ফিরে এসো মানুষ

মোশারফ সাহেবের অফিস হাঁটা দূরত্বে। আধঘণ্টার মতো লাগে হেঁটে পৌঁছাতে। তাতেই তার মেজাজ বিগড়ে যায়। এটি অবশ্য হাঁটার জন্য নয়। মেজাজ খারাপের কারণ আশপাশের পরিবেশ। মোশারফ সাহেবের মনে হয়, তার জন্ম এক শতক আগে হলে ভালো হতো! রাস্তায় যেদিকেই তাকান, ছোট ছেলেমেয়ে থেকে শুরু করে বয়সী মানুষ—সবার কানে হেডফোন! আবার যখন তিনি বাসে ওঠেন, দেখতে পান সবার চোখ জ্বলজ্বল করে তাকিয়ে আছে মোবাইল স্ক্রিনের দিকে! এমন জীবন্মৃতের মতো রোবটিক জীবনের কোনো মূল্য আছে? যে মানুষের ভেতর পশুত্ব আছে, তাদের খারাপ চোখে দেখে সমাজ; অথচ যেসব মানুষের ভেতর রোবটত্ব আছে, তাদের খারাপ চোখে দেখা হয় না। মোশারফ সাহেব মনে করেন, যান্ত্রিক মানুষকেও খারাপ চোখে দেখা উচিত। কারণ, রোবট গোত্রীয় মানুষের মাঝে মমত্ববোধ থাকে না। তারা হয় মনুষ্যত্ববিবর্জিত মানুষ।

অফিস শেষে ঘরে ফিরলেও শান্তি পান না মোশারফ সাহেব। বাসায় ঢুকেই দেখতে পান ছেলে গেমস খেলছে, মেয়ে ইউটিউবে সিরিয়াল দেখছে! মুঠোফোন আধুনিক মানুষকে এতটাই মুঠোবন্দী করে ফেলেছে যে এখন টেলিভিশনের অনুষ্ঠানও মানুষ দেখে মুঠোফোনে। তিনি ছেলেমেয়েকে নানাভাবে শাসন করেও কোনো ফল পাচ্ছেন না। মিসেস মোশারফ নরম মনের মানুষ। তিনি বাসায় থাকেন ঠিকই; কিন্তু বাচ্চারা মায়ের কথা একদমই শোনে না। মেজাজ ঠান্ডা করার জন্য মোশারফ সাহেব এফএম রেডিও সেট নিয়ে বসেন। ইদানীং গানগুলোর লিরিকও পাল্টে গেছে। ‘ফুল নেবে না অশ্রু নেবে’র জায়গা দখল করেছে ‘অ্যানালগ নেবে না ডিজিটাল নেবে’! মদপানে মানুষ আর কতটুকু টাল হয়; ডিজিটালে টাল হয় সবচেয়ে বেশি—গান শোনেন আর এমন ভাবেন মোশারফ সাহেব। এই তথাকথিত ভবিষ্যৎ যুগের মানুষের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত তিনি। যে সমাজে কমে এসেছে আত্মীয়দের যাওয়া-আসা, প্রতিবেশীদের মিলনমেলা, বন্ধুদের মেলামেশা, সেই সমাজের বারোটা বাজতে কতক্ষণ!

আজ অফিসে ঢুকেই মোশারফ সাহেব দেখলেন, এমডি সাহেব মুখ কালো করে পায়চারি করছেন। ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে এটি ভয়ানক ব্যাপার। মোশারফ সাহেবের আজ খুব বেশি দেরি হয়নি। পনেরো মিনিট দেরি করেছেন। বাসার কাছে অফিস হলে যা হয় আরকি! বসের মুখ কালো দেখে কিছুটা ঘাবড়ে গেলেন তিনি। পরক্ষণেই একটি বিষয় খেয়াল করে স্বস্তি পেলেন—শুধু বস নয়; সবাই মুখ কালো করে আছে। সবাই তো আর মোশারফ সাহেবের দেরির কারণে রেগে থাকার কথা নয়; সুতরাং অফিসে অন্য কিছু ঘটেছে।

চুপচাপ নিজের ডেস্কে এসে বসলেন মোশারফ সাহেব। কম্পিউটার অন করতেই পাশ থেকে নাজিম সাহেব ফিসফিস করে বললেন, ‘কম্পিউটার অন করে আর কী হবে?’

‘কেন?’

‘চাকরিই তো নেই!’

মোশারফ সাহেব হতভম্ব হয়ে বললেন, ‘চাকরি থাকবে না কেন?’

‘কীভাবে চাকরি থাকবে, আপনিই বলেন?’

মোশারফ সাহেব প্রো–অ্যাকটিভ ছাড়াও কিছুটা রি–অ্যাকটিভ গোছের মানুষ; অল্পতেই প্রতিক্রিয়া দেখান। তিনি বললেন, ‘পনেরো মিনিট লেট করার জন্য দুনিয়ায় কারও চাকরি গেছে কখনো?’

নাজিম সাহেব বললেন, ‘আপনি জানেন না তাহলে?’

ন্যাকামো পছন্দ করেন না মোশারফ সাহেব। বললেন, ‘কী হয়েছে বলেন তো?’

‘আপনি আইটির মানুষ। আপনিই বুঝবেন। আমি তো অতশত বুঝি না।’

‘কী হয়েছে, দয়া করে বলা যাবে?’

‘ইন্টারনেট কাজ করছে না! ই-মেইল যোগাযোগ বন্ধ। অফিসের কাজ করবেন কীভাবে?’

‘ও, এটা তো আমাকে কেউ জানায়নি। এখনই টিম নিয়ে ট্রাবলশুট করছি।’

‘লাভ নেই, ভাই।’

‘মানে কী?’

‘সারা দুনিয়ায় একই সমস্যা। আমরা ভাই ছোটখাটো মানুষ। ছোট এই কোম্পানির সমস্যা সমাধান করতেই হিমশিম খাই; দুনিয়ার সমস্যা সামাল দেব কীভাবে?’

মোশারফ সাহেবের আর ন্যাকামো আলোচনায় অংশ নিতে ইচ্ছা করছে না। অন্যদের সঙ্গে কথা বলা প্রয়োজন। আসল ঘটনা জানা প্রয়োজন। তিনি ডেস্ক থেকে উঠে গেলেন।

দুই

পরিচিত কয়েকজন আইটি স্পেশালিস্টের সঙ্গে কথা বললেন মোশারফ সাহেব। বেশ কিছু তথ্য জানলেন। নাজিম সাহেব ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে বললেও ঘটনা সত্য। পৃথিবীজুড়েই ইন্টারনেট কাজ করছে না! বড় বড় বিজ্ঞানী ঝাঁপিয়ে পড়েছেন এর সমাধানের জন্য। ইতিমধ্যে তারা চাঞ্চল্যকর কিছু তথ্যও পেয়েছেন। ইন্টারনেট যে টিসিপি/আইপি প্রটোকলের মাধ্যমে সচল থাকে, তার তৃতীয় স্তর অর্থাৎ নেটওয়ার্ক স্তরে মূল সমস্যাটি ধরা পড়েছে। এই লেয়ারে প্যাকেট আকারে যে ডেটা পাঠানো হচ্ছে, সেগুলো হারিয়ে যাচ্ছে চিরতরে! প্রকৃতপক্ষে, এ ক্ষেত্রে ডেটার প্যাকেটগুলোয় থাকে দুটি অংশ। এক অংশে থাকে ব্যবহারকারীর তথ্য, যাকে বলে ‘পেলোড’। আরেক অংশে থাকে ‘কন্ট্রোল ইনফরমেশন’, যেটি ধারণ করে প্রেরক বা প্রাপকের ঠিকানা, ভুল সংশোধনের কোড ইত্যাদি। বিজ্ঞানীরা ইন্টারনেট বিপর্যয়ের যে কারণটি খুঁজে পেয়েছেন তা হলো, কোনো এক বিচিত্র প্রক্রিয়ায় সব ডেটার ‘কন্ট্রোল ইনফরমেশন’ অংশ স্বয়ংক্রিয়ভাবে ডিলিট হয়ে যাচ্ছে! হারিয়ে যাচ্ছে ডেটার ঠিকানা, হারিয়ে যাচ্ছে মানুষের সব ম্যাসেজ, সব ইনফরমেশন। ফলাফল হিসেবে, ইন্টারনেট মৃত। এ অবস্থাকে ‘পৃথিবী গ্রহের ভয়ংকরতম দুর্যোগ’ হিসেবে অভিহিত করেছে জাতিসংঘ।

তিন

ইন্টারনেট ঠিক না হওয়ায় অফিস থেকে আজ আগেই ফিরলেন মোশারফ সাহেব। বাসায় ঢুকেই দেখলেন ছেলেমেয়ে তর্ক জুড়েছে বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে। বাচ্চাদের তর্কাতর্কি করতে দেখলেও মোশারফ সাহেব খুশি হলেন এই ভেবে যে অন্তত মুঠোফোন নিয়ে বসে নেই তারা। ইন্টারনেট না থাকায় যেন স্বস্তি ফিরে এসেছে। অনেক দিন পর রাতে পরিবারের সবার সঙ্গে বসে শান্তিমতো খাবার খেলেন মোশারফ সাহেব। অন্যান্য দিন ছেলেমেয়েরা খেলার বা সিরিয়াল দেখার অজুহাতে একসঙ্গে খায় না। খাওয়াপর্ব শেষে সবাই মিলে টেলিভিশন দেখতে বসলেন। একফাঁকে উঠে মিসেস মোশারফ চা নিয়ে এলেন স্বামীর জন্য; সবার জন্য নিয়ে এলেন তালের পিঠা। আজকের দিনটি অন্য রকম আমেজে কাটছে! বিভিন্ন চ্যানেলের খবরে ইন্টারনেট বিপর্যয়ের ওপর আপডেট বার্তা পরিবেশিত হচ্ছে। খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় গোয়েন্দারা বের করে ফেলেছেন! সেটি হলো, পৃথিবীখ্যাত সাতজন বিজ্ঞানীকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ধারণা করা হচ্ছে, অপকর্মটি তারাই করছেন! গোপন কোনো স্থান থেকে তারা তাদের এই অসৎ কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছেন। তাদের খুঁজে বের করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে গোয়েন্দা দল।

চার

দুই মাস পার হয়ে গেছে। ইন্টারনেট সমস্যার কোনো সমাধান আজও সম্ভব হয়নি। খুঁজে পাওয়া যায়নি বাঘা সাত বিজ্ঞানীকেও। তবে সাত বিজ্ঞানী অভিনব উপায়ে পাঠানো একটি বার্তার মাধ্যমে পৃথিবীবাসীকে জানিয়েছেন, ইন্টারনেট অকার্যকর করার পেছনে তাদের একটাই উদ্দেশ্য—মনুষ্যত্বকে ফিরিয়ে আনা। তারা মোশারফ সাহেবের মতোই অনুভব করেছেন, মানুষ ধীরে ধীরে তাদের সবচেয়ে বড় গুণ মানবিকতা হারিয়ে ডিজিটালের তালে যান্ত্রিক হয়ে উঠছিল! ইন্টারনেট সেবা বন্ধের পর পৃথিবীজুড়ে অর্থনৈতিক ধস কয়েক দিনের জন্য নেমেছিল ঠিকই; কিন্তু বিকল্প নানা উপায়ে মানুষ সেই ক্ষতি অনেকটাই পুষিয়ে নিয়েছে। হয়তো অর্থনীতি আগের মতো তুঙ্গে নেই; তবু চাঙাভাব মিইয়ে যায়নি।

পাঁচ

মোশারফ সাহেব বেডরুম লাগোয়া বারান্দায় এসে বসলেন। আকাশে গোল রুপালি চাঁদ উঠেছে। চাঁদের দিকে তাকিয়ে তিনি আরও একবার অনুভব করলেন, জন্ম সার্থক। বিশ্বখাদক ইন্টারনেট খেয়ে ফেয়েছিল সব পার্থিব সুখ। এখন হয়তো দুর্দান্ত গতি নেই, টাকার শৃঙ্গ মানুষ গড়তে পারছে না; কিন্তু মানুষের মনে সুখ ভর করেছে। বেড়েছে মানুষে মানুষে সৌহার্দ্য, পারিবারিক বন্ধন, সামাজিক শৃঙ্খলা। ফিরে এসেছে চিঠির চল, পাড়া বেড়ানো প্রথা। পৃথিবীর হর্তাকর্তারা এখনো হন্যে হয়ে খুঁজছেন সাত বিজ্ঞানীকে, যাদের তারা অভিহিত করেছেন ‘জঘন্যতম মানুষ’ হিসেবে। মোশারফ সাহেব মন থেকে দোয়া করেন এই জঘন্যতম মানুষদের জন্য। তিনি প্রার্থনা করেন, পৃথিবী গ্রহের বুকে ইন্টারনেট নয়; নেমে আসুক চাঁদের অবারিত জ্যোত্স্নাধারা, মানুষের ভালোবাসার ফল্গুধারা।