ফুলগুলি যেন কথা

এল মেজর রেনল্ডস

রূপান্তর: মুনির রানা

ফুলগুলি যেন কথা নামের একটা বই আমি দেখেছিলাম। বিপ্রদাশ বড়ুয়া কিংবা দ্বিজেন শর্মার হবে। কী ভেবে লেখক বইয়ের ও রকম নাম রেখেছিলেন, জানি না। সম্ভবত জগদীশচন্দ্রের কথা মাথায় ছিল তাঁর, রবিবাবুর কবিতাও মাথায় থাকতে পারে। বিজ্ঞানী বলেছিলেন, গাছেরও প্রাণ আছে। তারও পরে আরও অনেকে গবেষণা করে দেখিয়েছেন, গাছের সুখ-দুঃখের অনুভূতিও আছে। তারা কষ্ট পায়, আনন্দে থাকে। পরস্পরের সঙ্গে বার্তা বিনিময়ও করে, এ-ও বলেছেন কেউ কেউ। কিন্তু বিষয়টা কেউ হাতে-কলমে দেখাতে পারেননি। আমি বিষয়টাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিই এবং সত্যি বলতে কী সাফল্য আমার ওষ্ঠের প্রান্তে এসে গেছে বলতে পারেন। তার ঘ্রাণ আমাকে আমোদিত করে তুলেছে।

আমি একজন প্রকৃতিবিদ। বোটানি নিয়ে পড়ালেখা করেছি। পিএইচডি শুরু করেছিলাম গাছের বাক্শক্তি নিয়ে এবং কাজটা সম্পন্ন করে এনেছিলাম। তবে দুর্ভাগ্য, সেটা কেউ রিকগনাইজ করল না। আরেকবার করতে চেয়েছিলাম গাছের চলনশক্তি নিয়ে। সেটা করার সুযোগই পেলাম না। শিক্ষকদের অনেকের ধারণা, আমি বেশি বেশি মনস্টার মুভি দেখি। দেখে দেখে আমার মাথাটা গেছে। আমাকে দিয়ে আর কিসসু হবে না। পিএইচডি শেষ না করেই পড়াশোনার পাট চুকাতে হলো। সংসারে টাকা দরকার। হন্যে হয়ে ঘুরলাম। কিন্তু কোথাও চাকরি জোটেনি। শেষমেশ একটা নার্সারি খুলে বসলাম। দিন দিন সেটা বিশাল আকার ধারণ করল। এখন প্রায় একটা জঙ্গল বলা চলে। আয়-ইনকাম মন্দ না। রাজশাহীতে এ রকম নার্সারি দ্বিতীয়টি নেই।

প্রতিদিন ভোরে সূর্য ওঠারও আগে নার্সারিতে চলে আসি। গাছপালার তদারক করার জন্য লোক আছে। পানি দেওয়া, সার দেওয়া, আগাছা তোলা, ডালপাতা ছাঁটা—এসব কাজ ওরাই করে। মাস শেষে আমি শুধু আয়-ব্যয়ের হিসাব নিই। আর সারা দিন পড়ে থাকি নার্সারির এক কোণে তৈরি আমার নিজস্ব ল্যাবরেটরিতে।

আজ দরজা খুলে ল্যাবের ঠিক মাঝখানে রাখা নিচু টেবিলটার কাছে এসে দাঁড়াতেই আমার বুকটা ধড়াস করে উঠল। টেবিলের ওপরে টবে রাখা ছোট্ট করবীগাছের চারাটা টবে নেই। চট করে নিচে তাকাতেই দেখি, ওটা টেবিলের ওপরেই টবের পাশে পড়ে আছে। পড়ল কীভাবে? টব থেকেই বা বের হলো কীভাবে? তার মানে? ‘ওহ মাই গড!’ দ্রুত উবু হয়ে বসে পড়লাম ওটার কাছে। তাকালাম ওটার দিকে, তাকিয়ে রইলাম গভীর মনোযোগে। এর মাঝেই মিষ্টি আওয়াজ তুলে বেজে উঠল ডোরবেলটা। কিন্তু সেই শব্দ আমার মনোযোগকে বিন্দুমাত্র টলাতে পারল না। তখনো টলমল করছে ছোট্ট চারাগাছটা। খানিক পরেই একটু এগিয়ে এল ওর গুচ্ছমূলের কয়েকটা, পা ঘষটে ঘষটে চলার মতো করে। ওয়াও! এটাই আমার দেখা তার প্রথম পদক্ষেপ, বলা যায় এক জায়ান্ট লিপ। চোখ প্রায় বস্ফািরিত হওয়ার জোগাড় আমার তখন। ওর ওপর থেকে চোখ না সরিয়েই ডান দিকের দেয়ালের একটা সুইচের দিকে হাত বাড়ালাম। খুব ধীরে হাত দিয়ে ফোটো এমিশন মেশিনের পাওয়ারটা এত অল্প পরিমাণে বাড়ালাম যে একমাত্র আমি ছাড়া আর কিছুই সেটা টের পেল না। এরপর আমার বন্ধ করে রাখা দম এমনভাবে বেরিয়ে এল যে সেটাকে একটা হর্ষধ্বনি বলেই ধরে নেওয়া যায়।

ছোট্ট চারাটি অনেক চেষ্টায় তার গুচ্ছমূলের আরও কয়েকটা নড়াতে সক্ষম হলো ইতিমধ্যে এবং সেগুলো দিয়ে হাঁটার চেষ্টা করল! এতটাই মন্ত্রমুগ্ধের মতো তার নড়াচড়া লক্ষ করছিলাম যে দ্বিতীয়বারের মতো বেজে ওঠা ডোরবেলের শব্দটাও আমার চৈতন্যে কোনো তরঙ্গ তুলল না। দাঁড়িয়ে রইলাম আমি। আমার শরীরের প্রতিটি কোষ যেন প্রার্থনা করছিল ম্যাজিকটা পুরো হোক, পুরো হোক, ছোট্ট চারাখানি তার প্রথম পদক্ষেপটি পূর্ণ করুক।

খুব ধীরে ধীরে, অনেক সংগ্রাম করে চারাটি দুলতে দুলতে ঋজু হয়ে দাঁড়াল। এরপর মিনিটখানেক সময় চলে গেল। গুচ্ছমূলের একটি অনিশ্চিত ভঙ্গিতে এগোল, তারপর আরেকটি এভাবে একে একে সব কটি মিলে এগোতে লাগল এবং একসময় টেবিলের প্রান্তে গিয়ে দাঁড়াল।

উত্তেজনায় আমার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছিল। দ্রুত দৌড়ে আরেকটা সুইচ টিপে দিলাম। তার আগে একটা খুদে মাইক্রোফোন অ্যাডজাস্ট করে নিলাম টেবিলের প্রান্তে। মুহূর্তের মধ্যে পুরো ল্যাবরেটরিটা খসখস শব্দে ভরে উঠল। তারপর শোনা গেল নানা রকম চিঁ চিঁজাতীয় শব্দ। মনে হচ্ছিল অনেকে মিলে কিছু একটা বলছে। হতভম্বের মতো বসে বসে দেখলাম আর শুনতে থাকলাম গাছগুলোর কীর্তিকলাপ। সব কটি গাছ যে সিনথেসিস মেশিনের অ্যাকশনে একসঙ্গে সাড়া দেবে, এটা আমার ভাবনার অতীত ছিল।

ডোরবেলটা আবারও বাজল, কিন্তু এবারও আমার কানে পৌঁছাল না। এমনই হতভম্ব হয়েছি যে চেয়ারের সঙ্গে যেন গ্লু দিয়ে সেঁটে গেছি। বিশ্বের প্রথম চলমান আর কথা বলা গাছের সামনে বসে আমি, দিন-দুনিয়ার সবই তখন তুচ্ছ আমার কাছে। মাইক্রোফোনের অন্য ফেজটা হাতে নিলাম এবং মুখের কাছে নিয়ে কথা বললাম। সেই কথা একটা খুদে স্পিকার হয়ে চারাগাছটার কানে যেন ফিসফিসিয়ে উঠল, ‘করবী! ও করবী!’ আমাকে আনন্দে ভাসিয়ে দিয়ে প্রায় সঙ্গে সঙ্গে করবীর চারাগাছটিও একই কথার প্রতিধ্বনি তুলল।

‘করবী! ও করবী!’ সারা ঘরে সেই মিষ্টি আওয়াজ ছড়িয়ে পড়ল।

দ্রুত ব্যস্ত হয়ে পড়লাম আমি গাছগুলোর জন্য একটা ভোকাবুলারি তৈরির কাজে। কিছু কথা ওদের না শেখালেই নয়। নাহলে আমার সঙ্গে কমিউনিকেট করতে পারবে না ওরা। গোলমাল বেধে যাবে। কী কী লিখব, কীভাবে লিখব এসবের খসড়া যখন প্রায় শেষ করে এনেছি, তখনই হঠাত্ খেয়াল করলাম, ঘরের কোথা থেকে যেন একটা ভৌতিক শব্দ ভেসে আসছে। টেবিলের ওপর গাছটার দিকে তাকালাম। কিন্তু না, ওটা এখনো স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ও ঠিকই বুঝতে পারছে আর পা বাড়ানো ঠিক হবে না। কপালে ভাঁজ ফেলে ল্যাবরেটরির চারদিকে তাকালাম। জানালার কাছে একটা কিছুর নড়াচড়া নজরে এল।

আরেকটু ভালো করে তাকিয়ে দেখি, জেরানিয়ামগাছ, যেটা আমার মা উপহার দিয়েছিলেন আমাকে। উইন্ডোবক্স থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছিল ওটা প্রাণপণে! আর একটানা বিড়বিড় করে যাচ্ছিল। ওর কিছু কথা শুনতে শুনতে ভোকাবুলারি বানানোর কাজ শিকেয় উঠল আমার। কিছু কথা শুনে লজ্জায় লাল হয়ে উঠল গাল। অনেক দিনের পুরোনো গাছ ওটা। আমার সব বৈজ্ঞানিক ব্যর্থতার খবর ও জানে, যাবতীয় পাগলামিরও সাক্ষী ও এবং কথাবার্তা শুনেই বোঝা যাচ্ছে, স্মৃতিশক্তিটা বেশ ভালোই ওর। বস্ফািরিত নেত্রে দেখলাম, ধীরে ধীরে কঠিন সংগ্রাম করে বাক্সের মাটির ভেতর থেকে নিজের শিকড় একটা একটা করে বের করে নিয়ে বাক্সের প্রান্তগুলো ছুঁয়ে দাঁড়াল জেরেনিয়ামটা। ওর লাল ফুলগুলো চারপাশে ঘুরে দুলতে লাগল। গাছের কোনো চোখ নেই, কিন্তু আমার কেন যেন মনে হলো ওটা ঘরের চারপাশ দেখে নিচ্ছে মাথা ঘুরিয়ে। তারপর, খানিক বাদেই জানালার নিচের চৌকাঠের ওপর লাফ দিল। সেখান থেকে কাছেই রাখা একটা চেয়ারের সিটে। তারপর চেয়ারের একটা পায়া বেয়ে নেমে এল মেঝেতে। পাতাগুলো ঝাড়া দিল, ফুলগুলো একটু উঁচিয়ে এসে আমার পানে তাকিয়ে বেশ উত্ফুল্ল কণ্ঠে বলল, ‘হাই, দোস্ত।’ তারপর আমাকে পাশ কাটিয়ে মেঝের ওপর দিয়ে হেঁটে হেঁটে বিড়বিড় করতে করতে দরজার দিকে এগোতে লাগল, ‘কখন থেকে ঘণ্টাটা বেজে যাচ্ছে। কারও কোনো হুঁশ নেই।’

সত্যিই তো। আমি একদমই খেয়াল করিনি। এবার ডোরবেলের আওয়াজ বাজতেই তড়াক করে লাফিয়ে উঠে জেরানিয়ামটাকে প্রায় ধাক্কা দিয়েই এগিয়ে গেলাম দরজার দিকে। কে এল এই অসময়ে? এখন তো এদিকে কারও আসার কথা নয়। ভাবতে ভাবতেই হাঁ করে দরজাটা খোলার সঙ্গে সঙ্গে আমার মুখটাও হাঁ হয়ে গেল বিস্ময়ে। চোখের সামনে দরজাজুড়ে বাগানের কোণের গোলাপের ঝাড়টাকে দেখতে পেলাম। মুখটা তখনো আমার খোলাই ছিল কিন্তু কোনো কথা বেরোল না। গোলাপের ঝাড়টাই মুখ খুলল প্রথম, ‘সেই কখন থেকে বেল টিপে যাচ্ছি। কানের মাথা খেয়ে ফেলেছ নাকি। কয়েকটা দুষ্টু ছেলে আমার গোটা চারেক গোলাপ ছিঁড়ে নিয়ে গেছে। জ্বলে যাচ্ছে। একটা কিছু করো!’

এতক্ষণ পেরেছিলাম, কিন্তু এবার আর স্নায়ুর চাপ নিতে পারলাম না। অজ্ঞান হয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ার আগে শুধু শুনতে পেলাম জেরানিয়ামটা গোলাপ ঝাড়টাকে লক্ষ করে বলছে, ‘হাই বেবি! এসো ভেতরে এসো। কত দিন ধরে দেখছি তোমায়। আজই কাছে আসার সুযোগ হলো।’

*লেখাটি ২০১৭ সালে বিজ্ঞানচিন্তার জুন সংখ্যায় প্রকাশিত