আমাদের বিলুপ্ত শহর

আমাদের শহর থেকে পাহাড় দেখা যায়।

ফ্রেঞ্চ আলট্রামেরিন পাহাড়ের সারি।

দূরে বলে এমন নীল রঙের দেখায়।

কত দূরে?

আট কিলোমিটার।

নদী পার হয়ে হেঁটে যাওয়া যায়। রিকশাতেও যায়। আমরা যখন যাই, হেঁটেই চলে যাই। হাঁটতে হাঁটতে আজব ম্যাজিক দেখি একটা। নীল পাহাড় হঠাৎ সবুজ হয়ে যায়। ভেরিডিয়ান গ্রিন। কী করে? ধরাই যায় না। আমরা অন্তত ধরতে পারিনি কখনো। ছোট থাকতেও না, বড় হয়েও না। ধরতেও চাই না। কিছু ম্যাজিক না থাকলে হয়?

‘সিক্রেটস অব ম্যাজিক’ বলে একটা প্রোগ্রাম দেখায় টেলিভিশনে। আমরা দেখি না। কেউ দেখে না আমাদের শহরের। ম্যাজিকের কলাকৌশল দেখে না, ম্যাজিক দেখে বিস্মিত হয়ে থাকতে চাই আমরা।

পাহাড়ের নীল রং কী করে সবুজ হয়ে যায়? পাহাড়ে কি কিছু হলুদ রং থাকে? হলুদ রং আর নীল রং মিলে সবুজ রং হয়, স্কুলপাঠ্য বইয়ে আমরা পড়েছি। আমাদের মধ্যে যারা আর্ট করতে পারে, তারাও দেখি হলুদ রঙের সঙ্গে নীল রং মিশিয়ে সবুজ রং বানায়। আর্ট করে। মূলত তারাই আমাদের মাথায় কখনো ঢুকিয়ে দিয়েছিল চিন্তাটা, পাহাড়ে কিছু হলুদ রং থাকে। ছেলেমানুষি। কিন্তু আমরা একটা পছন্দ করি। আমরা ভাবি আমরা একদিন পাহাড়ে উঠে সেই হলুদ রং দেখব। আফসোস, একটাও আমাদের দেশে না, সব পাহাড় আরেকটা দেশে পড়েছে। পাসপোর্ট-ভিসা ছাড়া পাহাড়ে উঠতে গেলে সীমান্তরক্ষীরা গুলি করে মেরে দিতে পারে। উপত্যকার বর্ডার লাইন থেকে দেখা যায় তাদের। বন্দুক বাগিয়ে ধরে টহল দেয় তারা। পাসপোর্ট-ভিসা নেই আমাদের কারোরই। শহরের কারোরই। দরকারও পড়ে না। আমাদের মায়াবী শহর ছেড়ে আমরা খুব একটা কোথাও যাই না। পাহাড়ের হলুদ রং ছেলেমানুষি হয়তো কিন্তু আমরা সত্যি দেখতে চাই পাহাড় থেকে কি আমাদের শহর দেখা যায়? দিনে তো নয়, রাতে। আমাদের শহরটাকে কি কিছু জোনাকির শহর মনে হয়?

এভাবে সবকিছু চলছিল ঠিকঠাক, বিরাট একটা মুশকিল হয়ে গেল একদিন। উপত্যকায় গিয়েছিল শহরের একজন। সে একটা পাথর নিয়ে ফিরল। বলল, এই পাথরটা সে একটা পাখির বাসায় পেয়েছে। উপত্যকায় পড়ে ছিল পাখির বাসাটা। পাহাড়ের কোনো গাছ থেকে পড়েছে। কী অদ্ভুত কথা! আমরা ছোট পাথরটা দেখলাম। জোছনা রাত বলে আমাদের মনে হলো পাথরটার রং গাঢ় নীল হয়তো। কোবাল্ট ব্লু। আবার একবার মনে হলো পার্পল। আবার একবার মনে হলো হাই রিস্ক রেড। পাখির বাসায় ছিল এই পাথর! আমরা বললাম, ‘এটা দারুণ! ম্যাজিক পাথর!’

বিস্ময়ের সঙ্গে আমরা কথাটা বললাম।

আমাদের শহরের রাস্তার ল্যাম্পপোস্টে জোছনা রাতে বৈদ্যুতিক সংযোগ থাকে না। আশ্বিনের, হেমন্তের জোছনা। যত রাত হলো বাড়ল। রাতভর হাঁটল অনেকে। তাদের কেউ কেউ প্রথম অস্পষ্ট দেখল। রাত ফুরিয়ে যাচ্ছে, সকাল হয়নি, এমন একটা সময়। অস্পষ্ট থেকে ক্রমে স্পষ্ট হলো মানুষটা। হতশ্বাস ছুটছে। কাল এই মানুষটা উপত্যকা থেকে একটা ম্যাজিক পাথর কুড়িয়ে এনেছে। ছুটছে কেন সে? তার কী হয়েছে?

‘পাথর ফেটে গেছে! ছড়িয়ে পড়ছে!’

বলে ছুটতে ছুটতে চলে গেল মানুষটা। কোথায় চলে গেল? শহরের আর কেউ তাকে কখনো দেখেনি। আমরা এখন তাকে স্মরণ করি এবং দুঃখ প্রকাশ করি তার জন্য। আমাদের শহর থেকে এ রকম করে কেউ কখনো হারিয়ে যায়নি। এমন আজব কথা বলেও হারিয়ে যায়নি। পাথর ফেটে গেছে, ছড়িয়ে পড়ছে মানে? পাথর কি ডিম? সেই সকালে আমরা যখন এসব ভাবছি, চিত্কার করে উঠল আমাদের একজন, ‘এ-ই-ই-ই-ই-ই!’

আতঙ্কিত চিত্কার।

কী হয়েছে?

আমরাও দেখলাম এবং আতঙ্কিত হলাম। পাহাড়ের সারি দেখা যাচ্ছে না। মেঘ হলে এমনিতে দেখা যায় না, কুয়াশা হলে দেখা যায় না। সে অন্য কথা। সকালটা রোদের এবং আকাশ নীল রঙের। মেঘ করে নেই, কুয়াশাও পড়েনি। নদীর ওপারের গাঁওগেরাম সবুজ। রোদ পড়ে আরও সবুজ দেখাচ্ছে। পেছনেই কুয়াশার ঢিবি মনে হচ্ছে জমাট। বিরাট বিরাট সব কুয়াশার ঢিবি, পাহাড়ের সারি ঢেকে দিয়েছে। আবার কুয়াশার ঢিবি যে না, বোঝা যাচ্ছে সেটাও। কী তাহলে?

আমাদের শহরের প্রাজ্ঞ ইতিহাসবেত্তা জন্মান্ধ মানুষটা বললেন, ‘অরণ্য! জঙ্গল! জঙ্গল ফিরেছে!’

‘জঙ্গল ফিরেছে!’

‘হ্যাঁ। ইতিহাস বলে দুই শ সত্তর বছর আগেও জঙ্গলাকীর্ণ ছিল এই এলাকা। এই নদী খরস্রোতা ছিল।’

‘আমাদের এই নদী!’

‘হ্যাঁ, এই নদী। খরস্রোতা ছিল। গহিন জঙ্গল ছিল নদীর দুই ধারে। জঙ্গলে গন্ডার, চিতাবাঘ ছিল। ফ্লাইং স্কুইরেল ছিল।’

‘ফ্লাইং স্কুইরেল!’

‘উড়ন্ত কাঠবিড়ালি।’

তা বুঝলাম। কিন্তু জঙ্গল ফিরেছে মানে কী? কোত্থেকে ফিরেছে? জঙ্গল কি বেড়াতে গিয়েছিল নাকি কোথাও?

‘তা কেন? বসত করবে, আবাদ করবে, জঙ্গল পুড়িয়ে দিয়েছিল মানুষ। এত দিন পর সেই জঙ্গল আবার ফিরেছে।’

জন্মান্ধ মানুষটার ঘরে অনেক ইতিহাসের বই। বইয়ের র্যাকে, খাটে, টেবিলে, চেয়ারে। থান ইট সাইজের একটা বইয়ের মলাট দেখলাম। আরে! ম্যাজিক পাথরের ছবি মলাটে!

‘ম্যাজিক পাথর না, কোডেক্স পুঁথি এটা।’

জন্মান্ধ ইতিহাসবেত্তা বললেন। কী করে বুঝলেন? আসলে দেখতে পান? আমরা সেই প্রশ্ন তুললাম না, বললাম, ‘কোডেক্স পুঁথি!’

‘সাংকেতিক ভাষায় লেখা পুঁথি। এই পুঁথিটা পনেরো শতকের। তিন শ বছর আগে আবিষ্কৃত হয়। মেক্সিকোর একটা পিরামিডের ধ্বংসাবশেষ থেকে। এখনো পাঠোদ্ধার করা যায়নি।’

‘কোথায় আছে এখন পুঁথিটা?’

‘স্মিথসোনিয়ান মিউজিয়াম অব হিস্ট্রিতে।’

‘সেটা কোথায়?’

‘আমেরিকায়।’

‘সেটা কোথায়?’

‘আমেরিকা!’

‘হ্যাঁ। আমেরিকা কোথায়? কত মাইল দূরে? হেঁটে যাওয়া যায়?’

‘তা যায়। আট হাজার দুই শ একত্রিশ মাইল। তেরো হাজার দুই শ সাতচল্লিশ কিলোমিটার। হেঁটে গেলে এক শ এগারো কি বারো দিন লাগবে। তবে পাসপোর্ট-ভিসা ছাড়া যাওয়া যাবে না। আমেরিকার ভিসা পাওয়া খুব কঠিন।’

‘আমরা কোনো দিন আমেরিকা যাব না। এই শহর ছেড়ে কোথাও যাব না।’

‘এই শহরেও জঙ্গল ফিরে আসে যদি?’

‘কী? কী-কী-কী? তাহলে আমরা জঙ্গলে থাকব।’

‘ভালো কথা। আমিও থাকব।’

‘আমরা বলছিলাম আমরা এই পাথরটা...ইয়ে পুঁথিটা দেখেছি।’

‘কী? কোথায়?’

‘আমাদের শহরে।’

‘কী-ই-ই-ই-ই?’

আমরা ছুটলাম সেই মানুষটার ঘরে, চলে গেছে যে। পাথর ফেটে গেছে, ছড়িয়ে পড়ছে, আমরা কি এখন বুঝতে পারছি কিছু? ম্যাজিক পাথরটা বা কোডেক্স পুঁথিটা, মানুষটার ঘরের কোনোখানে নেই। পৃথিবীর কোনোখানেও নেই হয়তো। ফেটে গেছে, ছড়িয়ে পড়েছে। ফিরিয়ে এনেছে দুই শ সত্তর বছর আগের অরণ্য। মনে হলো আমাদের। ফেটে গেছে মানে কি কোডেক্স পুঁথিটা ডি-কোডেড হয়ে গেছে কোনো রকমে? গোপন তন্ত্রমন্ত্র, ম্যাজিকের কৌশল, ছড়িয়ে পড়েছে হাওয়ায়? তাই হবে। এ ছাড়া আর কী হতে পারে, আমাদের মনে পড়ল না। আমরা নিশ্চিত হতে পারলাম না। নিশ্চিত শুধু, জঙ্গল ফিরেছে। ক্রমে এটা আরও স্পষ্ট হয়ে উঠল। কুয়াশার ঢিবি না, পাহাড় আড়াল করে আছে জঙ্গলের উঁচু উঁচু গাছ।

দুপুরের কিছু পরে আমরা ঠিক করলাম দেখে আসি কী ঘটেছে আসলে, নদী পার হয়ে যাই ওপার। ঘাটে গিয়ে দেখি একটা মাত্র নৌকা। চোখ আঁকা গলুইয়ে। দোনোমনা করে এই সময় শহরে ফিরে গেল আমাদের একজন। চোখঅলা নৌকায় আমরা তিনজন উঠলাম। আশ্বিনের নদী। ছোট ছোট ঢেউ। কমলা রোদ পড়ে কমলা দেখাচ্ছে। কমলা রঙের ঢেউ। কমলা রঙের নদী। ভারমিলিয়ন অরেঞ্জ।

পাড়ে উঠে একপ্রস্থ বোকা হলাম আমরা। নদী পার হওয়ার দরকার ছিল না, জঙ্গল নদীর পাড় অবধি এসে পড়েছে। দুই শ সত্তর বছর আগের জঙ্গল। দুই শ সত্তর বছর পরের গাঁওগেরাম নিশ্চিহ্ন। গভীর গহিন জঙ্গল সবখানে শুধু। উঁচু উঁচু গাছ। একটাকে ছাড়িয়ে উঠেছে আরেকটা। গাঢ়, নিবিড়। কত রকম শব্দ যে হচ্ছে। কুব্ কুব! টিট্ টিট্! ইয়াক! ইয়াক! পাখির ডাক, জানোয়ারের আওয়াজ। আমরা কি এই জঙ্গলে ঢুকব? মাথা খারাপ নাকি? বেঘোরে মরব। এর চেয়ে শহরে ফিরে চলো, বাবা। আবার নৌকায় উঠে আরেক প্রস্থ বোকা হতে হলো। চোখঅলা নৌকা, ঠিক আছে। কিন্তু এই মাঝি মানুষটা কে? কত কাল আগের? এ আমাদের এপারে এনেছে? কোনো দিন না।

‘স্কুইরেল!’

ফিসফিস করে উঠল আমাদের একজন।

আরেকজন বলল, ‘কী?’

‘ফ্লাইং স্কুইরেল! দেখো!’

আমরা দেখলাম। দুটো উড়ন্ত কাঠবিড়ালি। উড়ে গেল জঙ্গলের আরও গহিনে। আমাদের মতো বিস্মিত হলো না নৌকার প্রাচীন মাঝি। বলল, ‘পুঁথির পাথরে আটকা ছিল এই জঙ্গল।’

‘কী? কী? কী? কী বললে তুমি?’

‘কী বললাম? নদী পার হলেই মঙ্গল।’

‘এই কথা তুমি বলোনি?’

‘তবে কে বলল?’

‘তুমি বলেছ,...তুমি বলেছ...।’

একটু আগে কী বলেছে মাঝি, আমরা কেউ মনে করতে পারলাম না। আমরা নদী দেখলাম এবং জমে গেলাম আতঙ্কে। এ কোন নদী? আমাদের নদী? এত কুরুল্লা কেন নদীতে? পানির ঘূর্ণিপাক। এখানে কুরুল্লা, ওখানে কুরুল্লা। রোদ পড়েও কমলা মনে হচ্ছে না, পানির রং কেমন অপার্থিব কালচে। আমরা আমাদের শহরটা দেখলাম। আমাদের শহর! না, জঙ্গল? জন্মান্ধ হলেও ক্লেয়ারভয়েন্ট আমাদের প্রাজ্ঞ ইতিহাসবেত্তা। যা বলেছেন, তা-ই হয়েছে। দুই শ সত্তর বছর আগের জঙ্গল আমাদের মায়াবী শহরেও ফিরেছে! বিলুপ্ত হয়ে গেছে আমাদের শহর। আমরা কি সেই বিলুপ্ত শহরে ফিরছি? নাকি জঙ্গলে?

আমরা আমাদের পোশাক-আশাক দেখলাম। আরে এসব কী! আমরা কী পরে আছি এসব! কখন পরলাম? দুই শ সত্তর বছর আগে কি এ রকম পোশাক-আশাক পরত মানুষজন? আমরা কি সেই সময়ের মানুষ? আমরা কি জঙ্গলে থাকি?

কুরুল্লার এই নদী আগে পার তো হই।