মা: বাবু সোনা, তুমি আমার কথা শুনতে পাচ্ছ?
ভ্রূণ: আমি কোথায়?
মা: ওহ, সোনা! তুমি আমার কথা শুনতে পারছ? আমি তোমার মা।
ভ্রূণ: মাম্মা! আমি কি সত্যিই তোমার পেটের ভেতরে? পানিতে ভাসছি...
মা: একে বলা হয় অ্যামি, না, অ্যানি…অ্যামনিওটিক ফ্লুইড। একেবারে দাঁতভাঙা শব্দ। আজকেই শিখলাম।
ভ্রূণ: ওই শব্দটা কিসের, মাম্মা? মনে হচ্ছে দূরে কোথাও বাজ পড়ছে।
মা: ওহ, ওটা আমার হৃৎস্পন্দন। হার্টবিট। তুমি তো আমার পেটের ভেতর, মনে আছে?
ভ্রূণ: জায়গাটা খুব পছন্দ হয়েছে আমার। আজীবন এখানেই থাকতে চাই।
মা: কী! না, তা তো পারবে না। তোমাকে জন্ম নিতে হবে।
ভ্রূণ: না, মাম্মা! বাইরে খুব ভয় লাগে।
মা: আচ্ছা...এ ব্যাপারে আমরা পরে কথা বলব।
ভ্রূণ: আমার পেটের সঙ্গে লাগানো এই লম্বা লাইনটা কিসের, মাম্মা।
মা: ওটাকে বলে নাভিরজ্জু। স্পাইনাল কর্ড। মায়ের পেটের ভেতর থাকতে গেলে তোমার বেঁচে থাকার জন্য এটা দরকার।
ভ্রূণ: হুম, বুঝতে পেরেছি। আমি এখন যেখানে আছি, তুমিও কি কখনো এখানে ছিলে?
মা: হ্যাঁ, ছিলাম। আমিও আমার মায়ের পেটের ভেতরে ছিলাম জন্মের আগে। তবে সেখানকার কিছুই মনে নেই। সে কারণে তুমিও কিছু মনে করতে পারবে না। বাবু, ভেতরে কি খুব অন্ধকার? তুমি কি কিছু দেখতে পাও?
ভ্রূণ: একটা অস্পষ্ট আলো বাইরে থেকে আসছে। কেমন লালচে কমলা আলো। জিটাও গ্রামের পাহাড়ের আড়ালে সূর্যটা ডুবে গেলে আকাশের রং যেমন দেখা যায়, অনেকটা সে রকম।
মা: তোমার জিটাওয়ের কথা মনে আছে? ওই গ্রামেই জন্মেছিলাম আমি। তাহলে তো তোমার মাম্মার চেহারাটাও জানার কথা?
ভ্রূণ: তুমি দেখতে কেমন, সেটা বেশ জানি আমি। এমনকি ছোটবেলায় তুমি দেখতে কেমন ছিলে, তা–ও জানি। মাম্মা, তোমার কি সেই মুহূর্তের কথা মনে আছে, যেদিন নিজেকে প্রথমবার দেখেছিলে তুমি।
মা: না, মনে নেই। কোনো আয়নায় দেখেছিলাম কি? একটা পুরনো ভাঙা আয়না ছিল তোমার নানুর, তিন খণ্ডে ভাঙা। সে জন্য পেছনে তালি মেরে দিয়েছিলেন তিনি...
ভ্রূণ: না, ওই ঘটনা নয়, মাম্মা। নিজেকে প্রথমবার পানির প্রতিচ্ছবিতে দেখতে পেয়েছিলে তুমি।
মা: হা হা...আমার কিন্তু তা মনে হয় না। জিটাও গ্রামটা তো গোবি মরুভূমির মধ্যে, গানসুতে। আমাদের সব সময় পানির অভাব লেগেই থাকত। বাতাসের অবিরাম চাবুকে চারদিক ধুলোবালিতে ভরে থাকত সব সময়।
ভ্রূণ: ঠিক বলেছ। নানিমা আর নানুকে প্রতিদিন কয়েক কিলোমিটার হেঁটে পানি আনতে হতো। একদিন, তখন তোমার বয়স মাত্র পাঁচ বছর হয়েছে, তুমি নানিমার সঙ্গে কুয়া থেকে পানি আনতে গিয়েছিলে। ফেরার সময় আকাশের গনগনে সূর্য আগুন ঢালছিল চারদিকে। অসহ্য গরম। খুব তৃষ্ণা পেয়েছিল তোমার। তবু নানিমার বালতি থেকে পানি খেতে চাওয়ার সাহস পাচ্ছিলে না তুমি। কারণ, তোমার ভয় হচ্ছিল, নানিমা হয়তো ধমকে উঠে বলবেন, এখন পানি দেওয়া যাবে না। আবার কুয়ার পানি নেওয়ার জন্য এত বেশি গ্রামবাসী লাইন ধরে দাঁড়িয়ে ছিল! তাই তোমার মতো কোনো ছোট বাচ্চা সেখানে গিয়ে পানি খাওয়ার উপায় ছিল না। সেবার ছিল খরার বছর। বেশির ভাগ কুয়া শুকিয়ে গিয়েছিল। একটু পানির জন্য ওই গভীর কুয়াটার কাছে এসে ভিড় করেছিল আশপাশের তিনটে গ্রামের মানুষ। যা–ই হোক, নানিমা বাড়ি ফেরার সময় রাস্তায় একটু জিরোবার জন্য দাঁড়িয়েছিলেন। সে সময় বালতির একচিলতে ফাঁক দিয়ে ভেতরে উঁকি দিয়েছিলে তুমি, একটু ঠান্ডার পানির গন্ধ নিতে, তোমার শুষ্ক মুখে একটু আর্দ্রতার পরশ নিতে...
মা: হ্যাঁ, এবার আমার মনে পড়েছে।
ভ্রূণ: ঠিক তখন বালতির পানিতে নিজের ছায়া দেখতে পেয়েছিলে তুমি। একফালি ধুলোবালির প্রলেপে ঢাকা তোমার মুখে ঘামের আঁকাবাঁকা দাগ দেখেছিলে, বৃষ্টির ধারায় তৈরি হওয়া গিরিখাতের মতো। নিজেকে দেখার ওইটাই তোমার প্রথম স্মৃতি।
মা: কিন্তু এটা আমার চেয়ে তুমি ভালোভাবে মনে করতে পারছ কীভাবে?
ভ্রূণ: তোমারও মনে আছে মাম্মা। তুমি শুধু স্মৃতিটা তুলে আনতে পারছ না। তবে আমার মনের মধ্যে তোমার সব স্মৃতি খুবই স্পষ্ট। এতটাই স্পষ্ট যে মনে হয় যেন গতকালের সব ঘটনা।
মা: কী বলব বুঝতে পারছি না...
ভ্রূণ: মাম্মা, মনে হচ্ছে তোমার সঙ্গে বাইরে আরও কেউ আছে।
মা: ওহ, হ্যাঁ, উনি ড. ইং। এই যন্ত্রটা তিনি বানিয়েছেন বলেই তো এভাবে কথা বলতে পারছি তোমার সঙ্গে। এমনকি অ্যামনিওটিক ফ্লুইডে ভাসতে ভাসতে তুমি সত্যি সত্যি কথা বলতে না পারলেও তোমার কথা বুঝতে পারছি।
ভ্রূণ: তাকে আমি চিনি। তোমার চেয়ে বয়সে একটু বড়। তিনি চশমা আর লম্বা সাদা কোট পরে আছেন।
মা: ড. ইং সত্যিই চমৎকার মানুষ আর বিচক্ষণ। তিনি বিজ্ঞানী।
ড. ইং: হ্যালো, বাবু।
ভ্রূণ: হ্যালো। আম...আমার ধারণা, মস্তিষ্ক নিয়ে গবেষণা করেন আপনি।
ড. ইং: ঠিক ধরেছ। আমি নিউরোসায়েন্টিস্ট। অর্থাৎ মস্তিষ্ক কীভাবে ভাবনার সৃষ্টি করে এবং স্মৃতি তৈরি করে, সেসব নিয়ে গবেষণা করি। মানুষের মস্তিষ্কের বিপুল তথ্য সংরক্ষণের ক্ষমতা আছে। মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতে যে পরিমাণ নক্ষত্র আছে, মস্তিষ্কে নিউরনের পরিমাণ তার চেয়েও বেশি। কিন্তু বেশির ভাগ মস্তিষ্কের ক্ষমতা অব্যবহৃতই থাকে। যে অংশটা ব্যবহৃত হয় না, সেটি নিয়েই আমার কাজকারবার। আমরা দেখেছি, মস্তিষ্কের যে অংশটা তথ্যশূন্য বলে এতকাল ভাবা হতো, সেখানে আসলে বিপুল পরিমাণ তথ্য থাকে। অতি সম্প্রতি আমরা আবিষ্কার করেছি, এসব স্মৃতি আসে আমাদের পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে। আমি কী বলছি, তুমি কি বুঝতে পারছ, সোনা?
ভ্রূণ: কিছু কিছু বুঝতে পারছি। আমি জানি, মাম্মার কাছে আপনি এ ব্যাপারটা অনেকবার ব্যাখ্যা করে বলেছেন। মাম্মা যেগুলো বুঝতে পেরেছে, আমিও সেগুলোই বুঝতে পারছি।
ড. ইং: সত্যি বলতে কী, পূর্বপুরুষদের স্মৃতির উত্তরাধিকার বিভিন্ন প্রজাতিতে খুবই সাধারণ ঘটনা। যেমন ধরো, অনেক কগনিটিভ প্যাটার্নকে আমরা ইন্সটিংক্ট বা প্রবৃত্তি বলি। যেমন মাকড়সা জানে কীভাবে জাল বুনতে হয়, কিংবা মৌচাক কীভাবে বানাতে হয়—সে কথা জানে মৌমাছি। এগুলো আসলে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া স্মৃতি। নতুন আবিষ্কৃত উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া মানুষের এই স্মৃতি অন্যান্য প্রজাতির চেয়ে অনেক বেশি জটিল। জেনেটিক কোডের মাধ্যমে আসা তথ্যের পরিমাণ অনেক বেশি। এই স্মৃতি পরমাণুর কোয়ান্টাম অবস্থার মধ্য দিয়ে ডিএনএতে পারমাণবিক পর্যায়ে লিপিবদ্ধ হয়। এটা অবশ্য কোয়ান্টাম বায়োলজির বিষয়...
মা: ড. ইং, বিষয়টা মনে হয় আমার বাবুটার জন্য অনেক বেশি জটিল হয়ে যাচ্ছে।
ড. ইং: দুঃখিত। আসলে অন্য বাচ্চাদের চেয়ে তোমার বাচ্চা কত সৌভাগ্যবান, সেটিই বোঝাতে চাচ্ছিলাম আমি। মানুষের মধ্যে উত্তরাধিকার সূত্রের স্মৃতি থাকলেও সেগুলো সাধারণত মস্তিষ্কে সুপ্ত আর গোপন থাকে। এর আগে কেউই এটা শনাক্ত করতেও পারেনি।
মা: ডাক্তার, মনে আছে তো, আমার পড়ালেখার দৌড় কিন্তু ওই প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যন্ত। এসব কথা আপনাকে আরও সহজ করে বলতে হবে।
ভ্রূণ: প্রাইমারি স্কুল শেষ করে কয়েক বছর মাঠে কাজ করেছ তুমি। তারপর কাজের খোঁজে বাড়ি ছেড়েছিলে।
মা: হ্যাঁ, বাবু, ঠিক বলেছ। জিটাওয়ে আর থাকতেও পারতাম না। সেখানকার পানিও আমার কাছে বিস্বাদ লাগত। সে কারণেই ভিন্ন কোনো জীবন খুঁজছিলাম।
ভ্রূণ: বেশ কয়েকটি শহরে গিয়েছিলে তুমি। প্রবাসী শ্রমিকদের কাজ করেছ সেসব জায়গায়। রেস্টুরেন্টে প্লেট-গ্লাস ধোয়ামোছার কাজ, অন্যদের বাচ্চাদের দেখাশোনা করা, কারখানায় কাগজের বাক্স বানানো, কনস্ট্রাকশন সাইটে রান্নাবান্না। অবস্থা খুব খারাপ হয়ে যাওয়ার পর ফেলে দেওয়া জিনিসপত্র কুড়িয়েছ বিক্রি করার জন্য...
মা: গুড বয়। বলে যাও। তারপর কী হলো?
ভ্রূণ: যা বলছি, তার সবই তো জানো তুমি।
মা: তারপরও গল্পটা বলো। তোমার কথা শুনতে ভালো লাগছে।
ভ্রূণ: গত বছর ড. ইংয়ের ল্যাবের জিম্মায় আসার আগপর্যন্ত তোমাকে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে।
মা: হ্যাঁ, শুরু থেকেই আমাকে পছন্দ করতেন ড. ইং। মাঝেমধ্যে আগেভাগে কাজে এসে আমাকে হলরুম ঝাড়ু দিতে দেখতে পেতেন। সেখানে থেমে আমার সঙ্গে কথা বলতেন। আমার জীবনের গল্প শুনতে চাইতেন। একদিন সকালে তার অফিসে ডেকেছিলেন তিনি।
ভ্রূণ: তারপর তোমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি যেখানে জন্মেছিলে, তার বদলে অন্য কোথাও আবার জন্ম নিতে চাও কি না।
মা: হ্যাঁ, জবাবে বলেছিলাম, ‘এখানে, অবশ্যই। বড় কোনো শহরে জন্ম নিতে চাই আমি। শহুরে নাগরিকদের মতো করে জীবনযাপন করতে চাই।’
ভ্রূণ: তোমার দিকে স্থিরদৃষ্টিতে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে ড. ইং মুচকি হেসেছিলেন। সেই হাসির মানে তুমি পুরোটা বুঝতে পারোনি। এরপর তিনি বললেন, ‘তুমি সাহসী হলে তোমার স্বপ্ন আমি সত্যি বানিয়ে দিতে পারি।’
মা: প্রথমে ভেবেছিলাম, তিনি হয়তো রসিকতা করছেন। কিন্তু এরপর উত্তরাধিকার স্মৃতি সম্পর্কে আমাকে ব্যাখ্যা করলেন তিনি।
ড. ইং: তোমার মাকে আমি বলেছিলাম, আমরা এমন একটি পদ্ধতি আবিষ্কার করেছি, যা দিয়ে নিষিক্ত ডিম্বাণুর জিন পরিবর্তন করা যায়। সুপ্ত থাকা উত্তরাধিকার স্মৃতিগুলো জাগিয়ে তোলা যায়। কৌশলটা সঠিকভাবে কাজ করলে, পরের প্রজন্ম তাদের উত্তরাধিকার স্মৃতি গড়ে তোলার মাধ্যমে আরও অনেক বেশি কিছু অর্জন করতে পারবে।
মা: কথাটা শুনে আমি স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। ড. ইংকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আমাকে নিয়ে কি এ রকম একটা শিশুর জন্ম দিতে চান?’
ড. ইং: মাথা নেড়ে আমি বলেছিলাম, ‘তুমি কোনো শিশুর জন্ম দেবে না, বরং তুমি জন্ম দেবে...’
ভ্রূণ: ‘নিজেকেই’, এটাই তো বলেছিলেন আপনি।
মা: ব্যাপারটা বোঝার আগে অনেক সময় নিয়ে ভেবেছিলাম। কোনো মস্তিষ্কে যদি তোমার মতো হুবহু একই স্মৃতি থাকে, তাহলে সেই মানুষটিও কি তোমার মতোই নয়? কিন্তু এ ধরনের কোনো শিশুর কথা আমি ভাবতেও পারছিলাম না।
ড. ইং: তাকে বুঝিয়ে বলেছিলাম যে, সেটা কোনো শিশু হবে না, বরং একটা শিশুর দেহে একজন পুর্ণবয়স্ক মানুষ। কারণ তারা জন্মের পরপরই কথা বলতে পারবে। কিংবা জন্মের আগে তুমি যেমন কথা বলছ, সে রকম। সাধারণ যেকোনো শিশুর চেয়ে অনেক দ্রুত অনেকগুলো মাইলফলক পেরিয়ে যেতে পারবে তারা। আবার বয়স্কদের মতো সব জ্ঞান আর অভিজ্ঞতা থাকার কারণে অন্য শিশুদের বিকাশের চেয়ে ২০ বছর এগিয়ে থাকবে। তবে তারা প্রোডিজি কি না, সে ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত কিছু জানি না। অবশ্য তাদের উত্তরসূরিরা নিঃসন্দেহে তা–ই হবে। কারণ উত্তরাধিকার স্মৃতি প্রজন্মের পর প্রজন্ম বাড়তে থাকে। কয়েক প্রজন্ম পর স্মৃতির উত্তরাধিকার অকল্পনীয়ভাবে মিরাকল ঘটাবে। সেটা হবে মানব সভ্যতার জন্য যুগান্তকারী এক পদক্ষেপ। আর এই অসাধারণ প্রচেষ্টায় অগ্রদূত মা হিসেবে তোমাকে ইতিহাসে চিরকাল স্মরণ করা হবে।
মা: হ্যাঁ, এভাবেই তোমাকে পেয়েছি, সোনা।
ভ্রূণ: আমার বাবা কে, সেটা তো আমরা কেউই জানি না।
ড. ইং: যৌক্তিক কারণেই আমাদেরকে তোমার মায়ের দেহের বাইরে টেস্টটিউবে ডিম্বাণু নিষিক্ত করতে হয়েছে। স্পার্মদাতাও তার পরিচয় গোপন রাখতে চেয়েছিল। তোমার মা–ও রাজি ছিলেন তাতে। আসলে তার পরিচয় এখানে গুরুত্বপূর্ণ নয়। অন্য শিশুদের বাবাদের সঙ্গে তুলনা করলে তোমার জীবনে তোমার বাবার গুরুত্ব অতি সামান্য। কারণ, তোমার সব স্মৃতি এসেছে তোমার মায়ের কাছ থেকে। আমাদের কাছে এমন প্রযুক্তিও আছে, যা ব্যবহার করে মা–বাবা দুজনের সুপ্ত স্মৃতিই জাগিয়ে তোলা যায়। তবে সাবধানতার কারণে শুধু তোমার মায়ের স্মৃতি তোমার মধ্যে জাগিয়ে তুলেছি আমরা। একক কোনো মানুষের মনে দুজন ব্যক্তির স্মৃতি স্বতস্ফূর্তভাবে জাগিয়ে তোলার পরিণতি যে কী হবে, তা আমরা এখনো জানি না।
মা: (একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে) শুধু আমার স্মৃতি জাগিয়ে তোলার পরিণতি কী হবে, সেটাও তো আপনারা জানেন না।
ড. ইং: (দীর্ঘ নীরবতার পর) কথাটা সত্য। আমরা আসলেই জানি না।
মা: ড. ইং, একটা প্রশ্ন আপনাকে কখনো করার সাহস পাইনি...আপনি নিজেও তো এখন তরুণ এবং সন্তানহীন। তাহলে আমার মতো আপনিও এ রকম কোনো সন্তান নিলেন না কেন?
ভ্রূণ: ইং আন্টি, মাম্মার ধারণা, আপনি খুবই স্বার্থপর।
মা: ও কথা বলতে হয় না, বাবু সোনা।
ড. ইং: না, তোমার সন্তান ঠিকই বলেছে। তোমার এ কথা ভাবা ঠিকই আছে। আসলেই স্বার্থপর আমি। শুরুতে উত্তরাধিকার স্মৃতির একটা সন্তান নিতে চেয়েছিলাম আমি নিজেই। কিন্তু একটা কারণে পিছিয়ে আসি। আসলে মানুষের উত্তরাধিকার স্মৃতির সুপ্ত প্রকৃতি সম্পর্কে দ্বিধায় ছিলাম আমরা। এই স্মৃতির যদি কোনো কাজই না থাকে, তাহলে এটা থাকার অর্থ কী? আরও কিছু গবেষণায় দেখা গেছে যে এটা অনেকটা অ্যাপেনডিক্সের মতো, শুধু নিদর্শনমাত্র। আধুনিক মানুষের দূরবর্তী পূর্বপুরুষদের হয়তো উত্তরাধিকার স্মৃতি সক্রিয় ছিল। তবে কালে কালে এই স্মৃতি সুপ্ত ও গোপন হতে থাকে। এতে গুরুত্বপূর্ণ কিছু সুবিধা থাকা সত্ত্বেও কেন এভাবে হারিয়ে গেল, তার ব্যাখ্যা আমাদের জানা নেই। তবে প্রকৃতিতে যেকোনো কিছুর পেছনে সব সময়ই কোনো না কোনো কারণ থাকে। এতে কোনো বিপদ নিশ্চয়ই ছিল, যার কারণে এই স্মৃতি সুপ্ত আর গোপন হয়ে গেছে।
মা: আপনাকে কোনো দোষ দেব না। কারণ, এই পরীক্ষায় স্বেচ্ছায় রাজি হয়েছি। আসলে দ্বিতীয়বার জন্ম নিতে চেয়েছিলাম আমি।
ড. ইং: কিন্তু তা আর হতে পারলে কই। এখন আমরা তো জানতে পারলাম, তুমি নিজেকে নয়, একটা শিশুকে পেটে ধরেছ, যার মাথায় তোমার সব স্মৃতি।
ভ্রূণ: আমিও একমত। আমি আসলে তুমি নই, মাম্মা। তবে আমার মাথার সব স্মৃতি তোমার কাছ থেকেই পেয়েছি। নিজের স্মৃতি বলতে, আমার চারপাশের পানি, তোমার হৃৎস্পন্দন আর বাইরে থেকে আসা লালচে কমলা রংয়ের আলোর দীপ্তি—এটুকুই।
ড. ইং: আমরা বড় একটা ভুল করে ফেলেছি। ভেবেছিলাম, স্মৃতির হুবহু প্রতিলিপি তৈরি করা মানেই কোনো ব্যক্তির প্রতিলিপি করা। কিন্তু স্মৃতির পাশাপাশি একটা মানুষের আরও অনেক কিছু থাকে, যেগুলোর আসলে কোনো প্রতিলিপি করা যায় না। কোনো মানুষের স্মৃতি আসলে একটা বইয়ের মতো। তা পড়ে বিভিন্ন পাঠক ভিন্ন ভিন্ন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়। এখনো জন্মই হয়নি, এমন শিশুকে এই ভারী আর বিষণ্ন কোনো বই পড়তে দেওয়া আসলে ভয়াবহ ব্যাপার।
মা: ঠিকই বলেছেন। এই শহর আমার খুব পছন্দের। কিন্তু এই শহর নিয়ে আমার পুরোনো স্মৃতি আমার বাচ্চাটাকে ভয় পাইয়ে দিচ্ছে।
ভ্রূণ: এই শহর খুবই ভয়ংকর। বাইরের সবকিছুই ভীতিকর, মাম্মা। আমি জন্ম নিতে চাই না।
মা: এ কথা কীভাবে বলতে পারলে, সোনা? তোমাকে জন্ম নিতেই হবে, বাবা।
ভ্রূণ: না, মাম্মা। জিটাও গ্রামের সেই শীতের সকালের কথা তোমার মনে আছে? তখন নানিমা আর নানু তোমাকে কী বলত?
মা: অবশ্যই মনে আছে। সূর্য ওঠার আগেই ঘুম থেকে উঠতে বলত মা–বাবা, যাতে ভেড়ার খোঁয়াড় পরিষ্কার করতে পারি। কিন্তু ঘুম থেকে মোটেও উঠতে চাইতাম না আমি। বাইরে তখনো অন্ধকার হয়ে থাকত। আর বাইরের বাতাস গায়ে ছুরির মতো বিঁধত। মাঝেমধ্যে তুষারও ঝরত। বিছানায় বেশ উষ্ণ থাকতাম, কম্বল দিয়ে নিজেকে জড়িয়ে পাখির বাসায় ডিমের মতো শুয়ে থাকতাম। আমার সব সময়ই মনে হতো, আরেকটু ঘুমাই।
ভ্রূণ: আরেকটু নয়। কম্বল জড়িয়ে তুমি চিরদিনের মতো ওভাবেই ঘুমিয়ে থাকতে চাইতে।
মা: (একটু থেমে) হ্যাঁ, ঠিক বলেছ।
ভ্রূণ: আমি বাইরে বের হব না। কক্ষনো না।
ড. ইং: বাবা, আমি নিশ্চয়তা দিচ্ছি, বাইরের পৃথিবী মানেই শুধু শীতরাত্রির ঝড় নয়। এখানে আলোকিত দিনও আছে, বসন্তের মিষ্টি মৃদু বাতাসও থাকে। জীবন সহজ নয়, তবে তাতে আনন্দ থাকে, সুখও থাকে।
মা: ড. ইং ঠিকই বলেছেন। তোমার মাম্মার ভাঁড়ারে অনেক সুখের স্মৃতিও আছে। যেমন যে দিনটি আমি বাড়ি থেকে চলে এসেছিলাম, সেদিনটির কথা স্মরণ করো। জিটাও যখন হেঁটে যাচ্ছিলাম, তখন সূর্য কেবল উঠেছে। মৃদু শীতল বাতাস আমার মুখে লেপ্টে যাচ্ছিল। আমার কান ভরে যাচ্ছিল পাখিদের গুঞ্জনে। খাঁচা ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়া একটা পাখির মতোই অনুভূতি হচ্ছিল আমার। শহরে এসে উপার্জন করেছিলাম সেবারই প্রথম। এরপর সুপারমার্কেটে হেঁটে গিয়েছিলাম। পরম সুখে মন ভরে উঠেছিল। কারণ আমার চারিদিকে তখন অফুরন্ত সম্ভাবনা। তুমি কি আমার সেই সুখ অনুভব করতে পারবে, বাবা?
ভ্রূণ: দুই সময়ের স্মৃতিই আমার খুব স্পষ্টভাবে মনে আছে। কিন্তু দুটোই খুবই ভয়ংকর স্মৃতি। তুমি যেদিন গ্রাম ছেড়ে চলে এলে, সেদিন সবচেয়ে কাছের শহর থেকে বাস ধরার জন্য তোমাকে পাহাড়ের ভেতর দিয়ে ত্রিশ কিলোমিটার হাঁটতে হয়েছিল। রাস্তাটা খুবই বাজে ছিল। সেদিন তোমার পকেটে মাত্র ষাট ইউন ছিল। সব টাকা শেষ হয়ে গেলে তুমি কী করতে? বাইরের পৃথিবীতে তুমি কি খুঁজে পাবে, তা কেউই জানত না। আর সুপারমার্কেট? সেটা তো আস্ত একটা পিঁপড়ের বাসা। হাজার হাজার মানুষের ভিড়ে একজন আরেকজনকে পিষে ফেলছে। অসংখ্য অচেনা মানুষ, খুবই ভয়ংকর...
ড. ইং: (দীর্ঘক্ষণ চুপ থেকে) এখন বুঝতে পারছি, মানুষের উত্তরাধিকার স্মৃতি প্রকৃতি কেন গোপন রেখেছে। কালে কালে আমাদের মন যতই সংবেদনশীল হয়েছে, ততই এ বিষয়ে অজ্ঞ হয়েছি আমরা। আমাদের জন্মটা একটা উষ্ণ কুঁড়েঘরের মতো, যা পৃথিবীর কঠিন বাস্তবতা থেকে আমাদের রক্ষা করে। আমরা তোমার সন্তানের বাসা থেকে বের করে নিরানন্দ জায়গায় নিক্ষেপ করব।
ভ্রূণ: ইং আন্টি, আমার পেটের সঙ্গে যুক্ত এই লাইন কিসের?
ড. ইং: আমার মনে হয়, তোমার মাকে প্রশ্নটা আগেই করেছিলে। ওটা তোমার নাভিরজ্জু। জন্মের আগে এর মাধ্যমে অক্সিজেন আর পুষ্টি পাও তুমি। ওটাই তোমার লাইফলাইন।
দুই বছর পরের বসন্তের এক সকাল।
ড. ইং এবং তরুণ মা এক কবরস্থানে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে। নিজের বাচ্চাকে হাত দিয়ে ধরে আছে মা।
‘ড. ইং, আপনি যা খুঁজছিলেন, তা কি পেয়েছেন?’
‘তুমি যার কথাই বোঝাও না কেন, স্মৃতির পাশাপাশি ওটাই মানুষকে স্বতন্ত্র করে তোলে,’ ধীরে ধীরে মাথা নাড়লেন ড. ইং। ‘এখনো পাইনি। বিজ্ঞান কখনো সেটা খুঁজে পাবে বলে আমার মনে হয় না।’
নতুন সূর্য তাদের চারপাশের সমাধি ফলকে প্রতিফলিত হচ্ছিল। হাজারো মানুষ, যারা এরই মধ্যে শেষ হয়ে গেছে, সূর্যের এই নরম কমলা আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠল যেন তারা।
‘বলো, সেই কাঙ্ক্ষিত সন্তান কোথায় থাকে, হৃদয়ে, নাকি মাথায়?’, বিড়বিড় করলেন ড. ইং।
‘কী বললেন?’ ড. ইংয়ের দিকে বিভ্রান্তভাবে তাকাল তরুণ মা।
‘শেক্সপিয়ার একবার এ রকম একটা কথা লিখেছিলেন।’ মায়ের দিকে হাত বাড়িয়ে বললেন ড. ইং। সেই হাতে বাচ্চাটা তুলে দিলেন মা।
যে বাচ্চাটার উত্তরাধিকার স্মৃতি জাগিয়ে তোলা হয়েছিল, এটা সেই বাচ্চা নয়। ল্যাবের এক টেকনিশিয়ানকে বিয়ে করেছিল সেই তরুণ মা। বাচ্চাটা তাদের।
মায়ের সব স্মৃতি পাওয়া সেই ভ্রূণ ওই কথাবার্তার কয়েক ঘণ্টা পর তার নাভিরজ্জু ছিড়ে ফেলেছিল। ঘটনা কী হয়েছে, সেটা উপস্থিত চিকিৎসক বোঝার আগেই বাচ্চাটা মারা যায়। কিন্তু ছোট্ট হাতে এ রকম একটা ঘটনা কীভাবে ঘটানো সম্ভব হলো, সে এক ধাঁধা বটে।
মানবজাতির ইতিহাসে সবচেয়ে ছোট আত্মহত্যাকারী এক মানুষের কবরের পাশে এখন দাঁড়িয়ে ওই দুই নারী।
ড. ইং হাতে ধরা বাচ্চাটার দিকে এমনভাবে নিরীক্ষা করলেন, যেন বৈজ্ঞানিক কোনো পরীক্ষার দিকে তাকিয়ে আছেন তিনি। কিন্তু বাচ্চাটার দৃষ্টি অন্য দিকে। তার ছোট্ট দুটি হাত তখন তুলোর মতো নরম পপলারের ফুল পাকড়াও করতে ব্যস্ত। তার কালো চোখে একই সঙ্গে বিস্ময় আর আনন্দ। তার কাছে পৃথিবী হলো ফুটন্ত এক ফুলের মতো, সুন্দর আর দানবীয় এক খেলনা। তার সামনের দীর্ঘ জীবন পথে চলার জন্য সে পুরোপুরি অপ্রস্তুত। সে কারণে সবকিছুর জন্য প্রস্তুত সে।
সমাধিফলকের মাঝখানের পথ ধরে হাঁটছিল দুই নারী। কবরস্থানের শেষ প্রান্তে তরুণ মা ড. ইংয়ের কোল থেকে তার সন্তান ফেরত নিল।
‘এবার যার যার পথে যাওয়ার সময় হয়েছে।’ সে বলল। কী এক উত্তেজনা আর ভালোবাসায় তার চোখ ঝিকমিক করছিল তখন।
চাইনিজ থেকে ইংরেজি কেন লিয়ু
ভাষান্তর: আবুল বাসার