একজন মহাশূন্যচারীর সাক্ষাৎকার

খুবই দুর্লভ একটি বিষয়! সরাসরি মহাশূন্যযান থেকে কারোর সাক্ষাৎকার! কোনো ভণিতা নেই। যা কিছু জানার, সরাসরি প্রশ্ন করা হচ্ছে। উপস্থাপক আর মহাশূন্যচারী দুজনেই সাবলীল। বেশ উপভোগ্য একটি সাক্ষাৎকার। একপর্যায়ে উপস্থাপক মহাশূন্যচারীর কাছে জানতে চান, মহাশূন্যে ভেসে থাকতে আপনার কেমন লাগে, ক্লান্ত লাগে না?

মহাশূন্যে ভাসাটাই আমার জীবন!

কখনো ক্লান্তি আসেনি?

না, আমি সারাক্ষণই অভিভূত হতে থাকি! তাই কখনো ক্লান্ত অনুভব করেছি বলে মনে পড়ে না।

এই মহাশূন্যে চলতে চলতে কোনো বিশেষ কিছু কি ভালো লেগেছে আপনার?

মহাশূন্যের সবকিছুই ভালো লাগে, দূরের তারা, অন্ধকার আকাশ...

আপনি কত দিন ধরে বা কত ঘণ্টা ধরে মহাশূন্যে আছেন?

৬ লাখ ২৩ হাজার ৭২৭ ঘণ্টা!

এত সময় ধরে আপনি মহাশূন্যে আছেন?

হ্যাঁ, আমি জন্মের পর থেকেই মহাশূন্যে ভেসে চলছি!

তা কীভাবে সম্ভব?

আমার মা-ও ছিলেন মহাশূন্যচারী!

তা–ই?

হ্যাঁ, আমরা বংশপরম্পরায় মহাশূন্যচারী।

শুনে খুবই ভালো লাগল।

উপস্থাপক সত্যিই চমকে উঠেছেন, মহাশূন্যচারীর কী সৌভাগ্য, নিজের মা–ও মহাশূন্যচারী, তার জন্মও হয়েছে মহাশূন্যে!

উপস্থাপক আবার শুরু করেন, মহাশূন্যে আপনি তো অনেক দিন ধরেই ভেসে আছেন, তো কী কী আছে ওখানে, যা দেখে আপনার ভালো লাগে?

আসলে মহাবিশ্বে তেমন কিছু নেই। বলতে গেলে পুরোটাই ফাঁকা!

তাহলে আপনি যে বললেন, আপনি সব সময় অভিভূত থাকেন, কীভাবে সম্ভব?

এটা শুধু আমার ভাবনার জন্য, আমার ভাবনার পেছনে যে মায়া, তার জন্য!

একটু বুঝিয়ে বলবেন কি?

এই মহাবিশ্বে যা আছে, সে শুধু ভাবনা, আমাদের ভাবনার ক্ষমতাই হচ্ছে মহাবিশ্বের সবচেয়ে দামি আর সুন্দর, এর পেছনে আছে মায়া, এক নৈসর্গিক মায়া।

এখন একটু অন্যদিকে যাই, আচ্ছা আপনার জীবনে কী সবচেয়ে প্রিয়?

মানুষ।

মানুষ!

হ্যাঁ, মানুষ।

উপস্থাপক আবার চমকে যান। তাই আবার জানতে চান, এত দিন মহাশূন্যে থাকার পরও আপনার সবচেয়ে প্রিয় মানুষ?

হ্যাঁ।

কোনো বিশেষ তারা বা নক্ষত্র—এ রকম কিছু আপনার প্রিয় নেই?

ওগুলোও প্রিয়, কিন্তু মানুষের ভাবনার যে ক্ষমতা, এর যে সৌন্দর্য, তার তুলনায় একটি তারা কেন, পুরো মহাবিশ্বই খুব সাদামাটা!

আপনার কাছে মহাবিশ্বের সবচেয়ে বড় আশ্চর্য কী?

প্রাণ!

প্রাণ নিয়ে আপনার কি নিজস্ব কোনো ধারণা আছে, যা আমাদের জানাতে চান?

আমার কাছে প্রাণ হচ্ছে মহাবিশ্বের এক বিশুদ্ধ অনুরণন!

কী রকম?

একটি প্রাণের উদ্ভব হয় সব মহাবিশ্বের অনুরণনে, প্রাণ কোনো বিচ্ছিন্ন বিষয় নয়, বরং এটি পুরো মহাবিশ্বের সঙ্গেই ওতপ্রোতভাবে জড়িত!

উপস্থাপককে দেখে মনে হচ্ছে, তিনি এখানে খেই হারিয়ে ফেলেছেন। মহাশূন্যচারীর কথাটা ঠিক মেনে নিতে পারছেন না। তাই বিষয়টা একটু ঘুরিয়ে জানতে চাইলেন, প্রেম বা ভালোবাসা সম্পর্কে আপনার ধারণা কী?

মহাশূন্যচারী যেন এই প্রশ্নের জন্য তৈরিই ছিলেন। তিনি খুব সহজভাবেই বললেন, প্রেম বা ভালোবাসা হচ্ছে মায়া বা ভাবনার জগতে সূক্ষ্মতম নৈসর্গিক অনুরণন!

আপনার কি মনে হয় এটা সবাই বুঝতে পারে?

যদিও অনুভবের মাত্রাটা কারোর মনের ওপর নির্ভর করে, কিন্তু সবার জীবনেই এটা ছড়িয়ে আছে, অনেকটা ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের মতো, শান্ত মনে চেষ্টা করলে সবাই শুনতে পাবে।

আর শুনতে বা ধরতে না পারলে?

তাতে যায়–আসে না, এর প্রভাব সবার জীবনেই আছে।

এই এত সময়ে ধরে মহাশূন্যে থাকার পরও আপনি তা–ই ভাবছেন?

জি, বলতে গেলে একটি জীবন যেন প্রেম বা ভালোবাসার এক নৈসর্গিক সাগরের একেকটা ঢেউ!

এখানে তাহলে নারী–পুরুষের যে সম্পর্ক, সেখানেও কি এই একই ভালোবাসা কাজ করে?

অবশ্যই, নারী আর পুরুষের ভালোবাসাও সূক্ষ্মতম নৈসর্গিক অনুরণনের একটি প্রকাশমাত্র!

এখানে উপস্থাপক যেন সহজভাবেই মহাশূন্যচারীর কথাটা মেনে নিলেন। বেশি ভেতরে যাওয়ার চেষ্টা করলেন না, তাহলে হয়তো অনেক দর্শকই ব্যাপারটা গুলিয়ে ফেলতে পারেন।

মহাশূন্যচারীকে উপস্থাপক বললেন, আপনার এই কথাগুলো খুব ভালো লাগছে। এখন বলুন একটি মহাশূন্যযানে কোন জিনিসটা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ?

মহাশূন্যযানের জন্য সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে কিছু নেই, এখানে সবই সমান গুরুত্বপূর্ণ। এখানে এক ফোঁটা অক্সিজেন যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি এক ফোঁটা ময়লাও গুরুত্বপূর্ণ!

ময়লা কেন গুরুত্বপূর্ণ?

কারণ, মহাশূন্যযানের জায়গাটা বদ্ধ, সবকিছুর সমান যত্ন না নিলে জীবন একমুহূর্তেই দুর্বিষহ হয়ে উঠতে পারে।

আপনি বর্তমানে কোথায় আছেন?

আমি একটি নীহারিকার কেন্দ্র থেকে প্রায় ২৪ হাজার আলোকবর্ষ দূর দিয়ে চলছি।

ঠিক এই মুহূর্তে আপনি কত বেগে চলছেন?

ঘণ্টায় প্রায় ৮ লাখ ৩২ হাজার কিলোমিটার বেগে।

আপনি ঠিক কোথায় যাওয়ার জন্যে এই মহাশূন্যযানে চলছেন?

মহাবিশ্ব এত বড় যে এতে বিশেষ কোনো গন্তব্য নেই, এখানে চলতে পারাই আনন্দের!

তারপরও, আপনি কোথায় যেতে চান?

মহাবিশ্বের একটি বিশেষ নিয়ম আছে, সেই নিয়মে আমি যেখানে পৌঁছাতে পারি!

আপনার মহাশূন্যযান আর কত দিন চলতে পারবে?

মানে?

মহাশূন্যযানে আর কত দিনের জ্বালানি আছে?

আচ্ছা, এবার বুঝতে পারছি। এটা সোলার লাইট দিয়ে চলে।

খাবার আছে কত দিনের কিংবা অক্সিজেন?

এটা একটি সেলফ সাসটেইনেবল মহাশূন্যযান। এর যত্ন নিলে কখনোই খাবার বা অক্সিজেনের অভাব হবে না।

তা–ই নাকি! কী অদ্ভুত!

আচ্ছা! আমাদের সময় শেষ হয়ে আসছে, এখন বলেন, পৃথিবীবাসীর জন্য আপনার বিশেষ কোনো বার্তা আছে কি?

জীবন সুন্দর!

আর কিছু?

সুন্দর জীবনের জন্য সবকিছুরই যত্ন নিতে হয়!

কিন্তু পৃথিবী তো কোনো মহাশূন্যযান নয়, এর তো অফুরন্ত জায়গা?

পৃথিবীর জায়গা অফুরন্ত নয়, মহাবিশ্বের ব্যাপকতার তুলনায় এটি খুবই ক্ষুদ্র একটি মহাশূন্য যান, এখানে প্রতিটি বিষয়েরই সমান যত্ন দরকার।

তা–ই! আপনার কথা বেশ অদ্ভুত লাগছে।

পৃথিবী হচ্ছে আমার দেখা সবচেয়ে সুন্দর আর বড় মহাশূন্যযান, প্রাণ নিয়ে প্রচণ্ড বেগে ছুটে চলছে ছায়াপথের কেন্দ্র থেকে অনেক অনেক দূরে দিয়ে, পথ দেখিয়ে দেওয়ার জন্য সঙ্গে আছে সূর্য, হাতের কাছে আছে এক মায়াবী চাঁদ আর আছে আকাশভর্তি অসংখ্য তারা আর সবকিছুই পড়ে আছে এক মায়ার সাগরে।

বাহ, খুব সুন্দর বলেছেন, তার মানে আমি নিজেও একজন মহাশূন্যচারী, তা–ই না!

অবশ্যই, ঠিক আমি যে রকম একজন মহাশূন্যচারী, সে রকম আপনিও একজন মহাশূন্যচারী!

উপস্থাপক নিজেও একজন মহাশূন্যচারী, এটা ভাবতেই তার ভালো লাগছে। এর পরেই তিনি চলে যান বর্তমানের খুব আলোচিত একটি বিষয়ে, পৃথিবীর খুব কাছেই বাসযোগ্য একটি নতুন গ্রহের সন্ধান পাওয়া গেছে।

আপনি কি জানেন, আমাদের খুব কাছেই বাসযোগ্য একটি গ্রহের সন্ধান পাওয়া গেছে?

হ্যাঁ পড়েছি, আমাদের গ্যালাক্সিতেই মাত্র ৩১ আলোকবর্ষ দূরে আর গ্রহটি পৃথিবীর চেয়ে প্রায় ছয়গুণ ভারী।

ওখানে কি প্রাণ থাকতে পারে?

থাকতে পারে, হয়তো আমরা যেভাবে প্রাণকে ভাবি, ঠিক ওভাবে হয়তো নয়, ভিন্ন রকমের প্রাণ থাকতে পারে।

কোনো দিন যদি পৃথিবী থেকে আমরা সেই গ্রহে যেতে চাই, তাহলে আমাদের কী ধরনের মহাশূন্যযান বানাতে হবে বলে আপনি মনে করেন?

ঠিক আমাদের মতোই একটি মহাশূন্যযান লাগবে।

মানে আমাদের এই পৃথিবীর মতো?

হ্যাঁ, কারণ সেই গ্রহে যেতে হলে আলোর লাগবে ৩১ বছর, আমরা যদি একটি মহাশূন্যযান বানাতে পারি, যা সেকেন্ডে তিন হাজার কিলোমিটার ছুটতে পারে, তাহলে এ রকম একটি মহাশূন্যযানে চড়ে সেই গ্রহে যেতে আমাদের সময় লাগবে ৩ হাজার ১০০ বছর।

এত সময়?

আমাদের জন্য অনেক সময় হলেও মহাকালের তুলনায় এটা কোনো সময়ই না। সে জন্য আমাদের দরকার এই পৃথিবীর মতোই একটি সেলফ সাসটেইনেবল মহাশূন্যযান।

এটা কীভাবে সম্ভব?

মানুষরূপে যেতে চাইলে এর কোনো বিকল্প নেই। সে জন্য আমাদের এখন থেকেই একটি গবেষণা চলতে পারে, কত অল্পে একটি সেলফ সাসটেইনেবল মহাশূন্যযান বানানো যায়, যেন প্রাণ টিকতে পারে লাখ লাখ বছর।

অন্য কোনোভাবে কী ভাবতে পারেন?

তা–ও হতে পারে, বিজ্ঞান তো অনেক দূর এগিয়ে গেছে, শুধু স্টেম সেল কোনোভাবে ফ্রিজ করে পাঠানো যেতে পারে, যা টিকে থাকতে পারবে হাজার হাজার বছর।

বাহ, বাসযোগ্যতা হারিয়ে গেলে পৃথিবী ছেড়ে আমরা চলে যেতে পারব অন্য কোনো গ্রহে, ভাবতেই ভালো লাগছে!

এটা কোনো ভালো ভাবনা নয়, পৃথিবীর প্রতি আমাদের খুবই যত্নশীল হতে হবে, কারণ, মহাবিশ্বে প্রাণ ধারণ করতে পারে—এ রকম খুব বেশি গ্রহ না–ও থাকতে পারে, অন্যরাও যেন আমাদের পৃথিবীতে এসে থাকতে পারে, তারও ব্যবস্থা আমাদের করতে হবে।

খুব চমৎকার একটি কথা বলেছেন।

এর একটু পরেই ধন্যবাদ দিয়ে অনুষ্ঠান শেষ হয়ে গেল। কিন্তু রেশটা থেকে গেল উপস্থাপকের মাথায়, আজ থেকে তিনিও একজন মহাশূন্যচারী, প্রচণ্ড বেগে অনন্ত মহাশূন্যে ভেসে চলছেন জন্মের পর থেকে! তার মহাশূন্যযানও সোলার লাইটে চলে এবং সেলফ সাসটেইনেবল, যত্ন নিলে অক্সিজেন আর খাবারের অভাব কখনোই হবে না। চাইলে অদূর ভবিষ্যতে পৃথিবী থেকে প্রাণ অন্য কোনো গ্রহে যেতে পারবে এবং অন্য গ্রহ থেকে প্রাণ এই পৃথিবীতে আসতে পারবে। দুটোর জন্যই এই পৃথিবীর যত্ন নেওয়াটা খুবই জরুরি!