দ্য গ্রেট সাইলেন্স

মানুষ আরেসিবো টেলিস্কোপ ব্যবহার করে বহির্জাগতিক বুদ্ধিমত্তার খোঁজ করছে। তাদের যোগাযোগ তৈরি করার এই আকাঙ্ক্ষা এত শক্তিশালী যে মহাবিশ্বের সবটা জুড়ে শোনার মতো একটা কান তৈরি করে ফেলেছে তারা।

কিন্তু আমি আর আমার প্রিয় তোতা ভাইবোনেরা তো এখানেই আছি। ওরা আমাদের গলা শুনতে আগ্রহী নয় কেন?

আমরাও তো একটি নন-হিউম্যান প্রজাতি এবং ওদের সঙ্গে যোগাযোগে সক্ষম। মানুষ তো ঠিক এ রকম কিছুই খুঁজছে, নাকি?

মহাবিশ্বটা এত বিশাল যে এখানে নিশ্চয়ই অনেকবারই বুদ্ধিমান প্রাণের উত্থান হয়েছে। সেই সঙ্গে এটার বয়সও এত বেশি যে অন্তত একটি প্রযুক্তিনির্ভর প্রজাতির চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে, তাদের গ্যালাক্সিটুকু অন্তত ভরে ফেলার কথা। অথচ পৃথিবী ছাড়া আর কোথাও কোনো প্রাণের চিহ্নও নেই। মানুষ এটাকে বলে ফার্মি প্যারাডক্স।

ফার্মি প্যারাডক্সের একটি প্রস্তাবিত সমাধান হলো, বুদ্ধিমান প্রাণীরা খুবই সতর্কভাবে তাদের অস্তিত্ব লুকিয়ে রাখে। যেন আগ্রাসী কেউ বাইরে থেকে এসে তাদের আক্রমণ করতে না পারে।

মানুষের হাতে বিলুপ্তপ্রায় একটি প্রজাতির সদস্য হিসেবে আমি বলতে পারি, কৌশল হিসেবে এটা বেশ ভালো। বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত।

চুপচাপ থেকে কারও মনোযোগ আকর্ষণ না করাটা ঠিকই আছে। ইট মেকস সেন্স।

*

ফার্মি প্যারাডক্সকে কখনো কখনো ‘দ্য গ্রেট সাইলেন্স’ও বলা হয়। মহাবিশ্বের যেখানে একগাদা সুর-বেসুরের সমষ্টি হওয়ার কথা ছিল, সেখানে এটি হয়ে আছে অদ্ভুত, অস্বস্তিকর নীরব।

মানুষের কেউ কেউ মনে করে, বুদ্ধিমান প্রজাতিরা তাদের গ্রহের বাইরে ছড়িয়ে পড়ার আগেই ধ্বংস হয়ে যায়। যদি তারা আসলেই ঠিক হয়, তার মানে রাতের নিস্তব্ধতা আসলে এক শ্মশানের নীরবতা।

শত শত বছর আগে আমাদের প্রজাতির এত এত সদস্য ছিল যে রিও আবাহো বনের পুরোটাই আমাদের স্বরে ভরে থাকত। এখন আমরা প্রায় নেই-ই হয়ে গেছি। কিছুদিন পরে এই বনও হয়তো মহাবিশ্বের মতো নিস্তব্ধ হয়ে যাবে।

*

অ্যালেক্স নামে একটা আফ্রিকান ধূসর তোতা ছিল। কগনিটিভ, মানে মস্তিষ্কের ক্ষমতার জন্য সে মানুষের কাছে বিখ্যাত হয়ে গিয়েছিল।

আইরিন পেপারবার্গ নামে এক মানব গবেষক ৩০ বছর ধরে অ্যালেক্সকে নিয়ে গবেষণা করেছে। সে আবিষ্কার করল, অ্যালেক্স যে শুধু আকার-আকৃতি ও রঙের জন্য নির্ধারিত শব্দগুলো জানে, তা–ই নয়; সে আসলেই আকার-আকৃতি ও রঙের ধারণা বুঝতে পারে।

একটা পাখি এ রকম বিমূর্ত ধারণা ধরতে পারছে, বুঝতে পারছে দেখে অনেক বিজ্ঞানীই প্রচণ্ড অবাক হয়েছে। মানুষ নিজেদের ইউনিক ভাবতে পছন্দ করে। কিন্তু ধীরে ধীরে পেপারবার্গ ওদের বোঝাতে পেরেছিল যে অ্যালেক্স শুধুই শব্দ রিপিট করছে না। সে কী বলে, সেটা সে আসলেই বুঝতে পারে।

আমার সব আত্মীয়স্বজনের মধ্যে অ্যালেক্সই কেবল মানুষের যোগাযোগের সঙ্গী হওয়ার সবচেয়ে কাছাকাছি যেতে পেরেছিল।

তারপর হুট করে একদিন মরে গেল বেচারা। তখনো সে বেশ তরুণ। মৃত্যুর আগের সন্ধ্যায় অ্যালেক্স পেপারবার্গকে বলেছিল, ‘ভালো থেকো। আমি তোমাকে ভালোবাসি।’

মানুষ যদি আসলেই নন-হিউম্যান বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে একটা সম্পর্ক তৈরি করতে চায়, এর চেয়ে বেশি তাদের আর কী চাই?

*

সব তোতারই একটা নিজস্ব ডাক আছে। এটাই তার পরিচয় বহন করে। জীববিজ্ঞানীরা এটাকে তোতাদের ‘কন্টাক্ট কল’ বলে।

১৯৭৪ সালে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা আরেসিবো টেলিস্কোপ দিয়ে, মানব বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়ে মহাশূন্যে একটি বার্তা সম্প্রচার করেছিল। এটা ছিল মানবতার ‘কন্টাক্ট কল’।

বনে তোতারা একে অন্যকে নাম ধরে ডাকে। এই নাম মানে, কন্টাক্ট কল। ওরা অন্য কোনো পাখির মনোযোগ আকর্ষণ করতে চাইলে, তার কন্টাক্ট কল নকল করে ডাকে।

একইভাবে, মানুষ যদি কখনো পৃথিবীতে আরেসিবো বার্তা আসতে দেখে, রিসিভ করে; তাহলে তারা বুঝবে, বাইরের কেউ তাদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে চাচ্ছে।

*

তোতারা ভোকাল লার্নার। শব্দ শুনে শুনে আমরা নতুন শব্দ করতে শিখি। অল্প কিছু প্রাণীরই কেবল এই ক্ষমতা আছে। একটা কুকুর হয়তো ডজন ডজন নির্দেশ মানতে পারে, কিন্তু ঘেউ ঘেউ করা ছাড়া এটা আর কিছুই করতে পারবে না।

মানুষও ভোকাল লার্নার। শুনে শুনে শেখাটা আমাদের কমন বৈশিষ্ট্য। তার মানে, শব্দের সঙ্গে মানুষ আর তোতার একটা বিশেষ সম্পর্ক আছে। আমরা শুধু কাঁদি না বা সাউন্ড করতে থাকি না। আমরা উচ্চারণ করি। স্পষ্ট বর্ণনা দিই।

সম্ভবত সে জন্যই মানুষ এভাবে আরেসিবো বানিয়েছে। একটা রিসিভার বা গ্রাহক যন্ত্রের তো ট্রান্সমিটার বা প্রেরক যন্ত্র হওয়ার কোনো দরকার নেই। কিন্তু আরেসিবো একসঙ্গে দুটোই। একই সঙ্গে সে কথা বলার মুখ এবং শোনার কান হিসেবে কাজ করে।

*

মানুষ তোতার সঙ্গে হাজার বছর ধরে পাশাপাশি বসবাস করছে। আমরা যে বুদ্ধিমান হতে পারি, এই সম্ভাবনা তারা কেবল এত দিনে এসে ভাবতে শুরু করেছে।

আমি ওদের এ জন্য কোনো দোষ দিই না। আমরাও একসময় ভাবতাম, মানুষ অতটা বুদ্ধিমান প্রাণী না। নিজের থেকে অনেক ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের কারও ব্যাপারে অর্থবোধক কিছু বের করাটা অত সহজও নয় আসলে।

কিন্তু যেকোনো বহির্জাগতিক প্রাণের চেয়ে মানুষের সঙ্গে তোতাদের মিলই বেশি। আর মানুষ চাইলে আমাদের কাছ থেকে খুঁটিয়ে দেখতে পারে, পর্যবেক্ষণ করতে পারে। ওরা চাইলে আমাদের চোখের দিকেও তাকাতে পারে। ওরা আমাদের ব্যাপারেই যেখানে কিছু বোঝেনি, সেখানে শ খানেক আলোকবর্ষ দূর থেকে ভেসে আসা এক টুকরা বার্তা থেকে ওরা এলিয়েন বুদ্ধিমত্তা চেনার আশা করে কীভাবে?

*

‘অ্যাসপিরেশন’ শব্দ দিয়ে যে একই সঙ্গে ‘আশা’ এবং ‘নিশ্বাস নেওয়া’কে বোঝায়, এটা কাকতালীয় কিছু নয়।

কথা বলার সময় ফুসফুসের নিশ্বাস ব্যবহার করে নিজেদের ভাবনাকে আমরা বাস্তব রূপ দিই। যেসব শব্দ করি, এগুলো একই সঙ্গে আমাদের উদ্দেশ্য ও জীবনের ভেতরের ব্যাপারটা প্রকাশ করে।

আমি কথা বলি, তার মানে আমার অস্তিত্বের একটা অর্থ আছে। ভোকাল লার্নাররা, যেমন তোতা বা মানুষই সম্ভবত কেবল এটার সত্যিকার অর্থ অনুভব করতে পারবে।

*

মুখ দিয়ে সাউন্ডকে আকৃতি দেওয়ার একটা অন্য রকম আনন্দ আছে। এটা এত আদিম এবং এর অবস্থান জীবনের এত গভীরে যে মানুষ তাদের ইতিহাসজুড়েই এই ব্যাপারকে স্রষ্টার সঙ্গে সম্পর্কের একটা পথ হিসেবে বিবেচনা করেছে।

পিথাগোরিয়ান অতীন্দ্রিয়বাদীরা বিশ্বাস করত, স্বরবর্ণগুলো গোলকের মধ্যকার সুর ও সংগীতের প্রতিনিধিত্ব করে। সে জন্য তারা স্বরবর্ণ জপ করে, স্তব গেয়ে ওটা থেকে শক্তি সংগ্রহ করতে চাইত।

পেন্টেকোস্টাল খ্রিষ্টানরা মনে করত, তারা যখন ভাষা ব্যবহার করছে; তখন তারা আসলে ফেরেশতাদের স্বর্গে ব্যবহার করা ভাষায় কথা বলছে।

ব্রাহ্মণ হিন্দুরা বিশ্বাস করত, মন্ত্র পড়ে পড়ে বস্তবতার মূল ভিত্তি বিিল্ডং ব্লকগুলোকে তারা আরও শক্তিশালী করছে।

শুধু ভোকাল লার্নার কোনো প্রজাতিই কেবল সাউন্ডকে কিংবদন্তিতে এতটা গুরুত্ব দিতে পারে। আমরা তোতারা এটাকে প্রশংসার চোখেই দেখি।

*

হিন্দু কিংবদন্তি অনুযায়ী, মহাবিশ্ব একটা শব্দের মাধ্যমে তৈরি হয়েছে: ‘ওম’। এটা একটা সিলেবল বা ধ্বনি। যা কিছু ছিল, আছে এবং হবে—এই শব্দ এর সবকিছুই ধারণ করে।

আরেসিবো টেলিস্কোপ যখন আন্তনাক্ষত্রিক স্থানের দিকে তাক করা হয়েছিল, একটা মৃদু গুনগুন শুনতে পেয়েছিল সে।

জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা এটাকে বলে ‘কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড’। বিগ ব্যাং—যে মহাবিস্ফোরণের ফলে চৌদ্দ বিলিয়ন বছর আগে মহাবিশ্ব তৈরি হয়েছিল, এটা তার অবশেষ।

তবে এটাকে চাইলে আপনি সেই মূল ‘ওম’ শব্দের একটা অনুরণন বা প্রতিধ্বনি বলেও ভাবতে পারেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এর তীব্রতা কমে এসেছে। ফলে এখন অনেক মৃদু এক ধ্বনিতে পরিণত হয়েছে এটা। কিন্তু এই ধ্বনি এত রেজোন্যান্ট বা প্রতিধ্বনিশীল যে যত দিন এই মহাবিশ্ব টিকে থাকবে, রাতের আকাশ তত দিন এই ধ্বনির জন্য কাঁপতে থাকবে।

আরেসিবো যখন আর কিছু শোনে না, তখন সে সৃষ্টির এই স্বরই শুনতে পায়।

*

আমরা, পুয়ের্তো রিকান তোতাদের নিজস্ব কিংবদন্তি আছে। মানুষের কিংবদন্তির চেয়ে এগুলো অনেক সরল। কিন্তু শুনলে মানুষ মজা পাবে বলেই আমার মনে হয়।

আমার দুর্ভাগ্য, আমাদের প্রজাতির বিলুপ্তির সঙ্গে সঙ্গে এসব কিংবদন্তিও হারিয়ে যাচ্ছে। আমরা একেবারে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার আগে মানুষ আমাদের ভাষা আদৌ বুঝে উঠতে পারবে কি না, সন্দেহ আছে।

আমাদের প্রজাতির বিলুপ্তি মানে কেবল একদল পাখির বিলুপ্তি নয়। এর মানে আমাদের ভাষা, সংস্কৃতি ও কৃষ্টির হারিয়ে যাওয়া। আমাদের স্বরটুকু চিরজীবনের জন্য নীরব হয়ে যাওয়া।

*

মানুষের কাজকর্মই আমাদের প্রজাতিকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে এসেছে। তবে এ জন্য আমি ওদের দোষ দিই না। ওরা যে এটা আমাদের ক্ষতি করার জন্য করছে, তা নয়। ওরা আসলে এদিকে মনোযোগই দেয়নি।

আর মানুষ যে দারুণ সব কিংবদন্তির গল্প বানায়! কী দারুণ তাদের কল্পনা! সে জন্যই সম্ভবত তাদের ‘অ্যাসপিরেশন’ এতটা বিস্তৃত। আরেসিবোর কথাই ধরুন। যে প্রজাতি এ রকম কিছু বানাতে পারে, তাদের মধ্যে মাহাত্ম্য থাকাটা তো আবশ্যক।

আমার প্রজাতি হয়তো পৃথিবীর বুকে আর বেশি দিন টিকব না। সম্ভবত সময়ের আগেই আমরা শেষ হয়ে যাব, মিশে যাব বিশাল ওই নীরবতার মধ্যে। কিন্তু যাওয়ার আগে, মানুষের কাছে একটা বার্তা পাঠিয়ে যেতে চাই আমরা। আশা করি, আরেসিবো টেলিস্কোপ এই বার্তাটুকু মানুষের কাছে পৌঁছে দেবে। ওদের শোনার সুযোগ করে দেবে।

বার্তাটা হলো: ভালো থেকো। আমি তোমাকে ভালোবাসি।