ক্রায়োজেনিক

আড়মোড়া ভাঙে শহর। রাস্তার শব্দে, মাইকের শব্দে ঘুম ভাঙলেও আবার ঘুমিয়ে পড়ে। কাজের দিনটাকে দূরে সরিয়ে রাখতে চায় আলস্য। ভোরের কুয়াশা থেকে উঁচু বাড়িগুলো বেরিয়ে আসতে বেশ দেরি করে, পোষা কবুতর চক্রাকারে ওপর দিয়ে ওড়ে। বৃষ্টি হয়নি বহুদিন, ধুলায় ঢেকে গেছে সব গাছ, সূর্য জ্বলে আবছা লাল আলোয়। সারা দিন শহরটা একটা অদ্ভুত ধোঁয়াশায় ঢেকে থাকে। ১২-১৪ তলা, খামখেয়ালিতে গড়ে ওঠা বাসস্থানগুলোর মধ্যে খাবারের খোঁজে ওড়ে ভুবনচিল, কাকদের দল সভা করে হঠাৎ নির্মাণকাজ বন্ধ হয়ে যাওয়া অসমাপ্ত দালানের ছাদে। এই শহরটা কার? ভাবি আমি, কে এই শহরকে নিজের বলে দাবি করতে পারে?

নিচের রাস্তায় গাড়ির হর্ন প্রকট হয়ে ওঠার আগেই ফোন বাজে। রশীদউদ্দিন, অনেক পুরোনো বন্ধু, একসঙ্গে কলেজে পড়েছিলাম, এখন একটি বিরাট ব্যাংকের কর্ণধার।

‘এলে কবে?’ রশীদ প্রশ্ন করে। রশীদের প্রশ্নে আন্তরিকতা থাকে।

‘দুসপ্তাহ হবে,’ উত্তর দিই, অপ্রস্তুত হই।

‘দুসপ্তাহ! আর আমাকে জানালে না?’ অভিযোগ রশীদের।

আমতা-আমতা করি, অজুহাত আছে অনেক, তার মধ্যে কোনটাকে বাছাই করা যায় ভাবি।

রশীদই উদ্ধার করে দেয়, বলে, ‘শোনো, তুমি ফিজিকসের লোক না? আজ সন্ধ্যায় ফ্রি আছ?’

ফ্রি ঠিক ছিলাম না, কিন্তু রশীদের প্রশ্নের পেছনে যে নির্বন্ধতা ছিল, তাতে আত্মসমর্পণ করলাম, ‘রাতে এক জায়গায় যাওয়ার কথা, তবে একটু দেরি করে গেলেও হবে। তুমি এখানে আসবে নাকি?’

‘তোমার বাসার কাছে ঢাকা মার্কেট নামে একটা খাবারের জায়গা আছে। ছয়টায় ওখানে থাকব। অবশ্যই আসবে,’ এই বলে রশীদ ফোন কেটে দিল।

ঢাকা মার্কেট খুঁজে পেতে একটু দেরি হলো। একটা ছোট রেস্তোরাঁ, পাঁচ-ছয়টি টেবিল। বাইরে বড় চুলায় নানরুটি হচ্ছে। দিনের কাজের শেষে অনেক খদ্দের কাউন্টার থেকে বিরিয়ানির প্যাকেট নিয়ে যাচ্ছে। ভেতরের দেয়ালে গত বছরের ছেঁড়া মলিন একটা ক্যালেন্ডার, তাতে মসলা মাখানো শহীদ মিনারের ছবি। টেবিলে চটা প্লাস্টিকের নিচে কাঠ বেরিয়ে আছে। সেখানে বসতে না বসতেই রশীদ হাজির। রশীদের সঙ্গে আরেকজন, পুরো স্যুট–টাই পরা, ঢাকা মার্কেটের হতশ্রী অভ্যন্তরের বিপরীত। রশীদের গায়েও কোট, কর্ডরয়ের, বেশ স্টাইলের, কেন জানি সেটা রেস্তোরাঁর মলিনতার সঙ্গে ছিল মানানসই। আমি ওদের জন্য উঠে দাঁড়াতেই রশীদ বলল, ‘অনেকক্ষণ এসেছ?’

মাথা নাড়িয়ে ‘না’ বলতে বলতেই সে সঙ্গের মানুষটিকে দেখিয়ে বলল, ‘এটা আমাদের কালাম ভাই।’

রশীদ যেমন দীর্ঘকায়, কালাম তেমনই খর্বকায়। কালামের মুখমণ্ডলে উদ্‌ভ্রান্ত ভাব, তবু একগাল হেসে আমার হাত জড়িয়ে ধরলেন, বললেন, ‘আপনার কথা রশীদ প্রায়ই বলে।’

তার চতুষ্কোণ মুখাবয়বের দুপাশে মসৃণ উজ্জ্বল ভরা গাল, চোখে সহৃদয়তা। বললাম, ‘আশা করি, খারাপ কিছু বলে না।’

উনি হেসে টেবিলের উল্টো পাশে বসলেন। তার হাসিতে বিষণ্নতা। রশীদ তার পাশে বসে বেয়ারাকে ডাক দিল। আমাকে জিজ্ঞেস করল, ‘কী খাবে?’ বেয়ারাকে বললাম, ‘শিঙাড়া আছে?’

‘‘না, শিঙাড়া শেষ।’

‘তাহলে আমাকে শুধু চা।’ কালাম ভাই ও রশীদ কিছু খাবে না। তারাও চা দিতে বলল।

রশীদ বলল, ‘তোমার হাতে তো বেশি সময় নেই, তাই অত ভূমিকা না করেই বলি, কালাম ভাই তোমাকে একটা কাহিনি শোনাতে চায়। তোমার সেটা শুনে কিছু মতামত দিতে হবে।’

রশীদউদ্দিনের মতো সময়ানুবর্তিতা ও দক্ষতা যদি শুধু কয়েকটি মানুষের থাকত, এই শহরের এ রকম দশা বোধ হয় হতো না।

কালাম ভাই শুরু করলেন, কিন্তু উনি এত আস্তে কথা বলছিলেন যে বাইরের কোলাহল ছাপিয়ে তার কথাগুলো আমার কাছে পৌঁছাচ্ছিল না। তার দিকে মাথা ঝুঁকিয়ে কথাগুলো শুনতে চাইলাম। বোঝাই যাচ্ছিল, তিনি চাইছিলেন না ওই জায়গায় অন্য কেউ তার কথা শুনতে পায়।

উনি বললেন, ‘আমার প্রশ্নটার উত্তর আমার জানাই বলতে পারেন, তবু বিশেষজ্ঞ হিসেবে আপনার কাছ থেকে সেটার সমর্থন চাইছি। আমার মামা, ওনার নামটা এখন বলতে চাই না, একজন বড় এবং বিখ্যাত প্রকৌশলী ছিলেন। বিলেতে একটা ইউনিভার্সিটিতে, তারপর একটা কোম্পানিতে কাজ করতেন। ওনার মতো গুণী মানুষ নাকি হয় না, এটাই ছিল আমাদের পারিবারিক প্রবাদ। তো, কয়েক বছর আগে অবসর নিয়ে দেশে চলে আসেন। স্ত্রী, ছেলেমেয়ে বাইরেই থেকে যায়। আমার আরেকটি যমজ ভাই আছে। আমার থেকে দুই মিনিটের ছোট। ওর নাম মুনির। তো আমাদের এই দুই ভাইয়ের মধ্যে মামা মুনিরকেই স্নেহ করেন বেশি। মুনির একজন শিল্পপতি। সাভারে ওর পোশাক কারখানা আছে। এ ছাড়া নতুন একটা কারখানা দেবে ভাবছে। কেব্‌ল তৈরি করবে। মামা লন্ডন থেকে ফেরার সময় তার গবেষণার অনেক যন্ত্রপাতি নিয়ে এসেছিলেন। সেগুলো আবার মুনিরের বাসায় রেখেছেন। মুনির বিয়ে করেছিল, ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। এখন একাই থাকে আমাদের আদি বাসায়। উত্তরাধিকারসূত্রে ওটাই পেয়েছে।

‘তো ওই যন্ত্রপাতি রাখার পরের কয়েক সপ্তাহ মুনিরের সঙ্গে আমার দেখা নেই। একদিন ওর বাসায় গিয়ে দেখি, সব অন্ধকার। বাসাটা দোতলা। চারপাশে ছয়-সাততলা অ্যাপার্টমেন্ট উঠেছে, কিন্তু মুনির বাড়িটা যেভাবে আছে, সেভাবেই রাখতে চায়। দারোয়ান সেলিমের কাছে শুনলাম, মাঝেমধ্যেই কোনো অজানা কারণে বিদ্যুৎ চলে যায়, ফিউজের সমস্যা। আর সাহেব সারা দিন নাকি ঘুমায়। কিন্তু সেদিন ওর শোবার ঘরে ঢুকে দেখি, কেউ নেই। দারোয়ান বলল, না, উনি বাইরে যাননি। গাড়ি তো বাড়িতেই আছে। ফোন করলাম, দেখি ফোন ধরে না। কত ধরনের দুশ্চিন্তা মাথায় এল। কেউ ওকে তুলে নিয়ে যায়নি তো? সেলিম বলল, সে রকম হলে সেই প্রথম জানবে। সেলিম বহু বছরের কর্মচারী, তাকে সন্দেহ করবার কিছু নেই। ওর বন্ধুদের ফোন করলাম, তারাও কিছু জানে না। পুলিশের কাছে যাব ভাবছিলাম, কিন্তু ব্যাপারটা আরও ভালো করে না জেনে সেটা করা ঠিক হবে না ভাবলাম।

‘বাড়ি ফিরছি, পথে দেখি, মোবাইলে ফোন করছে মুনির। বলল, বাসার ছাদে নাকি ছিল। অথচ ছাদে তো আমি গিয়েছিলাম। বলল অন্ধকারে বসে ছিল কোনায়, চিন্তায় ডুবে ছিল, আমাকে দেখতে পায়নি। বললাম, নিচে যে চেঁচামেচি করে বাড়ি মাথায় তুললাম, শুনতে পাওনি? বলল এমনই চিন্তা যে বাইরের কোনো শব্দই কানে ঢোকেনি। ঠিক বুঝলাম না ব্যাপারটা কী। চিন্তাটা কী জিজ্ঞেস করে কোনো উত্তর পাওয়া গেল না।’

কালাম ভাই বললেন, ‘তো আরেক সন্ধ্যায় গিয়েছি। আবার দেখি বিদ্যুৎ নেই। সেলিম বলল, সাহেব বাসায়ই আছে। ভেতরে ঢুকে আর খুঁজে পাই না। মিনিট দশেক খোঁজার পরে দেখি, রান্নাঘর থেকে মুনির বের হয়ে এল। বললাম, তোমার ব্যাপার কী? সে কিছু না বলে ইশারা করে তার সঙ্গে যেতে বলল। নিয়ে গেল রান্নাঘরের পেছনের ঘরটাতে, আগে সেখানে রাজ্যের পরিত্যক্ত খাট, আলমারি ডাঁই হয়ে থাকত। এখন দেখি একদম পরিষ্কার, শুধু এক কোনায় প্রাচীন মিসরের শবাধারের মতো একটা বড় জিনিস দাঁড় করানো। সেটার সামনে কিছু বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম। আর ঘরটা ভীষণ ঠান্ডা, আমি কাঁপতে লাগলাম।’

আমি আশ্চর্য হয়ে বললাম, ‘শবাধার, সেটা কী?’ কালাম ভাই বললেন, ‘ওই যে মমি যার মধ্যে রাখা হতো। ইংরেজিতে সার্কোফ্যাগাস বলে, কফিনের মতো অনেকটা। কিন্তু এই শবাধারের ওপর অনেক যন্ত্রপাতি লাগানো।’ দেখলাম রশীদ শবাধারের বর্ণনা শুনে আশ্চর্য হয়নি, এই কাহিনি সে আগে শুনেছে।

কালাম ভাই বলতে থাকলেন, ‘মুনির আমাকে ফিসফিস করে বলল, মামা দিয়েছেন।

আমি তো হতবাক। বললাম, এটা দিয়ে কী হয়?

মুনির বলল, এটা দিয়ে মানুষের শরীরকে স্বচ্ছ করে দেয়া যায়।

ও কী বলতে চায় কিছুই বুঝলাম না। দেখলাম, শবাধার থেকে শীতল বাষ্প বের হচ্ছে।

মুনির বলতে থাকে, এর ভেতরে ঢুকে ঘণ্টাখানেক থাকতে হয়, তাপমাত্রা অনেক নিচে নেমে যেতে থাকে, তারপর বেরিয়ে এলে দেয়ালের মধ্য দিয়ে বেরিয়ে যাওয়া যায়।

‘বললাম, মামা তোকে এসব ছাইপাঁশ বুঝিয়েছে? তুই বিজ্ঞানের ভালো ছাত্র ছিলি, এসব যে সম্ভব না, তা তো ভালো করে জানিস।

‘মুনির বলল, না না, মামা এর মধ্যে দাঁড়াতে বলেননি, বরং আমাকে সাবধান করে দিয়েছেন, যাতে ভেতরে না ঢুকি। তিনি আমাকে কিছু ছোট নিরেট বাক্সের মতো বস্তুর নমুনা দিয়েছিলেন, বলেছিলেন, একটা বাক্স শবাধারে ঢুকিয়ে বিদ্যুৎ চালু করতে হবে। ঘণ্টাখানেক পরে বিদ্যুৎ বন্ধ করে দিয়ে শবাধারটা খুলে বাক্সটা একটা আংটা দিয়ে ধরে ওঠাতে চাইলে বাক্সটার ভেতর দিয়ে আংটাটা গলে যাবে। আর বাক্সটা মেঝের মধ্য দিয়ে যেন গলে না যায়, সে জন্য শবাধারের নিচের অংশটা নাকি খুবই ঘন একটা পদার্থ দিয়ে তৈরি করা আছে।’

একটু থেমে কালাম ভাই আমাকে প্রশ্ন করেন, ‘এটা কি সম্ভব?’

আমি বললাম, ‘না, সম্ভব নয়। যদিও বস্তু মূলত ফাঁকা, কিন্তু দুটি বস্তুর ইলেকট্রনরা একে অপরকে বিকর্ষণ করবে। তা ছাড়া সেই বিকর্ষণকে অতিক্রম করলেও পাউলির বর্জন নীতি নামে একটি নিয়ম দুটি ইলেকট্রনকে কাছাকাছি আসতে দেবে না। তবে খুব ছোট বস্তুর জন্য, যেমন একটি ইলেকট্রনের পক্ষে সেটা সম্ভব।’

কালাম ভাই যেন একটু স্বস্তি পেলেন। বললেন, ‘আমিও এ রকম একটা কিছু মুনিরকে বললাম। কিন্তু ও বলল, এর মধ্যেই বাক্স নিয়ে পরীক্ষা করেছে। সেই পরীক্ষা সফল হয়েছে, বাক্স স্বচ্ছ হয়েছে। সমস্যা হলো এর জন্য যে পরিমাণ বৈদ্যুতিক ক্ষমতার দরকার, সেটা আমাদের সাপ্লাই লাইন দিতে পারে না। কারেন্ট বেশি বাড়লে বাসার ফিউজ পুড়ে বিদ্যুৎ–সংযোগ বন্ধ করে দেয়। এরপরে ও নিজের শরীরের ওপর পরীক্ষা করতে চায়। মনে পড়ল অন্যদিন ওকে খুঁজে পাইনি, বললাম, সেদিনও তুই নিশ্চয় এই শবাধারে মধ্যেই ছিলি, আর আমাকে বললি ছাদে ছিলি। ও বলল, আমাকে ভয় পাইয়ে দিতে চায়নি। আমি বললাম, তোর মাথা খারাপ হয়ে গেছে। এই পরীক্ষা করতে গেলে শবাধারে তোরই শব পড়ে থাকবে।’

জীবনে আমি অনেক অদ্ভুত কথা শুনেছি। কালাম ভাইয়ের কাহিনি যে এর মধ্যে অন্যতম, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এর কতটুকু বিশ্বাসযোগ্য, বুঝতে পারছিলাম না। দেখলাম, রশীদ গম্ভীর মুখে চা খাচ্ছে।

কালাম ভাইকে বললাম, ‘আমার মনে হয় এই শবাধার হলো একটা ক্রায়োজেনিক চেম্বার, যা কিনা কোনো বস্তু, মানুষের শরীরকেও খুব ঠান্ডা করে দেয়। আপনার মামা কি নিম্ন তাপমাত্রার বিজ্ঞান নিয়ে কাজ করছিলেন?’

কালাম ভাই বললেন, ‘সেটা তো ঠিক বলতে পারব না। সেদিন আমি মুনিরকে খুব অনুরোধ করে এলাম যাতে ও ওই শবাধারের ভেতর আর না ঢোকে। কিন্তু গতকাল রাত ১০টা নাগাদ দারোয়ান সেলিম ফোন করল। বলল, সাহেবকে খুঁজে পাচ্ছে না। আমি সঙ্গে সঙ্গে গেলাম। গিয়ে দেখি, সমস্ত পাড়ার বিদ্যুৎ চলে গেছে। অশনিসংকেত। মনে হলো মুনির শবাধারে ঠিকই ঢুকেছে। কিন্তু সেটার ভেতর কিছুই ছিল না। মুনিরকে বাড়ির অন্য কোথাও খুঁজে পেলাম না। ভাবলাম, এমন কি হতে পারে, সেই শবাধারে তার শরীর স্বচ্ছ হয়ে মাটিতে গলে গেছে অথবা কোনো দেয়াল দিয়ে বের হওয়ার সময় দেয়ালের মধ্যে আটকা পড়েছে! আমি জানি, এটা অসম্ভব একটা ব্যাপার, কিন্তু এটা হওয়ার একটা ক্ষীণ সম্ভাবনা কি নেই?’

আমি বললাম, ‘কোয়ান্টাম বলবিদ্যা বলে, ইলেকট্রন বা প্রোটনের মতো ছোট কণা সুড়ঙ্গ করে খুব ছোট প্রস্থের বাধা পার হতে পারে। একে কোয়ান্টাম টানেলিং বলে। কিন্তু বড় বস্তুর জন্য এটা অসম্ভব। কোয়ান্টাম তত্ত্ব অনুযায়ী ইলেকট্রনকে কণা ও তরঙ্গ উভয়ভাবেই ভাবা যেতে পারে। ইলেকট্রনের তরঙ্গদৈর্ঘ্য খুব বড়, তাই সেই তরঙ্গের একটা অংশ দেয়ালের অন্যদিকে অবস্থান করতে পারে। সেই অংশ ওই অবস্থানে ইলেকট্রনের থাকার সম্ভাবনা নির্দেশ করে, তাই মাঝেমধ্যে সেখানে ইলেকট্রনটি অস্তিত্ব পেতে পারে। অর্থাৎ দেয়ালের একদিকে অদৃশ্য হয়ে অন্যদিকে আবির্ভূত হতে পারে। ইলেকট্রন টানেলিং মাইক্রোস্কোপে, নানান ধরনের ইলেকট্রনিকসে বিজ্ঞানীরা ইলেকট্রনের টানেলিং বৈশিষ্ট্য এখনই ব্যবহার করছেন। ইউরেনিয়ামের পরমাণু থেকে আলফা কণা এ রকম সুড়ঙ্গ করেই বের হয়। তবে বড় বস্তুর তরঙ্গদৈর্ঘ্য খুব ছোট, তার পক্ষে দেয়াল ভেদ করার অবকাশ নেই। অবশ্য কিছু তত্ত্ব বলে, অসীম সময় অপেক্ষা করলে বড় বস্তু, যেমন আমাদের পক্ষেও, টানেলিং করার একটা সম্ভাবনা আছে। তবে আমাদের মহাবিশ্বে সেই সম্ভাবনা শূন্য বলেই ধরে নিতে পারেন।’

কালাম ভাই কথাগুলো বুঝতে পারলেন কি না জানি না, তবে আমার শেষের কথাগুলোতে মনে হলো ওনার চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বললেন, ‘আর ঠান্ডা করার ব্যাপারটা?’ বললাম, ‘কণাকে শীতল করলে তার ভরবেগ কমে, তরঙ্গদৈর্ঘ্য বাড়ে, কিন্তু অন্যদিকে তার শক্তি কমে যাওয়ার কারণে টানেলিংয়ের সম্ভাবনা কমে। তবু কিছু ইলেকট্রনিকসে ক্রায়োজেনিকস বা শীতল করার সরঞ্জাম থাকে, কারণ, তাতে বাইরে থেকে আসা নয়েজ, তাপ বা শক্তির প্রভাবকে কমানো যায়।’

‘আচ্ছা, তাহলে তা–ই। আমি দেখি পুলিশের কাছে একটা ডায়েরি করা যায় কি না।’ এই বলে কালাম ভাই আমাদের কাছে থেকে বিদায় নিয়ে তড়িঘড়ি বের হয়ে গেলেন। তার দ্রুত প্রস্থানে আমি যে রকম অবাক হলাম, রশীদও দেখলাম তার চেয়ে কম অবাক হয়নি।

বললাম, ‘তুমি কি মুনিরকে কখনো দেখেছ?’

রশীদ বলল, ‘একবারই। কয়েক মাস আগে কালাম ও মুনির একসঙ্গে এসেছিলেন আমার অফিসে একটা ব্যাংক লোনের জন্য। দুই ভাইকে আলাদা করে চেনা যায় না।’

‘কালাম ভাইয়ের ভুরুর ওপর একটা কাটা দাগ আছে। মনে হয় অনেক আগে পড়ে গিয়েছিলেন। মুনিরের কি সেটা আছে?’

‘মনে করতে পারছি না,’ বলে রশীদ।

‘আর লোনটা? ওটা দিলে?’ আমি জিজ্ঞেস করি।

‘না, লোনটার জন্য ওদের কিছু জামানত দেওয়ার দরকার ছিল। বলল কয়েক মাস পরে সব ঠিক করে আবার আসবে।’

২.

এর দুদিন পরে রশীদ ফোন করল, বলল, ‘ওই দিন সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।’

বললাম, ‘এত আনুষ্ঠানিকতা করছ কেন?’

ও বলল, ‘না, আসলে পুরো ব্যাপারটা নিয়ে খুব বিভ্রমে আছি। তোমাকে সেদিন কালাম ভাইদের একটা ব্যাংক লোনের ব্যাপারে বলছিলাম। আমার এক বন্ধু এক বড় ব্যাংকের অধিকর্তা। এখনই ফোন করে বলল, মুনির ভাই নাকি তাদের ব্যাংক থেকে ২৫ কোটি টাকা লোন নিয়েছিল একটা কারখানার জন্য। সমস্ত টাকাটাই নাকি বাইরে থেকে যন্ত্রপাতি কেনার জন্য পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এখন মুনিরকে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আর যে কোম্পানিকে টাকাটা পাঠানো হয়েছে, সেটারও কোনো হদিস নেই। মনে হচ্ছে কোম্পানিটাই ভুয়া।’

‘তাহলে মুনির টাকাটা মেরে দিয়ে কেটে পড়েছে?’

‘তা–ই তো মনে হচ্ছে। কিন্তু এর আগে নাকি সে আরও বড় লোন নিয়ে তা নিয়মিত পরিশোধ করছিল। তবে সে যে অন্তত ঢাকা বিমানবন্দর থেকে দেশের বাইরে যায়নি, এ খবর আমরা পেয়েছি।’

‘আর কালাম ভাই?’ জিজ্ঞেস করি আমি।

‘কালাম ভাই খুব ভেঙে পড়েছেন। বারবার বলছেন, আমি ওকে “না” করেছিলাম ওই শবাধারে ঢুকতে।’

খবরটা সংবাদমাধ্যমেও এল। তাতে ক্রায়োজেনিক চেম্বারটার কথাও বলা হলো। কালাম ভাই তার সাক্ষাৎকারে আমার নামটাও উল্লেখ করলেন বিশেষজ্ঞ হিসেবে। দু-একজন সাংবাদিক আমাকে ফোন করে প্রশ্ন করল, দেয়ালের মধ্য দিয়ে হেঁটে যাওয়া সম্ভব কি না। আমি ব্যাপারটা অসম্ভব বললেও তারা খবরটা লিখল এমনভাবে যে মুনিরের শরীর স্বচ্ছতা লাভ করে মাটি ফুঁড়ে নিচে চলে যেতে পারে বলে কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ বলছেন। আমার ক্রায়োজেনিক চেম্বারটা সম্বন্ধে খুব কৌতূহল হলো। কিন্তু রশীদউদ্দিন কালামের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছিল না। অবশেষে রশীদের কাছ থেকে মুনিরের ঠিকানাটা জেনে দুই সপ্তাহ বাদে যখন সেই বাড়ির সামনে পৌঁছলাম, তখন দেখলাম বাড়িটা নেই, বাড়ির বদলে বিশাল গর্ত, পাইলিংয়ের কাজ হচ্ছে। বাড়ির পেছন দিকের একটা কোনায় কংক্রিট ঢালা। বুঝলাম, ভাইয়ের অবর্তমানে কালাম পৈতৃক সম্পত্তি ডেভেলপারকে দিয়েছেন। এত তাড়াতাড়ি কেন বাড়িটা ভেঙে ফেলল কালাম, তা বুঝতে পারলাম না। এর এক সপ্তাহ বাদে ক্যালিফোর্নিয়া ফিরে এলাম।

পাঁচ বছর কেটে গেল। অনেক দিন পরে নিউইয়র্কে গেলাম। গ্রীষ্মকাল ছিল। সেখানে বন্ধুরা একটা বাংলাদেশি অনুষ্ঠানে নিয়ে গেল, নাটক করছেন স্থানীয় লোকজন। অনুষ্ঠানের শুরুতে এক ভদ্রলোককে দেখে মনে হলো কালাম। বললাম, ‘আপনি কালাম ভাই না?’

উনি একটু থতমত খেলেন। তারপর সামলে নিয়ে দাঁত বের করে বললেন, ‘না, আপনি ভুল করছেন। আমার নাম মনসুর খান।’

কালাম ভাইয়ের চতুষ্কোণ মুখে একটা ভুরুর ওপর কাটা দাগ আমার স্পষ্ট মনে ছিল। নিউইয়র্কের বন্ধুদের মনসুর খান সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তারা বলল, উনি বছর পাঁচেক হলো এসেছেন। এসেই বেশ দামি একটা বাড়ি কিনেছেন, দামি গাড়ি কিনেছেন। এ নিয়ে নাকি অনেক কথাবার্তা হয়েছে ওখানকার বাঙালি মহলে।

নাটক দেখে গাড়িতে ফিরতে ফিরতে দূরে ইস্ট রিভারের পাশে ম্যানহাটনের আলোকোজ্জ্বল সুউচ্চ অট্টালিকার প্রতিলেখের দিকে চেয়ে আনমনা হয়ে যাচ্ছিলাম, দূরে এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিংয়ের রঙে উদ্ভাসিত চূড়াটা দেখতে দেখতে মনে ভেসে উঠছিল এক ভয়ংকর দৃশ্য—মুনির শবাধারে ঢুকছে, ঢুকে বের হতে পারছে না, ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে তার শরীর, ঠোঁটে তুষার জমছে, বিড়বিড় করে বলছে, ‘বাঁচাও, বাঁচাও।’ বাইরে দু-তিনজন দাঁড়ানো, দারোয়ান সেলিমও আছে তাদের সঙ্গে। রাস্তায় গাড়ি একটা পার্ক করা ছিল, সেখানে কালাম বসা ছিল। এরপরে কালামের নির্দেশে সেলিমসহ কয়েকটি লোক শবাধারটা তুলে বাড়ির পেছনের বাগানে কোনায় খোঁড়া গর্তে ঢুকিয়ে দিল, তার ওপর ঢালা হল কংক্রিট। পরদিন থেকে শুরু হলো বাড়ি ভাঙা, পাইলিংয়ের কাজ।

বুঝলাম, কেন কালাম আমার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিল, কেন সে তড়িঘড়ি করে ঢাকা মার্কেট রেস্তোরাঁ থেকে বের হয়ে গিয়েছিল। সংবাদমাধ্যমে মুনিরের মাটির মধ্য দিয়ে গলে যাওয়া প্রতিষ্ঠিত করতে, যদিও আমি এই প্রক্রিয়া যে অসম্ভব, তা বলেছিলাম। মার্কিন দেশের ভুয়া কোম্পানি কালামেরই ছিল। তারপর ভাবলাম, আর এমনকি হতে পারে, মুনিরের শরীর ঠান্ডা হতে হতে শবাধারের নিচ দিয়ে গলে পৃথিবীর কেন্দ্রের দিকে চলে গেছে। ভ্রাতৃহত্যা এই মহাবিশ্বে হতে পারে, কিন্তু মহাবিশ্বের পদার্থবিদ্যার সূত্র মুনিরের শরীরকে শবাধার ভেদ করে টানেল করতে দেবে না। তবু আমার গায়ে কাঁটা দিল, নিউইয়র্কের গরমেও গাড়িতে শীতল হতে থাকলাম।