ডগ স্টার

Abdul Gaffar

যখন আমি লাইকার কর্কশ গলা শুনতে পেলাম, তখন আমার প্রথমে খুব রাগ হয়েছিল। আমি বাংকের ওপর ঘুরে শুলাম, ঘুম জড়ানো গলায় বিড় বিড় করে বললাম, ‘চুপ, জঘন্য জানোয়ার।’ স্বাপ্নিক এই নাটিকাটি টিকল মাত্র এক সেকেন্ডের ভগ্নাংশ; তারপর আমার চেতনা ফিরে এল, আর সেই সঙ্গে এল, ভীতি। একাকিত্বের ভীতি, পাগলামির ভীতি।

একমুহূর্ত আমি চোখ দুটো খুলতে ভয় পেলাম; কী দেখতে কী দেখে ফেলি, এই ভয়। সংগত কারণেই এই জগতে কোনো কুকুর পা রাখেনি, লাইকা মহাকাশে কোয়ার্টার মিলিয়ন মাইল দূরে চলে গেছে—তা–ও আবার পাঁচ বছর আগে।

‘তুমি স্বপ্ন দেখছিলে,’ রাগের সঙ্গে নিজেকে বললাম, আমি। ‘বোকামো বন্ধ করো, চোখ খোলো! দেয়ালের উজ্জ্বল রং ছাড়া কিছুই দেখতে পাবে না।

এটা ঠিক। ছোট্ট কেবিনটা খালি, দরজা বন্ধ। আমি আমার স্মৃতি রোমন্থন করতে থাকি, উজ্জ্বল একটা স্বপ্নের করুণ পরিণতিতে আমার ভেতর দুঃখ এসে গ্রাস করল। হারানোর অনুভূতি এতটাই নিঃসঙ্গ ছিল যে আবারও ঘুমে অচেতন হয়ে পড়ি। এটা ঠিক যে আমি কাজটা ঠিকমতো করতে পারিনি, ঘুম অনেকটা মৃতের মতো। কিন্তু আমি পাঁচ সেকেন্ডও মনে রাখতে পারিনি এবং এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তির জন্য ফিরে গেলাম পৃথিবীতে, খুঁজতে লাগলাম অতীতে ফেলে আসা স্মৃতি।

কেউই লাইকার অরিজিন বের করতে পারেনি, যদিও অবজারভেটরির স্টাফ করেছিল কয়েকটা অনুসন্ধান, আমিও পাসাডেনা নিউজ পেপারে কয়েকটা বিজ্ঞাপন দিই। ওকে পেয়েছিলাম এক গ্রীষ্মের দুপুরে প্যালোমা যাওয়ার পথে রাস্তার পাশে তালগোল পাকানো অবস্থায়। যদিও আমি কুকুর পছন্দ করি না, কিংবা অন্য কোনো প্রাণী, তারপরও এই অবস্থায় অসহায় এই প্রাণীটাকে ফেলে রেখে যেতে পারলাম না। অন্য কোনো গাড়ি চাপা দিয়ে যেতেও পারে। তাই বিবেকের তাড়নায় ভাবলাম, আমার তো দুটো গ্লাভস আছেই, ওটাকে ব্যাগেজ কম্পার্টমেন্টে তুলে রাখলাম। আমি আমার নতুন ৯২ ডিক গাড়ির আসবাবপত্র নষ্ট হতে দিতে চাইলাম না, যা নষ্ট করার, ব্যাগেজ কম্পার্টমেন্টেই করুক। সব কিছু মিলিয়ে আমি সঠিক ছিলাম না।

আমি যখন মনস্টারিতে গাড়ি পার্ক করলাম—মহাকাশচারীদের বাসস্থান, যেখানে আমি পরবর্তী দুই সপ্তাহ থাকব—আমি বেশি উত্সাহ না দেখিয়ে পরীক্ষা করে দেখলাম আমার নতুন পাওয়া জিনিসটা। আমি মনস্থ করেছিলাম, বাচ্চাটাকে পরিচারকের হাতে তুলে দেব; কিন্তু ওটা কুঁই কুঁই করে উঠল চোখ মেলে। তার চেহারায় অসহায়ত্ব প্রকাশ পাচ্ছে, তাই আমি আমার মনস্থির পরিবর্তন করলাম।

মাঝেমধ্যে আমার ওই সিদ্ধান্তের জন্য দুঃখ প্রকাশ করি, তবে বেশিক্ষণের জন্য নয়। আমার কোনো ধারণা ছিল না একটা পূর্ণবয়স্ক কুকুর কতটা ঝামেলা করতে পারে। আমার পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন এবং মেরামতের বিল যন্ত্রণার পর্যায়ে চলে গেল: আমি নিশ্চিত নই, পরিষ্কার একজোড়া মোজা কিংবা না কামড়ানো অ্যাস্ট্রোফিজিক্যাল জার্নাল পেয়ে যাব। কিন্তু লাইকার বাড়ি এবং অবজারভেটরি শিক্ষা দিল: সে-ই একমাত্র কুকুর, যাকে দুই শ ইঞ্চি ডোমে ঢুকতে অনুমতি দেওয়া হয়েছে। সে সেখানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ছায়ায় শুয়ে থাকত শান্তভাবে আর আমি খাঁচার ভেতর ঢুকে কাজ করতাম। সেখান থেকে সে আমার গলার শব্দ শুনতে পেত। অন্য অ্যাস্ট্রোনোমাররা ওর ভক্ত হয়ে গেল (বুড়ো ড. অ্যান্ডারসন ওর নামটা দিয়েছিলেন), কিন্তু প্রথম দিকে ও আমার কুকুর ছিল এবং অন্য কাউকেই মানত না ও। এটা ঠিক নয় যে ও সব সময় আমাকে মানত।

ও খুব সুন্দর প্রাণী, শতকরা পঁচানব্বই ভাগ অ্যালসেশিয়ান। শতকরা পাঁচ ভাগ কম ছিল বলেই আমার মনে হয় ওকে ফেলে রেখে গিয়েছিল (আমি এখন পর্যন্ত ওই কথাটা ভাবলেই প্রচণ্ড রেগে যাই, যদিও আমি আসল ঘটনাটা জানি না, আমি হয়তো ভুল সমাধানের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ছি)। চোখ দুটোয় দুটো কালো ছোপ আছে, সারা শরীরের রং খোলাটে ছাই আর ওর গায়ের লোম নরম এবং সিল্কি। যখন ওর কান দুটো খাড়া হয়ে যায়, তখন ওকে বুদ্ধিমান এবং সতর্ক মনে হয়। আমি সহকর্মীদের সঙ্গে স্টেলার এভুলেশনের স্পেকট্রাল টাইপ নিয়ে আলোচনা করি। তখন আমার মনে হয় সে আমাদের আলোচনা শুনছে!

এমনকি এখন আমি বুঝতে পারছি না আমার সঙ্গে কেন আছে? কারণ আমার বন্ধুর সংখ্যা খুবই কম। তারপরও আমি যখন অবজারভেটরি থেকে ফিরে আসতাম, তখন সে ভীষণ আনন্দিত হতো। পেছনের পায়ের ওপর দাঁড়িয়ে সামনের পা দুটো আমার কাঁধের ওপর তুলে দিত। খুব সহজেই পা দুটো তুলতে পারত সে। তারপর কুঁই কুঁই শব্দ বের হতো এত বড় কুকুরের মুখ থেকে। ওকে ছেড়ে কয়েক দিনমাত্র আলাদা থাকতেও কষ্ট হতো আমার। তবু আমি ওকে সঙ্গে করে নিতাম না। ছোট ছোট সফরগুলোতে সে আমার সঙ্গে যেত। একবার উত্তরের শহর বার্কলেতে সেমিনারে যোগ দিয়েছিলাম, তখন ওকে সঙ্গে করে নিয়েছিলাম।

আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচিত কিছু বন্ধুর আতিথ্য গ্রহণ করেছিলাম। তারা কুকুরটার সঙ্গে মার্জিত আচরণ করত। কিন্তু ঘরের ভেতর একটা জানোয়ার থাকবে, এটা মেনে নিতে পারছিলেন না। যাহোক, আমি তাদের আশ্বস্ত করলাম যে লাইকা বিন্দুমাত্র সমস্যা করবে না। অনিচ্ছা সত্ত্বেও তারা কুকুরটাকে লিভিং রুমে ঘুমানোর ব্যবস্থা করলেন। ‘আজ রাতে চোরের উপদ্রব ভাবতে হবে না তোমাদের,’ বললাম আমি। ‘বার্কলেতে চোর নেই,’ জবাবে ঠান্ডা গলায় বললেন তারা।

কিন্তু মাঝরাতে, মনে হলো ওদের ধারণা ছিল ভুল। আমার ঘুম ভেঙে গেল লাইকার ঘেউ ঘেউ ডাকে। এমন ডাক এর আগে আমি একবারই শুনেছিলাম। সেদিন ও প্রথম গরু দেখেছিল। কিন্তু বুঝে উঠতে পারছিলাম না আজ কেন সে এমনটি করছে? ধমক দিয়ে, গায়ের চাদর ছুড়ে ফেলে অন্ধকারে পা রাখলাম অপরিচিত বাড়ির মেঝেতে। লাইকাকে শান্ত করতে হবে, তা না হলে গৃহস্বামীকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলবে। অনুমান করলাম, এখনো ওদের ঘুম ভাঙেনি হয়তো। যদি ঘরের ভেতর কেউ ঢোকে, তাহলে তাকে এখনই ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে হবে। হয়তো আমার ধারণা বেরিয়ে গেছে।

সিঁড়ির ওপর সুইচের পাশে দাঁড়িয়ে দ্বিধায় পড়ে গেলাম। তারপর কড়া ধমক দিয়ে বলে উঠলাম, ‘চুপ করো, লাইকা!’

সুইচে হাত দিতেই আলোয় ঝলমলিয়ে উঠল চারদিকে।

দেখলাম সে দরজা আঁচড়াচ্ছে আর থেমে থেমে তারস্বরে কী চিত্কার করছে! ‘বাইরে যদি যেতে চাও,’ রাগত গলায় বললাম আমি, ‘এত হইচইয়ের কী আছে!’ নিচে নেমে দরজাটা খুলে দিতেই রকেটের গতিতে বাইরের অন্ধকারে বেরিয়ে গেল।

নীরব এবং শান্ত পরিবেশ। সানফ্রান্সিসকোর কুয়াশার ভেতর দিয়ে মাঝেমধ্যে চাঁদ উঁকি দিচ্ছে। আমি দাঁড়িয়ে রইলাম কুয়াশাচ্ছন্ন অস্পষ্ট পরিবেশে, তাকিয়ে রইলাম নদী ছাড়িয়ে শহরের আলোর দিকে। লাইকার ফিরে আসার অপেক্ষায় ধৈর্য ধরে দাঁড়িয়ে রইলাম। আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম তখনো, যখন বিংশ শতাব্দীতে দ্বিতীয়বারের মতো স্যান অ্যান্ড্রিয়াস ফস্ট জেগে উঠল।

প্রথমে ভয় পাইনি আমি। পরে বিপদের মাত্রাটা বুঝতে পারলাম। তখন দুটো চিন্তা আমার মনের ভেতর দিয়ে চলে গেল। ‘আমি নিশ্চিত,’ ‌নিজেকে বললাম আমি, জিওফিজিস্টদের আমাদের সতর্ক করা উচিত ছিল। তারপর আশ্চর্য হয়ে ভাবলাম, ‘আমার কোনো ধারণা ছিল না, ভূমিকম্পের এত আওয়াজ হয়!’

পরে আমি জেনেছি, এটা কোনো সাধারণ ভূমিকম্প ছিল না। পরে কী ঘটেছিল সেটা আমি ভুলে যেতে চাই। পরদিন সকালে শান্ত হওয়ার পর রেডক্রসের কর্মীরা আমাকে নিতে এসেছিল। আমি যাইনি, কারণ লাইকাকে রেখে যেতে পারি না আমি। তাকিয়ে দেখলাম, আমার বন্ধুদের বাড়ি ধ্বংস হয়ে গেছে এবং তার ভেতর চাপা পড়েছে বন্ধুদের মৃতদেহ। আমি লাইকার কাছে ঋণী আমার জীবন বাঁচানোর জন্য। কিন্তু হেলিকপ্টারের পাইলট তা বুঝতে চাইল না। সে ভাবল আমি বোধ হয় পাগল হয়ে গেছি। অবশ্য এটা ভাবা তাদের অন্যায় নয়। আরও অনেকে পাগলের মতো আগুন এবং ধ্বংসস্তূপের ভেতর তাদের আত্মীয়স্বজনকে খুঁজছে।

হঠাৎ লাইকা ফিরে এল। এরপর থেকে আমি কয়েক ঘণ্টার জন্যও ওর থেকে আলাদা হাইনি। আমি বলেছি এবং আমি বিশ্বাস করি, আমার মানবসঙ্গের প্রতি আগ্রহ খুব কম। তারকামণ্ডলী ও লাইকাই আমার জীবনটা ভরে রেখেছিল। আমরা একসঙ্গে পাহাড়ে ঘুরতে যেতাম। আমার জীবনের সবচেয়ে বেশি আনন্দ ছিল ওই পাহাড়ে হাঁটতে যাওয়াটা। এটায় একটা ভাঙন ধরেছে। আমি জানি, তবে লাইকা জানে না, কতটা তাড়াতাড়ি জোড়া লাগবে।

দশকজুড়ে আমাদের পরিকল্পনা ছিল ঘুরে বেড়ানোর। ১৯৬০ সালের দিকে বোঝা গেল যে অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল অবজারভেটরির জন্য পৃথিবী উপযুক্ত জায়গা নয়। চাঁদের বুকে ছোটখাটো যন্ত্রগুলো অতি পুরোনো হলেও সবগুলো টেলিস্কোপ অন্ধকার এবং অস্পষ্ট অপার্থিব বায়ুমণ্ডলের দিকে তাকিয়ে আছে। মাউন্ট উইলসন, প্যালোমার, গ্রিনউইচ এবং অন্যান্য বিখ্যাত জায়গাগুলো এবার পরিত্যাগ করা হবে। ওই সব জায়গা তখন পর্যন্ত প্রশিক্ষণের জন্য ব্যবহার হয়। তবে রিসার্চের জন্য মহাকাশের অন্য কোথাও নিতে হবে ওগুলোকে।

আমাকে এবার যেতে হবে। ইতিমধ্যে ফারসাইড অবজারভেটরি ডেপুটি ডিরেক্টর পদে পদোন্নতি করা হয়েছে আমাকে। কয়েক মাসের মধ্যে আমি সমাধান করতে পারব। এগুলো নিয়ে গত কয়েক বছর কাজ করে যাচ্ছি। বায়ুমণ্ডলের পেছনে, আমি একেবারে অন্ধ মানুষ, যাকে হঠাৎ করে আলোর পথ দেখানো হয়েছে।

আমি লাইকাকে সঙ্গে নিতে চাই, কিন্তু সেটা একেবারেই অসম্ভব। চাঁদে শুধু গবেষণার পশুদের নিয়ে যাওয়া যায়। হয়তো আরেক জেনারেশনের পর পোষা প্রাণী নিয়ে যাওয়ার জন্য অনুমতি দেওয়া হবে। আর এখন ওদের নিয়ে যাওয়াটা প্রচুর খরচের ব্যাপার। ওখানে ওদের বাঁচিয়ে রাখার খরচ আরও বেশি। প্রতিদিন লাইকার দুই পাউন্ডের মতো মাংস লাগে। হিসাব করে দেখলাম, আমার যে বেতন, তাতে সে খরচ কয়েকবার মাত্র করতে পারব।

সিদ্ধান্তটা সাধারণ এবং সোজাসাপ্টা। আমি ক্যারিয়ার বাদ দিয়ে পৃথিবীতে থেকে যাব। কিংবা আমি চাঁদে চলে যাব লাইকাকে বাদ দিয়ে। সে যাই–হোক, লাইকা একটি কুকুর বৈ তো কিছু নয় অন্যদের কাছে। আমি তাকে ছেড়ে গেলে, কে জানে, ঘুমের মধ্যেই হয়তো সে মারা যাবে। মানুষই দ্বিধা করবে না এই অবস্থায়, এই মুহূর্তে তুমি পুরো ব্যাপারটা বুঝবে না, অন্য কোনো শব্দ আমাকে বুঝ দিতে পারবে না।

অবশেষে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়ে উঠল। এক সপ্তাহের ভেতর আমাকে পৃথিবী ছাড়তে হবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত আমি লাইকার জন্য কোনো পরিকল্পনা করিনি। ড. অ্যান্ডারসন তার দায়িত্ব নিতে চাইলেন। আমি হতবুদ্ধির মতো ধন্যবাদ জানালাম। বুড়ো ফিজিজিস্ট এবং তার স্ত্রী সব সময়ই লাইকার ভক্ত ছিলেন। আমার মনে হয় তারা হয়তো ভাবছেন আমি কতটা নীরস এবং হৃদয়হীন মানুষ। আমরা আরেকবার পাহাড়ে বেড়াতে বেরোলাম। তারপর আমি নীরবে অ্যান্ডারসনদের কাছে তুলে দিলাম লাইকাকে।

প্রায় ২৪ ঘণ্টা পিছিয়ে গেল আমার টেক অফ। পৃথিবীর কক্ষপথ থেকে বৈদ্যুতিক ঝড় না থামা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। সে সময় ভ্যান অ্যালেন উত্তর মেরুর ওপরের কক্ষপথটা ব্যবহার করা যাবে কি না, সেটা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। ওজনহীনতার সমস্যা তো আছেই। আমরা অ্যান্টিরেডিয়েশন ড্রাগ খেয়ে নিলাম।

মহাকাশযান ইতিমধ্যে ফার সাইডে চলে এসেছে। তখন আমি ব্যস্ত ছিলাম এগিয়ে যাওয়ার কাজে। তাই ওপর থেকে নিচের পৃথিবীকে দেখতে পাইনি। না, আমি তাতে দুঃখিত নই। আমি কোনো কিছু মনে করতে চাই না, শুধু ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতেই চাই। এমনকি আমি অপরাধবোধ থেকে নিজেকে একচুলও নড়তে দিইনি। আমি আমার প্রিয় ও বিশ্বাসী কাউকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছি। ছোট্ট লাইকাকে একদিন তার মালিক পালোমার নোংরা রাস্তার পাশে ফেলে রেখে গিয়েছিল। সেই মালিকের চেয়েও আমি কম অপরাধী নই।

এক মাস পর আমি জানতে পারলাম লাইকা মারা গেছে। কী কারণে মারা গেছে, কেউ জানে না। অ্যান্ডারসনরা সাধ্যমতো চেষ্টা করেছেন। তারাও লাইকার মৃত্যুতে শোকার্ত। মনে হয়, লাইকা জীবনের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিল। তখন আমারও জীবনের প্রতি আগ্রহ কমে গেল। তবে কাজ ছিল খুবই সুন্দর যন্ত্রণা, আর আমার কাজ এগিয়ে যেতে লাগল। তবু আমি লাইকাকে ভুলে যেতে পারিনি। প্রায়ই তার স্মৃতি আমাকে কষ্ট দেয়।

পাঁচ বছর ধরে সুদূর চাঁদেও আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে কষ্টটা। আমি কারণ খোঁজার চেষ্টা করতেই মেটালের দালানটা যেন থর থর করে কেঁপে ওঠে প্রচণ্ড ধাক্কায়। কিছু চিন্তা না করে আমার ইমার্জেন্সি স্ক্যাটের হেলমেটটা মাথায় চাপালাম। ফাউন্ডেশন পিছলে গেল এবং দেয়াল ফাঁক হয়ে শব্দ তুলে বেরিয়ে যাচ্ছিল বাতাস। কারণ, আমি স্বয়ংক্রিয়ভাবে অ্যালার্ম বাটনে চাপ দিয়ে ফেলেছি। আমাদের মাত্র দুজন প্রাণ হারাল, আসলে ভূমিকম্প হয়েছিল। ফারসাইড সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে। ফাটল ধরেছে তিনটি অবজারভেটরি প্রেসার ডোমে।

আমি অতিপ্রাকৃতিক শক্তিতে বিশ্বাস করি না। সবকিছুরই যৌক্তিক ব্যাখ্যা আছে যেকোনো সাইকোলজি জানা লোকের কাছে। সানফ্রান্সিসকোতে ভূমিকম্পের সময় শুধু লাইকাই পূর্বাভাস পেয়েছে, তা নয়। অনেকেই পেয়েছে, সে রিপোর্ট আছে। আর এখানে ফারসাইডে আমার নিজের স্মৃতিই আমাকে সতর্ক করে দিয়েছে। আমার ঘুমে তুলিয়ে যাওয়ার পরই প্রথম কম্পনটা টের পেয়ে যাই।

মানুষের মন খুবই বিচিত্র এবং জটিল পথ ধরে কাজের দিকে এগিয়ে যাবে। সংকেতটা জানে বলেই বিপদের কথা মনে করিয়ে দিয়ে আমাকে জাগিয়ে তুলেছে সেই মনই। এ ছাড়া আর কিছুই নয়। তারপর একরোখা দৃষ্টিতে কেউ কেউ বলবে, লাইকাই আমাকে দুটো ঘটনার সময় জাগিয়ে তুলেছে। এতে কোনো রহস্য নেই, নেই কোনো অলৌকিক সতর্কতা। গালফজুড়ে ছিল না মানুষ কিংবা কুকুরের সংযোগ।

আমি নিশ্চিত, যদি আমি কোনো কিছুতে নিশ্চিত হই আরকি। তারপরও নীরব এই চাঁদে আমি এখনো জেগে উঠি। আমার মনে হয় স্বপ্ন মাত্র কয়েক সেকেন্ড স্থায়ী হয়। তারপরও আমি স্বপ্নে সেই কালো ছোট ছোট চোখ দুটো আবার দেখেছি। তাতে কানায় কানায় পূর্ণ ছিল নিঃস্বার্থপরতা, চাহিদাহীন ভালোবাসা ওই চোখ দুটোতে ছাড়া কোথাও পাইনি।