জীর্ণ একটা বাড়ি।
সামনে ছোট গেট। চারপাশে শেওলা জমেছে। গেটের ওপর ছড়িয়ে থাকা লতানো গাছ মনে করিয়ে দিচ্ছে ওটার যত্ন নেওয়ার মতো কেউ নেই।
আশপাশে তাকাল রাশেদ। নির্জন বাড়ির চারপাশে দেয়াল আর দেয়াল। গেটের এক পাশে ছোট একটা সাইনবোর্ড। সেখানে লেখা: ‘ড. টি জামান, এক্সক্লুসিভ মাইন্ড রিডার’।
‘খাইছে!’ পল্টন বলল। রাশেদের বন্ধু।
‘কী হয়েছে?’ জানতে চাইল রাশেদ।
‘ইনি যদি আমাদের মাইন্ড রিডিং করে ফেলেন, তাহলে তো ঠিকই বুঝতে পারবেন আমরা উনাকে নিয়ে কী ভাবছি।’
‘বুঝতেই পারেন। আমরা তো উনার কাছে একটা কাজেই এসেছি, তাই না?’ ধীরে ধীরে বলল ও।
‘আচ্ছা, এই যে এক্সক্লুসিভ লিখেছেন, সেটা কেন?’ পল্টন জানতে চাইল।
‘আমরা কেন এসেছি, সেটা ভেবে দেখ, তাহলেই বুঝতে পারবি।’
মাথা ঝাঁকাল পল্টন।
রাশেদ ভালো করে তাকিয়ে দেখল। কোনো ডোরবেল দেখতে পেল না।
অগত্যা গলা উঁচু করে রাশেদ ডাকল, ‘হ্যালো, শুনতে পাচ্ছেন? বাসায় কি কেউ আছেন?’
বেশ কিছুক্ষণ ডাকাডাকি করার পর সাড়া পাওয়া গেল।
কাশতে কাশতে বেরিয়ে এলেন বয়স্ক এক লোক। সারা মাথায় কাঁচা-পাকা চুল। চোখে পাওয়ারযুক্ত চশমা। ক্লিন শেভড।
‘কী চাই? কাকে চাই?’
‘আপনি কি ড. টি জামান?’ ইতস্তত করে জানতে চাইল রাশেদ।
মাথা ঝাঁকালেন ভদ্রলোক। ইশারায় ভেতরে ডাকলেন।
ভেতরে ঢুকে চমকে গেল দুজন। মনে হলো হঠাৎ কোনো শো-পিসের দোকানে ঢুকে পড়েছে ওরা। ঘরের চারপাশে শোভা পাচ্ছে অ্যান্টিকস। দেখেই বোঝা যাচ্ছে, অ্যান্টিকসগুলো বেশ দামি।
‘আমি একজন শৌখিন অ্যান্টিকস কালেক্টর।’
যেন ওদের মনের কথা বুঝতে পারলেন ভদ্রলোক।
‘এতগুলো অ্যান্টিকস কি আপনি জোগাড় করেছেন? না কিনেছেন?’
‘না। এর কোনোটাই কিনিনি। জোগাড় করেছি।’
‘জোগাড়! আপনি নিশ্চয়ই বেশ অ্যাডভেঞ্চারাস লোক। নইলে এত সব দামি আর দুর্লভ অ্যান্টিকস জোগাড় করলেন কীভাবে?’
হাসলেন টি জামান।
‘আসলে মনেপ্রাণে আমরা সবাই কি রোমাঞ্চপ্রিয় নই? ছোটবেলায় রহস্য-রোমাঞ্চের বই পড়ে কে না গুপ্তধন শিকারি হতে চেয়েছে।’
মাথা ঝাঁকাল ওরা।
‘তা আপনারা এসেছেন কেন?’
‘আমার বাবা ইসমাইল সিদ্দিকী। নৌ অফিসার ছিলেন। দেশে-বিদেশে ঘুরে বেড়িয়েছেন। আমি আর আমার মা দেশেই থাকতাম। তিনি ছয় মাস, কখনো এক বছর পরপর এসে আমাদের সঙ্গে থাকতেন কিছুদিন। গত পরশু লন্ডনে থাকা অবস্থায় তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন।’
‘দুঃখিত।’ ধীরে ধীরে বললেন টি জামান।
‘তাঁর লাশ আজ সকালে দেশে এসে পৌঁছেছে।’
‘আমি কি তাঁকে চিনতাম?’
‘না স্যার। আমি আপনার কাছে এসেছি সম্পূর্ণ অন্য কারণে।’
‘কী কারণ?’
‘আমার বাবা ধনসম্পদ, ব্যাংক–ব্যালান্স কেমন রেখে গেছেন, সেটা জানতে চাই। এ জন্য আপনাকে খুব দরকার।’
‘যেমন?’
প্রশ্ন শুনে বেশ বড় একটা শ্বাস নিল রাশেদ।
‘স্যার, আমি শুনেছি আপনি মৃত মানুষের স্মৃতিতে থাকা তথ্য উদ্ধার করতে পারেন। জানি না এটা কীভাবে সম্ভব করেন। তবে আপনি যে এটা পারেন, বিশ্বস্ত সূত্রে তা জেনেছি।’
‘আপনার মা হয়তো স্বামীর সব তথ্য জানেন। তাঁকে জিজ্ঞেস করুন।’
‘মাস ছয়েক হলো তিনিও মারা গেছেন।’
‘সরি। ঠিক আছে, আমি যাব আপনার সঙ্গে। একটু দাঁড়ান। আমি রেডি হয়ে নিই।’
দুই
আত্মীয়স্বজন সবাই রেডি হয়ে ছিল। লাশ আজ এলেও মৃত্যুর সংবাদ আগেই পৌঁছে গেছে আত্মীয়স্বজনের কাছে। রাশেদ ড. টি জামানকে নিয়ে যখন ফিরল, তখন আত্মীয়স্বজন উত্কণ্ঠায় অপেক্ষা করছে।
রাশেদ তাদের বুঝিয়ে–সুঝিয়ে ঘরের বাইরে পাঠাল। ড. টি জামান খাটিয়ায় রাখা ইসমাইল সিদ্দিকীর মাথার কাছে বসলেন। কাফনের কাপড় সরিয়ে লাশের মুখ দেখলেন। তারপর লাশের মাথায় একটা ছোট্ট ডিভাইস রেখে চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলেন।
বন্ধ অবস্থাতেও তার দুই চোখের পাতা কাঁপছে।
একটু পর তিনি ডিভাইস সরিয়ে নিলেন। রাশেদকে ইশারা করলেন পাশের ঘরে যেতে। নিজেও তার পিছু পিছু গেলেন। ইশারা করলেন কাগজ-কলম এনে দিতে।
রাশেদ কাগজ-কলম এনে দিল তাঁর হাতে।
টি জামান ডিভাইসে স্ক্রিন দেখে খসখস করে লিখতে শুরু করলেন। কোন ব্যাংকে কত পাউন্ড, কতগুলো বন্ড কিনেছেন এবং সেগুলো কোথায় রেখেছেন, তা লিখলেন। স্থাবর, অস্থাবর সম্পত্তির কথাও লিখলেন টি জামান।
শুধু লিখলেন না ইসমাইল সিদ্দিকীর জীবনের অজানা দিকগুলো। একটা মানুষের জীবনে কত স্মৃতিই না গোপনীয় থাকে!
সব প্রকাশ করে দেওয়া ঠিক নয়, ভাবলেন তিনি।
তিন
টাকাপয়সা সম্পত্তির সব তথ্য রাশেদকে সরবরাহ করলেও একটি তথ্যই ড. টি জামান গোপন রেখেছেন তাঁর কাছ থেকে। তা হলো, মহামূল্যবান অ্যান্টিকস আংটির কথা। এটি ইসমাইল সিদ্দিকী সংগ্রহ করেছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে। হীরা বসানো এই আংটির কথা জানতেন শুধু রাশেদের বাবা আর স্মৃতি উদ্ধার করে জেনেছেন তিনি। আংটির বিষয়টি তিনি গোপন করে গিয়েছিলেন।
রাশেদের বাবার মারা যাওয়ার মাস তিনেক পার হয়েছে।
আংটি রাখা ছিল লন্ডনে। একটি প্রাইভেট সংস্থার লকারে। গত সপ্তাহে লন্ডনে গিয়েছিলেন ড. টি জামান। লকার খুলে নিয়ে এসেছেন সেই আংটি। এই মুহূর্তে তাঁর টেবিলের ওপর ঝকমক করছে হীরা খচিত আংটি। টি জামান অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছেন। সত্যিই দুর্লভ একটা সংগ্রহ। নিজ ঘরের চারপাশে তাকালেন তিনি। এই আংটির কাছে অন্য সংগ্রহগুলোকে তুচ্ছ বলে মনে হচ্ছে তাঁর কাছে।
আকর্ষণ! তীব্রভাবে আকর্ষণ করছে আংটিটা তাঁকে। হাসলেন টি জামান। কার আংটি কে আঙুলে দেয়!
বাক্সে রাখা আংটিটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বেশ কিছুক্ষণ দেখলেন তিনি। তারপর চট করে নিয়ে পরে ফেললেন ডান হাতের মধ্যমায়।
অমনি খচ করে কী যেন বিঁধল আঙুলে। তাড়াতাড়ি আংটি বের করে টেবিলে রাখলেন তিনি। মধ্যমার দিকে তাকালেন। তীক্ষ্ণ কিসের খোঁচায় খুব সামান্য কেটে গেছে। রক্তও বেরিয়েছে সামান্য। কী মনে করে আংটি নিয়ে এর নিচে তাকালেন তিনি। খুব সামান্য আঁচড় দেওয়ার জন্য অতিক্ষুদ্র তীক্ষ্ণ একটা ফলা বেরিয়ে আছে।
মনে পড়ল, ইসমাইল সিদ্দিকীর স্মৃতি উদ্ধারের সময় খুব সামান্য সময়ের জন্য তথ্যটা ঝিলিক দিয়েছিল। তা হলো, মহামূল্যবান আংটিটি পরার সময় নিচে একটি ঢাকনা ঘুরিয়ে নিতে হবে। নয়তো খেতে হবে বিষাক্ত কাঁটার খোঁচা। নয়তো আক্রান্ত ব্যক্তি কিছুক্ষণের মধ্যেই ঢলে পড়বে মৃত্যুর মুখে।
মাথা কেমন যেন ভার লাগছে।
শরীরজুড়ে ঝিমানো ভাব।
টের পেলেন হাত দুটি অবশ হয়ে আসছে।
ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে মৃত্যু, টের পেলেন ড. টি জামান।