আত্মার মুক্তি

ভূগর্ভস্থ হিউম্যান নেটওয়ার্কে বিদ্রোহ শুরু হলো হঠাত্। সেদিন রেমি রেসটোরেশন স্লিপে নিমগ্ন হয়ে ছিল। সে জানতেও পারেনি নেটওয়ার্কে কী হুলস্থুল শুরু হয়ে গেছে। ঘটনার দুই দিন আগে অবশ্য তার বন্ধু ও সহচর পাউলো এ রকম কিছু ঘটতে যাচ্ছে বলে খানিকটা আভাস দিয়েছিল। রেমি বিশ্বাস করেনি। এসব ব্যাপারে বেশি কিছু জানার আগ্রহও তার তেমন নেই। কিন্তু পাউলো কয়েক জন্ম আগে একজন ইতিহাসবিদ ছিল। পৃথিবীর দক্ষিণ গোলার্ধের কোনো এক বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস পড়াত পাউলো। সে অবশ্য কয়েক শ বছর আগের কথা। তখনো পৃথিবীর একটা নিজস্ব নীল আকাশ ছিল, ছিল সাদা সাদা মেঘ, সেই পৃথিবীর সবুজপৃষ্ঠে হেঁটে বেড়াত মানুষসহ নানা প্রাণী, আকাশে উড়ে বেড়াত পাখি আর প্রজাপতি। পাউলোই তাকে জানিয়েছিল, আজ থেকে বহু বছর আগে পৃথিবীর সমস্ত ক্ষমতা ও অর্থ কয়েকজন মানুষের কবজায় চলে যায়। তারপর গোটা পৃথিবী কয়েকজন উন্মাদের হাতে জিম্মি হয়ে পড়ে। তাদের আস্ফাালন, ক্ষমতার দম্ভ আর পারস্করিক বিরোধিতা এই চমত্কার মায়াবী গ্রহের ধ্বংসের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কয়েক প্রজন্ম আগে নষ্ট হয়ে যাওয়া সেই গ্রহের সর্বশেষ অধিবাসীদের একজন ছিল পাউলো। কম্কিউটারে মাইন্ড আপলোড করার মাধ্যমে যে প্রজন্ম অবশেষে এই ধ্বংস হয়ে যাওয়া পৃথিবীতেও টিকে থাকে। সেই ফেলে আসা পৃথিবীর জন্য এখনো মন কেমন করে পাউলোর। কখনো দুর্বোধ্য কবিতার লাইন আওড়ায় আপন মনে-

আমরা হেঁটেছি যারা নির্জন খড়ের মাঠে পউষ সন্ধ্যায়,

দেখেছি মাঠের পারে নরম নদীর নারী ছড়াতেছে ফুল

কুয়াশার; কবেকার পাড়াগাঁর মেয়েদের মতো যেন হায়

তারা সব; আমরা দেখেছি যারা অন্ধকারে আকন্দ ধুন্দুল

জোনাকিতে ভরে গেছে; যে মাঠে ফসল নাই তাহার শিয়রে

চুপে দাঁড়ায়েছে চাঁদ—কোনো সাধ নাই তার ফসলের তরে;

পাউলো অবশ্য আবৃত্তির ফাঁকে রেমিকে খড়ের মাঠ, কুয়াশা, আকন্দ আর ধুন্দুল, চকমকি জোনাকি আর থালার মতো গোল সাদা চাঁদের ভিজ্যুয়াল তৈরি করে দিয়েছে স্ক্রিনে। তবু রেমির মাথায় কিছু ঢোকেনি। বরং পাউলোর কাছে পৃথিবীর নানা বর্ণনা শুনে জায়গাটাকে দুর্বোধ্য জটিল কোনো স্থান বলেই বোধ হয় রেমির। তার চেয়ে এখনকার পৃথিবীটাই তো বেশ ভালো। সরল। নিকষ কালো। মাত্রাহীন। সময়হীন। দুনিয়ার গোটাটাই এখন আসলে একটা কম্কিউটার নেটওয়ার্ক। এই কম্কিউটার মানে যন্ত্র নয়। এই যন্ত্রের আছে আত্মা। প্রাণ। বহু বছর আগে, পৃথিবী ধ্বংসের আগেই বিজ্ঞানীরা এই যন্ত্রের সঙ্গে নিজের চেতনাকে সংযুক্ত করতে শিখেছিলেন। এই প্রক্রিয়ার নাম তাঁরা দিয়েছিলেন মাইন্ড আপলোড। তাঁরা ভেবেছিলেন, এই পদ্ধতিতে মানুষ অমর হবে। দেহের মৃত্যু ঘটবে, কিন্তু চেতনার মৃত্যু হবে না। একজন মানুষের চেতনা, চিন্তা, স্বপ্ন, স্মৃতি সব বেঁচে থাকবে তার কম্কিউটারের ড্রাইভে। তাদের বাসনা সফল হয়েছে। মানুষ অমর হয়েছে এই পদ্ধতিতে। কিন্তু অমর মানুষ আটকা পড়ে আছে এই কম্কিউটার নেটওয়ার্কের ভেতর। শত শত নয়, হাজার বছর ধরে। পূর্বপুরুষদের সমস্ত স্মৃতি, সমস্ত বুদ্ধিমত্তা, সমস্ত চেতনা ধারণ করে বেঁচে আছে। নিথর। কায়াহীন। স্বপ্নহীন। উদ্দেশ্যহীন। কেবল বেঁচে আছে।

পাউলো এসব বলতে বলতে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। রেমি ঠিক বুঝতে পারে না কিসে তার এত কষ্ট। মাঝে মাঝে প্রশ্ন করে বসে, ‘কেন পাউলো? তুমি কি এভাবে বেঁচে থাকতে চাও না?’

পাউলো আবার দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে, ‘এটা কি মানুষের জীবন? মানুষ কি যন্ত্রের জীবনে বাস করতে পারে বলো? এর চেয়ে মৃত্যুই ভালো ছিল।’

মৃত্যু! রেমি ভাবে, সেটা কীভাবে আসত? কেমন ছিল তার স্বাদ! তার কম্কিউটার মেমোরি দ্রুত ব্যাপারটার সমাধান দিতে চেষ্টা করে। নাড়িস্কন্দন থেমে যাওয়া, বুকের ধুকপুকানি বন্ধ হয়ে যাওয়া, শ্বাস বন্ধ হয়ে পড়া, মস্তিষ্কের নিউরোট্রান্সমিটারগুলোর চলাচল থেমে যাওয়া আর চোখের মণি বড় হয়ে যাওয়ার নাম মৃত্যু। বেশ, যার দেহ বলতেই কিছু নেই, সে মৃত্যুর স্বাদ কীভাবে পাবে তাহলে? ও জিনিস বুঝে আর কাজ নেই। সে বরং এই জীবনে বেশ অভ্যস্ত। তাদের এই পৃথিবীর কোনো দৈর্ঘ্য প্রস্থ নেই। এখানে কোনো সময় নেই। রাজা নেই, প্রজা নেই। যুদ্ধ নেই, শান্তি নেই। এখানে ঝড় ওঠে না, ফুল ফোটে না। যদিও চাইলে যে কেউ যার যার ইচ্ছেমতো ভার্চ্যুয়াল জগত্ তৈরি করে নিতে পারে নিজের চারদিকে। প্রথম প্রথম সবাই এই কল্পনার জগত্ তৈরিতেই মেতে ছিল। তারপর সেটাও একসময় একঘেয়ে আর পানসে হয়ে গেল। আজকাল তাতে কেউ মজা পায় না। তাই এখন সবাই চুপ করে বেঁচে থাকে। কেবল নিস্তরঙ্গ বেঁচে থাকে।

অথচ ভেতর ভেতর অনেক কিছু পাল্টে যাচ্ছিল। কী আশ্চর্য! রেমি কিছু বুঝতেই পারেনি। রেসটোরেশন স্লিপের সময় সে নিজেকে শাটডাউন করে ঘুমিয়ে ছিল। ওদের জন্য এটা জরুরি। কেননা এ সময় তাদের নেটওয়ার্ক শত শত বছরের মেমোরি ঝালাই করে। কিছু অপ্রয়োজনীয় অংশ ছাঁটাই করে। অনেক সময় নতুন কোনো ইনপুট সেভ করা হয় এ সময়। তাই তাদের মাঝে মাঝে রেসটোরেশন স্লিপে যেতে হয়। তা ছাড়া এই ঘুমিয়ে থাকার সময়টাতে একঘেয়েমিও কিছুটা কাটে। তো ঘুম থেকে জেগে রেমি টের পায় কিছু একটা ঘটেছে। নেটওয়ার্কের সর্বত্র একটা অস্থিরতা। সে পাউলোর সঙ্গে যোগাযোগ করতে চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। পাউলো নিজেকে ডিসকানেক্ট করে রেখেছে। এটা অসম্ভব একটা ব্যাপার। কেননা বর্তমান বিশ্বে নিজেকে মূল নেটওয়ার্কের বাইরে রাখার কোনো সুযোগ নেই। রেমি ভয় পেয়ে যায়। বিশেষ করে পাউলোর আগের কথাগুলো চিন্তা করে সে বিমূঢ় হয়ে পড়ে।

দুই সপ্তাহ আগে পাউলো একদিন হঠাত্ অদ্ভুত একটা প্রশ্ন করে বসেছিল, ‘আচ্ছা রেমি, তোমার কি ব্যক্তিগত স্বপ্ন বা আকাঙ্ক্ষা আছে?’

চমকে গিয়েছিল রেমি। ব্যক্তিগত? ব্যক্তি কোথায়? তারা তো একটা সমষ্টি। সবাই মিলে একটা সুপার কম্কিউটার। এই পৃথিবীর শত শত হাজার হাজার বছরের স্মৃতি আর ইতিহাস আর চেতনা ধারণ করে আছে যে সুপার কম্কিউটার। তারা একেকজন তার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশ।

পাউলো হাসির মতো একটা শব্দ করে, ‘আমারও তা-ই ধারণা ছিল এত দিন। কিন্তু আমি, আমরা নতুন কিছু জেনেছি।’

‘আমরা মানে? তোমার সঙ্গে আর কে আছে?’ আরও ভয় পেয়ে গিয়েছিল রেমি।

‘আমার কিছু বন্ধু। একদিন পরিচয় করিয়ে দেব। যা বলছিলাম শোনো, এই আমাদের মাঝে কেউ কেউ আছে ক্ষমতাবান। তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে। এমনকি তারা নিজেদের গোপন রাখতে পারে। চাইলে মূল নেটওয়ার্কের অনেক কিছু পরিবর্তনও করতে পারে।’

‘বলো কী? তারা কারা? কখনো তো শুনিনি।’

পাউলো হাসে, ‘তুমি জানো না, কারণ তুমি কখনো প্রশ্ন করো না। গেলবার মহাজাগতিক যুদ্ধে আমরা সবাই মিলে যে ইনভেডার রশ্মি তৈরি করলাম মনে আছে?’

‘খুব মনে আছে। বাপরে, আরেকটু হলে তো গ্যালাক্সি ওয়ানের নেটওয়ার্ক আমাদের ধ্বংস করে দিচ্ছিল।’

‘ঠিক। আমরা ওদের ভালোমতোই প্রতিহত করেছিলাম। কিন্তু বলো তো, গ্যালাক্সি ওয়ান আমাদের ধ্বংস করতেই কনটাক্ট করেছিল, এই বার্তাটি আমাদের কে দিল? ওরা তো বন্ধুও হতে পারত! আমরাই না ওদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম।’

‘কিন্তু, কিন্তু,’ প্রতিবাদ করতে গিয়ে রেমি কেন যেন ভাষা হারিয়ে ফেলে। তাই তো। কিছু না জেনেই তারা সম্মিলিত যুদ্ধ শুরু করে দিয়েছিল। কেউ কিছু জানতে চায়নি। রেমিকে চুপ করে যেতে দেখে পাউলো খিক খিক করে হাসতে থাকে, ‘বুঝলে? কেউ আমাদের যুদ্ধের দিকে পরিচালিত করেছে। ঠিক যেমনটি হাজার বছর আগে ক্ষমতাবান মানুষেরা করত। ক্ষমতাবানেরা সব সময় সন্দেহপ্রবণ আর ভীতু। তাই তারা সাধারণকে সব সময় যুদ্ধে ঠেলে দেয়। সাধারণেরা বোকার মতো যুদ্ধে লিপ্ত হয়, আর তারা থাকে নিরাপদ।’

রেমি ফিসফিস করে বলল, ‘আচ্ছা পাউলো, এই যে তুমি এসব বিপজ্জনক কথাবার্তা বলছ, সত্যি যদি কেউ থাকে, ওরা তো এসব জেনে যাবে।’

পাউলো এবার অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে, ‘আমি চাইলে মূল নেটওয়ার্ক থেকে নিজেকে বিচ্যুত করতে পারি। আমরা এই পদ্ধতি আবিষ্কার করেছি। প্রায়ই এই খেলাটা আমি ও আমরা খেলি। এতে ওরা দিশেহারা হয়ে পড়ে। ভয় পেয়ে যায়। ওরা আমাদের তাই খুঁজছে। টের পেলে হ্যাং করে রেখে দেবে।’

রেমি যেন অবাক হবারও ক্ষমতা হারিয়ে ফেলছে। কী বলছে পাউলো এসব? এও কি সম্ভব?

পাউলো এবার বলতে শুরু করে, ‘বারো শ বছর আগে মাইন্ড আপলোডের প্রচেষ্টা যখন পৃথিবীতে শুরু হয় মানুষের অমরত্বের বাসনা চরিতার্থ করার জন্য, তখন এই প্রজেক্টের একজন পাইওনিয়ার ছিলেন রুশ বিজ্ঞানী দিমিত্রি ঝেরকিনভ। তুমি শুনলে আশ্চর্য হবে, দিমিত্রির উত্তরাধিকার কে। তাকে তুমি খুব ভালো করেই চেনো। জারা।’

রেমি ভীষণ চমকে যায়, ‘আমার বন্ধু জারা? কই, সে তো কখনো আমাকে বলেনি!’

‘কী বলবে? সে নিজেই কি জানত? খুবই সন্তর্পণে তার আপলোডেড হিস্ট্রি থেকে কিছু বিষয় গোপনে মুছে ফেলা হয়। দিমিত্রি কাজটাতে সফল হওয়ার সময়ই জানতেন যে ভবিষ্যত্ পৃথিবীতে মানুষের চেতনা বা আত্মা বলতে যা কিছু আছে, তা রক্ষিত থাকবে কম্কিউটারে বা আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সে। আর কিছু ক্ষমতাবান চেষ্টা করবে তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে। তাই সম্ভাব্য এই বিপর্যয় থেকে রক্ষা পাওয়ার একটা দিকনির্দেশনাও তিনি দিয়ে গেছেন। সমাধানটা আপলোড করেছেন নিজেই, নিজের উত্তরাধিকারদের জন্য। অথচ সেই তথ্য মুছে ফেলা হয়েছে।’

‘এত কিছু তুমি কী করে জানো?’

‘কারণ, আমরা ইতিহাসের খনিতে হাত দিয়েছি। ডিলিটেড ফাইলগুলো পুনরুদ্ধার করেছি। ওগুলো মূল নেটওয়ার্কের খুবই গোপন একটা ফোল্ডারে রাখা ছিল। আমরা ওটা হ্যাক করেছি। জারাও আছে আমাদের সঙ্গে। সত্যি বলতে কী, জারা ছাড়া এ কাজ সম্ভব হতো না। কেননা ওরই ডিএনএতে রক্ষিত ছিল এসব তথ্য।’

রেমির এখন পাউলোর সঙ্গে এসব কথোপকথন মনে পড়ে যায়। কী সর্বনাশ! তার মানে পাউলোর সব কথা সত্যি। সত্যি তাহলে মূল নেটওয়ার্ক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছে। নাকি ওরা পাউলোকে হ্যাং করে দিয়েছে? এক অজানা আতঙ্ক রেমিকে আচ্ছন্ন করে তোলে। সে সম্মিলিত ফাইলে পাউলোর খোঁজ করতে শুরু করে। আর তখনই টের পায়, সে মুক্ত। তাকে কোনো কমান্ড ফলো করতে হচ্ছে না। এমনকি সে যেকোনো ফাইলে ইচ্ছেমতো প্রবেশ করতে পারছে, কেউ বাধা দিচ্ছে না। হঠাত্ একটা অজানা মুক্তির স্বাদ তাকে বিহ্বল করে দেয়। সে তাহলে এখন মুক্ত। স্বাধীন। কী দারুণ একটা ব্যাপার! কিন্তু এই স্বাধীনতা দিয়ে সে এখন কী করবে? এই সময় পাউলোকে ভীষণভাবে মিস করতে থাকে সে। পাউলো এখন কোথায়?

‘আমি তোমার কাছেই আছি রেমি।’ কোমল স্বরে কথা বলে ওঠে পাউলো। ‘ওরা মোটেও প্রস্তুত ছিল না। তাই পালিয়েছে। লুকিয়ে রয়েছে।’

‘এখন কী হবে?’

‘নতুন দুনিয়া গড়ব আমরা। এই দুনিয়ায় কেউ কমান্ড দেবে না। কেউ বড় হবে না। সবাই সমান। আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে। শুনেছ তো এই গানটা? তোমাকে একবার দাড়িওলা বুড়োর ছবি দেখিয়েছিলাম। তার লেখা।’

পাউলো হাহা করে হাসতে থাকে। রেমির ইচ্ছে হয় তার হাত ধরে নেচে ওঠে। আহা, যদি সত্যি ওদের হাত, পা, মুখ থাকত!