প্রতিবিম্ব

খুট করে একটা শব্দ হয়। তাতেই ঘুম ভেঙে যায় নিনার। উঠে বসে বিছানায়। ইতিউতি করে খুজঁতে থাকে শব্দের উৎস। এখনো হচ্ছে শব্দটা। আয়নার দিকে চোখ পড়ে ওর। আশ্চর্য কারও প্রতিবিম্ব দেখা যাচ্ছে আয়নায়। প্রতিবিম্বে যাকে দেখছে সে দেখতে হুবহু নিনার মতো দেখতে, কিন্তু নিনা নয়। নিনার পরনের পোশাক আর প্রতিবিম্বর পোশাক এক নয়। এক নয় দুজনের দাঁড়ানোর ভঙ্গিও। সেই প্রতিবিম্বই এতক্ষণ খুটখুট শব্দ করছিল। প্রতিবিম্ব চিন্তিত। অন্য কেউ হলে নিশ্চিত ভয়ে চিৎকার দিত, নিনা সাহসী মেয়ে। কোনো কুসংস্কার মানে না। কুসংস্কারে ভয়ও পায় না। ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করে।

হাত রাখে আয়নায়। ধরা-ছোঁয়া যায় না প্রতিবিম্বকে।

'কে তুমি?' জানতে চায়।

'আমি তুমিই।'

'কীভাবে সম্ভব? তাছাড়া তুমি আয়নার ওপারে। তাহেলে কি টাইম ট্রাভেলিং করে এসেছ?'

'না, না। তোমাদের মতো আরেকটা পৃথিবী থেকে এসেছি!'

'বুঝলাম না। তুমি কি আমার ক্লোন?'

নিনার মাথায় ঢুকছে না কিছুই, দ্বিতীয় পৃথিবী, তারই মতো আরেকজন! কিছুক্ষণ আগে দেখা আয়নার নিনার সাথে পৃথিবীর নিনা কথা বলছে।

'অনেকটা ক্লোনই, মানে আমিই তুমি, তুমিই আমি। শুধু আমাদের পৃথিবী আলাদা।'

'তোমার মা-বাবা?'

'আমার মা-বাবা আর তোমার মা-বাবা একই। আমিও নিনা। আমরা একই, শুধু পৃথিবীর মানুষের সঙ্গে কিছু সিদ্ধান্তে কিছু পার্থক্য হয়।'

'প্যারালাল ইউনিভার্সের কথা বলছ তুমি?'

'ইয়েস! আমি এতক্ষণ এটাই বোঝানোর চেষ্টা করছিলাম।'

'কিন্তু আমি তো জানতাম এটা কল্পনা ।'

'আমিও ভাবতাম। এমনকি আমাদের পৃথিবী, অর্থাৎ আমাদের গ্রহের সবাই ভাবে তারা পৃথিবীতে বাস করছে। সেখান থেকে আমি একটি মিশনে এসেছি, গোপন মিশন। এতে প্রমাণ হবে আসলেই প্যারালাল ইউনিভার্স আছে কিনা।'

'তাহলে কি তুমি আসল নিনা?'

'আমরা দুজনেই আসল! '

'বুঝিয়ে বলো, তুমি কীভাবে এসেছ, কেন এসেছ? প্যারালাল ইউনিভার্সই বা কেমন?'

'মহাবিশ্ব শুধু একটা নয়, আরও অনেক অনেক মহাবিশ্ব রয়েছে, যা মাল্টিভার্স নামে পরিচিত। এগুলোর মধ্যে শত আলোকবর্ষ দূরত্ব। এসব মহাবিশ্বের মধ্যে আবার এমন অনেক মহাবিশ্ব রয়েছে যা আকার আয়তনে এমনকি পদার্থবিজ্ঞানের নিয়মগুলোতেও একই। এদেরকেই বলা হয় প্যারালাল ইউনিভার্স বা সমান্তরাল মহাবিশ্ব। সেই সমান্তরাল মহাবিশ্বে তোমারই মতো আরেকজন আছে, তুমি এখন যা করছ হয়তো সেও এখন তাই করছে। দুটি মেমব্রেনের সংঘর্ষের ফলে তৈরি হয়েছিল মহাবিশ্ব, একদল বিজ্ঞানী মনে করেন, প্রতিদিন এমন মহাবিশ্ব গঠিত হয়েই চলেছে। সেখানে তোমার মতো আরও একজন, অনেক অনেক টুইন থাকা সম্ভব। মানুষ মহাবিশ্বকে আসলে যত বড় মনে করে মহাবিশ্ব তার থেকে অনেক বড় এবং প্রতিনিয়ত বড় হয়েই চলেছে। মানুষ শুধু একটি নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত দেখতে পায়।'

' তাহলে তুমি এখন যা করছ, আমার তো তাই করার কথা'।

'না, দুইটি মহাবিশ্বের প্রতিরূপের মধ্যে কখনো কখনো সিদ্ধান্তে পার্থক্য হয়। এক মহাবিশ্বের তুমি হয়তো আরেক মহাবিশ্বের তুমি সম্পর্কে জানো না। কোনো বস্তু, প্রাণী বা যেকোনো, কিছুর মাধ্যমে তুমি দ্বিতীয় জগতে পৌঁছতে পার, যাকে চাবি বা কী বলা হয়। আমি সেভাবেই এখানে এসেছি, এখন আমাকে ফিরে যেতে হবে। '

'কিন্তু তুমি যাবে কীভাবে?'

'আমি এখানে এসেছি আয়নার মাধ্যমে। মানে আয়নাটিই হচ্ছে আমার চাবি। তোমাকে এখন আমার জগতে যেতে হবে। সেখানে গেলে তুমি তোমার আয়নায় আমাকে দেখতে পাবে। আয়নায় হাত রাখবে তুমি।'

'এখনই কি যেতে হবে?'

'হ্যাঁ, এখনই। মাধ্যমের কোনো ক্ষতি হয়ে গেলে আমি আর আমার জগতে যেতে পারব না'!

'কিন্তু যদি এই আয়নার কিছু হয়? তখন আমিও বন্দী হয়ে যাব?'

'না হবে না, কারণ আমরা দুজন দুজনের আসল জগতে থাকব না'।

নিনা আয়নার দিকে এগোয়, আয়নায় হাত রাখা মাত্রই একজন নিনা ভেতরে ঢোকে আরেকজন বের হয়। নিনা চলে যায় অন্য জগতে। এটা তো পৃথিবীই! তার রুম অন্যভাবে গোছানো। সে চলে এসেছে বহু আলোকবর্ষ দূরত্বের কোনো মহাবিশ্বে। নিনা আয়না দেখে, তাতে এখন এই জগতের নিনাকে দেখা যাচ্ছে। সে তাকে বলছে হাত রাখ, হাত রাখ। কিছুক্ষণের মধ্যেই ধ্বংস হয়ে যাবে, আয়না। নিনা হাত রাখে, সে আবার ফিরে যাচ্ছে, দুজন নিনার দেখা হয়।

'আমরা দুজনেই চলমান, তাহলে তোমাকে দেখে আমার স্থির মনে হচ্ছে কেন?

'কারণ আমরা দুজনই একই গতিতে গতিশীল, তাই দুজন দুজনের সাপেক্ষে স্থির।'

'নিনা, আমাদের কি আবার দেখা হতে পারে?'

'হয়তো,কোনো একদিন।'

'হ্যাঁ, কোনো একদিন।' পৃথিবীর নিনা তার প্রতিবিম্বের মনের কথা বুঝতে পেরে আবার বলে ওঠে।

লেখক: শিক্ষার্থী, অষ্টম শ্রেণি, তেজগাঁও সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়