আলমারি

নাটক–সিনেমা দেখে অভিজ্ঞতা হয়েছিল। ভেবেছিলাম, এ সময় রুনা আচার খেতে চাইবে। চট্টগ্রামের সহকর্মী সানিকে দিয়ে বার্মিজ আচারও আনিয়েছিলাম। কিন্তু রুনার মন আছড়াতে লাগল অন্য কিছুতে।

কামাল ভাই বলেছিলেন, সন্তানসম্ভবা অবস্থায় তার স্ত্রী নাকি টিস্যু খেতেন। কামাল ভাই সকাল-বিকেল বাসায় টিস্যু নিয়ে ঢুকতেন। এতই কিনতেন যে দোকানদার সন্দেহের চোখে তাকাতেন।

রুনার তেমন না হলেও কাছাকাছি গেল ব্যাপারটা। তার মাথায় ঢুকল বাচ্চার জন্য শোকেস করবে। সেখানে বাচ্চার খেলনা গুছিয়ে-গাছিয়ে রাখবে।

বাচ্চাই আসেনি, ডাক্তারি হিসাবে আরও দুই মাসের ব্যাপার; সেই বাচ্চার খেলনাও কেনা হয়নি, অথচ সেই খেলনার শোকেস!

আমি অল্প বেতনের চাকরি করি, স্বল্প জীবনের যাপন করি, আমার জন্য এসব বিলাসিতা বটে। এড়াতে চাই। বলি, ‘দেখি সামনের মাসে কী করা যায়?’

মাস পেরিয়ে মাস আসে। রুনার মাথা থেকে শোকেস যায় না। আমি বলি, ‘এখন তো একটু সঞ্চয় করতে হবে, তা-ই না? তোমার চেকআপ, তা ছাড়া ডেলিভারি...’

রুনা সে রাতে খায় না।

আমি মিজানুরের সঙ্গে কথা বলি। মিজানুর হিসাব দেয়, হাজার ছয়েক তো লাগবেই। তা-ও জিনিসটা কাঠের হবে না। মালয়েশিয়ার কী মাল দিয়ে যেন বানাবে...আমার মন ওঠে না।

মিজানুর চালাক মিস্ত্রি। মুখ দেখেই বলে, ‘আপনার বাড়িত পুরানা কাঠটাঠ নাই? ওইগুলা কাইটা বানায়া দিই? আমারে মজুরি দিয়েন তিন হাজার। কাঠের মজবুত জিনিস হইব। পোলা বড় হইয়া শোকেস মাথায় নিয়া ঘুরব। কিচ্ছু হইব না!’

তা বাড়িতে একটা পুরোনো কাঠের জিনিস তো আছেই। ব্যবহার করা হয় না। পড়ে আছে ব্যালকনির একপাশে। ঘাড় ভেঙে। একটা আলমারি। আগে কফি কালারের ছিল বোধ হয়। এখন লোমওঠা ভুলো।

আমি বললাম, ‘তিন না, আড়াই পাবা...সামনের সপ্তায় বাসায় আসবা!’

আমি বলি, দুনিয়ায় সবকিছুরই বুজরুকি আছে। বিজ্ঞানের থাকবে না কেন? প্যারালাল-আনপ্যারালাল এগুলো হলো বিজ্ঞানের বুজরুকি।

আলমারির ভেতরটা জবরজং।

কাগজ, ত্যানা, তেলাপোকার বিষ্ঠা, ইঁদুরের শিল্প—সবকিছুতেই ঠাসা। কিন্তু রুনার ভ্রুক্ষেপ নেই। তার উৎসাহ চরমে। সব এক হাতে পরিষ্কার করে যাচ্ছে। আমি কিছুক্ষণ দেখে, ঝাড়ু রেখে, টিভিতে মন দিই। কিছুক্ষণ পরই রুনার কণ্ঠ, ‘এই, দেখে যাও, এইখানে কী!’

অগত্যা যাই।

দেখি আলমারির পেছনটায় বিরাট এক গর্ত।

এ গর্ত ইঁদুর করেছে বিশ্বাস হয় না। কিন্তু আর কোনো অপরাধীকেও পাওয়া যায় না।

সন্ধ্যার দিকে আমার সামনে একটা খাতা রাখে রুনা। বলে, ‘এইটাই শুধু ঠিক আছে। দেখো কিছু আছে নাকি এতে...নাইলে কাল ময়লার সাথে ফেলে দেব।’

ওঠাতে ইচ্ছা করে না। কিন্তু রুনা এত আগ্রহ নিয়ে দিল। চিকিৎসক আমাকে আলাদা করে ডেকে বলেছেন, এ সময় যেন রুনাকে বেশি বেশি করে উৎসাহ দিই। ফলে ধূলিমলিন খাতাটি ছুঁতে হয়।

খুবই সাধারণ খাতা।

মোটা লালচে রঙের পাতা দিয়ে বানানো। কালো ডোর দিয়ে সেলাই করা। ওপরে মিশকালো রঙে লেখা—আরেক জীবন। তার নিচে লেখা মঞ্জুর আলী খান।

তা মঞ্জুর আলী খান আমার দাদার নাম। এই লোককে আমার চোখে দেখা হয়নি। শুনেছিলাম তিনি গান বাঁধতেন এবং পালায় গান করতেন। কবিগানের লড়াইয়েও থাকতেন। তার বাঁধা দু–একটা গান এখনো নাকি মালদহের কৃষকের কণ্ঠে গুনগুন করে। ’৪৮-এর পর আমরা সেখান থেকে যোজন দূরের মানুষ।

বুঝলাম, এই খাতা দাদার গানের। ফলে রেখে দিলাম। কিন্তু রাখতে গিয়ে কৌতূহল আবার চাগিয়ে উঠল। দেখি ব্যাটা কী লিখে গেছে! রবীন্দ্রনাথ হতে পেরেছিল?

প্রথম চারটা পাতায় গান আছে। কাটাকুটি আছে। আর অযথা কলমের টান আছে। গানের কথা খুবই সাধারণ।

‘মাতাল হয়ে রই রে বন্ধু মাতাল হয়ে রই।।

পঙ্ক দেহ বুকে নেবে গো এমন স্বজন কই।।’

পঞ্চম পাতাটা ফাঁকা। ষষ্ঠ পাতায় একটা চারকোনা কিছু আঁকা। পাশে বড় করে লেখা—আরেক জীবন। তারপরের পাতায় লেখা—

প্রতিটি জীবনেরই আরেকটা জীবন আছে। নদীর আছে নদী, পাখির আছে পাখি, মেঘের আছে মেঘ।

মরমি লাইনের কথাবার্তা মনে হচ্ছে। এ লাইনে আমার তেমন আগ্রহ নেই। কিন্তু এই পাতার একেবারে শেষ লাইনটা ছোট্ট ধাক্কা দেয়। বড় করে লেখা—

তাহলে কি পৃথিবীরও আরেকটা পৃথিবী আছে?

এটা তো এখন বিজ্ঞানও বলছে, না?

বিজ্ঞান যে বলছে, আমি তা জেনেছি রুনার কাছ থেকে। সারা দিন ওটিটিতে সাইফাই মুভিগুলো দেখে। প্যারালাল ওয়ার্ল্ড নিয়ে হাউকাউ করে।

আমি বলি, দুনিয়ায় সবকিছুরই বুজরুকি আছে। বিজ্ঞানের থাকবে না কেন? প্যারালাল-আনপ্যারালাল এগুলো হলো বিজ্ঞানের বুজরুকি।

রুনা শক্ত চোখে তাকিয়ে থাকে খালি। তার ওটিটি মিথ্যা হবে, এমন বিশ্বাস সে করে না।

ফলে খাতাটা তাকে ফেরত দিই। বলি, ‘তুমি হয়তো লোকটার সাথে দেখা করলে খুশি হতে। তোমার মতোই আউলবাউল ভাবতে পারত!’

রুনা খাতা রেখে দেয়। তার মনোযোগে আলমারি।

করলা খাওয়ায় মুখটা তিতা হয়ে আছে। মোড়ের শেষ মাথায় যে চাচার দোকান, সেখানে পান বিক্রি করে। কিন্তু রাত ১১টায় সে দোকান খোলা থাকার কোনো কারণ নেই। আমি তিতা মুখ নিয়েই ঘুমাতে যাই। রুনা বলে, ‘তোমার দাদা যে বিজ্ঞানীও ছিল, বলো নাই তো!’

‘ছিল নাকি?’ একটু অবজ্ঞা বেরিয়ে আসে সুরে। ‘তা কী বানাইছেন তিনি? গানের রেকর্ডার?’

‘শুধু কিছু বানাইলেই বিজ্ঞানী? চিন্তায় বিজ্ঞানী হওয়া যায় না?’

রুনা মনে হচ্ছে সিরিয়াস। বলি, ‘শোনো, তাকে নিয়েও নানা বুজরুকি চালু আছে। পৌষের এক ভোরে নাকি তিনি ইচ্ছামৃত্যু নিছিলেন...আব্বাকে তামাক সাজাতে বলেছিলেন মাঝরাতে। সেটা টেনে নাকি বলেছিলেন, আজকে আমি চলে যাব। তোমাদের কারও সাথে দেখা হবে না... ব্লা ব্লা ব্লা... ভোর থেকে নাই।’

রুনা বলে, ‘কই গেছিলেন?’

‘আব্বারা বলে যে গায়েব হয়ে গেছিলেন। আসলে তো তা না...পালায়ে গেছিলেন। আমার ধারণা, তার কোনো বড় ধারদেনা হইছিল, সেইটা শোধ করতে না পেরে হাওয়া...’

‘তিনি যাওয়ার পর কেউ ধারদেনার ব্যাপারে তোমার আব্বাদের কিছু বলেনি?’

‘মানে?’

‘মানে তিনি চলে গেলেই তো আর পাওনাদার চলে যাচ্ছে না। সে নিশ্চয় তোমাদের কাছে তার পাওনা চাইত, তা–ই না?’

আমার এসব উত্তর জানা নেই। বলি, ‘ঘুমাও। এত রাতে এই সব কাসুন্দি ঘাঁইটো না তো!’

‘তোমার দাদার খাতাটা কালকে দেখো। ভিঞ্চির খাতাগুলো দেখছ না নেটে...কত আঁকিবুঁকি...! ভেতরটা ওই রকম ড্রয়িংয়ে ভরা!’

‘কী আঁকছে, উড়োজাহাজ না পানিজাহাজ?’ আবারও অবজ্ঞা বেরিয়ে আসে।

রুনা শক্তমুখে বলে, ‘না। আলমারি।’

তা গোটা দশেক আলমারি যে দাদা এঁকেছেন, এটা সত্যি। পাশে পাশে আবার নানান হিসাব-নিকাশ। দাদা গান বাঁধতেন, এ পর্যন্ত নেওয়া যায়; দাদা পাগলও ছিলেন, এটা নেওয়া কঠিন হয়ে যায়।

আমি বলি, ‘তাইলে কী? খাতাটা ফেলবা না, তা–ই তো?’

রুনা বলে, ‘তোমার মতো ইডিয়ট সত্যিই আছে কি না, কে জানে! আর কিছু না হোক, পূর্বপুরুষের স্মৃতি হিসেবে তো রাখবা নাকি?’

রাতে করলা খাওয়া ঠিক হয়নি। সকালেও মুখটা তিতা হয়ে থাকে। অগত্যা বলি, ‘রাখো।’

মিজানুর চলে আসে। তার প্রথম কাজ ঘাড়ভাঙা আলমারিটাকে খুলে ফেলা। ছেনি–হাতুড়ি দিয়ে ধুমধাম শুরু হয়ে যায়৷ আমি অফিসের উদ্দেশে বেরিয়ে জানে বাঁচি।

বিকেলে ফিরতে আলমারির একপাশটা খোলা হয়েছে শুধু। মিজানুর খুবই বিরক্ত। আমাকে দেখেই ফিসফিস করে বলে, ‘ভাবি তো কাজই করতে দিতাছে না ভাই!’

‘কেন? কী হইছে?’

‘একটা করে পার্ট খুলি আর ভাবি থামায়া থামায়া একটা খাতা দেইখা কী যেন কী করতে থাকে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা চইলা যায়।’

রুনা এসে স্বাভাবিক কণ্ঠে বলে, ‘চা খাবা?’

রুনার কণ্ঠ স্বাভাবিক হলেও চোখের দৃষ্টি সুবিধার না। কেমন একটা উদ্‌ভ্রান্ত ভাব। মিজানুরকে বলি, ‘তুমি কাইল আইসো। আলমারি খুলে পুরোদমে কাজ শুরু করে দিয়ো।’

মিজানুর উত্তর না দিয়ে চলে যায়। বারান্দায় গিয়ে দেখি, আলমারির মাত্র দুটি দিক খোলা হয়েছে। মিজানুরের বিরক্তি আমার ভেতরেও উথলে ওঠে, ‘তুমি কী? ছেলেটাকে তো কাজই করতে দাওনি দেখা যায়!’

রুনা বলে, ‘বলছিলাম না তোমার দাদা বিজ্ঞানী ছিল। দেখো, কী সিস্টেমে আলমারিটা বানাইছে। এতে অন্য রকম হিসাব-নিকাশ আছে, বুঝলা?’

‘কী হিসাব–নিকাশ আছে?’ গলা চড়িয়ে দিই আমি। রুনা রাগটা ধরতেই পারে না। বলে, ‘আরে, তা আমি ঠিক জানি নাকি! কিন্তু জানার চেষ্টা তো করা যায়, তা–ই না?’

রুনা খাতা নিয়ে আবার বসে যায়। আমি যাওয়া ধরলে একবার তাকিয়ে বলে, ‘শোনো, মিস্ত্রিকে কালকে আসতে বইল না তো...আগে আমি একটু দেখি।’

কামাল ভাই আমার অফিসের বড় ভাই-কলিগ। হেসে বলে, ‘আপনি তো শান্তিতেই আছেন, মিয়া। আর যা–ই হোক, টিস্যু কিনতে হয় না। থাকুক না আলমারি নিয়া। চা খান।’

আমি বলি, ‘তিন দিন ধরে ভাই এই এক আলমারি নিয়েই আছে। রাতে আমার দাদার গল্প আমাকেই শোনায়। সে কত বড় চিন্তক, কত বড় ইয়ে...এই সব। আরে, আমি তো জানি সে কে...এক দাগে চুয়াল্লিশ বিঘা জমি জাল হইছিল আমাদের, সে কিছুই করতে পারে নাই। ওই জমিগুলা থাকলে আমাকে চাকরি করে সংসার চালাতে হয়?’

‘আরে, আপনি তো দেখি খুবই সিরিয়াস হয়ে গেছেন! প্রেগন্যান্সির এই সময় একটু অস্থির কাটে রে ভাই...এত অল্পে মাথা খারাপ কইরেন না!’

আমি চা খাই। স্বস্তি পাই না। সন্ধ্যায় রুনাকে নিয়ে চিকিৎসকের কাছে যাই। চিকিৎসক চেকআপ করেন। সব ঠিক আছে বলে খুশি হন। এসিডিটির অসুবিধাটাও যে কমে গেছে, তাতে দাঁত বের করে ফেলেন। আমাকে বলেন, ‘আপনি যে ওনাকে ভালোমতো সময় দিচ্ছেন, দেখেই বোঝা যাচ্ছে। এ সময় এমন সময় দিতে পারাটাই গুরুত্বপূর্ণ। আর তো কয়টা দিন...হাসিখুশি থাকেন দুজন।’

এরপরের অংশটা চমৎকার। আমরা এবার আয়াসকে দেখতে পাই। মায়ের পেটের ভেতর সে শুয়ে আছে। মাঝেমধ্যেই ঝটপট করছে। চিকিৎসক খুব মায়া নিয়ে বলেন, ‘এই তো বাবু, আর কয়টা দিন পরেই তুমি বেরিয়ে আসবে। মায়ের কোলে উঠবে, বাবার কোলেও উঠবে। আমার কাছেও একটু এসো।’

ঝপ করে চোখে পানি চলে আসে। রুনা আমার হাত আঁকড়ে ধরে। তার নখ বসে যাচ্ছে আমার চামড়ায়। অথচ আমার খুশি লাগছে। আমি বোধ হয় একটু ফুঁপিয়েও উঠি।

এ নিয়ে পরে রুনা খুব হাসি–তামাশা করে। ফোনে ফোনে বন্ধুদের জানায় আমাদের ছেলেটাকে দেখে তার পাথরবাবা কীভাবে কান্নাকাটি করেছে। আমার একটুও মেজাজ খারাপ হয় না। আমি রান্না করে ফেলি কচুর লতি। ভেজালের রান্না, কিন্তু রুনার প্রিয় বলে রাঁধতে আনন্দ হয়। রাতটা কেমন চাঁদরাতের মতো হয়ে যায়। আমরা অনেকক্ষণ ঘুমাই না। বারান্দায় বসে থাকি। আমাদের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে আলমারিটা। আমি বলি, ‘কালকে মিজানুরকে ডাকি...ও কাজ শুরু করে দিক...’

রুনা হাসে। বলে, ‘এইটা থাক। দাদার আলমারিটা নষ্ট করতে ইচ্ছা করছে না। আমি দুপাশটা আটকে দেব। তুমি চিন্তা করো না...আয়াস তখন হাসছিল, না?’

আমি রুনাকে একটু আদর করে দিই। বলি, ‘তুমি হাসলেই ও হাসে, জানো তো!’

রুনা হাসে। হয়তো তখন আয়াসও হাসে। রাতটা মখমলের মতো হয়ে ওঠে।

তিনটা দিন বাতাসেই কাটে। কিন্তু এরপরেই রুনার মাথায় আবার আলমারি অথবা দাদা অথবা প্যারালাল দুনিয়া ফিরে আসে। খেতে খেতে জিজ্ঞাসা করে, ‘আচ্ছা, এমন কি হতে পারে, তোমার দাদা আসলে গায়েব হয়ে যায়নি?’

আমার খাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। বোঝার চেষ্টা করি রুনা কী বোঝাতে চাচ্ছে। চিকিৎসক বলেছেন এ সময় সবকিছু খুব সূক্ষ্মভাবে সামলাতে। হালকা গলায় বলি, ‘আমিও তো বলি গায়েব হন নাই। পালিয়েছে। অন্য কোথাও...অন্য কোনো জেলায়। তারপর তো আব্বারা দেশভাগের পর এদিকে চলে আসল। দাদা নিশ্চয় ওই দিকেই থেকে গেছে। কে জানে হয়তো আরেকটা সংসারও করেছে। কবি মানুষ ছিল, কিছু বলা যায় না।’

এরপর অযথা টেনে টেনে হাসি। রুনা তাকিয়ে থাকে বড় বড় চোখ নিয়ে। বলে, ‘দেশভাগের অনেক আগে কেউ যদি দেশভাগ নিয়ে বলত, তখন মানুষ কেমন রিঅ্যাক্ট করত বলে তুমি মনে করো? কেউ যদি বলত, পাশাপাশি দুইটা দেশ থাকবে এরই মধ্যে! কেউ থাকবে এদিকে, কেউ থাকবে ওদিকে...একটা দেশেরই দুইটা রূপ...প্যারালাল দুইটা দেশ হয়ে যাবে...তখন নিশ্চয় অনেকেই ভাবত এই সব বুজরুকি, তা–ই না?’

এবার আমার একটু রাগই হয়। বলি, ‘তুমি কী বলতে চাইছ? দেশভাগ হয়ে দুইটা দেশ হলে প্যারালাল জগৎ হয়ে যায়? এইবার একটু সাইফাই দেখা বন্ধ করো, প্লিজ।’

রুনা বলে, ‘স্থান ভাগ হতে পারলে সময় ভাগ হতে পারে না?’

আমি বলি, ‘দেখো, এত বিজ্ঞান তো আমি বুঝি না। এটুকু বুঝি, তুমি একটু বেশিই বুঝতে চাইতেছ। দয়া করে এই সব ভাবনাকে বন্ধ রাখো। আয়াসের ব্যাপারে মনোযোগ দাও।’

রুনা আমার কথার ধার দিয়েও যায় না। বলে, ‘সময়ও তো ভাগ হতে পারে। হতে পারে কি, হয়ই। সময়টা কী, আমরা কি এখনো বুঝতে পেরেছি পুরাটা? যারা পেরেছে, তারা নিশ্চয় অন্য জীবন যাপন করেছে, তা–ই না?’

‘আর সেটা কারা বুঝতে পেরেছে, আমার দাদা? ফ্রড একটা লোক সে...নিজের রক্ত বলেই বলিনি কথাটা এত দিন। বাড়ির সবাইকে ডুবিয়ে পালিয়ে যাওয়া মানুষ সে।’

‘যদি তিনি ঠিক পালিয়ে না যান? যদি প্যারালাল জগতে যাওয়ার উপায়টা উনি জেনে থাকেন?’

‘আর সেটা তিনি কীভাবে গিয়েছিলেন? মন্ত্র পড়ে? অং বং চং!’

‘যদি ওই আলমারি সেই বর্ডার হয়? ভিসা পাসপোর্ট না, ওখানে অন্য কিছু চলে...ধরো কোনো কৌশল। ধরো বিশেষ কোনো সময়...সুনির্দিষ্ট। তোমার দাদার খাতায় পৌষ মাস নিয়ে অনেক কাটাকুটি হিসাব আছে। পঞ্জিকার পাতা কেটে বসানো আছে!’

‘শুধু পঞ্জিকা না, ভালো করে দেখলে নিশ্চয় গঞ্জিকার পাতাও দেখতে পাবে ওইখানে...’

খাওয়া শেষ হয় না আমার; কিন্তু আর খেতেও ইচ্ছা করে না। উঠে যাই আমি।

মধ্যরাতে ঘুম ভাঙে ভীতিকর চাপা গোঙানিতে। চোখ মেলে দেখি বিছানার মাঝে স্থির বসে আছে রুনা। চোখ ফেটে পানি গড়াচ্ছে। মুখটা ব্যথায় ভরা।

এমন রুনাকে আমি আগে কখনো দেখিনি; এমন বিভীষিকার রাত আগে কখনো আসেনি।

আয়াসের শ্বাসনালিতে কিছু একটা হয়েছিল বলে জানিয়েছিলেন চিকিৎসক। মারা সে পেটের ভেতরেই গিয়েছিল কয়েক ঘণ্টা আগে। তারপর রক্তপাত। আমরা আয়াসকে শুধু কবর দিয়ে আসতে পারি। একটা প্রায় পূর্ণ হয়ে ওঠা শিশু। রুনা কাঁদে না, আমি কাঁদি না। কিন্তু আমরা দিনের পর দিন কথা না বলে দিন পার করে দিতে পারি। আমরা কথা বলি না এ জন্য না যে দুজনের ওপর রাগ করে আছি; আমরা কথা বলি না, কারণ, আমাদের কথা বলার কোনো প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয় না।

কয়েক মাস কেটে গেলে রুনা গভীর রাতে আমাকে ডাক দেয়। আমি উঠে আসি। আমরা কফি খাই। তারপর বারান্দায় আলমারির সামনে গিয়ে বসি। রুনা আমার হাতটা ধরে থাকে। পৌষের শীত শীত রাত। রুনার হাত হিম হয়ে আসে।

আমরা ভোরের অপেক্ষা করি। ওপারে একটা জগৎ আছে বলে আমরা বিশ্বাস করি। আমরা এ–ও বিশ্বাস করি, আয়াস সে জগতে রয়েছে। এখন তার বয়স দুই মাস। কোনো এক স্ট্রলারে বসে সে নিশ্চয় হাসছে। আমরা তার হাসিটা দেখতে চাই। একবারের জন্য হলেও।

ঠান্ডা বাতাস হচ্ছে, ভোর হচ্ছে, আর আমরা অপেক্ষা করছি একটা বিশেষ সময়ের। খুব নির্দিষ্ট একটা সময়ের। রুনার নখ আমার চামড়ায় বসে যাচ্ছে।