মোবাইল ফোনের ঘড়ির দিকে তাকাল রিফাত। রাত দশটা। আরও ঘণ্টাখানেক পর দোকান বন্ধ করবে ও। এই বেকারি প্লাস স্টেশনারি দোকানের কয়েকজন বাঁধা খদ্দের আছেন, যাঁরা এ সময় আসেন। এক জাহেদ সাহেবই একগাদা জিনিস কেনেন।
কিন্তু আজ ধৈর্যে কুলাচ্ছে না। দুদিন ধরে পিঠব্যথা ওর। রাত জেগে ফেসবুক নিয়ে পড়ে থাকার ফল।
ফেসবুক খুললে দিনদুনিয়া ভুলে যায় রিফাত। এমনই নেশা! সেদিন ঘটে গেছে কেলেঙ্কারি। ফজল মামা ফজরের নামাজ শেষে হাঁটতে বের হন। যেতে হয় ওর ঘরের সামনে দিয়ে। মোবাইল হাতে ভাগনেকে দেখে দাঁড়িয়ে গেলেন।
‘কিরে, এত ভোরে কার সঙ্গে কথা বলিস?’
‘এক বন্ধু কল দিয়েছে, মামা।’
রিফাত বলল বটে, কিন্তু ওর জড়তা দেখে মামা বুঝে গেলেন যা বোঝার। বললেন, ‘রাত জেগে এসব না করলে কি হয় না?’
মামা কম কথার মানুষ। ঠান্ডা স্বভাবের। তবে ভেতরটা কঠিন। রিফাত জানে, বারবার এমন করলে মামার বাসায় ঠাঁই হবে না। তাই কাল রাতে আর জেগে থাকেনি। কিন্তু পিঠের ব্যথাটা যে যাচ্ছে না।
গ্রামের ছেলে রিফাত। বাবা নেই। কিছু জমি আছে। তাই দেখাশোনা করে মা ওদের বড় করছেন। রিফাতের ছোট দুটি ভাইবোন আছে। ওরা মায়ের কাছেই থাকে। এইচএসসি পাস করে রিফাত ঢাকায় এসেছে। ফজল সাহেব ওর আপন মামা নন। মায়ের চাচাতো ভাই। বিদ্যুৎ অফিসের সুপারভাইজার। পাশাপাশি এই দোকানটা রয়েছে। দিনে কলেজ করে রাতে এই দোকানে বসে রিফাত। এ ছাড়া এই দুর্মূল্যের বাজারে ওর মতো একটা ধামড়াকে সহ্য করবে কে?
রিফাতের রেজাল্ট কিন্তু ভালোই। ভেবেছিল, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারবে। কিন্তু হয়নি। শেষে তেজগাঁও কলেজে অনার্সে ভর্তি হয়েছে। কিন্তু পড়াশোনা তো কিছুই হচ্ছে না। মাকে পটিয়ে জমিটমি বেচে বিদেশ যাবে কি না, ভাবছে। ঢাকা শহর চকমকির আজব দুনিয়া। এখানে আসার পর থেকে বড়লোক হওয়ার একটা অদম্য ইচ্ছা মাথা কুটে মরছে।
জাহিদ সাহেব এসে রিফাতের ভাবনার রেলগাড়ি থামিয়ে দিলেন। পাউরুটি, জেলি, বিস্কুট, মোমবাতি, সাবান—একগাদা জিনিস নিলেন তিনি।
এরপর এলেন রহমত বকশি। এই লোক দুদিন পরপরই একগাদা করে টিস্যু পেপার কেনেন। এত টিস্যু দিয়ে কী করেন, তা কে জানে।
আরও কয়েকজন খদ্দের চলে যাওয়ার পর রিফাত দোকান যেই বন্ধ করতে যাবে, এমন সময় এল সেই আজব লোকটা।
না, লোকটা দেখতে কিন্তু মোটেও কিম্ভূত নয়। সাদাসিধে চেহারা। রোগাটে শরীর। চোখের দৃষ্টি সরল। কথায় একধরনের মাদকতা আছে। রিফাত নিশ্চিত, এই লোক ওর পাশে বসে কিছুক্ষণ একটানা কথা বললে ওর ঘুম চলে আসবে।
এই লোক কোথায় থাকে কে জানে? এখানে সে নিয়মিত আসে না। হুট করে উদয় হয়। আর তা এমন ঝিম ধরা রাতেই। রিফাত খেয়াল করেছে, মাস ছয়েক ধরে আসছে লোকটা। এ নিয়ে চৌদ্দ-পনেরোবার হবে। আর প্রতিবারই সে ডিম কেনে।
আজও এক ডজন ডিম চাইল লোকটা। উদাস একটা ভাব নিয়ে বলল, ‘খাওয়ার মধ্যে তো শুধু এটাই খাওয়া যায়!’
‘জি, তা ঠিকই বলেছেন।’
লোকটার সঙ্গে খাতির জমানোর চেষ্টা করে রিফাত। তার মধ্যে একটা রহস্য আছে। একটা প্রশ্ন খুব তড়পায় ওর মনে। রিফাত খেয়াল করেছে, এই লোকটা যখনই আসে, দোকান থেকে কিছু না কিছু খোয়া যায়। আর যে জিনিস খোয়া যায়, সেটা এই লোকের হাত বাড়িয়ে নেওয়া সম্ভব নয়। আসলে খোয়া যায় না বলে বলা উচিত অদৃশ্য হয়ে যায়। এটা কীভাবে সম্ভব?
এর আগে শেষবার যখন লোকটা এসেছিল, তখন তাক থেকে ছোট একটা চর্টলাইট হাওয়া। অথচ এর মিনিটখানেক আগেও টর্চটা দিব্যি ওখানে ছিল! দেড় শ টাকা ওটার দাম। জিনিস অদৃশ্য হওয়ার এই রহস্য জানতে হবে।
শিরশিরে একটা অনুভূতি নাড়া দিচ্ছে রিফাতকে। অদ্ভুত এক রোমাঞ্চ। পারলে লোকটাকে আটকে দোকানের ভেতর নিয়ে আসে ও। কিন্তু কোনো জোরাজুরি নয়। আলাপ জমাতে হবে।
যেন কত দিনের খাতির—এমন একটা ভাব নিয়ে রিফাত বলল, ‘এখন তো তবু ডিম খেতে পারছেন, কিছুদিন পর হয়তো এসবও আমাদের জুটবে না।’
‘আপনার কথা একদম ঠিক। মানুষ বাড়ছে, কী করবেন? এখন আমাদের বসতি বাড়াতে হবে। যেতে হবে ভিনগ্রহে।’
‘ভিনগ্রহে যেতে পারলে তো ভালো। অবশ্য তা হতে হবে বাসযোগ্য তেমন গ্রহ। কিন্তু এটা কি আদৌ সম্ভব?’
‘এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড আজব কারখানা। এখানে অসম্ভব বলে কিছু নেই।’
‘কিছু যদি মনে না করেন, একটা কথা জিজ্ঞেস করব?’
‘একটা কেন, একশটা করুন।’
‘আমি খেয়াল করেছি, যখনই আপনি আসেন, আমার দোকান থেকে কিছু না কিছু খোয়া যায়। এটা কীভাবে সম্ভব?’
নিমেষে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল লোকটার চেহারায়। সরলতা মুছে গিয়ে আদিম এক বুনো ভাব ফুটে উঠল তার মাঝে। ভয়ে কুঁকড়ে গেল রিফাত। মনে হলো যেন এখনই কিছু একটা ঘটবে।
না, কিছুই ঘটল না। লোকটা আবার ফিরে এল স্বাভাবিক চেহারায়। বলল, ‘আপনি ঠিকই বলেছেন। এক দিন এক প্যাকেট বিস্কুট, আরেক দিন ক্যান্ডির প্যাকেট, অন্য দিন ফুল সাইজের একটা পাউরুটি—এমন অনেক জিনিসই অদৃশ্য হয়েছে। ঠিক কি না?’
‘আপনি তো তাহলে সবই জানেন।’
‘জানি বৈকি। এসব তো আমার কারণেই ঘটেছে।’
‘কেন? কীভাবে?’
‘আমি আসলে একটা এক্সপেরিমেন্ট চালাচ্ছিলাম। ভেবেছিলাম, আরও কয়েকটা দিন এই কাজ করব। কিন্তু ধরা যখন পড়েছি, এখানে আর পরীক্ষা চালানো যাবে না। আপনি আমার দেখাও আর পাবেন না।’
‘কিন্তু আমার প্রশ্নের কোনো জবাব তো পেলাম না।’
‘জিনিসগুলো অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার বিষয় তো? এর জবাব পেতে হলে আপনাকে একটা প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে।’
‘বলুন কী প্রশ্ন?’
‘আপনি কি ভিনগ্রহে যেতে ইচ্ছুক।’
‘দেখুন, ভালোভাবে খেয়ে-পরে বাঁচতে আমি সৌরজগতের যেকোনো জায়গায় যেতে রাজি।’
‘তাহলে অপেক্ষা করুন। সুযোগ আসবে। আর একই সঙ্গে আপনার প্রশ্নের জবাবও পেয়ে যাবেন। জানতে পারবেন জিনিসগুলো অদৃশ্য হওয়ার রহস্যটা আসলে কী।’
এই বলে ঘুরে দাঁড়াল লোকটা। কয়েক কদম গিয়ে ফিরে এল। বলল, ‘ও হ্যাঁ, আপনার দোকান থেকে এত দিন যেসব জিনিস নিয়েছি, তার দাম হিসাব করে রেখেছি। এই নিন।’
৫০০ টাকার একটা কড়কড়ে নোট রিফাতের দিকে বাড়িয়ে ধরল সে। রিফাত নিল নোটটা। লোকটা বলল, ‘বিশ টাকা ফেরত পাব। কিন্তু লাগবে না।’
এই বলে পাঁই করে ঘুরে হনহনিয়ে হাঁটতে লাগল সে। দেখতে দেখতে মিলিয়ে গেল।
লোকটা আসলে কে, কী আছে তার মধ্যে—এ নিয়ে ভাবতে ভাবতে দুটো দিন অদ্ভুত এক ঘোরের মধ্যে কাটাল রিফাত। তারপর থেকে ধীরে ধীরে কেটে যেতে লাগল এই ঘোর।
আরও কয়েক দিন পর একদিন খুব ঝেঁপে বৃষ্টি নামল। ঢাকা শহরের রাস্তাঘাট সব সয়লাব। রিফাতের কাছে অসহ্য মনে হলো এই মহানগর। ভাবল, সেই কলেজেই যখন পড়ছে, তখন আর এখানে পড়ে থেকে কষ্ট করা কেন?
গ্রামে ফিরে যাবে ও। কিলো পাঁচেক দূরের মফস্বলের কলেজে ভর্তি হবে। সেখানেও অনার্স পড়া যাবে। বাড়ির ভাত খেয়ে পড়বে। সাইকেল মেরে দু-তিনটে টিউশনি করলে দিব্যি চলে যাবে ওর।
ঝুমবৃষ্টির কারণে সেদিন দোকান বন্ধ করতে একটু দেরি হয়ে গেল। রাত ১২টার দিকে দোকান থেকে বেরোতে পারল রিফাত। তখনো ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। ছাতায় ফুটো থাকায় খানিকটা ভিজেও গেল ও।
তেজতুরী বাজারে মামার বাসার সামনে এর মধ্যে হাঁটুপানি জমে গেছে। এই নোংরা কালো পানি ভেঙে যাওয়া কি সহজ কথা? একটা রিকশাও নেই কোথাও। রাস্তা পুরোটাই জনমানবহীন। খেয়েদেয়ে কার কাজ পড়েছে এই ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে ভিজতে?
‘পানি পার হবেন? আসেন এই দিকে।’
কেউ যেন ডাকল রিফাতকে। কিন্তু কোথায়? একটু ভয় ভয়ও করছে। অশরীরী কিছু নয় তো?
রিফাত কাঁপ ধরা গলায় বলল, ‘কে ডাকছেন, ভাই? আপনি কোথায়?’
‘এই যে এদিকে।’
কাছেই একটা সেলুনের ছাউনির নিচে দেখা গেল ছায়ামূর্তি। পরিষ্কার বোঝা গেল না। সেলুনের শাটারে তালা মারা। ছাউনির নিচে বাল্বটা জ্বলছে না। হয়তো ফিলামেন্ট কেটে গেছে। স্ট্রিট লাইটের আলোয় কে বা কী—বোঝার উপায় নেই।
‘আরে ভাই, আসেন না। ভয় কী?’
তার কথার মধ্যে যেন জাদু আছে। সম্মোহিত বালকের মতো এগোয় রিফাত। একটা আজব ধরনের চেয়ার রয়েছে সেখানে। দেখতে অনেকটা সেলুনের চেয়ারের মতো। তবে ওপরে একটা স্ট্যান্ডের মধ্যে হেলিকপ্টারের মতো পাখা। চেয়ারের নিচে কী সব যন্ত্র লাগানো! চেয়ারের পেছনে একটা লোক দাঁড়িয়ে। রিফাতকে তাড়া দিল সে, ‘দাঁড়িয়ে থেকে সময় নষ্ট করবেন না। এখানে বসুন। আপনাকে পার করে দিচ্ছি।’
রিফাতের মনে হলো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একটা স্বপ্ন দেখছে ও। দুঃস্বপ্ন বলা যাবে না। বরং অদ্ভুত স্বপ্ন বলা যায়।
লোকটা তাড়া দিল, ‘আরে ভাই, দাঁড়িয়ে কেন? বসুন না। সময় নেই।’
রিফাত মোহাবিষ্টের মতো বসল ওই চেয়ারে।
আদেশের মতো শোনা গেল, ‘হ্যাঁ, হাতল দুটো এবার শক্ত করে চেপে ধরুন।’
রিফাত তাই করল। মৌমাছির গুঞ্জনের মতো একটা শব্দ হলো। কেঁপে উঠল চেয়ারটা। মাথার ওপর বনবন ঘুরতে লাগল পাখা। চেয়ারটা শাঁ করে উঠে যেতে লাগল শূন্যে। চেয়ারের হাতল দুটো শক্ত করে ধরে রইল রিফাত। এ যেন আলাদিনের চেরাগের জাদু! দেখতে দেখতে অনেক উঁচুতে উঠল চেয়ার। নিচের দিকে একবার তাকিয়ে আতঙ্কে চোখ বুজে ফেলল ও। ভয়কাতুরে গলায় বলল, ‘আপনি কে ভাই? আমাকে এভাবে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?’
কিন্তু কোনো জবাব নেই।
মিনিট কয়েক পর চেয়ারটা নামতে শুরু করল। পতন বলে কথা। বুক আর পেটের ভেতর ভয়ানক শিরশিরে এক অনুভূতি। যেন এখনই দমটা বেরিয়ে যাবে। ঠকাস! মৃদু একটা ঝাঁকুনি দিয়ে থেমে গেল চেয়ার। থামল পাখা। থামল মৌমাছির গুঞ্জনও।
রিফাত চোখ মেলে দেখে, অচেনা এক বাড়ির ছাদে এসে নেমেছে। সামনে কে একজন। ভালো করে তাকাতেই চোখ দুটো ভিরমি কা লাড্ডু। ওর দোকানের সেই আজব খদ্দের। যে এলে একটা না একটা জিনিস অদৃশ্য হয়ে যায়।
‘আপনি এখানে এলেন কীভাবে?’ জানতে চাইল রিফাত।
‘আরে, আমিই তো আপনাকে উড়ুক্কু চেয়ারে করে এখানে নিয়ে এলাম। টের পাননি?’
‘মোটেও না। তা—আমাকে এভাবে পাকড়াও করার কারণ কী? আর ওই উড়ুক্কু চেয়ারটাই বা পেলেন কোথায়?’
‘আপনাকে খুলেই বলি। আমি একদল এলিয়েন, মানে ভিনগ্রহের বাসিন্দাদের হয়ে কাজ করছি। ওরাই আমাকে দিয়ে এভাবে লোকজন জোগাড় করছে ওদের দেশে নিয়ে যাওয়ার জন্য। আপনি সেদিন আগ্রহ দেখালেন না? এ জন্যই তো আপনাকে নিয়ে এলাম। ওদের গ্রহটা খুব ছোট, তবে অনেক সুন্দর। আপনি যা চান, চট করে পেয়ে যাবেন। কেবল একটা পরিবর্তন আনতে হবে।’
‘পরিবর্তন?’
‘হ্যাঁ, আসুন আমার সঙ্গে। সব দেখতে পাবেন।’
লোকটার সঙ্গে সিঁড়ি ভেঙে নিচে একটা ঘরে চলে এল রিফাত। গাঢ় কাচ দিয়ে ঘেরা একটা হলঘর। ভেতরে আজব কিছু প্রাণী। তারা বিভিন্ন কলকবজা নিয়ে যে যার মতো মশগুল। মানুষের মতো দৈহিক গড়ন হলেও হাত-পা আর চেহারায় অনেক তফাত। লোকটা বিদঘুটে ভাষায় একজনকে ডেকে পরিচয় করিয়ে দিল। হেসে হেসে আরও কী সব বলল, এক বর্ণও বুঝতে পারল না রিফাত। বেশির ভাগ শব্দ গলার একেবারে ভেতর থেকে আসে।
রিফাত বুঝতে পারল, এই বিটকেলে প্রাণীর নাম ক আর খ-এর মাঝামাঝি কিছু একটা। সে পাশের এক টেবিল থেকে লম্বাটে চ্যাপ্টা একটা বোতল তুলে নিল। ভেতরে কমলা রঙের তরল। একটা আঙুল ছিপি খোলার ধাতব যন্ত্রের মতো পেঁচিয়ে বোতলের মুখ খুলে ফেলল সে। তারপর বোতলটা ধরল রিফাতের সামনে। কাঁচা ডিমের সঙ্গে অন্য একটা রাসায়নিক দ্রব্যের মিশেল উত্কট গন্ধ পেল ও। পেট খিঁচে বমি এল। হাত দিয়ে ঠেলে বোতলটা সরিয়ে দিল রিফাত। মরে গেলেও এটা মুখে দিতে পারবে না।
কিন্তু লোকটা নাছোড়। বলল, ‘আরে, খেয়ে নিন এটা। এসব না খেলে ওই গ্রহের উপযোগী হতে পারবেন না।’
রিফাত বলল, ‘আপনার গোঁয়ার্তুমি অনেক হজম করেছি! ওই গ্রহে আমি যেতে চাই না।’
‘তবে কি এখানে পচে মরতে চান? এই দেশে মানুষ থাকে?’
রিফাত খেপে গেল এবার। ঝাঁজিয়ে উঠে বলল, ‘আরে—যা ব্যাটা, এটা আমার জন্মভূমি। এর চেয়ে ভালো জায়গা আর কোথাও নেই!’
‘ও আচ্ছা, যাবেন না তাহলে! ঠিক আছে, এরাও অনিচ্ছুক কাউকে নিতে আগ্রহী না। ওখানে গিয়ে বিদ্রোহ করলে সেটা আরেক ঝামেলা! চলুন, আপনাকে ফিরিয়ে দিয়ে আসি।’
এ সময় অভাবনীয় এক কাণ্ড ঘটে গেল। রিফাতকে আচমকা চেপে ধরে মুখের ভেতর ওই বিদঘুটে তরল ঢেলে দিল এলিয়েন। রিফাতের প্রথমে মনে হলো যেন ওর মুখের ভেতর কেউ আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। এরপর জিবটা ক্রমে ভারী হয়ে এল। বুজে এল চোখের পাতা।
রিফাত চোখ মেলে দেখে, ফুটপাতে শুয়ে আছে ও। হাত দুয়েক দূরে ঘুমে বিভোর চটের টুকরো জড়ানো সেই পাগলটা, সারাক্ষণ যে বকবক করে। ধড়মড়িয়ে উঠে বসে রিফাত। ভাবতে চেষ্টা করে, এখানে কেন?
এখনো দিনের আলো ভালো করে ফোটেনি। ফজল মামা এই বেশে দেখলে আজই তাড়িয়ে দেবেন। এর আগেই কোনোভাবে বাসায় ঢুকতে হবে।
কিছুদূর এগোতেই রিফাত দেখে, পত্রিকার একটা পাতা পড়ে আছে, যেখানে ওর ছবি। চট করে পাতাটা তুলে ফিকে আলোতে মেলে ধরে ও। পড়া শেষ করে রিফাতের আক্কেলগুড়ুম! ওর রহস্যময় অন্তর্ধান নিয়ে পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে। জঙ্গি সংগঠনে যোগ দিয়েছে, না গুম হয়েছে—এ নিয়ে সংশয় প্রকাশ করা হয়েছে। এর মধ্যে পেরিয়ে গেছে তিন মাস!
বাসায় পা দিতেই হুলুস্থুল পড়ে গেল। কোথায় গেলি, কেন গেলি, কেমন ছিলি—একের পর এক প্রশ্ন। কিন্তু এত প্রশ্নের উত্তর তো ওর জানা নেই। থানায় খবর গেল। পুলিশ এসে নিয়ে গেল ওকে। জিজ্ঞাসাবাদে সন্তোষজনক জবাব না পেয়ে ওকে পুরে দিল হাজতে।
হাজতে বসে অপেক্ষা করছে রিফাত। ওকে আদালতে চালান দেওয়া হবে। শিকের ফাঁক দিয়ে দেখে, চেয়ারে বসে আয়েশ করে শিঙাড়া খাচ্ছেন দারোগা।
পিরিচে একসঙ্গে তিনটা শিঙাড়া। ভারি লোভ হলো রিফাতের। সেই সকাল থেকে এখন এই দুপুর পর্যন্ত পেটে একটুও দানাপানি পড়েনি। তা ছাড়া এই খাবারটা ওর খুব প্রিয়। শিঙাড়া খাওয়ার জন্য মনটা ব্যাকুল হয়ে উঠল রিফাতের। আর তখনই ঘটে গেল কাণ্ডটা। দাঁতের ফাঁক দিয়ে জিবটা সরসর করে লম্বা হয়ে স্যাঁত্ করে তুলে আনল একটা শিঙাড়া। ঘটনাটা এত দ্রুত ঘটল যে দারোগা কিছুই টের পেলেন না। কেবল দেখেন একটা শিঙাড়া ভোজবাজির মতো হাওয়া। বসা থেকে এক লাফে দাঁড়িয়ে গেলেন তিনি।
সেই লোকটার কথা মনে পড়ে গেল রিফাতের। সে দোকানে এলে তাক থেকে জিনিসগুলো অদৃশ্য হতো কীভাবে, রহস্যটা এত দিনে উন্মোচিত হলো।
*লেখাটি ২০১৭ সালে বিজ্ঞানচিন্তার সেপ্টেম্বর সংখ্যায় প্রকাশিত