দ্য ডার্ক সাইড অব দ্য মুন

সামনের ফাঁকা জায়গাটুকু পার হওয়ার সময় বাতাসের আওয়াজ আমার কানে এসে লাগল। বাতাস—পনের-বিশ সেকেন্ডের একটা চক্রের পুনরাবৃত্তি আমার গতি ধীর করে দিল। হিসসসস শব্দ করে বাতাস উঠছে আর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে গাছের পাতায় সর-সর শব্দ তুলে আশেপাশে ছড়িয়ে পড়ছে। পনের বিশ সেকেন্ড—তারপর আবার—পুনরাবৃত্তি। পুরো ব্যাপারটা আমাকে কিছুটা অমনোযোগী-ভাবনাহীন-নাম্ব করে দিল। খন্ড খন্ড ওই মুহূর্তের মধ্যে কয়েকবার নিজেকে হালকা লাগল আমার। আমার গতি ধীর হয়ে এল। আমি একটা একটা করে পা ফেলছিলাম, খুব ধীরে পার হচ্ছিলাম সামনের ফাঁকা জায়গাটা।

এখানে প্রথমবার আসি আমি আমরা সাত বছর আগে। আমার মেয়ে ডিয়ানার জন্মেরও বছর দুয়েক আগে। তখন আমরা দুজন—ইয়োস আর আমি। ইয়োসের কাছে, এটা ছিল আমার জন্য তার সারপ্রাইজ। আর আমি সারপ্রাইজড হয়েছিলাম, সত্যি সত্যি। প্রথমে আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল—একটা আর্টিফিশিয়াল জায়গা, আশেপাশে যা কিছু দেখছিলাম, সবকিছুই আর্টিফিশিয়াল, মনে করেছিলাম আমি তখন। মনে করেছিলাম, সবকিছুই হয়ত থ্রি-ডি স্ক্রিনে দেখছি, কৌশল করে স্ক্রিনগুলি জায়গামত বসানো হয়েছে, অথবা সবকিছুই কোনো এক ধরনের গ্রাফিকাল সিমুলেশন, আর্কিটেকচারাল ডিজাইন খুবই পারফেক্ট। সামনের রাস্তা পার হয়ে ঘাসে ঢাকা ঢেউ খেলানো খোলা জায়গা, তারপরে দক্ষিণ-পশ্চিম কোণের দিকে বিশাল লম্বা লম্বা সেগুন গাছের বন, ওখানে জায়গাটা আরেকটু সামনে আবার টিলার মত উঁচু হয়ে উঠছে। আর অন্যদিকে, দক্ষিণ পূর্ব কোণের দিকে গুল্মের বড় একটা ঝোপ—কয়েকটাকে আমি চিনতে পারলাম—টগর, জয়তী, সাদা রঙ্গন। আর সেই ঝোপের ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছিল একটা হ্রদ, পূর্ব দিক থেকে দক্ষিণ-পশ্চিম কোণের দিক বরাবর, বাতাসের সাথে সাথে পানিতে সামান্য স্রোতের আভাস—আর সত্যি সত্যি হালকা বাতাস ছিল তখন আমি খেয়াল করেছিলাম। হ্রদের অন্য পাড়ে আবার সবুজ ঘাসে ঢাকা ঢেউ খেলানো জমি—সেখানে সাদা রঙের কয়েকটা ঘোড়া আর গরু চরছিল।

আমি ভেবেছিলাম ইয়োস আমাকে নিয়ে এসেছে কোথাও একটা আর্টিফিশিয়াল নেচারের কোনো পার্কে, অথবা কোনো রিসোর্টে।

আমি তখন ইয়োসকে বলেছিলাম, সুন্দর—অলমোস্ট, অলমোস্ট—সত্যিকারের নেচার...

আমার মনে আছে, ইয়োস ওর চোখ মুখ কুঁচকে ফেলেছিল, কিসের অলমোস্ট! অলমোস্টের কিছু নেই, এখানকার সবকিছুই সত্যিকারের—এটাই নেচার ডোরসিয়া।

ইয়োস যখন তার কোনো একটা কথাকে বেশি গুরুত্ব দিতে চাইত, সিরিয়াস হয়ে যেত একটু, তখন সে ডাকত ডোরসিয়া, আমাকে, সম্পূর্ণ নাম ধরে। আর ডাকত এমনিতে ডোরস—শুধু ডোরস।

সিরিয়াস ভঙ্গিতে কথাটা বলেই আমার দিকে তাকিয়ে হাসছিল ইয়োস। রাস্তার এই পাশে, যেখানে দাঁড়িয়েছিলাম আমরা সেখান থেকে সামান্য পিছনে ছিল একটা বাড়ি, গাঢ় ধূসর রঙের আর জানালায় ঝকঝকে কাঁচ। সেটার দিকে দেখিয়ে ও... ইয়োস বলেছিল, আর এটা আমাদের বাড়ি।

আমি চোখ বন্ধ করে বলেছিলাম, অ্যাবসার্ড!

কারণ, আমরা থাকতাম ব্লিসনে, আমাদের দিন শুরু হত ড্রোন, এয়ার-কার, এয়ার-কার্গোর শব্দে, দিন শেষ হত মাঝরাতে, একইভাবে। প্রতিদিন আমরা রাস্তায় বের হতাম অটোনোমাস গাড়ির কাছে আমাদের আইকিউ ও রিফ্লেক্সের পরীক্ষা দেওয়ার জন্য। আর প্রতি সপ্তাহে ছুটির দিনে আমরা ব্লিসনের বাইরে রোদ খুঁজতে বের হতাম।

তখন গ্রাফিকাল সিমুলেশনের কোনো আর্টিফিশিয়াল প্রকৃতির মধ্যে—অথবা তার কাছাকাছি থাকার সুযোগটাও হয়ত আমাদের জন্য কল্পনার চেয়ে একটু বেশি কিছু ছিল। সেখানে হঠাৎ করে, সরাসরি এই সত্যিকারের প্রকৃতির মধ্যে চলে আসা। আর ইয়োস বলছিল আমরা এখানে থাকব, আমাদের বাড়ি—সম্পূর্ণ ব্যাপারটাকে আমার নার্ভ হজম করতে পারছিল না।

আমি বাড়িটার দিকে তাকালাম, পিছনে-ডানে-বামে দূরে দূরে কোথাও একটা বাড়ি বা বাড়ির ছাদ দেখা যাচ্ছে। আর একটু পর পর বিশাল লম্বা বার্চ গাছ, জলপাই গাছ।

এই আইয়ার্ক রিজার্ভেশনে আসার পর প্রথম প্রথম কিছুদিন আমার কাছে পুরো ব্যাপারটাকে সেমি-হ্যালুসিনেশন মনে হত। মনে হত আমি অর্ধেক ভুলে যাওয়া কোনো স্বপ্নের ভিতরে ঢুকে পড়েছি, আর কিছুক্ষণ পরপর আমার সব লজিক বদলে যাচ্ছে, আমার ভাবনা-চিন্তার শৃংখলা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।

সামনে ফাঁকা জায়গাটা পার হওয়ার সময় আমি খুব সামান্য হলেও আশা করেছিলাম, দেখব ঘরে আলো জ্বলছে, জানালার পর্দা সরানো। কিন্তু না, অর্থাৎ ইয়োস ফিরে আসেনি। গত সপ্তাহে যেমন রেখে গিয়েছিলাম ঠিক তেমনই আছে সবকিছু।

আমি গত ছয়মাস ধরে ওর জন্য অপেক্ষা করছি। ওকে খুঁজে বেড়াচ্ছি।

আমি ঘরে ঢুকলাম। আমাকে ওয়েলকাম করল আমার হোম মেকার ডিভাইস, আর ওকে আমি চায়ের পানি রেডি করতে বললাম। পূর্ব দিকের জানালার পাশে রাখা কাউচে বসে আরেকবার আমার মেসেজ বক্সে কানেক্টেড হলাম। নাহ, আর আসেনি কোনো নতুন মেসেজ।

আমি গিয়েছিলাম ব্যুরো অব ফিজিকস অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোনমি-তে, ইপলিসন শহরে। অবশেষে সেখানকার ওয়েদার ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট ডেকে পাঠিয়েছিল আমাকে। ইয়োস সর্বশেষ ওখানেই কাজ করত।

সেখানে যাওয়ার পরপরই একজন মাঝারি গড়নের মধ্যবয়স্ক লোক, যার চুল ছোট করে ছাঁটা, চোখের দৃষ্টি খুব তীক্ষ্ণ, আমাকে আলাদা একটা রুমে নিয়ে গেল।

আমাকে রুমের এক পাশে রাখা সোফার দিকে বসতে ইঙ্গিত করে সে তার টেবিলের অন্য পাশের চেয়ারে গিয়ে বসল।

আমাকে জিজ্ঞেস করল, আপনিই ডোরসিয়া কাজান?

আমি উত্তর দিলাম, হ্যাঁ।

সেই লোক বলল, আচ্ছা, কিন্তু ইয়োসের লাস্ট নেম তো লিয়েব!

আমি উত্তর দিলাম, মাই সারনেইম ইজ ফ্রম মাই প্যারেন্টস সাইড।

সেই লোক তখন বলল, গ্রেট। আমি পিটার, পিটার ইসক্যারিয়ট। আমিই ওয়েদার ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্টের চিফ।

আমি বললাম, হ্যালো।

আমি অন্যদিকে তাকিয়ে ছিলাম। এবার সরাসরি তার দিকে তাকালাম। এতক্ষণ আমি খেয়াল করিনি, আমার চোখে পড়ল, আমার সামনে, রুমের ঠিক মাঝখানে, উপরে কয়েকটা ক্যাকটাসের পট, পটসহ সেইসব ক্যাকটাস শূন্যে ভাসছে।

আমি কিছু বলার আগেই, সেই লোক, পিটার ইসক্যারিয়ট বলল, খুবই অস্বাভাবিক পরিস্থিতি। দমবন্ধ সময়। আপনার জন্য নিশ্চয়ই সময়টা অনেক বেশি কঠিন।

আমি বললাম, অবশ্যই।

পিটার এবার তার হাত দুটি টেবিলে রেখে সামনের দিকে ঝুঁকে বসল। বলল, দেখেন ডোরসিয়া, আমাদের জন্য সময়টা ভয়াবহ। সেটা বললেও আসলে কম বলা হবে, আমরা একটা দূর্যোগ পার করছি। আমরা এটাও নিশ্চিত হতে পারছি না আবহাওয়া একেবারে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে নাকি আরো ভয়ানক খারাপের দিকে যাবে—স্টিল আনস্ট্যাবল। আপনার হাজব্যান্ড অবশ্যই আমাদের কনসার্ন, সেইসঙ্গে আরো যারা আগে পরে সেখানে গেছে তারাও আমাদের কনসার্ন। কিন্তু আমাদের আরো বড় কনসার্ন পুরো মানবজাতি, মানবজাতির ভবিষ্যত, পৃথিবীর কী হয় না হয়। এটা এখন সবারই কনসার্ন। আর সেখানে আমরা তো খুবই নগণ্য। আমাদেরকে এখন অনেকগুলি ফ্রন্টে যুদ্ধ করতে হচ্ছে।

আমি চুপ করে ছিলাম। আমি বুঝতে পারছিলাম না আমার কী বলা উচিৎ।

পিটার ইসক্যারিয়ট জিজ্ঞেস করল, ইয়োসের সাথে আপনার সর্বশেষ যোগাযোগ হয়েছিল কবে?

আমি বললাম, মাস তিনেক। মাস তিনেকেরও বেশি সময় আগে।

পিটার জিজ্ঞেস করল, কথা হয়েছিল?

আমি উত্তর দিলাম, মেসেজ।

পিটার জিজ্ঞেস করল, কী বলেছে সে?

আমি বললাম, সে আশা করছে যে আমি ভাল আছি এবং সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।

পিটার বলল, আচ্ছা। নিজের সম্পর্কে কিছু বলেছে?

আমি কয়েক সেকেন্ড নীরব থাকলাম। বললাম, নাহ।

দুই

মাস তিনেক আগে ইয়োস আমাকে মেসেজ পাঠিয়েছিল, অল্প কয়েকটা লাইনে—ডোরস, হয়ত ভাল আছো। তবে অনুমান করতে পারছি যে তুমি দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। আমরা জানি আমাদের গন্তব্য কোথায় এবং কোথা থেকে আমরা এসেছি, সেই গন্তব্যেই আমরা আমাদেরকে নিয়ে যাই, তবে সেই তথ্য আমাদের ভিতরে এমনভাবে দেওয়া আছে যে কখনো সেই তথ্য আমাদেরকে সরাসরি জানাতে পারি না। ডিয়ানা জীবন সম্পর্কে আমাদের চেয়ে বেশি কিছু জানে। ডিয়ানা লাভস ইউ। এবং আমিও ভালবাসি তোমাকে। যা কিছু আলোতে আছে তার চেয়ে অনেক বেশি কিছু আছে অন্ধকারে।

আমি এই মেসেজের অনেক কিছুই বুঝিনি। এরকম অস্পষ্ট রহস্যময় আপাত গভীর কথা যে ইয়োস মাঝে মাঝে বলত না। এমন নয়, কিন্তু আমি তখন এত দীর্ঘদিন পরের মেসেজে, তাও আবার এরকম সময়ে সেটা হয়ত আশা করিনি। আর সবকিছু ঠিক আছে ধরে নিলেও, বিশেষ করে শেষ লাইন খুবই অদ্ভুত।

আমি মেসেজের ভিতরের সেইসব অস্পষ্ট কথা আর পিটার ইসক্যারিয়টকে বললাম না।

পিটার জিজ্ঞেস করল, সেই মেসেজ আছে আপনার কাছে?

আমি মিথ্যা বললাম, না, ডিলিট করে দিয়েছি?

পিটার জিজ্ঞেস করল, কেন? যদিও আমার জিজ্ঞেস করা উচিৎ নয় অবশ্যই, জাস্ট কিউরিওসিটি।

আমি বললাম, অভ্যাস। আমার মেসেজ বক্স প্রতি মাসে একবার ক্লিয়ার করি, জরুরি কোনো তথ্য না থাকলে সেই মেসেজ রাখিনা।

পিটার জিজ্ঞেস করল, আর সর্বশেষ সরাসরি কথা হয়েছে?

আমি উত্তর দিলাম, এখান থেকে যাওয়ার মাসখানেক পরে। পাঁচ মাস আগের কথা।

পিটার ইসক্যারিয়ট তার কপাল কুচকাল। আমার দিকে তাকিয়ে বলা শুরু করল, এবার আসল কথায় আসি, যে খবর জানানোর জন্য আপনাকে এখানে ডেকেছি। এই অবস্থায় এটাকে আমাদের আপাতত ভালো সংবাদ হিসেবেই বিবেচনা করতে হবে। চাঁদের যে অংশটাতে আমাদের সমস্যা, যেখানটাতে ইয়োস এবং অন্যান্যদেরকে পাঠানো হয়েছে, সেখানে আমরা গত তিন-সাড়ে তিন মাস ধরে কোনো অবজেক্ট বা কিছু ট্রেস করতে পারছিলাম না। কিন্তু এই সপ্তাহের শুরুর দিকে, চারদিন আগে আমরা তিনজনকে ট্রেস করতে পেরেছি।

আমি উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলাম তখন। পিটারকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ইয়োস আছে তার মধ্যে?

মনে হল পিটার আমার প্রশ্নে একটু অস্বস্তিতে পড়ল। বলল, কোন তিনজন তা আমরা জানি না এখনো। তারা সেখানে আছে, মুভ করছে, কিন্তু কে কোনজন সেটা আইডেন্টিফাই করা যাচ্ছে না।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, কতজনকে ট্রেস করতে পারার কথা?

পিটার সম্ভবত মনে মনে কিছু একটা হিসাব করল, বলল, নয়জন, নয়জনকে ট্রেস করার কথা।

আশ্চর্য মনে হল আমার কাছে, বললাম, আর সেখানে তিনজন, এটা ভাল খবর বলছেন আপনি!

পিটারের চোখ ছোট ছোট হয়ে এল, ভাল খবর—হ্যাঁ—কারণ গত তিন মাস সাড়ে তিন মাস ধরে আমরা মানুষ তো দূরের কথা কোনো অবজেক্টই ট্রেস করতে পারছিলাম না চাঁদের ওই অংশে। আর এখন সেটা পারছি এবং আমরা আশা করছি বাকিদেরকেও ট্রেস করতে পারব দ্রুত।

আমি চুপ করে থাকলাম।

পিটার বলল, ডোরসিয়া, আপনার কনসার্ন, আপনার মানসিক অবস্থা, রিঅ্যাকশন খুবই র‍্যাশনাল। কিন্তু এখানে—আপনাকে কী বলব, কতটুকু বলব—আপনি তো জানেন না যে, পৃথিবীর ওয়েদার কন্ডিশন খুবই আনস্ট্যাবল, উত্তর গোলার্ধের অনেক জায়গায় প্রায় আইস এইজ চলে আসছে, উত্তর গোলার্ধের অনেক শহর থেকে সব মানুষকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। আবার যখনই অবস্থা একটু ইমপ্রুভ করেছে, দক্ষিণ গোলার্ধের কিছু জায়গা একেবারে মরুভূমি—বলা নেই কওয়া নেই, হঠাৎ করে কোনো এক জায়গায় দাবানল—এসব কথা যতটা সম্ভব গোপন রাখা হয়েছে, কারণ মানুষজন আতঙ্কিত হলে পরিস্থিতি আরও খারাপই হবে।

তিন

এরপর আমি সেখান থেকে চলে আসি। তখন আমার মনে হয়েছে, শুধু এসব কথা জানানোর জন্য আমাকে এখানে ডেকে পাঠানোর কোনো অর্থ হয় না, যা আমাকে ফোনে বা ভিডিও কলেই জানানো যেত। তবে ঠিক এটাও যে, এই আনআইডেন্টিফায়েড তিনজনকে ট্রেস করার বিষয়টা যদি আমি দূর থেকে জানতাম যে আরো ছয়জনকে ট্রেস করা যাচ্ছে না, তাহলে হয়ত আমি হাইপার হয়ে যেতাম, ইমোশনাল হতাম। ওখানে যাওয়ার জার্নি, পিটার ইসক্যারিয়টের সাথে সামনাসামনি কথা বলা আর সেখানকার পরিবেশ আমার ব্রেইনকে আগে থেকেই প্রস্তুত করে ফেলেছিল হয়ত, তাই ব্যাপারটা তুলনামূলকভাবে কম উত্তেজিত করেছে আমাকে।

আসার আগে কিছু ফর্মালিটির অফিশিয়াল ডকুমেন্টে সই নিয়েছিল ওরা, আর পিটার ইসক্যারিয়ট আমাকে জানিয়েছিল যে, ইয়োসের স্যালারি ও ফিন্যানসিয়াল ব্যাপারগুলি নিয়ে যেন আমি টেনশন না করি। সেগুলি স্মুথলি চলবে আগের মতো বা প্রয়োজনে আগের চেয়ে আরও বেশি ভালভাবে। তাদের কাছে ইয়োসের পরিবারও তা-ই, যা ইয়োস তাদের কাছে।

হোম মেকার ডিভাইস আমাকে জানাল যে আমার চায়ের পানি প্রস্তুত। আমাকে সে আরও জিজ্ঞেস করল, আমি রাতের খাবার কখন খাবো আর কী খাবো। আমি বললাম, তোমাকে জানাব আমি।

চার

ইপলিসন থেকে ফেরার পথে আমি ব্লিসনে গিয়েছিলাম দুদিনের জন্য। আমার বড় বোন ফিওবির ওখানে। ব্লিসনে উপস্থিত হওয়ার পরে আমাদের ছেড়ে যাওয়া সেই ব্লিসন আর এই ব্লিসনকে আমি যেন মেলাতে পারলাম না। সেই আগের মতই সবকিছু রাস্তায় শাই শাই করে চলে যাচ্ছে— অটোনোমাস কার, মাথার উপরে এয়ার-কার, এয়ার কার্গো আর ড্রোনের চিরস্থায়ী গুঞ্জন, কিন্তু টের পাওয়া যাচ্ছে এই সারফেসের নীচের লেয়ারেই আছে প্রাণহীন একটা ভাব। সবকিছুতে একটা চাপা নিস্তেজ আভাস।

আমি ফিওবিদেরকে বললাম সে কথা। ফিওবির হাজব্যান্ড ওমাইর বলল যে আমি নাকি ঠিকই ধরেছি।

ফিওবি কিছুটা অবাক হয়ে বলল, সব জায়গায় তো প্রায় এরকমই অবস্থা, কিন্তু তুমি সেটা এই ব্লিসনে এসে ধরতে পারলে! অবশ্য তুমি যেখানে থাকো, সেই আইয়ার্ক তো রিজার্ভেশন, ওখানে থেকে বুঝতে পারার কথা না।

ওমাইর আর ফিওবি দুজনই ব্লিসনের নীলস বোর ইউনিভার্সিটিতে থিওরেটিক্যাল কেমিস্ট্রি পড়ায়। ওদের সঙ্গে আমার শেষ দেখা হয়েছিল ইয়োসকে যখন চাঁদে পাঠানো হয়। আমরা নিমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম ওদেরকে আমাদের ওখানে।

ওমাইর বলল, উত্তর গোলার্ধের একবারে শেষ প্রান্তের অনেক শহর একেবারে বরফের নিচে। সেখানে মনে হয় পৃথিবীর বরফ যুগ আবার শুরু হয়েছে।

আমি অবাক হলাম, সবাই জানে এই কথা! এই তথ্য কনফিডেনশিয়াল না?

ওমাইর বলল, হ্যাঁ, অনানুষ্ঠানিকভাবে সবাই জানে আর কি।

কিছুক্ষণ পরে ওমাইর বলল, ইটস নট অনলি অ্যাবাউট দ্য ওয়েদার। পৃথিবীর অস্তিত্বের ব্যাপারটাও এখন কিছুটা প্রশ্নের মুখে।

আমাকে কিছুটা দ্বিধান্বিত দেখে ওমাইর কথা বলা শুরু করল, ইয়োস যাওয়ার আগে আমার সাথে অনেক কিছু শেয়ার করেছিল, যা হয়ত তোমার সাথে শেয়ার করেনি। স্বাভাবিকভাবেই, কারণ তা তোমাকে আতঙ্কিত করবে এবং এই পরিস্থিতিতে সেটা না হওয়াই ভাল। তুমি তো জানো, পৃথিবীর আবহাওয়া কীভাবে অ্যাফেক্টেড হল?

আমি নিচু স্বরে বললাম, হ্যাঁ। এটা তো দুই বছর আগে থেকে শুরু হল। পৃথিবী যখন কক্ষপথে ঘোরে। পৃথিবীর একটা টিল্ট আছে, অর্থাৎ পৃথিবী একদিকে কাত হয়ে থাকে। এবং এই টিল্ট বা কাত হয়ে থাকার ওপরেই পৃথিবীর আবহাওয়া ও ঋতু পরিবর্তন নির্ভর করে। এই কাত হয়ে থাকাটা নির্ভর করে চাঁদে ওপর।

ওমাইর বলল, হ্যাঁ, চাঁদ নিয়ন্ত্রণ করে এটা।

ফিওবি বলল, জানি, ২৩.৫ ডিগ্রি।

ওমাইর বলছিল, পৃথিবী কক্ষপথে ঘোরার সময়ে, তার কক্ষপথের সাথে ২৩.৪ ডিগ্রিতে কাত হয়ে থাকে। এটা পৃথিবীর অবলিকুইটি। চাঁদের গ্র্যাভিটেশনাল পুল এটাকে ২৩.৫ ডিগ্রিতে স্থির রাখে। চাঁদের গ্র্যাভিটেশনাল পুল এখানে একটা স্ট্যাবিলাইজিং ফোর্স। এ কারণেই পৃথিবীতে ঋতু পরিবর্তন ঘটে। কাত হয়ে থাকার কারণে একটা অংশ যখন বছরের একটা সময় সূর্য থেকে বেশি আলো পায়, তখন আরেকটা অংশ ওই সময়ে কম আলো পায়। চাঁদ বা চাঁদের এই গ্র্যাভিটেশনাল পুল না থাকলে পৃথিবীর কোনো টিল্ট থাকত না। কোনোদিকে কাত হয়ে থাকত না, তার মানে কোনো ঋতু পরিবর্তন থাকত না, বছরের সব সময় সব জায়গায় একই সমান আলো ও তাপ পাওয়া যেত সূর্য থেকে। অথবা চাঁদের গ্র্যাভিটেশনাল পুল ছাড়া এই কাত হয়ে থাকার পরিমাণ বেড়ে চলে যেত ৪৫ ডিগ্রিতে, তার মানে পৃথিবীর অনেক জায়গায় বরফ যুগ চলে আসত। প্রাণের বিকাশের কোনো চান্স ছিল না। ইন্টারেস্টিংলি, বুধ গ্রহ তার কক্ষপথের সাথে কাত হয়ে থাকে না, তাই বুধ গ্রহের কক্ষপথ অনেক বেশি উপবৃত্তাকার। একবার সূর্যের খুব বেশি কাছে আসে তো আরেকবার খুব বেশি দূরে সরে যায়। এক্সট্রিম ওয়েদার। আবার মঙ্গল কাত হয়ে থাকে, ২৫ ডিগ্রিতে, কিন্তু মঙ্গলের চাঁদের মত কোনো স্ট্যাবিলাইজিং ফোর্স নাই, তাই মঙ্গলের কক্ষপথও উপবৃত্তাকার। সেখানেও মোটামুটি এক্সট্রিম ওয়েদার, খুব গরম এবং খুব ঠান্ডা।

ফিওবি জানতে চাইল, তার মানে চাঁদের গ্র্যাভিটেশনাল পুল কাজ করছে না?

আমি বললাম, কাজ করছে, কিন্তু পারফেক্টলি নয়।

ফিওবি জিজ্ঞেস করল, এবং ইয়োসদেরকে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু এখনো ওরা সেই গ্র্যাভিটেশনাল পুল রিস্টোর করতে পারছে না?

আমি কিছু বলার আগেই ওমাইর আমার দিকে তাকাল। বলতে শুরু করল, ঠিক তা নয়। রিস্টোর করা তো পরের কথা, আমার ধারণা এখনো কেউ জানে না ঠিক কেন এমন হচ্ছে। ইয়োসদেরকে পাঠানো হয়েছিল বের করার জন্য সেটা। ঠিক?

আমি মাথা নাড়লাম, হ্যাঁ, ঠিক।

পাঁচ

চাঁদের অন্যান্য অংশ থেকে গ্র্যাভিটেশনাল পুল এর কোনো তারতম্য হচ্ছিল না, শুধু একটা অংশ ছাড়া। চাঁদের দূরতম অংশ। যে অংশটাতে সূর্যের আলো পড়ে না, পৃথিবী থেকে চাঁদের যে অংশটা কখনোই সম্পূর্ণ দেখা যায় না। শুধু ১৮ শতাংশ দেখা যায় কখনো কখনো, সেই ডার্ক সাইড অব দ্য মুন। ইয়োস আমাকে বলেছিল, চাঁদের সেই ফার সাইড অংশে গ্র্যাভিটেশনাল ফোর্স আর কাজ করছে না, আর তাই পৃথিবীর উপর চাঁদের টোটাল গ্র্যাভিটেশনাল পুলে তারতম্য দেখা দিয়েছে। ইয়োস এবং আরও কয়েকজনকে সেখানে পাঠানো হচ্ছে। যাওয়ার কয়েক দিন আগে চিন্তিত হয়ে ইয়োস বলছিল, এখান থেকে যতটুকু দেখা যাচ্ছে, ঘটনা মনে হয় এর চেয়েও বেশি কিছু।

আমি ফিওবি আর ওমাইরকে বললাম, পিটার ইসক্যারিয়ট আমাকে যা যা বলেছে, তিনজনকে ট্রেস করতে পারার কথা এবং বাকি সবকিছু। ফিওবি আর ওমাইর চিন্তিত হল, আর তারা আমাকে ব্লিসনে ওদের ওখানে আরো বেশ কিছুদিন থাকতে বলেছিল।

আমার হোম মেকার ডিভাইস আবার কথা বলে উঠল। জানতে চাইল আমি রাতে কখন খাব, কী খাব। আমি বিরক্ত হলাম, বললাম, আমি জানাব তোমাকে, আর যদি না জানাই তাহলে আর জিজ্ঞেস করার দরকার নাই।

আমি ইয়োসকে মিস করা শুরু করলাম প্রচন্ড, সেই সাথে ডিয়ানাকেও। আমার জীবনে কখনো আমি কাউকে এরকম মিস করিনি। আমার কখনো এত একা লাগেনি। আমরা আইয়ার্ক রিজার্ভেশনে আসার বেশ কিছুদিন পরে একদিন সন্ধ্যায় ইয়োসকে বলেছিলাম। এখানে আসার পর আমাদের কারো সাথেই পরিচয় হলো না।এতদিন হয়ে গেল। একটু দূরে দূরে যেসব বাড়ি, রাস্তায় যাদেরকে হঠাৎ দেখি কারো সাথেই কোনো পরিচয়-যোগাযোগ হল না, অবশ্য আমরাও যেতে পারতাম কোনো কোনো বাড়িতে।

ইয়োস বলেছিল, না ডোরস, পারতাম না। দে আর রিচ পিপল।

আমি বলেছিলাম, তো কী?

ইয়োস তখন কিছুটা সিরিয়াস হয়ে গেল, তর্ক করার সময় যেমন হয়ে যেত, বলল, সিরিয়াসলি? তারা শুধু ধনীই নয়, তারা রয়্যাল। আমরা এখানে থাকতে পারছি মানে এই নয়, আমরা তাদের একজন হয়ে গেছি। তারা আমাদেরকে কাউন্টও করে না।

আমি হাসতে হাসতে বলেছিলাম, তুমি বেশি সিরিয়াস হয়ে যাচ্ছ!

ও বলছিল, এটা সিরিয়াস বিষয়ই ডোরসিয়া। আমাদের ওয়ার্ল্ড, আমাদের রিয়ালিটি, আমাদের লাইফ এভাবেই ফাংশন করে। একটা আনঅফিসিয়াল, ডি-ফ্যাক্টো সোশ্যাল অ্যালগরিদম। আমরা কোন ক্লাসে জন্মাই, কোন ক্লাস থেকে আসি, সেটাই নির্ধারণ করে দেয় আমরা কোথায় থাকব, কী হব, কোথায় যাব, কী হবে আমাদের ডেস্টিনেশন, আমরা কী চিন্তা করব, কী করতে পারব আর কতটুকু পারব। আমাদের জীবনের উদ্দেশ্য কী হবে সবকিছু ঠিক করে দেয় এই আগে থেকেই চালু থাকা সোশ্যাল অ্যালগরিদম। এবং তুমি কখনোই এর নিয়ন্ত্রণের বাইরে যেতে পারবে না ডোরস। তুমি স্পিরিচুয়াল ট্রি অব লাইফের কথা বল না, আগে থেকেই প্রি-ডিটারমাইন্ড ডেস্টিনেশনের কথা বল না? আমার কী মনে হয় জানো, আমার মনে হয়, সেই কসমিক ট্রি অব লাইফকে কন্ট্রোল করে এই ডি-ফ্যাক্টো সোশ্যাল অ্যালগরিদম। সে-ই প্রি-ডিটারমাইন্ড ডেস্টিনেশন নিয়ন্ত্রণ করে এই আগে থেকেই ঠিক হয়ে থাকা ক্লাস আর স্ট্যান্ডার্ড, যার মধ্যে আমরা জন্মাই, যার মধ্যে আমরা বিলং করি। আমরা সেই অ্যালগরিদমের কোনো একটা ধাপকে ফাঁকি দিয়েছি, কারণ লাক আমাদেরকে ফেভার করেছে, সেটাও আবার ওই অ্যালগরিদমেরই পার্ট। আমরা এখানে এই বাস্তব প্রকৃতির মধ্যে থাকতে পারছি, তার মানে এই না যে আমাদের অবস্থান বদলে গেছে, এই না যে আমরা তাদের সমাজের অংশ হয়ে গেছি।

আমি চুপ করে ছিলাম।

ছয়

আমি হঠাত করেই বুঝতে পারলাম ইয়োস রিজার্ভেশনে কীভাবে এই বাড়িটা ম্যানেজ করেছিল, আমার কাছে আস্তে আস্তে সব পরিষ্কার হয়ে এলো। ব্যুরো অব ফিজিক্স অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোনমির মূল ডিপার্টমেন্ট থেকে ওয়েদার কন্ট্রোল অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্টে কাজ করতে রাজি হওয়া ছিল একটা কারণ। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণটা ছিল ওয়েদার কন্ট্রোল অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্টের যেকোনো মিশনে অংশ নিতে সম্মত হওয়া। তারপরেও, বিরাট একটা ঋণের চাপ মাথায় নিতে হয়েছিল ইয়োসকে। সেদিন ওরা যেসব অফিসিয়াল ডকুমেন্টে আমার স্বাক্ষর নিচ্ছিল, সেখানে আমি বুঝতে পারছিলাম এই সংক্রান্ত কাগজপত্রও ছিল।

ইয়োস পাগলের মত হয়ে গিয়েছিল, বছর খানেক আগে ডিয়ানার যখন অ্যাক্সিডেন্ট হল, আইওয়ার্কে ঢোকার ওই প্রধান রাস্তাটাতে, একটা সেলফ ড্রাইভিং গাড়ির সাথে, ডিয়ানা তখন স্কেটিং করছিল। প্রথমে আমরা ভেবেছিলাম শুধু বাইরের হাতে পায়ে আঘাত। আমি তখনো আমার নার্ভকে ধরে রেখেছিলাম কিন্তু ইয়োস নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিলনা যখন আমরা জানলাম ডিয়ানার মস্তিষ্কের বাম সেরেব্রাল হেমিস্ফিয়ার আংশিক ড্যামেজ হয়ে গেছে, কোমাতে চলে গেছে ডিয়ানা। এরপর ডিয়ানাকে দেড় বছরের জন্য ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে ক্রায়োপ্রিজারভেশনে। আমার খেয়াল হল, আর ছয় মাসের মত সময়, তারপরই ডিয়ানা ফিরে আসবে আমার কাছে, আগের মত। আমার ভাল লাগল। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম আমি ডিয়ানাকে দেখতে যাব সামনের সপ্তাহে, ওর ঘুমন্ত, নিষ্পাপ মুখ।

প্রতিটা দিন পার হচ্ছিল কোনো অগ্রগতি ছাড়াই, ইয়োসের ব্যাপারে কোনো নতুন খবর ছাড়াই, আর আমি নিজেকেই নিজের হতাশার বিরুদ্ধে লড়াই করার শক্তি যোগানোর চেষ্টা করছিলাম। দিন গুণছিলাম ডিয়ানাকে দেখার, সময় আস্তে আস্তে একা একা এগিয়ে আসছে।

সাত

এরমধ্যেই, ডিয়ানাকে দেখতে যাওয়ার কথা বৃহস্পতিবার, আর মঙ্গলবারেএকটা জরুরি ফোন এলো আমার কাছে। ব্যুরো অব ফিজিকস অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোনমি থেকে, কোনো একটা মেয়ে ওখানকার ফোন করেছে, আমাকে তাড়াতাড়ি এপলিসনে ওদের ওখানে যেতে বলল।

আমি উত্তেজিত হয়ে পড়লাম, ইয়োসের সন্ধান পাওয়া গেছে?

মেয়েটি উত্তর দিল, আমি আপনাকে কোনো তথ্যই জানাতে পারছি না এখন, কারণ আমি নিজেই কিছু জানি না। তবে এখানে আপনি আসুন।

আমি উৎসাহ হারিয়ে ফেললাম। বললাম, আপনি যদি আমাকে কোনো তথ্যই জানাতে না পারেন, আমি কেন যাব! আমি যাব না।

আমি ফোন রেখে দিলাম।

কিছুক্ষণ পরে আবার ফোন আসল, পিটার ইসক্যারিয়ট আমাকে জানাল, ইয়োসের সাথে গিয়েছিল, ওর সাথে ছিল এমন একজনকে ফিরিয়ে আনা হয়েছে পৃথিবীতে, গত পরশু, আমি যদি তার সাথে কথা বলতে চাই তাহলে আমাকে আজকেই সেখানে যেতে হবে।

আমি যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম, এবং ফিওবি আর ওমাইরকে জানালাম ব্যাপারটা। ওমাইর বলল যে সেও যাবে আমার সাথে, থাকবে আমার সাথে।

ওমাইর আসছিল ব্লিসন থেকে আর আমি আইয়ার্ক থেকে। ব্যুরোর বাইরে আমাদের দেখা হল।

ওমাইর আর আমাকে নিয়ে যাওয়া হল ওয়েদার কন্ট্রোল অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্টে। আমি মনে করতে পারছিলাম না যে, আগেরবার আমি এই রাস্তা দিয়েই ওখানে গিয়েছিলাম কিনা।

পিটার ইসক্যারিয়ট বের হয়ে আসলেন, আর জানালেন, যাকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে তার সাথে শুধু আমিই দেখা করতে পারব আর কথা বলতে পারব, একা, এবং আমাকে সব তথ্য এবং কথোপকথন গোপন রাখার ব্যাপারে সম্মত হতে হবে, অ্যাগ্রিমেন্টে স্বাক্ষর করতে হবে। আমি রাজি হলাম।

আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ইয়োসের ব্যাপারে কোনো তথ্য সে দিয়েছে আপনাদেরকে?

আমি আমার নার্ভ কন্ট্রোলে রাখার চেষ্টা করছিলাম।

পিটার ইসক্যারিয়ট আমার কথার কোনো উত্তর না দিয়ে বলল, যার সাথে আপনি এখন কথা বলবেন, তার সব তথ্য আপনার কাছে গোপন রাখা হচ্ছে। তাকে কোনো ব্যক্তিগত প্রশ্ন করবেন না। তার ব্যাপারে কোনো তথ্য, এমনকি তার নামও কাউকে জানানো হচ্ছে না, আপনাকেও জানানো হবে না। তার জন্য একটা নম্বর ঠিক করা আছে, সেটাই তার নাম। সেটা হল ৫৬।

আমাকে একটা করিডোরের প্রান্তে একটা দরজার সামনে নিয়ে যাওয়া হল এবং আমাকে সেই দরজার ভিতরে ঢোকার ইশারা করা হল।

আমি ভারী দরজা সরিয়ে ঘরে ঢুকলাম।

ঘরের ভিতরে মাঝ বরাবর একটা খুব স্বচ্ছ কাঁচের দেয়াল। দেয়ালের এই পাশে একটা চেয়ার রাখা, আর অন্য পাশে সেই ব্যক্তি, বা ৫৬ বসে আছে।

আমি ধারণা করলাম, এই ঘরে শুধু আমি এবং ওই ব্যক্তিই না, বাইরে থেকে আরও কেউ কেউ, হয়ত পিটার ইসক্যারিয়ট এখানে দেখছে। এখানে যা যা কথা হবে সে তা শুনতে পাবে। আমি ব্যাপারটাকে পাত্তা দিলাম না। এগিয়ে গিয়ে চেয়ারটাতে বসলাম আমি।

আমার সামনের লোকটি লম্বা, তার চেহারা দেখে বোঝা যাচ্ছে দুই-তিন দিন আগেই তার চুল কাটা হয়েছে এবং শেভ করানো হয়েছে, ফুল হাতা শার্ট পরা লোকটা সোজা হয়ে বসে আছে।

স্বচ্ছ কাঁচের দেয়ালের এই পাশে বসার পরে, আমি তার দিকে তাকিয়ে দেখলাম, তার চোখ দৃষ্টিশূন্য। আমি কখনো এরকম দৃষ্টিশূন্য জীবন্ত মানুষ দেখিনি।

তার দিকে তাকিয়ে বললাম, হ্যালো। কিন্তু কোনো সাড়া পেলাম না।

এবার তাকে প্রশ্ন করলাম, আপনারাই গিয়েছিলেন, গ্র্যাভিটেশনাল পুল ফিক্স করতে? আপনিই ছিলেন, ইয়োসের সাথে?

কোনো উত্তর এলো না, তার মধ্যে কোনো পরিবর্তনও হল না।

আমি আবার বললাম, আমি ইয়োসের স্ত্রী।

আমি বুঝতে পারছিলাম না সে আদৌ আমার প্রশ্ন শুনতে পাচ্ছে কিনা, আমাকে দেখতে পাচ্ছে কিনা।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, মিস্টার ৫৬, আপনিই কি ফিরে এসেছেন চাঁদের ফার সাইড থেকে? ফ্রম দ্য ডার্ক সাইড অব দ্য মুন?

এবার সে আমার দিকে তাকাল, এবং আমি দেখলাম তার চোখে পলক পড়ল। সে খুব আস্তে, খুবই ক্ষীণস্বরে বলল, আমার নাম সিমন।

আমি সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলাম, হ্যাঁ সিমন, আমি ডোরসিয়া, ডোরসিয়া কাজান। আপনার টিমমেট ইয়োসের স্ত্রী। ইয়োস, যে আপনাদের সাথে গিয়েছিল, চাঁদের ডার্ক সাইডে।

সিমন সরাসরি আমার দিকে তাকাল, এটা আর ফার সাইড, ডার্ক সাইড কিছু নয়, নট এনিমোর। ইটস ডার্ক এনার্জি, দ্যাটস অল।

আমি ধরতে পারলাম না সে কী বলতে চাইছে। তবুও বললাম, হ্যাঁ, আপনারা যেখানে গিয়েছিলেন চাঁদের গ্র্যাভিটেশনাল পুল এর সমস্যা খুঁজে বের করতে?

সে কিছুই বলল না প্রথমে, আর আমি আগ্রহ নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। হঠাৎ করে তার চোখ মুখ কঠিন হয়ে গেল, সামনের দিকে ঝুঁকে আসল সিমন। খুব ফিসফিস করে, শোনা যায় না এমনভাবে বলতে শুরু করল, না, নাহ, কোনো গ্র্যাভিটেশনাল পুল, গ্র্যাভিটি এগুলি কিছুই না, এগুলির কোনো অস্তিত্ব নেই। বিভ্রম। যার অস্তিত্ব নেই, তার সমস্যা আপনি কীভাবে খুঁজে বের করবেন, আর সেই সমস্যা-ই বা আপনি কীভাবে ঠিক করবেন। এই ইউনিভার্সের বেসিক এবং আল্টিমেট অবজেক্টিভ হচ্ছে এনট্রপি, ম্যাক্সিমাম এনট্রপি এবং সে কারণেই এই ইউনিভার্স প্রসারিত হচ্ছে, হয়েই যাচ্ছে। কম এনট্রপিক অবস্থা থেকে আরো বেশি এনট্রপিক অবস্থায় যাচ্ছে। আর ইউনিভার্স এইভাবে প্রসারণের সময় কোনো কোনো পার্টিকেল একটা আরেকটার কাছাকাছি এসে একটা কিছু তৈরি করছে, বস্তু তৈরি হচ্ছে, হয়ত একটা শৃংখলিত সিস্টেম তৈরি হচ্ছে, আর এন্ট্রপি কমে যাচ্ছে সেই অংশে। আর আমরা দেখছি গ্র্যাভিটি তৈরি হয়েছে সেখানে, দ্য মাইটি গ্র্যাভিটি যার আসলে কোনো অস্তিত্ব নেই। আর সমগ্র ইউনিভার্সে এনট্রপি বাড়ছে ইকুইলিব্রিয়ামের দিকে, ম্যাক্সিমাম ভ্যালুর দিকে, যখন সেখানে পৌঁছাবে, গ্র্যাভিটি উইল ভ্যানিশ টোটালি। গ্র্যাভিটির বিভ্রম আর থাকবে না তখন। আর ইউনিভার্সের এই প্রসারণ, এই এন্ট্রপি কে নিয়ন্ত্রণ করছে, কোথা থেকে আসছে—ডার্ক এনার্জি। ইয়েস, ডার্ক এনার্জি। আর সেই ডার্ক এনার্জির ভিতরে কী আছে, কারা আছে, কীভাবে কন্ট্রোল করে—আমরা কিছুই জানি না।

আট

আমি মাথা ঠান্ডা রাখার চেষ্টা করলাম, বললাম, সিমন, সিমন আপনি যা বলছেন, আমি শুনতে খুবই আগ্রহী। কিন্তু আগে আমি আমার হাসব্যান্ডের খবর জানতে চাই, আমার সন্তানের পিতার কথা শুনতে চাই, প্লিজ।

সে জোরে একটা নিঃশ্বাস নিল, আগের মতই ফিসফিস করে বলল, বলব, আমি বলব, যদিও তাতে কিছু আসে যায় না। আমি খুব সামান্য জানি। আপনি বললেন না যে ফার সাইড না ডার্ক সাইড অব দ্য মুন, তাই বলছি, সেখানে কোনো সাইড আর নাই, কোনো স্পেস নেই সেখানে। তাহলে? সেখানে ডার্ক এনার্জি ফরমুলেট করেছে। সেখানে ভ্যাকুয়াম স্পেস-টাইম কিছু নেই। ‘কিছু-নাই’ ব্যাপারটাও আর সেখানে নাই। ইউনিভার্সের গ্রেটেস্ট মিস্ট্রি এখন আপনার নিজের গ্যালাক্সিতে, না শুধু তাই নয়, আপনার সবচেয়ে নিকটে, আপনার প্রিয় পৃথিবীর পাশেই। আর আপনি জানতে চাচ্ছেন তো—আমি বলব আপনাকে, আমি বলব।

আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ও বেঁচে আছে? ইয়োস বেঁচে আছে?

মনে হল সে আমার ডেসপারেশন বুঝতে পারল, কিছুটা ধাতস্থ হল সে আমার প্রশ্ন শুনে। আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ।

এরপর বলতে থাকল, শুরুতে আমরা সবাই আলাদা দুইটা টিমে ছিলাম। সে আর আমি আলাদা আলাদা টিমে ছিলাম। আমরা তখনো জানতাম না আসলে কী ঘটছে, ওখানে একটা অংশে কোনো গ্র্যাভিটি নেই, কোনো স্পেস নেই—গ্র্যাভিটি নেই বলাটা ঠিক না—ওখানে রিভার্স গ্র্যাভিটি, মানে এনট্রপি মারাত্মক বেশি। আমরা খুব আশ্চর্য হয়েছিলাম সবাই, প্রথম প্রথম, ধরতে পারছিলাম না কিছু। আমরা বেশ দূরে থাকতাম ওই জায়গা থেকে, আমরা খেয়াল করলাম যে ওখানে সবকিছুই খুব দ্রুত ঘটছে, খুব দ্রুত, ধরেন, আমি কিছু বলতেছি আমার পাশের জনকে, আমি কিছু বলার আগেই সে শুনে ফেলছে, আমি কফি বানাব, পানি বসানোর আগেই বাষ্প হয়ে যাচ্ছে।

আমি খেয়াল করলাম, কথা বলার সময় সিমনের কপালের রগ টানটান হয়ে উঠেছে।

সে বলতে থাকল, এভরিথিং ইজ সো ফাস্ট দেয়ার, যেন ভার্চুয়ালি টাইম জিনিসটা আর সেখানে নেই, কীভাবে বুঝাব আপনাকে আমি! কোনো ভিডিও দেখার সময় খেয়াল করেছেন তো ফাস্ট ফরোয়ার্ড করলে কী হয়, অনেক বেশি ফাস্ট ফরোয়ার্ড করে দেন—কত দ্রুত যায় সবকিছু। অনেকটা সেরকম। আমরা ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম, আমরা আরো পিছনের দিকে সরে আসি। আমাদের মধ্যে মিলার ছিল, ফিজিসিস্ট, আরও কেউ কেউ ছিল ফিজিসিস্ট, মিলার-ই একদিন বলল যে ও নিশ্চিত ধরতে পেরেছে জিনিসটা কী। ডার্ক এনার্জি। মিলার তখন সবাইকে বলল যে সে দেখতে চায় এই এনার্জিটা ঠিক কী ফর্মে আছে, গ্যাসীয় অবস্থায় নাকি পিওর এনার্জি ফর্মে, সে দেখতে চায় কাজ করছে কীভাবে!

আমি ধৈর্য্য ধরে শুনছিলাম সিমনের কথা।

সে বলল, ওরা পাঁচজন, মিলারের নেতৃত্বে তখন ওই অংশটার কাছাকাছি চলে যায়, আপনার ইয়োসও ছিল তাদের মধ্যে। আমরা বাকিরা তখন চাঁদ এর ল্যান্ডিং স্টেশনে যারা ছিল তাদের সাথে আর এখানে পৃথিবীতে যোগাযোগ করছিলাম। বেশ কিছুদিন পরে, যে পাঁচ জন গিয়েছিল ওখানে তাদের দুইজন ফিরে আসে। এবং খুব অদ্ভুত, আমরা তাদের চিনতে পারি না, মনে হচ্ছিল তাদের বয়স অনেক কমে গেছে নয়ত আমাদের বয়স অনেক বেড়ে গেছে, তাদের চেহারা খুব আতংকগ্রস্ত, কথাবার্তা অসংলগ্ন। তারা বলল, ওরা নাকি ওই অংশের খুব কাছে ক্যাম্প তৈরি করার চেষ্টা করেছিল, এবং হঠাৎ পরিস্থিতি তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, তারা যা কিছুই করছে সবকিছু পিছনের দিকে যাচ্ছে, মানে রিওয়াইন্ড হচ্ছে। আমরা তখন কিছুটা বুঝতে পারলাম, ডার্ক এনার্জি যদি হয়, ম্যাক্সিমাম এন্ট্রপিতে পৌঁছে গেলে, তারপরে কমতে শুরু করবে। টাইমস অ্যারো হ্যাজ বিন রিভার্সড। সময়ের তীর উলটা দিকে ঘুরে গেছে।

আমি টের পেলাম আমার গাল দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। আমি খুব আস্তে জিজ্ঞেস করলাম, ইয়োস আর ফিরে আসেনি?

সিমন কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। পরে বলল, ওরা আমাদেরকে বলেছিল, বাকিরা তারপরও এনার্জির ফর্ম-টা কী তা বের করার চেষ্টা করছিল ওখানে। ওরা বলছিল, খুবই অসংলগ্ন কথাবার্তা, যে ডার্ক এনার্জি আমাদের সম্পূর্ণ ইউনিভার্স, পৃথিবী, আমাদের প্রত্যেকের জীবন কন্ট্রোল করছে, যেহেতু সে এন্ট্রপি কন্ট্রোল করছে, ওই মেকানিজম। যদি ওই অংশের ভিতরে ঢুকে পড়া যায়, ম্যাক্সিমাম এন্ট্রপিতে পৌঁছানো যাবে, মানে ওরা মৃত্যুর পরবর্তী জগতে চলে যাবে এবং তখন এন্ট্রপি আবার কমতে শুরু করবে, টাইম’স অ্যারো উইল বি রিভার্সড, এবং তারা জন্মের আগের স্টেটে, আগের অবস্থায় ফিরে যেতে পারবে। আমার সন্দেহ, ততদিনে মিলার আর ওই দলের নেতৃত্বে ছিল না, ইয়োস ছিল তাদের লিড।

আমি টের পেলাম আমার গাল দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। আমি খুব নীচু কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলাম, ইয়োস আর ফিরে আসবে না?

সিমন কোনো কথা বলল না। আমার দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল।

আমি শুনতে পেলাম, বাইরে কোথাও খুব জোরে, তীক্ষ্ণ শব্দে সাইরেন বেজে উঠল।