গভীরে গোপনে

অলংকরণ:জুনায়েদ

মাল বোঝাইয়ের কাজ প্রায় শেষ। ক্যাপ্টেন ফ্রাঙ্কো স্থানীয় দালালদের সঙ্গে দামদস্তুর চুকিয়ে অপেক্ষা করছেন উড়াল দেওয়ার। এ যাত্রায় গ্রহটি থেকে অনেক পশুপাখি সংগ্রহ করা গেছে। ফার্স্ট মেট জোন্স অন্যদের নিয়ে একে একে উঠছে মহাকাশযানে। এমন সময় সামনের দিকে তাকিয়ে ফ্রাঙ্কো সকৌতুকে দেখলেন তাঁরই এক ক্রু পিটারসন হেঁটে আসছে, তার হাতে একটা দড়ি, দড়ির মাথায় একটা অদ্ভুতদর্শন প্রাণী।

ক্যাপ্টেনের সামনে এসে দাঁড়াল। ‘আয়্যাম সরি ক্যাপ্টেন, একটু দেরি হয়ে গেল।’ বলল পিটারসন, কিছুটা কুণ্ঠিত, মুখটা লাল হয়ে আছে, রোদে তেতে সম্ভবত। ফ্রাঙ্কো এগিয়ে গেলেন তার দিকে।

‘এটা কী?’

দোদুল্যমান ক্লান্ত বিশাল বপু নিয়ে ধীরে ধীরে বসল প্রাণীটা। চক্ষু অর্ধনির্মিলিত। আশপাশে কয়েকটা মাছির মতো পতঙ্গ ভনভন করছিল। লেজ দিয়ে সেগুলোকে তাড়ানোর চেষ্টা করল বেচারা।

‘এটা একটা ওয়াব।’ জবাব দিলে পিটারসন। ‘এখানকারই এক স্থানীয় বাসিন্দার কাছ থেকে ৫০ সেন্ট দিয়ে কিনলাম। লোকটা বলল খুবই অসাধারণ নাকি এরা। সবাই এদের সম্মান করে। ভাবলাম, একটা নিয়ে নিই।’

‘অসাধারণ?’ ওয়াবটার বিশাল দেহে একটা গুঁতো দিলেন ফ্রাঙ্কো, ‘এটা তো বিশালদেহী নোংরা প্রাণীই একটা।’

‘জি স্যার। এটা নোংরা প্রাণীই হয়তো। তবে এখানকার লোকজন এটাকে ওয়াব বলে ডাকে।’

‘হুহ! হোত্কা আজব প্রাণী একটা। কম করে হলেও ৪০০ পাউন্ড ওজন হবে।’ ওয়াবটার অনেকখানি পশম মুঠোর মধ্যে চেপে ধরলেন ফ্রাঙ্কো। খাবি খেতে লাগল ওয়াবটা, ছোট্ট ভেজা চোখ দুটো খুলে গেল ওর, বিশাল মাথাটা ঝাঁকাতে লাগল। বিচলিত পিটারসন মুখ খুলল দ্রুত, ‘খেতে মনে হয় ভালো লাগবে।’

‘ঠিক আছে। দেখা যাবে।’ অনুমোদনের সুরে বললেন ক্যাপ্টেন।

দুই

টেক অফের ধকলটা বেশ ভালোমতোই সামলে নিল ওয়াবটা। লাল গ্রহের সীমানা পেরিয়ে মহাশূন্যে আপন গতিতে যখন চলতে শুরু করল মহাকাশযান তখন কয়েকজন ক্রু ওপরতলায় এল ওকে পরখ করতে।

‘হায় খোদা!’ পয়লা মুখ খুলল ফ্রেঞ্চ। ‘এটা কী?’

‘পিটারসন বলেছে এটা একটা ওয়াব।’ জবাব দিল জোন্স। ‘পিটারসনই এটার মালিক।’ বলতে বলতে ওয়াবটাকে একটা হালকা লাথি ঝাড়ল সে। দম বন্ধ করে দাঁড়িয়ে গেল ওয়াবটা।

‘এটার হলোটা কী?’ এগিয়ে এল ফ্রেঞ্চ। ‘অসুস্থ হয়ে পড়ছে নাকি?’

ভালো করে তাকাল ওরা বিচলিত প্রাণীটার দিকে। বিষাদমাখা চোখে ওদেরও একে একে দেখল ওয়াবটা।

‘আমার মনে হচ্ছে ওর তেষ্টা পেয়েছে।’ বলেই পানি আনতে গেল পিটারসন।

‘অবাক হওয়ার কিছু নেই। টেক অফ করতে আমাদের ওপর দিয়েই যে ধকলটা গেল। আবার সব ব্যালাস্ট ক্যালকুলেশন সেট করতে হবে আমাকে।’ বলল জোন্স।

পানি নিয়ে এল পিটারসন। পানি খেয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে সবার গায়ে ছিটিয়ে দিল খানিকটা। তারপর ধীরে ধীরে মোচড়াতে লাগল শরীর।

এমন সময় দরজার সামনে দেখা দিলেন ক্যাপ্টেন ফ্রাঙ্কো।

‘দেখি কেমন মাল এটা।’ এগিয়ে এলেন তিনি। খুঁটিয়ে খুটিয়ে দেখতে লাগলেন। ‘মাত্র ৫০ সেন্ট দিয়ে কিনেছ?’

‘ইয়েস স্যার।’ জবাব দিল পিটারসন। ‘এটা প্রায় সর্বভুক। আমি শস্যদানা দিয়েছিলাম। খুব পছন্দ করেছে। তারপর আলুভর্তা করে দিলাম সেটাও খেলো বেশ মজা করে। ঝুটাকাঁটাও খায়। দুধও। মনে হচ্ছে খেতে খুবই পছন্দ করে ওয়াবটা। খাওয়ার পরই শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।’

‘আচ্ছা,’ বললেন ফ্রাঙ্কো। ‘এখন বলো, এটা খেতে কেমন হবে? এটাই তো মূল প্রশ্ন। ওপরের দিকে এত মোটা এটা। অনেক চর্বি হবে। কুক কোথায়? ওকে ডাকো তো। ও কী বলে একটু ...।

শরীর মোচড়ানো থামিয়ে বিচলিত দৃষ্টি মেলে ক্যাপ্টেনের দিকে তাকাল প্রাণীটা। ‘রিয়েলি ক্যাপ্টেন!’ অবিকল মানবকণ্ঠে কথা বলে উঠল। ‘আমার মনে হয় আমরা বরং অন্য কিছু নিয়ে আলাপ করি।’

পুরো ঘরে সুচপতন নীরবতা। প্রায় দম বন্ধ হওয়ার জোগাড় সবারই।

‘কী হলো এটা?’ পয়লা মুখ খুললেন ফ্রাঙ্কো। ঘরের লোকজনের দিকে তাকিয়ে আবার বললেন, ‘কে কথা বলল?’

‘ওয়াবটা স্যার।’ পিটারসন বলল, ‘ওটাই কথা বলেছে মনে হলো।’

ঘরের সবাই মিলে তাকাল প্রাণীটার দিকে।

‘কী বলল? কী বলল ওটা?’

‘বলল, আমরা যেন অন্য কিছু নিয়ে আলাপ করি।’

ফ্রাঙ্কো উঠে ওয়াবটার দিকে গেলেন। চারপাশ থেকে ওটাকে ভালো করে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন। ‘আমার মনে হচ্ছে ওটার ভেতর কোনো নেটিভ লুকিয়ে আছে।’ বেশ ভেবেচিন্তে বললেন তিনি। ‘ওটাকে কেটে ভেতরটা দেখা যাক, ঘটনাটা কী।’

‘ওহ খোদা!’ কাতরস্বরে বলল ওয়াবটা, ‘আপনারা কি মারাকাটা ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারেন না?’

এক হাত মুষ্টিবদ্ধ করে ওয়াবের দিকে তাক করলেন ফ্রাঙ্কো, ‘তুই যেই হোস না কেন আগে ওটার ভেতর থেকে বেরিয়ে আয়।’

ওয়াবের মধ্যে কোনো ভাবান্তর দেখা গেল না। ঘরের সব মানুষ এক জায়গায় জড়ো হয়েছে। সবার মুখ ফ্যাকাশে, নিষ্পলকে তাকিয়ে আছে ওয়াবটার দিকে। শব্দ করে লেজ নাড়াল প্রাণীটা। আচমকা একটা ঢেঁকুর তুলল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই লজ্জিতস্বরে বলল, ‘আই বেগ ইওর পারডন।’

‘আমার মনে হয় না ওটার ভেতরে কোনো মানুষ আছে।’ প্রায় ফিসফিস করে বলল জোন্স। সব ক্রু একবার দৃষ্টি বিনিময় করল নিজেদের মধ্যে।

এমন সময় এল কুক।

‘আমাকে ডেকেছেন ক্যাপ্টেন।’ ঘরে ঢুকেই ক্যাপ্টেনের কাছে চলে এল সে। তারপরই ওয়াবটার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এটা কী?’

‘এটা একটা ওয়াব।’ বলল ফ্রাঙ্ক। ‘এটাকে খেতে হবে। কীভাবে রান্না করবে ভেবে ... ’

‘আমার মনে হয় আমাদের একটু আলাপ করা দরকার।’ বলে উঠল ওয়াবটা। কুকের বস্ফািরিত নেত্রকে উপেক্ষা করে ফ্রাঙ্কোর দিকে তাকাল সে, ‘আপনি অনুমতি দিলে, ক্যাপ্টেন, আপনার সঙ্গে বিষয়টা নিয়ে আলাপ করতে চাই। আমি বুঝতে পারছি কিছু মৌলিক বিষয়ে আপনার সঙ্গে আমার দ্বিমত আছে।’

উত্তর দিতে অনেকটা সময় নিলেন ক্যাপ্টেন। তারপর বললেন, ‘ওকে। আমার অফিসে এসো।’ বলেই রুম ছেড়ে চলে গেলেন ক্যাপ্টেন।

তিন

ক্যাপ্টেনের ঘরে ঢুকে এক কোনায় গিয়ে বসল ওয়াবটা। ডেস্কের কিনারে হেলান দিয়ে ক্যাপ্টেন হাত দুটো ভাঁজ করলেন বুকের ওপর, ‘অল রাইট,’ বললেন তিনি, ‘বলো তোমার কী বলার আছে। তুমি একটা ওয়াব? ঠিক আছে?’

‘জি।’

‘পৃথিবীর মানুষের সঙ্গে এর আগে যোগাযোগ হয়েছে কখনো?’

‘না।’

‘তাহলে ইংরেজিতে কথা বলা কীভাবে শিখলে?’

‘আমি কি ইংরেজিতে কথা বলছি? আমি আসলে নির্দিষ্ট কোন ভাষায় কথা বলছি সে ব্যাপারে আমি মোটেই সচেতন না। আমি আসলে আপনার মনের ভেতরে ঢুকে...’

‘আমার মন?’

‘জি। সেখানে ভাষার যে গুদামঘরটা আছে, সেটাকে ভালো করে স্টাডি করেছি, ব্যস..’

‘আই সি।’ চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন ক্যাপ্টেন। ‘টেলিপ্যাথি, অব কোর্স।’

‘আমরা অনেক পুরোনো জাতি,’ বলতে শুরু করল ওয়াবটা। ‘খুবই পুরোনো এবং বিপুলায়তন। বেশি চলাফেরা করা আমাদের জন্য খুব কষ্টকর। আপনি নিশ্চয়ই বুঝবেন যে এ রকম একটা ধীরগতির ভারী প্রাণী ক্ষিপ্রগতির প্রাণীদের দয়ায় বেঁচে থাকে। নিজেদের দেহটাকে রক্ষা করার কোনো উপায় আমাদের নেই। আমরা কীভাবে কারও সঙ্গে পেরে উঠব বলেন। এত ভারী শরীর, দৌড়াতে পারি না। এত নরম হাত-পা, কাউকে মারলে সে আরামই পাবে। মনটাও এত কোমল যে কোনো কিছু শিকার করতেও আগ্রহ হয় না...

‘তাহলে বেঁচে আছো কীভাবে? খাও কী?’

‘গাছপালা, শাকসবজি। সবকিছুই খেতে পারি আমরা। তবে কোনো কিছুকে মেরেকেটে নয়। নিজে বাঁচো, অন্যকে বাঁচতে দাও—এটাই আমাদের জীবনদর্শন।’

বলতে বলতে আড়চোখে ক্যাপ্টেনের দিকে তাকাল ওয়াবটা।

‘এবং এ কারণেই আমাকে রান্না করে খাওয়ার টেবিলে নেওয়ার ব্যাপারে প্রবলভাবে আপত্তি জানিয়েছি। আমি আপনার মনের কথা পড়তে পারছি ক্যাপ্টেন। সেখানে দেখতে পাচ্ছি আমার শরীরের অনেকটা অংশ ফ্রোজেন ফুড লকারে, কিছু কেটলিতে, সামান্য কিছু অংশ আপনার পোষা বিড়ালটার জন্য...’

‘আচ্ছা, আচ্ছা। তুমি তাহলে মনের কথা পড়তে পারো।’ কিছুটা শ্লেষের সঙ্গে বললেন ক্যাপ্টেন। ‘ইন্টারেস্টিং। আর কিছু? মানে এ রকম আর কী কী করতে পারো?’

‘পারি। কিছু পাঁচমিশালী কাজ’, ঘরের চারদিকে আনমনে তাকাতে তাকাতে বলল ওয়াবটা। ‘আপনার অ্যাপার্টমেন্টটা চমত্কার। বেশ ঝকঝকে করে রেখেছেন। যেসব প্রাণী পরিপাটি থাকে তাদের আমার ভালো লাগে।...’

‘বটে!’ মাথা ঝাঁকালেন ক্যাপ্টেন। ‘তো মূল আলোচনায় আসা যাক...’

‘বেশ। কথা হচ্ছিল আমাকে খাওয়া নিয়ে। কিন্তু ক্যাপ্টেন এ ধরনের বর্বর মনোভাবকে প্রশ্রয় দিলে আমাদের সঙ্গে আপনাদের যোগাযোগ কীভাবে টেকসই হবে বলেন? আমাকে না খেয়ে বরং দর্শন বা শিল্পকলার নানা সমস্যা নিয়ে আলাপ করুন। আপনার... ’

‘হুহ, দর্শন! শোনো,’ ক্যাপ্টেন উঠে দাঁড়ালেন। ‘মহাশূন্যে মাসের পর মাস ভেসে থাকতে গেলে অনেক খাবার দরকার।’

‘জানি, আমি জানি।’ চিন্তিত দেখাল ওয়াবটাকে। ‘আচ্ছা, আপনারা তো গণতন্ত্র মেনে চলেন, তাই না? আপনাদের গণতান্ত্রিক রীতিনীতির সঙ্গে এটা খুব সংগতিপূর্ণ হতো যদি সবাই একটা করে ভোট দেয় আর তারপর...। আফটার অল, গণতন্ত্রই পারে এ রকম অনিয়ম থেকে সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা দিতে।...’

ক্যাপ্টেন হেঁটে গেলেন দরজার দিকে।

‘চুলোয় যাও।’ বলে দরজাটা খুললেন। তারপর মুখটা খুললেন, কিন্তু কিছু বলার আগেই ওই অবস্থাতেই নট নড়নচড়ন অবস্থায় দাঁড়িয়ে রইলেন। হাতটা তখনো নবের ওপরে, চোখ মেলে তাকিয়ে আছেন, কিন্তু পুরো শরীরটাই ফ্রিজড।

ওয়াবটা দেখল তাকে, তারপর অনতিবিলম্বে ক্যাপ্টেনকে পাশ কাটিয়ে হেলেদুলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

চার

ওপরের ঘরে দুজনের বেশ আড্ডা জমেছে। চুপ করে ওয়াবটার কথা শুনছিল পিটারসন।

‘আমাদের মধ্যেও নানা রকম মিথ প্রচলিত আছে। এবং আপনাদের মনেও নানা রকম পরিচিত পৌরাণিক প্রতীক নানাভাবে কাজ করে নিশ্চয়ই। ইস্তার, অডেসিয়াস... আপনাদের অধিকাংশ আত্মসচেতন জাতির মধ্যে আপনাদের পুরাণের একটা কমন ফিগার অডিসিয়াসের ছায়া দেখতে পাই। আমি যেভাবে বিষয়টা দেখতে পাচ্ছি, অডিসিয়াস একা একাই ঘুরে বেড়ায়, বিভিন্ন দিকে অভিযাত্রা করে, নিজের ওপর প্রবল আস্থা তার। পরিবার থেকে, দেশ থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন ভাবার ধারণাটা, আমার মনে হয়, এখান থেকেই এসেছে। এটাই ব্যক্তিস্বাত্যন্ত্রবাদের সূচনা করেছে।’

‘কিন্তু অডিসিয়াস তো বাড়িতে ফিরেছিল।’ পোর্ট উইন্ডো দিয়ে বাইরের তারকারাজির দিকে তাকিয়ে বলল পিটারসন।

‘অধিকাংশ প্রাণী তা-ই করে। বিচ্ছিন্নতাটা সাময়িক। একটা সংক্ষিপ্ত ভ্রমণের মতো। শুরু হয়, শেষ হয়। পর্যটক তার দেশে, স্বজাতির কাছে ফিরে আসে...’

হঠাৎ সশব্দে দরজাটা খুলে ঘরের ভেতর ঢুকলেন ক্যাপ্টেন ফ্রাঙ্কো। তাঁর পেছনে অনেকে, ফেঞ্চের হাতে বন্দুক, তাক করা ওয়াবটার দিকে। উদ্বেগের সঙ্গে পিটারসনকে জিজ্ঞেস করল সে, ‘আর ইউ অল রাইট?’

‘আমাকে জিজ্ঞেস করছ?’ বিস্মিত পিটারসন। ‘কেন, কী হয়েছে?’

‘এদিকে চলে এসো।’ জোন্স ইশারা করল পিটারসনকে। ‘ওঠো, উঠে এসো।’

‘ডাকছে যখন যাও।’ মৃদুস্বরে বলল ওয়াবটা, ‘নো প্রোবলেম।’

‘কিন্তু কেন? কী হয়েছে?’ উঠে দাঁড়াল পিটারসন।

‘ইটস অ্যান অর্ডার। তুমি এদিকে এসো।’

দরজার দিকে হেঁটে গেল পিটারসন। ফ্রেঞ্চ তার হাতটা ধরে যেন নিরাপদ দূরত্বে টেনে নিল।

হাতটা ছাড়িয়ে নিল পিটারসন, ‘হচ্ছেটা কী, বলবে তো?’

অদ্ভুতদর্শন প্রাণীটার দিকে এগিয়ে গেলেন ফ্রাঙ্কো।

‘এটা খুবই ইন্টারেস্টিং,’ তাকে লক্ষ্য করে বলল ওয়াব। ‘আমাকে খাওয়ার আইডিয়াটা মাথা থেকে তাড়াতেই পারছেন না আপনি। আমি বুঝতে পারছি না কেন?’

‘ওঠো।’ রীতিমতো হুংকার দিলেন ফ্রাঙ্কো।

‘জো হুকুম।’ উঠে দাঁড়াল ওয়াবটা।

‘এক্ষুনি এটাকে গুলি করো।’ বলল ফ্রাঙ্কো।

‘ফর গডস সেক!’ চিত্কার করে উঠল পিটারসন। জোন্স জাপটে ধরল ওকে, ‘তুমি ওকে দেখোনি পিটারসন—একটা মূর্তির মতো, ওখানে দাঁড়িয়েছিল, মুখ খোলা। আমরা নিচে না এলে এখনো ওখানেই থাকত।’

‘কে? কাকে দেখিনি? ক্যাপ্টেনকে?’ আশপাশে তাকালো পিটারসন। ‘কিন্তু এখন তো তিনি ঠিকই আছেন দেখতে পাচ্ছি।’

ওরা সবাই তাকালো আবার ওয়াবটার দিকে।

‘আপনি খুব ভয় পেয়েছেন, তাই না?’ ফ্রাঙ্কোকে লক্ষ্য করে বলল প্রাণীটা। ‘আমি কি আপনার কোনো ক্ষতি করেছি? যা করেছি শুধু নিজেকে রক্ষা করার জন্য। দেখুন, আমিও আপনাদের মতো সংবেদনশীল প্রাণী। জাহাজটা দেখার খুব কৌতূহল ছিল আমার, শিখতে চাচ্ছিলাম কীভাবে ...’

জোন্সের কাছ থেকে বন্দুকটা নিলেন ফ্রাঙ্কো।

‘তাই, না!’ শ্লেষের সুরে বললেন, ‘আমি সে রকমটাই ভাবছিলাম।’

ওয়াবটা বসল, ‘গরম লাগছে। আমরা মনে হয় জেটের খুব কাছাকাছি আছি। অ্যাটমিক পাওয়ার। টেকনিক্যালি আপনারা কিন্তু অনেক চমত্কার কাজ করেছেন। তবে আপনাদের বৈজ্ঞানিক অগ্রযাত্রা নৈতিক অবস্থার বিশেষ উন্নতি ঘটাতে পারেনি।...’

‘চোপ!’ হুংকার দিলেন ফ্রাঙ্কো।

‘শুনুন ক্যাপ্টেন,’ শেষবার চেষ্টা করল পিটারসন, ‘ও কী ক্ষতি করেছে বলুন? তা ছাড়া যেভাবেই হোক এখনো পর্যন্ত ও আমার সম্পত্তি। আপনার কোনো অধিকার নেই ওকে গুলি করার।’

কোনো জবাব না দিয়ে ফ্রাঙ্কো বন্দুকটা তুলে ধরলেন।

পিটারসন আবার বলল, ‘ও আমার সঙ্গে পুরাণ নিয়ে আলাপ করছিল। কারও ক্ষতি করত না ও।’

ওয়াবটার দিকে এগিয়ে গেল ফ্রাঙ্কো। ধীরে ধীরে ওপরের দিকে তাকাল প্রাণীটা। ঢোক গিলল। ‘খুবই বোকার মতো কাজ হচ্ছে,’ বলল ও। ‘আমার খুবই খারাপ লাগছে যে আপনি এই কাজটা করতে চাাচ্ছেন। ঈশপের একটা গল্প আছে, যেখানে যে ত্রাতা তার...’ বলতে বলতে উদ্যত বন্দুকটার দিতে তাকিয়ে থেমে গেল ওয়াব। ‘আচ্ছা, আপনি কি আমার চোখে চোখ রেখে কাজটা করতে পারবেন?’

‘পারব। আমাদের ওখানে অনেক নোংরা প্রাণী আছে। কাজটা আমার জন্য মোটেই কঠিন না।’

ওয়াবটার ভেজা চকচকে চোখের দিকে তাকিয়ে ট্রিগার চেপে দিলেন ক্যাপ্টেন ফ্রাঙ্কো।

পাঁচ

খেতে বেশ মজাই লাগল। টেবিলের চারপাশে গোমড়ামুখে বসে খাচ্ছিল ওরা। কেউ কেউ নামে মাত্র নাড়াচাড়া করল। একমাত্র ক্যাপ্টেন ফ্রাঙ্কোকে দেখেই মনে হলো বেশ তৃপ্তিসহকারে খাচ্ছেন তিনি।

‘আরও একটু চলবে নাকি,’ চারদিকে তাকালেন তিনি।

‘আমি আর নেব না,’ বলল ফ্রেঞ্চ। ‘চার্ট রুমে যাব।’

‘আমিও,’ বলতে বলতেই উঠে দাঁড়াল জোন্সও।

ওদের গমন পথের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন ক্যাপ্টেন। ‘ঘটনাটা কী বলো তো?’ পিটারসনের দিকে ফিরে জানতে চাইলেন। মাথা নিচু করে প্লেটে রাখা আলু, সবুজ মটরশুঁটি আর গরম মাংসের একটা বড় টুকরার দিকে তাকিয়ে ছিল পিটারসন। ‘দ্যাখো, এটা এখন স্রেফ একটা জৈব পদার্থ।’ বলতে বলতে আবার এক টুকরা ব্রেডের সঙ্গে অনেকটা মাংস চালান করে দিলেন পেটে। ‘আমি নিজে খেতে ভালোবাসি। এটা একটা বিরাট আনন্দের ব্যাপার। খাওয়াদাওয়া, বিশ্রাম করা, ধ্যান করা, বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করা...’

পিটারসন মাথা ঝাঁকাল। আরও দুজন উঠে চলে গেল টেবিল ছেড়ে। ক্যাপ্টেন পানি খেলেন এবং লম্বা করে একটা দম নিলেন। ‘ওয়েল,’ বললেন, ‘খাবারটা খুবই মজার ছিল, বলতেই হবে। খুব ভালো। অথচ এই আনন্দ থেকে আমাকে বঞ্চিত করার চেষ্টা হয়েছে। কী আশ্চর্য!’

ন্যাপকিন দিয়ে মুখটা মুছলেন তিনি। হেলান দিলেন চেয়ারে। চোখ বুজে রইলেন কিছুক্ষণ, যেন ধ্যানস্থ হলেন। খানিক বাদে যখন চোখ খুললেন মনে হলো চেহারাটা বদলে গেছে তার। মুখে এক টুকরো স্মিত হাসি।

পিটারসন তখনো মনমরা চোখে তাকিয়ে ছিল টেবিলের ওপর। ওর দিকে ঝুঁকলেন ক্যাপ্টেন, কাঁধে হাত রাখলেন, ‘আরে ছাড়ো। চলো মন খুলে আলাপ করা যাক।’

‘আচ্ছা কোথায় যেন ছিলাম আমরা। কোথায় যেন থামিয়ে দেওয়া হলো আমাকে, ওহ, হ্যাঁ, মনে পড়েছে, পুরাণে অডিসির ভূমিকা...’

‘হোয়াট?’ প্রবল একটা ঝাঁকি দিয়ে ক্যাপ্টেনের দিকে তাকাল পিটারসন। চোখ বড় বড় হয়ে গেছে তার।

‘যা বলছিলাম,’ একটা চোখ টিপে ক্যাপ্টেন বলতে লাগলেন, ‘অডিসিয়াস, আমি যে রকমটা বুঝেছি তাকে, বুঝলে...’

(ঈষৎ সংক্ষেপিত)