শারি এই পৃথিবীর মেয়ে নয়।
কখনো কখনো কার মনে হয়?
নীলকণ্ঠ, নীলকণ্ঠ দেখাঁর।
নীলকণ্ঠ দেখাঁ কে?
বিরামপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক।
বিরামপুর নদীর ওপারে। নদী পার হয়ে আরও আড়াই কিলোমিটার হেঁটে যেতে হয়। তা যায় শ্রীমান নীলকণ্ঠ দেখাঁ। শারির বর সে। বয়স ৩৬। শারির ২৭।
সম্বন্ধ এনেছিলেন নীহারেন্দু পুরকাইত। অমলকান্তি দেখাঁর স্কুল লাইফের বন্ধু। যোগীনগরের বিরাট গেরস্থ। ছেলের বিয়ে দিতে পারছেন না বলে একদিন তাঁর কাছে আফসোস করছিলেন অমলকান্তি দেখাঁ। দুই দিন পর নীহারেন্দু পুরকাইত শারির কথা পাড়েন এবং মোবাইল ফোনে শারির কয়েকটা ছবি দেখান অমলকান্তি দেখাঁকে। ধারারগাঁওয়ের হরিশ পণ্ডিতের মেয়ে। অতিশয় সুলক্ষণা কন্যা। চন্দ্রাবতী পণ্ডিত (শারি)।
নীলকণ্ঠ দেখাঁকে সুলক্ষণা কন্যার একটা ছবি প্রিন্ট করে দেওয়া হয়েছিল। নীলকণ্ঠ দেখাঁ সেই ছবি অতি গোপনীয়তার সঙ্গে দেখিয়েছিল টাউনে তার একমাত্র বন্ধু হাছননগরের তৈয়ব আল আজাদকে। তৈয়ব আল আজাদ টাউনের মহাকবি। জ্বালাময়ী কবিতা লেখে। রাইস মিল, স মিল, ডেইরি ফার্ম, পোলট্রি নানা কিছুর ব্যবসা তাদের। আয়রোজগারের জন্য কিছু করতে হয় না ব্যাটাকে। নিজেকে মহাকবি ঘোষণা করেছে এবং নিশ্চিন্তে মহাকবি হওয়ার সাধনা করছে সে।
মহাকবিরও তখন একটা বিয়ের কথাবার্তা চলছে। লন্ডনি পাত্রী। তারা ইন্টারনেটে কথা বলতে পারত, তা না, তৈয়ব আল আজাদের হাঁটাচলা ইত্যাদি ভিডিও করে পাঠানো হয়েছে লন্ডনে। তারা আর হ্যাঁ-না কিছু জানায়নি। এমতাবস্থায় হয়তো কিছুটা মানসিক বৈকল্যে ভুগছিল তৈয়ব আল আজাদ, শারির ছবি দেখে অত্যন্ত অশালীন একটা মন্তব্য করেছিল সে। সঙ্গে সঙ্গে ক্ষুব্ধ নীলকণ্ঠ দেখাঁ মনে মনে অভিশাপ দিয়েছিল তাকে, তোর এই বিয়ে কোনো দিনই হবে না। লন্ডনি পাত্রীর সঙ্গে কখনোই না। হয়নি। নীলকণ্ঠ দেখাঁ ও শারির বিয়েটা হয়েছে। ১৮ আশ্বিন, বৃহস্পতিবার। মিথুন-কর্কট এবং সিংহলগ্নে সুতহিবুকযোগে বিবাহ। শুভদৃষ্টি মনে আছে নীলকণ্ঠ দেখাঁর। পল্লী বিদ্যুতের আলোয় বউয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে খুবই চমকে গিয়েছিল সে।
তার বউ শারির চোখের মণির রং সবুজ! স্নিগ্ধ, ঠান্ডা। আজব! ঘুম ধরে গিয়েছিল নীলকণ্ঠ দেখাঁর। শারি পরে শুনে হেসেছে, ‘বোকা মানুষ। চোখের মণির রং বুঝি কাউকে ঘুম পাড়িয়ে দিতে পারে? আবার রংটাও কী দেখেছ। এখন আবার দেখো তো! দেখো তো! দেখো তো! হি! হি! হি!’
কথায় কথায় খুব হাসতে পারে শারি। হাসলে তার গালে টোল পড়ে এবং একটা গেজদাঁত দেখা যায়। মহা রূপবতী কেউ বলবে না হয়তো, কিন্তু একটা কিছু আছে তার মধ্যে। টানে। নিরন্তর টানে নীলকণ্ঠ দেখাঁকে।
বিয়ের পরদিন বউ নিয়ে টাউনে ফিরেছিল নীলকণ্ঠ দেখাঁ। কালরাত্রিতে ষোলোঘরের চারুবালা পিসিমার বাসায় ছিল শারি। বাসররাত ২১ আশ্বিন। রবিবার ছিল এবং রাতে হঠাৎ করে বৃষ্টি নেমেছিল।
শারি আড়াই-তিন দিনেই তার নিজের সংসার করে নিয়েছিল—অমলকান্তি দেখাঁ এবং নীলকণ্ঠ দেখাঁ, বাপ-ব্যাটার সংসারকে। কত-কী এটুকুতেই! ‘মেয়ে’ এবং ‘মা’ হয়ে বসে আছে শ্বশুরের। পাড়ার এর তার বউদি, মামি, কাকি। জন্ম থেকে যেন সে এই টিনের চালওয়ালা মাটির বাসাতেই আছে। নীলকণ্ঠ দেখাঁ বিপরীত স্বভাবের। অমিশুক কিছুটা, কথা কম বলে। শারির কথায় কথায় তখন শুধু বোকা হতো সে।
‘তুমিও পাখি, আমিও পাখি। মানুষ বলবে পাখপাখালির সংসার! হি! হি! হি!’
‘মানে?’
‘নীলকণ্ঠ পাখি আছে না?’
‘অ।’
‘আমিও পাখি তো। শারি।’
‘শারি পাখি?’
‘পাখি না? এমা! রূপকথার শুক-শারির শারি হলো শালিক আর শুক হলো টিয়া পাখি। তোমার নাম শুক হলে ভালো হতো।’
‘অ।’
‘আচ্ছা, তুমি কী মনে করেছিলে? শারি মানে আমি পিঁপড়ার সারি? হি! হি! হি! আচ্ছা, তোমার প্রিয় লেখক কে গো?’
‘আউট বই আমি পড়ি না।’
‘আউট বই মানে? গল্পের বইকে মানুষজন এখনো আউট বই বলে নাকি? হি! হি! হি! আচ্ছা, আউট বই। আমি ভাই অনেক আউট বই পড়ি। হুমায়ূন আহমেদের বই বারবার পড়ি।’
‘হুমায়ূন আহমেদের নাটক দেখেছি টিভিতে। খুবই মজার।’
‘তাঁর লেখা বই আরও মজার। হি! হি! হি! আমি একটা ছোট ট্রাঙ্কে করে আমার কিছু বই নিয়ে এসেছি। তার মধ্যে ১৭টা বই-ই হলো হুমায়ূন আহমেদের। তুমি একটা বই অন্তত পোড়ো।’
‘নাহ্!’
‘নাহ্ কেন? বই পড়ার অভ্যাস হয়ে যাবে? হি! হি! হি! শোনো এটা বিশেষ একটা বই। এই বইটা পড়লে আমি তোমাকে একটা বিশেষ কথা বলব।’
‘কী বিশেষ কথা?’
‘এখন বলব না। তুমি আগে পড়ো বইটা।’
‘কী বই? দিয়ো।’
‘নিশিকাব্য।’ হুমায়ূন আহমেদের একটা ছোটগল্পের বই। ১১টা গল্প। পৃষ্ঠাসংখ্যা ৮৬।
‘ভালো যদি না লাগে সব গল্প তোমাকে পড়তে হবে না। তুমি শুধু শঙ্খমালা গল্পটা পড়বে।’
‘আচ্ছা।’
‘শঙ্খমালা’ বইয়ের ৫০ পৃষ্ঠায়। ৫৪ পৃষ্ঠায় শেষ হয়ে গেছে। তাই পড়তে দেড় ঘণ্টা লাগল অনভ্যস্ত পাঠক নীলকণ্ঠ দেখাঁর।
‘পড়েছি। এখন বলো কথাটা কী?’
‘কী কথা?’
‘কী কথা মানে? তোমার বিশেষ কথাটা কী?’
‘অ। হি! হি! হি! শোনো। ছোটনের দাদা এনড্রিন না খেলে আমি তাকে বিয়ে করতাম।’
‘ছোটনের দাদা!’
‘শঙ্খমালা গল্পের ছোটনের বড়দা। হি! হি! হি! আমি তার প্রেমে পড়েছিলাম।’
‘তুমি খুব অদ্ভুত। পৃথিবীর কেউ না।’
সেটা অবশ্য বাসররাতেই বুঝে গিয়েছিল নীলকণ্ঠ দেখাঁ। হঠাৎ আইতনের সেই রাতটা তারা কথা বলে কাটিয়ে দিয়েছিল।
‘তুমি আমাকে একদিন পাহাড়ে নিয়ে যাবে গো?’
‘নিয়ে যাব।’
‘নিয়ে যেয়ো না।’
‘কেন?’
‘পাহাড়ে গেলে আমি আর ফিরব না। সত্যি ফিরব না।’
‘ফিরো না। আমিও তোমার সঙ্গে থেকে যাব পাহাড়ে।’
‘কী? তুমি? তুমি তো থাকতে পারবে না গো।’
‘কী? কেন?’
‘তারা বলেছে।’
‘তারা কারা?’
‘তারা।’
তারা কারা?
খুব ছোট সময়ের কথা মনে নেই, যে সময় থেকে মনে আছে, তখন থেকে শারির সঙ্গে কথা বলে তারা। কী কথা বলে?
‘তুমি কেমন আছ, আমাদের মেয়ে?’
‘ভালো।’
‘তোমার মন খারাপ, আমাদের মেয়ে?’
‘না।’
‘মন খারাপ করে না, আমাদের মেয়ে। আমরা তোমাকে পেয়ে যাব একদিন।’
‘তোমরা কারা?’
তারা হাসে। ফিসফিস করে হাসে উতল হাওয়ার মতো।
‘তুমি আমাদের মেয়ে! তুমি আমাদের মেয়ে!’
তারা বলেছে তারা থাকে পাহাড়ে।
বারবার বলে, ‘আমরা তোমাকে পেয়ে যাব একদিন। তুমি আমাদের মেয়ে।’
তারা কি মানুষ? শারি দেখেনি। তবে তার মনে হয়, তারা সবুজ রঙের এবং মনে হয় তারা গাছ।
‘গাছ! কেন?’
‘পাহাড়ে থাকে, গাছ ছাড়া আর কী হবে তারা?’
‘পাহাড়ে আরও কত-কী থাকে।’
‘তারা গাছ।’
‘আচ্ছা, তারা গাছ। তুমি গাছের মেয়ে। গেছো মেয়ে।’
‘তুমি আমার কথা বিশ্বাস করোনি গো?’
‘আরে পাগল! বিশ্বাস করেছি। তুমি যা বলো, আমি বিশ্বাস করি। সারা জীবন বিশ্বাস করব।’
‘তারা যদি আমাকে পেয়ে যায় একদিন?’
‘পাবে না।’
কখন শারির সঙ্গে কথা বলে তারা?
কিছুর ঠিক নেই। তবে শারি যখন একা থাকে তখন। স্বপ্ন বা তন্দ্রার মধ্যে না। তারা ফিসফিস করে কথা বলে এবং তাদের কথা স্পষ্ট শুনতে পায় শারি।
‘আমরা তোমাকে পেয়ে যাব একদিন। তুমি আমাদের মেয়ে।’
বিশ্বাস করার মতো কথা? কিন্তু বিশ্বাস করে নীলকণ্ঠ দেখাঁ। সত্যি। শারি যা বলে, বিশ্বাস করে সে। আবার একটুও যে ভাবে না, তা-ও না ঠিক। তার যতটুক বিদ্যাবুদ্ধি, কখনো কখনো মনে তো হয়ই, সাইকোলজিক্যাল ডিজঅর্ডার হয়তো। সেটা হলেও ভয়ংকর কিছু না। এমনি চিরকালের একটা ছেলেমানুষ শারি। হাসিখুশি, সহজ। নীলকণ্ঠ দেখাঁ ছাড়া আর কাউকে সে কখনো তার অদ্ভুত জগত্টার কথা বলেনি। নীলকণ্ঠ দেখাঁও কাউকে বলেনি। সাড়ে ৬-৭ বছর কম দিন না, স্বাভাবিক হয়ে গেছে সব। শারি কখনো কখনো থাকুক তার জগতে, সংসারের কিছু ক্ষতি তো হচ্ছে না।
শৈশবে মাতৃহীন নীলকণ্ঠ দেখাঁ। অমলকান্তি দেখাঁও গত হয়েছেন। নাতি-নাতকুরের মুখ দেখে যেতে পারেননি। এখনো তারা কেউ জন্ম নেয়নি। মহাকবি তৈয়ব আল আজাদ এর মধ্যে বিশ্বরেকর্ড করে ফেলেছে। তিন বছর আগে বিয়ে করে দুই জোড়া ছেলেমেয়ের বাপ হয়ে গেছে। যমজ। জোড়া মেয়ে, জোড়া ছেলে। লন্ডনি পাত্রীর ভিডিও পছন্দ হয়নি, মহাকবি বিয়ে করেছে দেড়ঘরিয়ার শুনু মহাজনের মেয়ে রিমাকে। রিমা টাউনে খুবই বিখ্যাত। স্কুল লাইফ থেকেই। জিকু গুন্ডার ভাই জুগনুর হাড্ডিগুড্ডি গুঁড়া করে দিয়েছিল পিটিয়ে। নাদান জুগনু ‘টোন’ মেরেছিল তাকে।
শারির সঙ্গে খুবই ভাব রিমার। বলেছে তাদের যদি ছেলেপুলে না হয়, এক পিস এক পিস দুই পিস ছেলেমেয়ে সে দলিল করে দিয়ে দেবে শারিকে। কসম।
২৩ ডিসেম্বর থেকে শীতের ছুটি পড়ে। ১১ ডিসেম্বর রিমা এবং তৈয়ব আল আজাদের বিবাহবার্ষিকী। গিয়েছিল তারা। শারি ও নীলকণ্ঠ দেখাঁ। প্রস্তাব তৈয়ব আল আজাদের, ‘তোর তো ছুটি আর কদিন পর থেকে। চল কোথাও থেকে ঘুরে আসি কয়েক দিন।’
‘কোথায় যাবি?’
‘পাহাড়ে যাবেন?’
শারি বলেছিল।
‘বিশাল’ দুঃখিত হয়েছিল তৈয়ব আল আজাদ, ‘পাহাড়ে! আমি তো পাহাড়েই থাকি, সিস্টার।’
তত্ক্ষণাৎ খেপে উঠেছিল রিমা, ‘দেখলি! দেখলি! আমাকে এখন পাহাড় মনে হয় তার!’
তারা প্রস্তাবিত সেই পাহাড়ে এখন।
ভালো লাগছে। তবে গোড়ায় কিছু পরিমাণ বিস্মিতই হয়েছিল নীলকণ্ঠ দেখাঁ। সেই রাতেই জিজ্ঞেস করেছিল শারিকে, ‘পাহাড়ে যাবে?’
‘যাব তো। কেন? আমি কখনো পাহাড়ে যাইনি।’
‘তারা যদি তোমাকে পেয়ে যায়...।’
‘যাবে তো।’
‘কী বলছ তুমি?’
নীলকণ্ঠ দেখাঁর নাকের ডগায় একটা ছোট্ট করে কামড় দিয়েছিল শারি, ‘কিছু বলছি না! কিছু বলছি না!’
নীলকণ্ঠ দেখাঁ সব ভুলে গিয়েছিল।
সব ব্যবস্থা তৈয়ব আল আজাদ করেছে। কাল দুপুর থেকে তারা আছে পাহাড়ে। পানছড়ি রিসোর্টের কটেজে। পাহাড় লিজ নিয়ে বানানো রিসোর্ট। ছোট ছোট ১১টা কটেজ। তারা বুক করেছে ৩টা। রিমার বোন ইমা এবং ভাই রিবনও এসেছে সঙ্গে। বোনপো, বোনঝিদের সামলায় তারাও।
জিপ আছে রিসোর্টের। সারা দিন এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়ায় তারা। দারুণ। আজ একটা গুহা দেখতে গিয়েছিল। জুজুবাবার গুহা বলে স্থানীয় লোকজন। জুজুবাবা হলেন গাছদের ‘দেওতা’। বহুকাল আগে এই গুহায় থাকতেন। ত্যক্ত হয়ে বহুকাল আগে চলে গেছেন দূরের আরেক গুহায়। সেই গুহা কোথায় কেউ জানে না, কোনো মানুষ কখনো যায়নি। তবে জুজুবাবা, আবার ফিরবেন। একদিন ফিরবেন। বিশ্বাস করে পাহাড়ি মানুষেরা।
গাছের খোঁড়লের মতো গুহাটা। শেওলা পড়ে সবুজ হয়ে আছে। ৩১৮ হাত দীর্ঘ। ছোট ছোট মশাল নিয়ে ঢুকতে হয়। বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে রিমা ঢোকেনি।
জিপের ড্রাইভার ছাড়া রিসোর্টের দুজন গাইডও ছিল তাদের সঙ্গে। তৈয়ব আল আজাদ জুজুবাবার গুহা নিয়ে দুই লাইন কাব্য রচনা করেছে। যথারীতি অশালীন। হায়াশরম নেই শালার। ইমা কত ছোট, রিবন কত ছোট! দুলাভাইয়ের অশ্লীল কাব্য শুনে তারাও হি হি করে হেসেছে। জিপের ড্রাইভার, গাইড দুজনও হেসেছে। আর কিছু কি গুহায় ঘটেনি?
ঘটেছে। নীলকণ্ঠ দেখাঁ আবার একবার চোখের মণির রং সবুজ দেখেছে শারির। গুহার সবুজ রং, মশালের আলোয়, বিভ্রম হতেই পারে অবশ্য।
কাল-পরশু এত শীত ছিল না, আজ যত শীত পড়েছে পাহাড়ে। ঠান্ডা কী ঠান্ডা! কুয়াশার মধ্যে তারা ফিরেছে রিসোর্টে। ১৭-১৮ কিলোমিটার পাহাড়ি রাস্তা, পাক্কা পৌনে ৩ ঘণ্টা লেগেছে কুয়াশায়।
রুম হিটার আছে কটেজে।
তারা ডিনার সেরেছে ৯টায়।
ঘুমিয়েছে কখন?
বলতে পারবে না।
হঠাৎ শারি ফিসফিস করে বলল, ‘এই! এই!’
কী হয়েছে? নীলকণ্ঠ দেখাঁ তাকাল।
‘শুনতে পাচ্ছ তুমি? শুনতে পাচ্ছ তুমি?’
‘কী?’
শুনতে পাচ্ছে নীলকণ্ঠ দেখাঁ।
তারা ফিসফিস করে বলছে, ‘তুমি আমাদের মেয়ে। তুমি আমাদের মেয়ে। আমরা তোমাকে পেয়ে গেছি। তুমি আমাদের মেয়ে।’
স্বপ্ন। কিন্তু এ রকম স্বপ্ন হয় নাকি?
আবার ফিসফিস। ফিসফিস ফিসফিস।
‘আমরা তোমাকে পেয়ে গেছি, তুমি আমাদের মেয়ে।’
অস্বস্তি এবং ভয়েও কিছুটা, ঘুম ভেঙে গেল নীলকণ্ঠ দেখাঁর। নাকি ভাঙল না? জটিলতর হলো স্বপ্নটা?
নীলকণ্ঠ দেখাঁ দেখল শারি তার পাশে শুয়ে নেই এবং দরজা-জানালা খোলা কটেজের। কুয়াশা কোথায়, তারাভর্তি আকাশ কটেজের জানালায়। আর দরজায়?
গাছ। একটা দুটো না, অনেক অনেক গাছ। সেই সব গাছের পাতা অদ্ভুত। চোখের মণির মতো এবং সবুজ। তারা ফিসফিস করে কিছু বলছে।
কী বলছে?
‘আহা! আমাদের মেয়ে! আহা! আমাদের মেয়ে!’
শারিকেও দেখল নীলকণ্ঠ দেখাঁ। চলে যাচ্ছে শারি। চলে যাচ্ছে, নাকি গাছ হয়ে যাচ্ছে? গাছ হয়ে যাচ্ছে। চোখের মণির মতো পাতাওয়ালা গাছ। ফিসফিস করছে তার আত্মীয় গাছেরা, ‘আহা, আমাদের মেয়ে! আহা, আমাদের মেয়ে!’
নীলকণ্ঠ দেখাঁ ডাক দিল, ‘শারি!’
শারি কি আর শারি আছে একটুও? গাছ হয়ে গেছে। সবুজ চোখের মণির মতো পাতাওয়ালা গাছ। তার সব পাতা ফিসফিস করে কী বলল, নীলকণ্ঠ দেখাঁ বুঝতে পারল না। এবং এ রকম একটা পরিস্থিতিতে আশ্চর্য ঘুম ধরে গেল তার! জানালা-দরজা খোলা থাকল কটেজের, চোখের মণির মতো পাতার গাছ থাকল, আর থাকল কিছু আশ্চর্য ফিসফিস, দিব্যি ঘুমিয়ে পড়ল নীলকণ্ঠ দেখাঁ। আবার একটা স্বপ্ন দেখল সে? নাকি আবার ঘুম ভাঙল তার? এই নীলকণ্ঠ দেখাঁ জানে, শারি কোথায় গেছে। নাকি জানে না? ঘুমচোখে সে শারিকে দেখল। ঘুমন্ত শারি। শীতকালের সকালের কিছু আলো শারির স্নিগ্ধ-কোমল মুখটায় পড়েছে। দেখে কী মনে হলো, কী মনে হতে পারে নীলকণ্ঠ দেখাঁর?
শারি এই পৃথিবীর মেয়ে না।
কাল রাতে কী হয়েছিল?
ঠিক ৭ মাস ১৭ দিন পর একটা ছানা হবে শারির। টাউনের মাতৃমঙ্গলে। শারি তার ছানার নাম রাখবে অরো।
অরো! অরো মানে কী?
আর্থা গ্রহের গাছ অরো। এই গাছের পাতা খুবই অদ্ভুত। মানুষের চোখের মণির মতো। সবুজ রঙের মণি। শারি এসব বলবে এবং বিশ্বাস করবে নীলকণ্ঠ দেখাঁ?
বিশ্বাস করবে।
তবে অরোর জন্মের পর শারি আর কখনো বলবে না, তার সঙ্গে ফিসফিস করে কথা বলে কারা। এই ৭ মাস ১৭ দিনের মধ্যেও বলবে না। নীলকণ্ঠ দেখাঁরও কিছুই মনে থাকবে না আর। অরো একটু একটু বড় হয়ে উঠলে সে একদিন শারিকে বলবে, ‘আমার কখনো কখনো কী মনে হয়, জানো?’
‘কী মনে হয়, পাখি?’
‘আমাদের অরো এই পৃথিবীর মেয়ে না।’
‘অ। আমার কখনো কখনো কী মনে হয় জানো?’
‘কী মনে হয়?’
‘তুমি এই পৃথিবীর মানুষ না।’
বলে শারি হাসবে। গালে আশ্চর্য টোল পড়বে এবং গেজদাঁত দেখা যাবে তার। নীলকণ্ঠ দেখাঁ তখন কী ভাববে?
শারি তবে এই পৃথিবীর মেয়ে!
*লেখাটি ২০১৭ সালে বিজ্ঞানচিন্তার ডিসেম্বর সংখ্যায় প্রকাশিত