উপহার

অলংকরণ: রাকিব

এই গল্পের ঘটনা যে সময়ে ঘটেছে, সেই সময় এখনো আসেনি, ভবিষ্যতে আসবে। তবে ঘটনার শুরু হয়েছে এমন এক দৃশ্য থেকে, যেমনটা আমাদের বর্তমানেও অহরহ দেখা যায়।

দৃশ্যটা এমন: এক কিশোরী মন খারাপ করে ছাদে বসে আছে। তার পাশে আছে এক কিশোর। মন খারাপের ব্যাপারটা ওই কিশোর একদমই খেয়াল করেনি। সে অন্য একটা বিষয়ে খুব উত্তেজিত। ক্রমাগত কথা বলে যাচ্ছে। কিশোরী জবাব দিচ্ছে না। তাতে ছেলেটির কোনো সমস্যা হচ্ছে না।

দৃশ্য পরিচিত হলেও এটাকে ঘিরে যে পৃথিবীটা আছে, সেটা দেখলে আমাদের সামান্য ধাক্কা লাগতে পারে। খুব বেশি নয়, সামান্য ধাক্কা। কারণ, এই বিশ্বের সঙ্গে আমাদের বর্তমানের মিল আছে। বর্তমানের বেশ কিছু বৈশিষ্ট্যের আরও উগ্র রূপ জায়গা করে নিয়েছে ভবিষ্যতের পৃথিবীতে। সেগুলোর মধ্যে একটা হচ্ছে শহরের ব্যস্ততা।

কিশোর ও কিশোরী যে ভবনের ছাদে বসে আছে, সেই ভবন দেড় শ তলা উঁচু। প্রতি তলার জানালা দিয়ে চোখধাঁধানো আলো ঝলসাচ্ছে। কারণ, জানালাগুলো আসলে স্বয়ংক্রিয়, বিদ্যুৎ-তাড়িত কাচের পর্দা। সেখানে ক্রমাগত বিজ্ঞাপন দেখানো হয়। বিভিন্ন পণ্যের বিজ্ঞাপন। এর বদলে ভবনের মালিকপক্ষ পণ্যের মালিকপক্ষের কাছ থেকে কিছু টাকা পায়। বাড়িতে যাঁরা থাকেন, তাঁরা বাইরের বিজ্ঞাপন দেখতে পান না। তবে জানালার যে দিকটা বাড়ির ভেতরে, সেটায় তাঁরা চাইলে বিজ্ঞাপনগুলো চালাতে পারেন। যাঁরা দিনে ১০ বার করে বিজ্ঞাপন চালান, তাঁদেরকেও কিছু টাকা দেওয়া হয়। বাড়ির বাসিন্দা যত বেশি, টাকার পরিমাণ তত বেশি। বেশির ভাগ বাড়িতে সারাক্ষণ বিজ্ঞাপন চলে। কারণ, সব বাড়িতেই টাকার টানাটানি আছে।

কিশোর আকাশ থেকে পড়ল। তার নাম বংশী। ওদের শহরের মানুষ খুব একটা ঘুরতে যাওয়ার সুযোগ পায় না। একটা কারণ হচ্ছে, এই শহর বিশাল। অর্ধেকটা মহাদেশজুড়ে ছড়িয়ে। এখান থেকে বের হওয়ার বিমানভাড়া অনেক বেশি। ভাষার মা–বাবা পাঁচ বছর ধরে টাকা জমাচ্ছে।

এই বিশ্বের অধিকাংশ প্রতিভাবান ও সৃষ্টিশীল মানুষ বিজ্ঞাপনী সংস্থায় কাজ করেন। তাঁদের প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে, কোথায় বিজ্ঞাপন দেওয়া যায়, আর সেই বিজ্ঞাপন কত দ্রুত মনোযোগ কাড়তে পারে—এসব চিন্তা করা। চিন্তার জোরে বিশ্বের অনেকখানি বিজ্ঞাপনে ছেয়ে গেছে। এমনকি আকাশও। এখানে উজ্জ্বল স্পটলাইট দিয়ে সারা রাত আকাশে বিজ্ঞাপন চালানো হয়। ৩০ বছর ধরে চালানো হচ্ছে। সৌভাগ্যবশত এখনো আকাশে শব্দ চালানোর কোনো প্রক্রিয়া খুঁজে পাওয়া যায়নি। নাহলে শহরের সবাই নির্ঘাত উন্মাদ হয়ে যেত।

আমাদের জুটির কাছে ফিরে আসি। কিশোর এখনো কথা বলে যাচ্ছে। সে ভীষণ চিন্তিত ও ক্ষুব্ধ। এসব আবেগের উৎস ও লক্ষ্য হচ্ছে একটা সাদা-হলদে ডোরাকাটা বিড়াল। সে আরও দুটি ভবন সামনে একটা জানালার সানশেডে বসে আছে। কিশোর বলছে, সে আগেও দুবার এই বোকার জীবন বাঁচিয়েছে। একবার গাড়ির নিচ থেকে উদ্ধার করেছে, একবার একপাল কুকুরের সামনে থেকে। তা–ও সে আজ সানশেডে চড়ে বেড়াচ্ছে। কিসের এত দুঃখ এই বিড়ালের? জীবনের প্রতি এই বিদ্বেষের উৎস কোথায়?

অবশেষে কিশোর খেয়াল করে, কিশোরী চুপ করে আছে। সে বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করে—‘কিরে? কী হয়েছে তোর? জন্মদিনের আগে যে মন খারাপটা আসে, সেটা এসেছে?’

‘কী হবে?’ কিশোরী মাথা নাড়ে। ‘তোর কথা শুনছিলাম।’

‘না, তোর কথা-শোনা চেহারা আমি চিনি। তুই এতক্ষণ যেটা বানিয়ে রেখেছিলি, সেটা হচ্ছে, ‘আমি এখানে আছি কিন্তু আসলে নেই’–চেহারা।

‘ধুর।’

‘কী হয়েছে বল। প্রথমবার বিদেশে যাবি দেখে

দুশ্চিন্তা হচ্ছে?’

‘আমি আগেও বিদেশে গিয়েছি।’

‘হ্যাঁ, তিন বছর বয়সে। খুব মনে আছে তোর।’

‘আছে। উড়োজাহাজে কাঁদছিলাম। আশপাশের যাত্রীরা বিরক্ত হচ্ছিল। একজন আমাকে ঘুমপাড়ানি গান শুনিয়েছিল।’

‘সেই গল্প তোর মনে নেই। চাচির কাছে শুনেছিস।’ কিশোরীর পাশে এসে বসল কিশোর। ‘শোন ভাষা, তুই তো জানিস, কাহিনি না বললে আমি ঘ্যান ঘ্যান করতে থাকব। একপর্যায়ে তোর মনে হবে, শুরুতে বলে দিলেই ভালো হতো। তাই বলছি, এখনই শুরু কর। বলে দে, পরে ঝামেলা হবে না।’

কিশোরী, যার নাম ভাষা, দীর্ঘশ্বাস ফেলল, ‘আমাদের বিদেশে যাওয়া হচ্ছে না।’

‘কেন?’ কিশোর আকাশ থেকে পড়ল। তার নাম বংশী। ওদের শহরের মানুষ খুব একটা ঘুরতে যাওয়ার সুযোগ পায় না। একটা কারণ হচ্ছে, এই শহর বিশাল। অর্ধেকটা মহাদেশজুড়ে ছড়িয়ে। এখান থেকে বের হওয়ার বিমানভাড়া অনেক বেশি। ভাষার মা–বাবা পাঁচ বছর ধরে টাকা জমাচ্ছে। ভাষার জন্মদিন আগামীকাল। এ বছর ওর জন্মদিনে একটা ছোট্ট দ্বীপে যাওয়ার কথা ছিল। উষ্ণ বালুতে পা ডুবিয়ে সমুদ্র দেখার কথা ছিল। ভাষা কোনো দিন সমুদ্র দেখেনি। এই সফর নিয়ে সে প্রচণ্ড উৎসাহী ছিল। বংশীকে অনেকবার বলেছে। কারণ, বংশী ওর সবচেয়ে কাছের বন্ধু।

‘আব্বার কাজ পড়ে গেছে’, ভাষা বলল।

‘কী কাজ? সুরেন চাচা না ছুটি নিয়েছেন?’

‘আসলে কাজটাজ কিছু নয়। আমাকে বলেছে আরকি।’

‘আসলে কী?’

‘আমার নানার শরীর খারাপ। তার জন্য টাকাপয়সা লাগবে।’

‘সেটা তোকে বললে সমস্যা কী?’

‘ভেবেছে, আমি নানার ওপর রাগ করব।’

‘আমার কাছে এসেছে।’ চিলেকোঠার ভেতরের সিঁড়ি থেকে ভেসে এল একটা কণ্ঠস্বর। একটু পরে হেলেদুলে উঠে এল কণ্ঠস্বরের মালিক বংশী। মাথায় বিচিত্র লাল টুপি।

‘হুঁ’, বংশীর চিন্তিত চেহারা ফিরে এল। বেশ খানিকক্ষণ ভেবেটেবে তারপর বলল, ‘চল, একটা বুদ্ধি আছে।’

‘কী? তুই আমাকে ঘাড়ে করে বিদেশে নিয়ে যাবি?’

‘হয়তো, তুই খাওয়াদাওয়া একটু কমালে তারপর। আপাতত চল।’

বংশী ও ভাষা আলাদা বিদ্যালয়ে পড়ালেখা করে। আলাদা এলাকায় থাকে। ওদের বন্ধুত্বের ছুতো অন্য। দুজনই শিল্পী। তবে ওরা ক্যানভাসে ছবি আঁকে না, মাটি দিয়ে মূর্তিও করে না।

ওদেরকে বরং বৈদ্যুতিক শিল্পী বলা যায়। অনেকটা আমাদের বর্তমানের গ্রাফিতিশিল্পীদের ভবিষ্যৎ সংস্করণ। ওদের শহরজুড়ে বিজ্ঞাপন চালানোর যে অসংখ্য পর্দা আছে, ভাষা আর বংশী বিভিন্ন কৌশলে সেগুলোর কয়েকটার নিয়ন্ত্রণ নিতে পারে। ওদের কাছে কিছু ছোটখাটো যন্ত্র আছে। আর মাথাভর্তি দুষ্ট বুদ্ধি। একবার শহরের সবচেয়ে উঁচু ভবনের সব কটি জানালায় বিজ্ঞাপন বন্ধ করে ভিক্ষুকদের হাসিমুখের ছবি দিয়েছিল। আরেকবার আকাশের বিজ্ঞাপনগুলোর মধ্য দিয়ে একটা ত্রিমাত্রিক ড্রাগন উড়িয়ে দিয়েছিল। সেই ড্রাগন গপগপ করে বিজ্ঞাপনগুলোকে খেয়ে আবার বিষ্ঠা হিসেবে ছেড়ে দিচ্ছিল। শহরের পুলিশ ও বিজ্ঞাপনদাতারা খাপ্পা হয়েছিল বেশ। কিন্তু ওদেরকে খুঁজে পায়নি। শহরে প্রচুর অপরাধ থাকায় পুলিশ বেশি দিন খোঁজেওনি অবশ্য।

এ–ছাদ ও–ছাদ করে ভাষাকে বংশী বেশ খানিকটা দূরে নিয়ে এল। ভোঁতা, ধূসর দেখতে এক ভবনের ওপর এসে থামল। বংশী বলল, ‘তুই এখানে পাহারা দে তো। আমি আসছি।’

‘কোথায় যাস?’ ভাষা অত্যন্ত অবাক হলো।

‘এই যে ভেতরে। দাঁড়া না, বেশিক্ষণ লাগবে না। কেউ—’

‘কেউ এলে কী করব?’

‘বলছি তো। কেউ এলে এই চিলেকোঠার দরজায় টোকা দিবি দুবার, জোরে।’

ভাষাকে প্রতিবাদের সুযোগ না দিয়ে বংশী চিলেকোঠার ভেতরে ঢুকে গেল। ভাষা বিরক্ত হলো। মন খারাপ থাকলে দায়িত্ব নিতে ভালো লাগে না। তার ওপর এখানে কী করছে, তা-ও জানে না। শুধু আশা করল, বংশী যেন দ্রুত ফিরে আসে।

কিছুক্ষণ পর চিলেকোঠার ওপাশের সিঁড়িতে পায়ের শব্দ শোনা গেল। খুশি হলো ভাষা। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়নি।

কিন্তু দরজা খুলে বেরিয়ে এল এক অপরিচিত লোক। ভবনের রঙের সঙ্গে মিলিয়ে ধূসর উর্দি পরেছে। অন্যমনস্ক চেহারা। ভাষাকে দেখে সে খুব বিস্মিত হলো। ‘আপনি কে? এখানে কী?’

ভাষা দ্রুত বুদ্ধি বের করার জন্য মগজ হাতড়াল। ভালো কিছু পেল না। প্রথম বুদ্ধিটাই ছিটকে বের হলো মুখ দিয়ে, ‘আমি একজনকে ভালোবাসি। সে এখানে কাজ করে।’

‘মানে?’ লোকটার বিস্ময় বেড়ে চলেছে। ‘আপনি তো নাবালিকা। আমাদের অফিসের মানুষ নাবালিকা মেয়ের সঙ্গে প্রেম করে? বলেন কী?’

‘আমি নাবালিকা নই।’

‘অবশ্যই আপনি নাবালিকা। পরিচয়পত্র আছে? বের করেন দেখি।’

ভাষা বুঝল, বিপদ গভীর হচ্ছে। লোকটা দাঁড়িয়ে আছে চিলেকোঠার দরজার একদম সামনে। তাকে এড়িয়ে টোকা দেওয়া সম্ভব নয়। ‘একটা কথা শুনবেন?’ ও অনুরোধ করল।

‘কী কথা?’

‘আগামীকাল আমার জন্মদিন। মানে আজ রাত থেকে আরকি। এ জন্য আমার ভালোবাসার মানুষের সঙ্গে দেখা করতে এসেছি। ওর আজ সারা রাত ডিউটি। তাই গোপনে এসেছি। কিছুক্ষণ গল্প করে চলে যাব। আমাকে থাকতে দিন, চাচা?’

‘আমার বয়স ৩০। আমাকে চাচা ডাকবেন না।’

‘জি, ভাই। থাকতে পারব?’

‘কার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন?’ লোকটার সন্দেহ তীব্র হচ্ছে। ‘নাম বলেন। আমি এখানকার সবাইকে চিনি।’

‘আমার চেহারাটা একটু বাচ্চা বাচ্চা। আপনাকে দেখে যেমন বড় বলে ভুল করলাম, আমাকে দেখেও অনেকে কম বয়সী মনে করে।’ মনখোলা একটা হাসি দিল ভাষা। ভাবল, বংশী গেছে কোথায়?

‘আমার ছোট বোনের বয়স ১৫। আপনি তার চেয়ে এক দিনও বেশি বড় হবেন না।’

‘আপনার বোনের কি মন খারাপ হয়?’

‘কেন মন খারাপ হবে?’

‘মানে আপনি ৩০ ও ১৫। ও কি অপরিকল্পিত শিশু ছিল? এই ব্যাপারটা নিয়ে মানুষ একটু কষ্ট পায়। কিন্তু আমার মনে হয়, কষ্ট পাওয়ার কিছু নেই। আমরা কেউ তো ইচ্ছা করে পৃথিবীতে আসি না। আসার পর কী করছি, সেটাই জীবন। কীভাবে এলাম তা নিয়ে—’

ভাষার মুখে হাসি ফুটে উঠল এবার। বংশীর ফন্দির উদ্দেশ্য বুঝতে পেরেছে। পাঁচ মিনিট পর রাত ১২টা ১ বাজবে। ‘কী করেছিস? বল না, বল, বল?’ কনুই দিয়ে খোঁচা দিল বংশীর পাঁজরে। সেই সুযোগে বিড়ালটা গলা লম্বা করল। পালাবার পথ খুঁজছে। আবার ওকে ধরে বসাল ভাষা

‘আমার বোন খুব হাসিখুশি মানুষ।’ লোকটার চেহারা এখন ভীষণ গম্ভীর। ‘আর ও মোটেই অপরিকল্পিত শিশু নয়। বাবা মাঝখানে অনেক দিন বিদেশে চাকরি করেছেন’, চকিতে তার মনে পড়ল, এসবের ব্যাখ্যা দেওয়ার দরকার নেই। ‘আপনি কথা প্যাঁচাবেন না। কার কাছে এসেছেন? কী করতে?’

‘আমার কাছে এসেছে।’ চিলেকোঠার ভেতরের সিঁড়ি থেকে ভেসে এল একটা কণ্ঠস্বর। একটু পরে হেলেদুলে উঠে এল কণ্ঠস্বরের মালিক বংশী। মাথায় বিচিত্র লাল টুপি।

‘আপনি কে?’ লোকটা আবার সন্দিগ্ধ স্বরে প্রশ্ন করল। বংশীর টুপির দিকে দৃষ্টি গেল তার। ‘ব্যবস্থাপনা পরিচালকের টুপি পরেছেন কেন?’

‘আমি নতুন ব্যবস্থাপনা পরিচালক।’

‘না, আমি ওনাকে চিনি। স্বীকৃতি সাহেব। আপনার চেয়ে বয়সে অনেক বড়।’

‘ওকে দেখলেও বয়স বুঝতে ভুল করে অনেকে’, শুরু করল ভাষা।

‘না না, একদম না।’ লোকটা জোরে জোরে মাথা নাড়ল। ‘স্বীকৃতি সাহেব একবার আমাকে নিজের হাতে খাইয়ে দিয়েছিলেন।’

‘খাইয়ে দিয়েছিলেন?’ ভাষা বিস্মিত হলো। ‘কেন?’

‘অফিসের অনুষ্ঠান ছিল, উনি সব রক্ষীর সঙ্গে দেখা করে দুপুরের খাওয়াদাওয়া’, আবার থেমে গেল লোকটা। ‘এই, আপনারা এত কিছু জানতে চান কেন? এখানে কী করতে এসেছেন, ঠিক করে বলেন।’

‘শুনুন’, গম্ভীর মুখে বংশী এগিয়ে এল। দুই হাত পিঠের পেছনে নিয়ে গেছে মুরব্বিদের মতো। ‘আপনাকে কিছু কথা বলব। অফিসের গোপন তথ্য। কাউকে জানানো যাবে না।’

‘কী তথ্য?’ লোকটার চোখ বড় হয়ে গেল।

‘আমি স্বীকৃতি সাহেবের ছেলে বিকৃতি। আমাকে নতুন ব্যবস্থাপনা পরিচালক বানানোর প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। তাই আমার চোখে প্রশ্ন নিয়ে ভাষার দিকে তাকাল বংশী। রক্ষীর চোখ এড়িয়ে ভাষা নিঃশব্দে ঠোঁট গোল করে উচ্চারণ করল: ‘প্রে-মি-কা—’

‘প্রেমিকার সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পাইনি সারা দিন।’ বংশী বলল। ভাষা কী ইশারা দিচ্ছে, তা আরেকবার আড়চোখে দেখে নিয়ে বলল, ‘আগামীকাল আমার জন্মদিন, তাই।’

‘কালকে না ওনার জন্মদিন?’ লোকটা বাধা দিল।

‘হ্যাঁ’, বংশী একটু হোঁচট খেয়ে পরমুহূর্তে সামলে নিল। ‘আমাদের দুজনের জন্ম একই দিনে। জনম জনম ধরে আমরা একে অপরকে ভালোবাসি। প্রতি জন্মে ফিরে এসে একে অপরকে খুঁজে পাই।’

লোকটা তাকিয়ে রইল।

‘আমরা এখন যাচ্ছি। এক ঘণ্টা পর ফিরে আসব। এসব কাউকে জানাবেন না। নাহলে আমার বাবা আপনাকে অন্য কিছু খাওয়াবে।’ টুপিতে হালকা টোকা দিল বংশী।

লোকটা খানিকক্ষণ চুপচাপ চিন্তা করল। তারপর মাথা ঝাঁকিয়ে ঢুকে গেল চিলেকোঠার ভেতরে।

‘চল, চল, দৌড়!’ বলতে বলতে বংশী দিল ছুট।

ওর পেছনে ছুটতে ছুটতে ভাষা বলল, ‘বিকৃতি? বিকৃতি মানুষের নাম হয়?’

‘জোশে বলে ফেলেছি। ব্যাটা নিশ্চয়ই নিচে গিয়ে খতিয়ে দেখবে। ব্যাপার না। যা করার করে ফেলেছি। আগামী এক ঘণ্টা ওরা যতই চেষ্টা করুক, বদলাতে পারবে না।’

‘করেছিসটা কী?’

‘দেখবি তো। একটু পরেই দেখবি।’

‘টুপি পেলি কোথায়?’

বংশী এমন দৃষ্টিতে তাকাল, যেন এমন বোকার মতো প্রশ্ন কোনো দিন শোনেনি, ‘চুরি করেছি।’

আবার ছাদ থেকে ছাদে লাফিয়ে ওরা ফিরে এল নিজেদের পছন্দের জায়গায়। ফেরার পথে ভাষা একটুখানি থামল। পাশের ছাদের প্রান্ত থেকে ঝুলে খপ করে বিড়ালটাকে তুলে নিল নিজের কোলে।

আগের জায়গায় ফিরে ওরা পা মুড়ে পাশাপাশি বসল। বিড়ালটাকে কোলে রাখল ভাষা। বিড়াল মোটেও খুশি হলো না। ঘাড় বাঁকা করে ঘোঁ ঘোঁ করতে লাগল। কিন্তু ভাষা সেসব পাত্তা দিল না।

দুজনের দম একটু স্বাভাবিক হয়ে আসার পর ও বলল, ‘কোথায়? কিছু তো দেখছি না। নাকি দেখতে হলে সেই ভবনে ফিরে যেতে হবে?’

ভাষা বিড়বিড় করে নিজের প্রিয়তম উপন্যাসের কিছু বাক্য উচ্চারণ করল, ‘মনে কেমন যেন একটা উদাস বাধাহীন মুক্তভাব—মন হু হু করিয়া ওঠে, চারিধারে চাহিয়া সেই নীরব নিশিথরাত্রে জ্যোৎস্নাভরা আকাশতলে দাঁড়াইয়া মনে হইল

পকেট থেকে ঘড়ি বের করে সময় দেখল বংশী। ‘আর…পাঁচ মিনিট।’

ভাষার মুখে হাসি ফুটে উঠল এবার। বংশীর ফন্দির উদ্দেশ্য বুঝতে পেরেছে। পাঁচ মিনিট পর রাত ১২টা ১ বাজবে। ‘কী করেছিস? বল না, বল, বল?’ কনুই দিয়ে খোঁচা দিল বংশীর পাঁজরে। সেই সুযোগে বিড়ালটা গলা লম্বা করল। পালাবার পথ খুঁজছে। আবার ওকে ধরে বসাল ভাষা।

‘দাঁড়া না। দেখবি তো।’ আবার ঘড়ির দিকে তাকাল বংশী। ওকে ভাষার চেয়ে বেশি অধৈর্য দেখাচ্ছে। সেই আগুনে ইন্ধন জোগানোর জন্য পরবর্তী ৪ মিনিট ৫৫ সেকেন্ড ভাষা ক্রমাগত জিজ্ঞাসা করতে লাগল, ‘কী দিবি আমাকে? বল না। বল। আরে বলে ফেল।’

অবশেষে বংশী মুখ খুলল, ‘পাঁচ…চার…তিন…দুই…এক।’

ঝুপ করে নিভে গেল এলাকার সব বাতি।

চোখ বুজল সব জানালা। ঘুমিয়ে গেল সব ভবন। আকাশ থেকে সরে গেল আলোর জঞ্জাল।

সেখানে দেখা দিল গাঢ় মখমলের মতো গাঢ় বেগুনি আকাশ। বিন্দু বিন্দু রত্নের মতো অজস্র নক্ষত্র।

আর মায়ের উৎসুক চেহারার মতো জ্বলজ্বলে চাঁদ।

বংশী বলল, ‘আমরা যে ভবনে গিয়েছিলাম, তারা এই পুরো এলাকার বিদ্যুৎ সরবরাহ সামলায়। আজ হাসপাতাল বাদে রাত ১২টা থেকে ১টা পর্যন্ত পুরো এলাকায় সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছি।’

স্তব্ধ বিস্ময়ে ওপরে তাকিয়ে আছে ভাষা।

‘সমুদ্র যেমন কোনো দিন দেখিসনি, রাতের আকাশও কোনো দিন দেখিসনি, তা–ই না?’ বংশী বলল। ‘আজ তোকে পুরো আকাশটা দিলাম।’

ভাষা বিড়বিড় করে নিজের প্রিয়তম উপন্যাসের কিছু বাক্য উচ্চারণ করল, ‘মনে কেমন যেন একটা উদাস বাধাহীন মুক্তভাব—মন হু হু করিয়া ওঠে, চারিধারে চাহিয়া সেই নীরব নিশিথরাত্রে জ্যোৎস্নাভরা আকাশতলে দাঁড়াইয়া মনে হইল, এক অজানা পরিরাজ্যে আসিয়া পড়িয়াছি, মানুষের কোনো নিয়ম এখানে খাটিবে না…’

আলতো করে ওর হাত ধরল বংশী। বলল, ‘শুভ জন্মদিন।’

*লেখাটি ২০২৪ সালে বিজ্ঞানচিন্তার মার্চ সংখ্যায় প্রকাশিত