার সন্তানকে দেখতে পাবে না। কিন্তু এত দুশ্চিন্তা করলে কি আর দেশ স্বাধীন করা যায়!

জুলাই মাসে ভারত থেকে ট্রেনিং করে এসেছে রাশেদ। এসেই নেমে পড়েছে যুদ্ধে। বেশ কয়েকটা সফল অভিযান চালিয়ে রহমতপুর গ্রামকে করেছে শত্রুমুক্ত। এখন পাশের গ্রাম সোনাদিয়ায় অভিযান চালাচ্ছে সে ও তার দলবল। কিন্তু কিছুতেই এখান থেকে পাকিস্তানিদের হঠাতে পারছে না তারা। তাদের সব পরিকল্পনা নস্যাৎ করে দিচ্ছে পাকিস্তানী হানাদাররা। যেন আগে থেকেই কেউ হানাদার বাহিনীর কাছে সব তথ্য দিয়ে দিচ্ছে। রাশেদ এই বিষয়টা নিয়ে ভীষণ চিন্তিত। কেউ বিশ্বাসঘাতকতা করছে কি না, তা খুঁজে বের করার দায়িত্ব পড়েছে রাশেদের সবচেয়ে কাছের বন্ধু নিপুণের কাঁধে।

সোনাদিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ঘাঁটি গেড়েছিল পাকিস্তানিরা। বিদ্যালয়ের পাশে বিঘা বিঘা চাষের জমি। তার একপাশে মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটি। হঠাৎ আক্রমণের ভয়ে ঘাঁটিতে রাতে দুজন মুক্তিযোদ্ধা পাহারা দেয়। সেদিন রাতে পাহারা দিচ্ছিল রহিম ও করিম। তারা আপন দুই ভাই। হঠাৎ তারা দূরে একটা অদ্ভুত জিনিস লক্ষ্য করল। পরিষ্কার আকাশ চিড়ে একটা বজ্রপাত হলো। বজ্রপাতের স্থানে ঘাস লতাপাতায় ধরে গেল আগুন। কিন্তু অবাক বিষয়, বজ্রপাতের কোনো শব্দ হয়নি! রহিম ও করিম দৌড়ে গেল সেখানে। দেখল ঘাস লতাপাতা পুড়ে সব ছাই হয়ে গেছে। আর সেই ছাইয়ের ওপরে একটা মানুষের পায়ের কিছু ছাপ। ছাপগুলো কিছুদূর গিয়ে ধান ক্ষেতের ভেতর চলে গেছে। ছাপ অনুসরণ করে তারাও গেল ধানক্ষেতের কাছে। দেখতে পেল, ধানক্ষেতের কাদায় উপুড় হয়ে পড়ে আছে একজন পুরুষের দেহ।

দুজনেই ভীষণ ভয় পেল। দৌড়ে এসে ডেকে তুলল রাশেদকে। রাশেদ এসে বিষয়টা পর্যবেক্ষণ করল। দেখল, লোকটা জীবিত আছে। তারা লোকটাকে ধরে ঘাঁটিতে নিয়ে গেল। আগন্তুক লোকটাকে গোসল করিয়ে শুইয়ে দিল খাটে। জ্ঞান ফিরল পরদিন সকালে। খবর পেয়েই ছুটে এল রাশেদ। লোকটার নাম ড. সারওয়ার। তিনি বিজ্ঞানী। এখানে এসেছেন ভবিষ্যৎ থেকে। তাঁর হারিয়ে যাওয়া একটা জিনিস খুঁজতেই এখানে এসেছেন। বিজ্ঞানীর কথা শুনে ক্যাম্পের সবাই হেসে উঠল। এরকম কথা শুনলে হাসি পাবারই কথা।

কিন্তু রাশেদ হাসল না। সে বেশ বিস্মিত। রাশেদ শিক্ষিত। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় টাইম ট্রাভেলের কথা শুনেছে। কিন্তু সেগুলো শুধু হাইপোথিসিস ছিল। বাস্তবে কি তা সম্ভব! রাশেদ লোকটাকে একটু বাজিয়ে দেখতে চাইল। সে ড. সারওয়ারকে জিজ্ঞেস করল, কী এমন জিনিস খুঁজতে আপনি ভবিষ্যৎ থেকে এসেছেন? জবাবে বিজ্ঞানী বললেন, আমি জীবনের অনেকটা সময় টাইম ট্রাভেল নিয়ে গবেষণা করেছি। খেটেখুটে আবিষ্কার করেছি কয়েকটি মেশিন। যেমন, টাইম মেশিন, মাইক্রো টাইম মেশিন, টাইম স্টপার, রিভার্স টাইমার ও ভিশন চেকারের মতো যন্ত্র। এর মধ্যে ভিশন চেকার যন্ত্রটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ যন্ত্রটি মহাজাগতিক বিভিন্ন তরঙ্গকে শোষণ করে ভবিষ্যতের সর্বোচ্চ সম্ভাব্য ঘটনা সম্পর্কে জানাতে পারে। ফলে মানুষের কী করা উচিৎ আর কী করা উচিৎ নয়, সে সম্পর্কে খুব সহজেই সিদ্ধান্ত নিতে পারে।

রাশেদ জিজ্ঞেস করল, এই যন্ত্রটি আপনি হারালেন কী করে?

আমার একটি পোষা বিড়াল আছে। আমি ল্যাবে না থাকায় বিড়ালটি আমার টাইম চেকার যন্ত্রটাকে টাইম মেশিনের পোর্টালে ফেলে দেয়। তখন টাইম মেশিনে সময় সেট করা ছিল ১৯৭১ সালের ৩ আগস্ট। স্থান ছিল বাংলাদেশের সোনাদিয়া। এ কারণেই আমি টাইম মেশিনে করে এখানে এসেছি আমার যন্ত্রটা ফেরত নিতে।

শিল্পীর কল্পনায় মুক্তিযোদ্ধারা
পাঁচজন মুক্তিযোদ্ধা গোলাগুলিতে নিহত হয়েছেন। অনেকেই হয়েছেন আহত।

অবশ্য তার এই কথা কেউ বিশ্বাস করল না। সবাই তাকে পাগল ভাবতে লাগল। কিন্তু রাশেদ তার কথাগুলো একেবারে উড়িয়ে দিতে পারল না। সে বরং বিজ্ঞানীকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, ড. সারওয়ার, আপনি আসলে ভুল সময়ে ভুল জায়গায় এসে পড়েছেন। সারা দেশে এখন যুদ্ধ চলছে। কখন কী হয় কিছু বলা যায় না। তবে আপনার যন্ত্রটা আমরা নিশ্চয়ই খুঁজে বের করার চেষ্টা করব। এমন একটা অস্ত্র শত্রুপক্ষের হাতে কিছুতেই পড়তে দেওয়া যাবে না।

সেদিন গভীর রাতে হঠাৎ রাশেদদের ঘাঁটিতে হামলা করল পাকবাহিনীরা। প্রথমেই ক্যাম্প থেকে ড. সারওয়ারকে নিরাপদে সরিয়ে নেওয়া হলো। তারপর লড়াই হলো তুমুল। পাঁচজন মুক্তিযোদ্ধা গোলাগুলিতে নিহত হয়েছেন। অনেকেই হয়েছেন আহত। তবুও অনেক চেষ্টার পরে রাশেদ ও তার সঙ্গীরা পাকবাহিনীকে সেখান থেকে হটাতে সক্ষম হলো।

মাঝরাতেই সব মুক্তিযোদ্ধারা জরুরী মিটিংয়ে বসল। সবাই হতভম্ব! পাহারা থাকা সত্ত্বেও কীভাবে পাকিস্তানিরা এত সুপরিকল্পিতভাবে হামলা চালায়! তারা সংখ্যাতেও কম। কেউ কোনো কুলকিনারা পেল না। মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হলো, পাহারাদার আরও দুজন বাড়ানো হবে এবং সবাইকে আরও সতর্ক থাকতে হবে।

রাশেদ মিটিং শেষ করে শুয়ে পড়ল। পাকিস্তানের সেনারা কীভাবে এত শক্তিশালী হয়ে উঠল, সেটাই ভাবছে শুয়ে শুয়ে! হঠাৎ তার মনে হলো, তাহলে কি ড. সারওয়ারের ভিশন চেকার যন্ত্রটি পাকিস্তানীদের হাতে পড়েছে! ওটা ব্যবহার করেই তারা সব আগেভাগে জানতে পারছে? রাশেদ দ্রুত গিয়ে ড. সারওয়ারকে ঘুম থেকে উঠাল। তাকে খুলে বলল নিজের চিন্তাভাবনার কথা। ড. সারওয়ার একমত প্রকাশ করলেন এবং জানালেন, আমার যন্ত্রটা সামনে কী হতে পারে, তা বের করতে পারে ঠিকই। কিন্তু সবসময় সেটা শতভাগ সত্যি নাও হতে পারে।

তবে কি আর কোনো উপায় আছে ওদের হারানোর?

একটা উপায় হয়তো আছে।

কী সেটা?

ব্যস! ব্যস! আর বলতে হবে না। হাতে বেশি সময় নেই। আমি এখনই বেরিয়ে পড়ছি যন্ত্রটা উদ্ধার করতে।

আমার যন্ত্রটা আগামী ছয় ঘণ্টার মধ্যে কী কী হতে পারে তা দেখাতে পারে। পাকসেনারা হামলা চালিয়েছে তিন ঘন্টা হলো। যেহেতু ওরা মোটামুটি সফল একটা আক্রমণ চালিয়েছে, অতএব ওরা ক্যাম্পে নিশ্চয়ই এখন আনন্দ করছে। আহত মুক্তিযোদ্ধারা এই রাতেই তাদেরকে আক্রমণ করতে পারে, এমন সম্ভাবনা হয়তো নেই ওদের মনে। তাই হয়তো মেশিনটা এখন ওরা ব্যবহার করছে না। তার মানে...

ব্যস! ব্যস! আর বলতে হবে না। হাতে বেশি সময় নেই। আমি এখনই বেরিয়ে পড়ছি যন্ত্রটা উদ্ধার করতে। আজ হয় এসপার, না হয় ওসপার!

রাশেদ কাউকে কিছু না জানিয়ে একাই বেরিয়ে পড়ল। ফসলের মাঠ পেরিয়ে পাকিস্তানীদের ক্যাম্পের কাছে পৌঁছাল। ড. সারওয়ারের কথাই ঠিক হলো। সবাই ক্যাম্প ফায়ারে নাচ-গান করছে। পাকিস্তানি কমান্ডারের রুম কোনটা, তা জানা ছিল রাশেদের। যন্ত্রটা তার ঘরে থাকার সম্ভাবনাই বেশি। ওখানেই আগে দেখতে হবে। রাশেদ দু-একজন  গার্ডের চোখ ফাঁকি দিয়ে কমান্ডারের রুমে প্রবেশ করল। কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজির পর কমান্ডারের নিজস্ব ট্রাংকের ভিতর অদ্ভুত একটা যন্ত্র খুঁজে পেল। সেটা দেখতে অনেকটা বিদেশি রেডিওর মত। যন্ত্রটির ভেতর থেকে লাল, নীল আলো বেরোচ্ছে। তার বুঝতে আর বাকি রইল না যে এটাই সেই ভিশন চেকার যন্ত্র। দ্রুত যন্ত্রটাকে নিয়ে সে বাইরে বেরিয়ে এল। কিন্তু দুর্ভাগ্য, বাইরে এক গার্ড তাকে দেখে ফেলেছে। বাঁশি বাজিয়ে গার্ড সবাইকে এলার্ট করে দিল। কিছু সেনারা বন্দুক নিয়ে ধাওয়া করলো রাশেদকে। রাশেদ যন্ত্রটা হাতে নিয়ে দৌড় দিল ধান ক্ষেতের ভিতর। পাকিস্তানি সেনারাও তার পেছনে ছুটল, মুহুর্মুহু গুলি করছে। কিন্তু তাকে কে থামায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই লম্বা লম্বা ধান ক্ষেতের ভেতর হারিয়ে গেল রাশেদ।

কাল সকাল ঠিক সাতটায় তোমরা সবাই পাকবাহিনীর ক্যাম্পের পশ্চিম দিক দিয়ে হামলা চালাবে।

যন্ত্রটা নিয়ে রাশেদ ঘাঁটিতে ফিরে এল। প্রথমেই ড. সারওয়ারকে ফেরত দিল তার যন্ত্রটা। আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল, হঠাৎ করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল রাশেদ। তার শরীর থেকে রক্ত বের হচ্ছে। রক্তে চারদিক লাল হয়ে গেছে। কিছুক্ষণের মধ্যে রাশেদ মারা গেল। ড. সারওয়ারের চোখ ভিজে উঠল পানিতে। তার যন্ত্রটার জন্য রাশেদের জীবন গেল। রাশেদের স্বপ্নপূরণে কিছু না করতে পারলে সে নিজেকে কোনোদিন ক্ষমা করতে পারবে না।

সেই মুহূর্তে সে একটা চিঠি লিখে রাশেদের মৃতদেহের পাশে রেখে টাইম ভিশন যন্ত্রটি নিয়ে ভবিষ্যতে ফিরে গেল। সকালে সবাই রাশেদের মৃতদেহ দেখতে পেল। তিনটা গুলি রাশেদের কাধ ফুড়ে বেরিয়ে গিয়েছিল। রাশেদের সবচেয়ে কাছের বন্ধু নিপুন চিঠিটা হাতে নিয়ে সবাইকে পড়ে শোনাল। চিঠিতে রাশেদের মৃত্যুর কারণ লেখা ছিল। অপর পৃষ্ঠায় লেখা ছিল একটা খুদেবার্তা—

কাল সকাল ঠিক সাতটায় তোমরা সবাই পাকবাহিনীর ক্যাম্পের পশ্চিম দিক দিয়ে হামলা চালাবে। ওরা একটাও বাঁচতে পারবে না।

—ড. সারওয়ার

লেখক: শিক্ষার্থী, স্নাতক ১ম বর্ষ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা