কুহক

‘সাধারণত কোন সময়ের দিকে ডাকটা শুনতে পান?’

‘পাই না, পেতাম আসলে।’

‘ওহ আচ্ছা। সরি। কোন সময়ে ডাকটা শুনতে পেতেন?’

‘সেটাকে কোন সময় যে বলব…’

‘কেন, কখনো ডাকটা শোনার সময় ঘড়ি দেখেননি?’

‘ঘড়ি! ঘড়ির দেখার কথা তো কখনো মাথায় আসেনি!’

‘আচ্ছা, আনুমানিক একটা সময় বলেন তো। আসলে ডাকটা শোনার সঙ্গে সময়ের একটা গভীর সম্পর্ক আছে বলে আমার অনুমান।’

ডা. সুদীপ্ত মুখার্জি অনেক সময়ই রোগীকে চিকিত্সাপ্রক্রিয়ার ব্যাখ্যা দেন। সব তো আর রোগী বুঝবে না। ডাক্তারি অনেক টার্মও আছে। চেষ্টা করেন যতটা সম্ভব রোগীকে রোগীর মতো করে ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করতে। এতে কাজ হয়। রোগী আস্থা পায়। আর এ ধরনের চিকিত্সায় রোগীর আস্থা অর্জন খুব জরুরি।

‘সময়টা কেন জানতে চাইছি, আপনাকে বলি। আসলে হিউম্যান বিহেভিয়ারের সঙ্গে দিনের আলোর একটা গভীর সম্পর্ক আছে। সকালে যে মানুষটা যে রকম বিহেভ করে, বিকেলে বা সন্ধ্যায় সে একই সিচুয়েশনে একই বিহেভ নাও করতে পারে। আর রাতে তো একেবারেই অন্য রকম। সাইকোলজিক্যাল এক্সপেরিমেন্টে দেখা গেছে, রাতের অন্ধকারে সাবজেক্ট পুরোপুরি অন্য মানুষ হয়ে গেছে। দিনের আলোতে যে একেবারে ভালো মানুষ, রাতের অন্ধকারে সে একেবারে পশু। পাভলভের এক পরীক্ষায়...।’

সুদীপ্ত মুখার্জি বলতে বলতেই আড়চোখে রোগীর দিকে তাচ্ছিলেন। এটাও তাঁর আরেকটা কৌশল। দেখলেন, রোগী একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ঠিকই, কিন্তু বোঝাই যাচ্ছে, মন দিয়ে শুনছে না। রোগীর চোখের তারা আর ফেসিয়াল এক্সপ্রেশনে কোনো পরিবর্তন আসেনি। ডা. মুখার্জি তার লেকচার সেখানেই থামিয়ে দিলেন।

ফাইলটায় আড়চোখে তাকালেন। রোগীর নাম লেখা শুধু ফারজানা। পুরো নাম নেই। বিবাহিতা। বয়স লেখা আছে ৩০। কিন্তু দেখে মনে হয় আরও বয়সী।

খুবই সাধারণ বেশভূষা। ঠোঁটে লিপস্টিকের হালকা আভা দেখা যাচ্ছে। চেম্বারে আসার সময় হালকা লিপস্টিক দিয়ে বেরিয়েছিল মেয়েটা, কিন্তু তা–ও মুছে ফেলেছে। হাতের চেটোয় লিপস্টিক দেখা যাচ্ছে। রোগীর মধ্যে একটা এনিগমা কাজ করছে। অথচ রোগী বেশ ভালো পদে চাকরি করত। ৬ অঙ্কের বেতন ছিল। রোগীর মধ্যে উইথড্রয়াল সিনড্রোম প্রবল!

‘তা, ঠিক কোন সময়ে ডাকটা শুনতেন?’

‘হ্যাঁ? ওহ্...ডাক!’ সামনে বসা রোগীটি যেন ভাবনার ঘুমে ডুবে গিয়েছিল। চোখ পিটপিট করে বলল, ‘অদ্ভুত একটা সময়ে, জানেন। বিকেল আর সন্ধ্যার মাঝামাঝি একটা সময় থাকে না...কেমন একটা ঘোরলাগা বিষণ্ন সময়। আসলে আগে যখন জব করতাম, তখন তো এই সময়টা কখন আসত আর কখন চলে যেত, খেয়ালই থাকত না। দিনের আলোতে অফিসে ঢুকতাম আর বের হতাম অন্ধকারে।’

রোগী একটু ভাবুক প্রকৃতির বোঝা যাচ্ছে। স্কুল-কলেজে কবিতা-টবিতা লিখত নিশ্চয়ই।

‘আপনাদের কি প্রেমের বিয়ে? আই মিন, নিজেরাই পছন্দ করে?’

রোগী মাথা নিচু করল ঠিকই। কিন্তু ডা. মুখার্জি তার ৩৫ বছরের দীর্ঘ ক্যারিয়ারের অভিজ্ঞ চোখ দিয়ে দেখেই বুঝলেন, বিয়েটা প্রেম করে হলেও বিয়েতে আর প্রেম নেই।

রোগীর মনের জানালাগুলো একটু একটু করে খুলছেন, আর ডা. মুখার্জির কৌতূহল বাড়ছে।

এমনিতে ইদানীং চেম্বারে বসা প্রায় বাদই দিয়ে দিয়েছেন। মানুষের মনস্তত্ত্বের চেয়ে জটিল আর কিছু হতে পারে না। মনের জট পাকা সুতোর গিট্টুগুলো খুলতে খুলতে তিনি নিজেই এখন ক্লান্ত।

পুরোপুরি অবসর নিয়ে নেবেন সাইকিয়াট্রিস্টের এই পেশা থেকে। ভালুকায় একটা খামারবাড়ি করেছেন। সেখানে গিয়েই বাকিটা সময় মাছ ধরে আর বই পড়ে কাটানোর ইচ্ছা আছে তার। পুকুরের পোষ মানা সব মাছ। বড়শি ফেলার আগেই ধরা দেয়। কিন্তু মানুষের মন যে অনন্ত অতল এক পুকুর, সেখানে ঝাঁপ দিতে চাইলে সাহসী ডুবুরি হতে হয়।

তবু কিছু অনুরোধ-উপরোধ ফেলতে পারেন না। বিশেষ কিছু মানুষের রেফারেন্সে এখনো পেশেন্ট দেখতে হয় তাকে। আজকের পেশেন্টটা যেমন তার কাছে পাঠিয়েছে হেলাল। হেলাল তার সবচেয়ে প্রিয় ছাত্রদের একজন ছিল। নিজেই এখন দেশের সেরা মনোবিজ্ঞানীদের একজন। হেলাল এই রোগীর পুরো ফাইলটা পাঠিয়েছে। আর একটা ছোট নোট: ‘স্যার, কেসটা দেখুন। ইন্টারেস্টিং।’

ডা. মুখার্জি অবশ্য এখন পর্যন্ত ইন্টারেস্টিং কিছু খুঁজে পাননি। অডিটরি হেলুসিনেশনের সমস্যা। রোগীর পুরো ফাইলটাও দেখেননি। দ্রুত কয়েক পাতা উল্টে নিয়েছেন।

‘আচ্ছা, প্রথম কোন দিন এই সমস্যাটা হয়েছিল, মনে আছে?’

রোগী মাথা নাড়ল। এই প্রথম তার চোখের তারায় একধরনের চঞ্চলতা খেয়াল করলেন ডা. মুখার্জি।

‘প্রথম দিনটার কথা আমাকে একটু খুলে বলুন। যতটা ডিটেইলে সম্ভব।’

‘ছুটির দিন ছিল। বাসায় আমি একাই ছিলাম। মাগরিবের আজান তখনো হয়নি। হঠাৎ মনে হলো, দরজার ওপাশ থেকে কে যেন “মা, মা” বলে ডাকছে আর দরজায় হাঁচড়-পাঁচড় করছে। আমি ভাবলাম আমাদের বাসার কেয়ারটেকারের ছেলেটা। আড়াই কি তিন বছরের মতো বয়স। মাঝেমধ্যে একা একা সিঁড়ি দিয়ে ওঠে–নামে। হয়তো নিচতলা মনে করে দোতলায় এসে পড়েছে ভুল করে। নিচতলায় পার্কিংয়ের এক সাইডে একটা ঘরে ওরা থাকে। দরজা খুলে নিচে তাকাতেই দেখি...।’

রোগীর চোখমুখে একটা অস্থিরতা। বোঝাই যাচ্ছে, সাত-আট মাস পেরিয়ে গেলেও ঘটনাটি এখনো তার মনে বেশ দাগ কেটে রেখেছে। রোগী বলল, ‘পানি খাব।’

তার চেম্বারে আসা রোগীদের পানি খেতে চাওয়া নতুন কিছু নয়। পানির গ্লাস তৈরিই থাকে। ডা. মুখার্জি চোখ ইশারায় টেবিলের গ্লাসটার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন ফারজানার। এটাও তার একটা পর্যবেক্ষণ কৌশল। রোগী যদি নিজে হাত বাড়িয়ে গ্লাসটা টেনে নেয়, ধরে নিতে হবে, পানির তৃষ্ণা তার বেশি। রোগী যদি ইতস্তত করে, অপেক্ষা করে অন্য কারও বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য, বুঝতে হবে, পানির তৃষ্ণার মাত্রা ততটা নয়।

ফারজানা নিজে পানির গ্লাসটা নিল ঠিকই। তবে যাকে ঢকঢক করে খাওয়া বলে, সেভাবে খেল না। আলতো একটু চুমুক দিয়ে গলা ভিজিয়ে নিল। ডা. মুখার্জি মনে মনে বললেন, ইন্টারেস্টিং।

‘তো, কী দেখলেন?’

‘দেখলাম একটা জন্তুমতন, মানে অনেকটা মানুষের বাচ্চার মতো দেখতে। কিন্তু পরিপূর্ণ মানুষের বাচ্চা নয়। হাত-পাগুলো জানি কেমন কেমন। গা দিয়ে থিকথিকে লালার মতো রস ঝরছে। আঠালো রস। মাছের আঁশটে গন্ধ। ‘ঘিনঘিনে...কিন্তু...’

‘কিন্তু কী?’

‘চোখ।’

‘চোখ!’

‘হ্যাঁ, চোখজোড়ায় কী অসম্ভব মায়া! আমি দরজা খুলতেই মাথা উঁচু করে তাকাল। তারপর ডাকল, “মা!”’

‘আপনাকে মা ডাকল?’

‘হুম। ভয়ে আমার গা গুলিয়ে উঠল। আমি দরজা বন্ধ করে ছুটে শোবার ঘরে এলাম। সেটারও দরজা বন্ধ করে দিলাম। তারপর কী হলো, জানি না। বেহুঁশ হয়ে পড়লাম।’

রোগীকে কিছুটা ধাতস্থ হওয়ার অবকাশ দিলেন ডা. মুখার্জি। রোগীর বুকের হাঁপর উঠছে-নামছে। কিছুটা ঘামছেও। হাতের চেটোয় রোগী কপালের ঘাম মুছে নিল। আচ্ছা রোগী টিস্যু বা রুমাল কেন ব্যবহার করে না? মেয়েদের কাছে থাকার কথা।

‘ভয় পেলেন কেন? মা-ই তো ডেকেছে।’

এই প্রশ্নে রোগী অপরাধীর মতো মাথা নিচু করল। মৃদু স্বরে বলল, ‘বাচ্চাটা না অপরিণত বাচ্চাদের মতো। মানে প্রিম্যাচিউর ডেলিভারি হলে অনেক সময় দেখা যায় না...ওই রকম। সব কটি অরগ্যান ঠিকমতো তৈরিই হয়নি...গর্ভে ছয় মাসের মতো থাকলে যেমন হয়। দেখতে যে কী বীভত্স লাগছিল!’

রোগীর শরীর কাঁপছে। ঠোঁটও কাঁপছে তিরতির করে। নাকের পাতা ফুলে গেছে। বারবার হাতের পাতা দুই হাঁটুতে ডলছে। ঘামছে নিশ্চয়ই। ডা. মুখার্জি বেল বাজিয়ে সহকারীকে ডাকলেন। কিছু বলতে হলো না। সহকারী যন্ত্রের মতো রোগীকে আলতো করে চেয়ার থেকে তুলে নিয়ে সাদা বিছানায় শুইয়ে দিল। দ্বিতীয়বারের মতো মেপে নিল প্রেশার, চেম্বারে আসার সময়ই একবার রক্তচাপ আর ওজন মেনে নেওয়া হয়েছিল।

থার্মোমিটারটা রোগীর মুখ থেকে বের করতে একটু কসরত করতে হলো সহকারীকে। একপলক তাকিয়েই ডা. মুখার্জি বুঝলেন, রোগী থার্মোমিটারটা আর একটু হলেই কামড়ে ভেঙেই ফেলত। দাঁত কিড়মিড় করছে এখনো। হিস্টিরিয়ার লক্ষণ স্পষ্ট।

শুধু অডিটারি নয়, রোগী পুরোদস্তুর হেলুসিনেশনে ভুগছে। সাইকোসিসের দিকে টার্ন করছে।

রোগীকে কিছুটা বিশ্রাম দেওয়া দরকার। সহকারীকে ইশারায় চলে যেতে বলে ডা. মুখার্জি ফাইলটায় মন দিলেন। কেস হিস্ট্রিটা দেখে নেওয়া দরকার।

একটা বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠানে চাকরি করত ফারজানা। ২৫ বছর বয়সে বিয়ে হয়। প্রেমের বিয়ে। পাস করেই চাকরি পেয়েছিল মেয়েটা। তারপরই বিয়ে করে। বিয়ের চার-পাঁচ মাসের মাথায় প্রেগন্যান্ট। তখনো বিয়ের হানিমুন পিরিয়ডই শেষ হয়নি।

হেলালের কাছে থেরাপি নেওয়ার সময় রোগী নিজে কনফেস করেছে, প্রথমবারের এই প্রেগন্যান্সি নিয়ে সে আতঙ্কিত ছিল। আনএক্সপেকটেড প্রেগন্যান্সি। ক্যারিয়ার মাত্র শুরু। এ সময় বাচ্চা নিলে...। তা ছাড়া সংসারও শুরু করেছে কেবলই। স্বামী-স্ত্রী দুজন মিলে টাকা জমাচ্ছিল, বিয়ের এক বছর পূর্তিতে ইউরোপের কোনো দেশে গিয়ে হানিমুন করে আসবে বলে। সব পরিকল্পনা ভেস্তে যাওয়ার জোগাড়।

শেষ পর্যন্ত ফারজানাই সিদ্ধান্ত নেয় অ্যাবরশনের। কিন্তু তত দিনে বেশ দেরি হয়ে গেছে। তার গাইনি ডাক্তার বলেছিল, ঝুঁকিটা না নিতে। কিন্তু ক্যারিয়ার নামের সিঁড়িটা বেয়ে ওঠার হাতছানি, দুজনের ইচ্ছেমতনের সংসারটা আরও কিছুদিন উপভোগ করতে চাওয়ার চাওয়াকে প্রাধান্য দিয়েছিল ফারজানা।

তখনো সবকিছু ঠিকই ছিল। ফারজানার ক্যারিয়ার তরতর করে এগিয়েছে। বেতন লাখের ঘরে চলে গেছে। লাফিয়ে লাফিয়ে প্রমোশন। এর মধ্যে একবারের বদলে তিনবার স্বামীকে নিয়ে বিদেশ ঘোরা হয়ে গেছে।

বিয়ের চার বছরের মাথায় দুজন মিলে ঠিক করে, এখন সময় হয়েছে। এবার ঘরে একজন অতিথিকে আনা যায়। আর তখনই শুরু হলো ঝামেলা। প্রথমে শারীরিক। তারপর মানসিক।

ডা. মুখার্জিকে পড়া থামাতে হলো। ফারজানা বিছানা থেকে নিজে উঠে বসেছে। ডা. মুখার্জি এবার নিজে এগিয়ে গিয়ে রোগীকে আলতো করে ধরলেন। পিতার স্নেহে।

‘থাক না, আরেকটু বিশ্রাম নিন।’

ফারজানা মাথা নাড়াল, বিশ্রামের প্রয়োজন নেই। তার মধ্যে কিসের যেন তাড়া।

‘আচ্ছা, আসুন, বসুন চেয়ারটায়। আপনার গাইনি ডাক্তারের কাগজপত্রগুলো দেখছি না এর মধ্যে। ওগুলো আছে।’

‘না, মানে ওগুলো যে লাগবে, তা তো বুঝতে পারিনি।’

‘কোনো অসুবিধা নেই। পরের বার আনবেন। একটু দেখে নিলাম আরকি। আচ্ছা আমাকে বলুন তো, আপনার ফিজিক্যাল কী সমস্যা হয়েছিল? মানে কেন আপনার প্রেগন্যান্সিতে ঝামেলা হচ্ছে?’

‘প্রথমবার আসলে ছয় মাসের কাছাকাছি হয়ে গিয়েছিল প্রেগন্যান্সির। তখনই ডাক্তার বলেছিল, ভবিষ্যতে ঝামেলা হতে পারে। আর এর মধ্যে আমার থাইরয়েডেও সমস্যা ধরা পড়ে। আমি আসলে হাইপোথাইরয়েডে ভুগছি। তা ছাড়া...’

‘তা ছাড়া কী?’

‘আমার স্বামী চায় না আমি এখন মা হই।’

‘এখনো!’

‘না, ওই কারণে না, আপনি যেটা ভাবছেন। ও তো আমাকে পাগল ভাবে। ও মনে করে, বাচ্চা হলে আমি হয়তো ভালো মা হতে পারব না।’

‘পাগল বলে তো কিছু নেই। জ্বর যেমন একটা অসুখ, ওষুধ খেলে ছেড়ে যায়। তেমনি যেকোনো মানসিক সমস্যাও শুধুই একটি অসুখ।’

‘ডক্টর, আপনারও কি মনে হয় আমি পাগল?’

‘তা হবে কেন?’

‘না, আসলে আমি নিজে যে কী অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে গেছি, জানেন! কত রাতে আমার ঘুম ভেঙে গেছে। স্পষ্ট শুনছি, কে যেন আমাকে “মা, মা” বলে ডাকছে। কী আদুরে গলায়! কী কাতর স্বরে ডা, “মা, মা!” বুকের ভেতরটা হাহাকার করে উঠত। যতবার ডাকটা শুনতাম, মনে হতো, মনের ভেতর কাগজের মতো দলেমচে দিচ্ছে কেউ। তুহিন ভেবে বের করল, খুব বেশি করে মা হতে চাইছি বলেই এই সমস্যা হচ্ছে। বিড়ালের ডাকেও মা শুনছি। একবার তো বাসার সব বিড়াল ও তাড়ানোর ব্যবস্থাও করল। তখন সমস্যাটা মিটেও গিয়েছিল। আমি বেশ কিছুদিন ডাকটা শুনিনি। স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে শুরু করলাম। ওমনি একদিন...।’

ডা. মুখার্জি এবার কোনো প্রশ্ন করলেন না। চুপ করে থাকলেন। ফারজানার কথার জন্য অপেক্ষা করতে থাকলেন। কয়েকবার ঢোঁক গিলে ফারজানা আবার বলতে শুরু করল।

‘ততদিনে চাকরি-বাকরি সব ছেড়ে দিয়েছি। অফিস অনির্দিষ্টকালের ছুটি দিতে রাজি ছিল। তিন বছর সেরা এমপ্লয়ি হয়েছিলাম তো, অফিস অনেক কনসিডার করেছে। কিন্তু ভেবে দেখলাম, চাকরি করছি, যাতায়াত, টেনশন এসব কারণেও তো অনেক সময় প্রেগন্যান্সিতে ঝামেলা হয়। চাকরিটাই ছেড়ে দিলাম!’

ডা. মুখার্জিই এবার গোপন দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। যে চাকরির জন্য এত কিছু...।

‘তখন বাসাতেই রেস্ট নিতাম। ওই রকম আরও একদিন বিকেলে ঘুমিয়েছি। পাতলা কমফোর্টারটা গায়ে ছিল। হঠাৎ বিড়ালেরই আওয়াজ পেলাম। পায়ের দিকটায় কী যেন নড়ছে। গুটিসুটি মেরে বসে আছে হয়তো। আরও কয়েকবার বিড়ালটা ডাকল। আমি ভাবলাম, এর মধ্যে একটা বিড়াল নিশ্চয়ই ফিরে এসেছে তাড়িয়ে দেওয়ার পরও। মায়াই লাগল। কিন্তু বিছানা যদি নোংরা করে! আমি কমফোর্টারটা তুলে ওটাকে তাড়িয়ে দিতে যাব, তখুনি দেখি...।’

রোগীর চেহারায় আবার সেই আতঙ্কের ছায়া খেলা করতে শুরু করল। কিন্তু এবার সে বলা থামাল না। বলে চলল, ‘হুবহু সেই প্রথম দিনের বাচ্চার মতন দেখতে জন্তুটা, জানেন! কেমন লিকলিকে আঙুল! একদম সরু পা। গায়ের রং ফ্যাকাসে সাদা, শরীরে রক্তই নেই। মাথার খুলিটাও ঠিকমতো হয়নি। বুকের হাড়গুলো গোনা যাচ্ছে। আর সেই থিকথিকে, ঘিনঘিনে শরীর চুইয়ে পড়া আঠালো রস! আমি ভয় পেয়ে বিছানার একদিকে ছিটকে গেলাম। হাঁটু দুটো ভাঁজ করে কাঁপছি এক কোনায়। বাচ্চামতন জন্তুটা হামাগুড়ি দিয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসতে থাকল। আর ডাকতে থাকল, “মা, মা, মা...।” পা ধরে শরীর বেয়ে উঠল। মনে হলো অসংখ্য মাকড়সা আমার শরীরে কিলবিল করে ছুটছে। কালো বড় বড় মাকড়সা। আমি ভয়ে জ্ঞান হারালাম।’

রোগীর শরীর আবারও কাঁপছে। আজ যথেষ্ট হয়েছে। আরেক দিন কথা বলা যাবে। রোগীকে এবার ফেরত পাঠানো দরকার। ডা. মুখার্জি সহকারীকে ডাকার আগে রোগীকে একটু ধাতস্থ হওয়ার সময় দিলেন। রোগী এবার খালি গ্লাসে নিজেই পাশের জগ থেকে পানি ঢেলে ঢকঢক করে খেল। ডা. মুখার্জি নিজে টিস্যুর বাক্স বাড়িয়ে দিলেন।

যতবার এই স্মৃতি রোগী মনে করছে, ততবার তার মধ্যে একধরনের ট্রমা কাজ করছে। রোগীর জন্য মায়াই হতে লাগল ডা. মুখার্জির।

রোগীকে কিছুটা রেস্ট নেওয়ার সুযোগ দিতে আবারও ফাইলটায় চোখ বোলালেন। এবার একটু একটু করে কেসটার প্রতি আগ্রহ বাড়ছে।

দ্রুত পাতাগুলো উল্টে নিতে নিতেই ডা. মুখার্জি বুঝছিলেন, তাঁর শিষ্য হেলাল বেশ ভালো পথেই এগোচ্ছিল। দ্রুত সমাধান করে ফেলছিল সমস্যাটার। তাহলে তাঁর কাছে কেন পাঠাল?

কৌতূহল বাড়তেই ডা. মুখার্জি দ্রুত শেষের পাতাগুলোয় গেলেন। আশ্চর্য হয়ে খেয়াল করলেন, এই রোগী আসলে ছয় মাস আগে পুরো সুস্থ হয়ে গেছে। এখন তার কোনো সমস্যা নেই! এমনকি এই ছয় মাসে এমন কোনো সিম্পটম দেখা যায়নি, যাতে পুরোনো সমস্যা ফিরে আসার ইঙ্গিত আছে। তাহলে?

ডা. মুখার্জি নিজের নেওয়া নোটগুলোর দিকে তাকালেন। তার মনে পড়ে গেল, একেবারে শুরুর দিকের কথাবার্তা। যখন তিনি জানতে চেয়েছিলেন, রোগী সাধারণত কোন সময়ে ‘মা’ ডাকটা শুনতে পেতেন, তার উত্তরে ফারজানা বলেছিল, এখন আর সে ডাকটা শোনে না। শুনত একসময়।

ডা. মুখার্জি জেগে ওঠা প্রচণ্ড কৌতূহল যথাসম্ভব আড়াল করে ফারজানাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এখন কি আর আপনি “মা” ডাকটা শোনেন?’

ফারজানা মাথা নাড়ল।

‘তাহলে আপনার এখন কী সমস্যা হয়? অন্য কোনো কিছু শোনেন বা দেখতে পান?’

ফারজানা আবারও ডানে-বাঁয়ে মাথা নাড়ল।

‘তাহলে এখন তো আপনার কোনো সমস্যা নেই। শরীর অনেক দুর্বল। ম্যালনিউট্রিশনে ভুগছেন। সাধারণত এ ধরনের অসুখে শরীরে অনেক ধকল যায়। শরীরটা পুরো ফিট হয়ে গেলে দেখবেন আর কোনো সমস্যা হচ্ছে না।’

‘কিন্তু আমি তো সমস্যাই চাই।’

‘মানে?’

‘মানে আমি চাই সমস্যাটা ফিরে আসুক।’

‘সরি, আমি বুঝতে পারছি না!’

‘আমি আবারও মা ডাকটা শুনতে চাই। ওভাবে হলেও শুনতে চাই। বিশ্বাস করুন, আর একবার হলেও শুনতে চাই। প্লিজ, আমাকে আমার অসুখ ফিরিয়ে দিন। প্লিজ, ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করুন। আমি আর একবার হলেও ওকে দেখতে চাই। এবার আর ওকে আমি ভয় পাব না। এবার আমি ওকে কোলে তুলে নেব। এবার আমি ওকে অনেক আদর করব। ওর শরীর চুমোয় চুমোয় ভরে দিয়ে বলব, বাপধন, মাকে ক্ষমা করে দিস। আর আর কিছু চাই না। শুধু ও আমাকে একবার মা বলে ডাকুক। প্লিজ, একবারের জন্য হলেও আমি আরেকবার মা ডাকটা শুনতে চাই, একবারের জন্য...।’

ফারজানা হু হু করে কান্নায় ভেঙে পড়ল। কাঁদতেই থাকল।

ডা. মুখার্জি মাথা নিচু করে রইলেন।

মনের ডাক্তার তিনি, মনের অসুখ সারানোর কায়দাই কেবল জানেন। অসুখ ফিরিয়ে আনার উপায় তাঁর জানা নেই।