মৌলের নাম ফার্মিয়াম

বিশ্বের প্রথম হাইড্রোজেন বোমা বিস্ফোরণ ঘটায় যুক্তরাষ্ট্র। এর সাংকেতিক নাম ছিল মাইক আইভি। ১৯৫২ সালের ১ নভেম্বর প্রশান্ত মহাসাগরের একটি ছোট্ট উপদ্বীপে অতি গোপনে এই থার্মোনিউক্লিয়ার বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। এতে তৈরি হয়েছিল বিশাল এক মাশরুম মেঘ বা মাশরুম ক্লাউড। পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য বিমান থেকে ওই মেঘ থেকে বিস্ফোরণের ধ্বংসাবশেষ সংগ্রহ করেছিল যুক্তরাষ্ট্রের বার্কলির ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি দল। সেগুলো বিশ্লেষণ করে পাওয়া গিয়েছিল দুটি নতুন মৌল। এর একটির পারমাণবিক সংখ্যা ৯৯ এবং আরেকটির পারমাণবিক সংখ্যা ১০০।

ইউরেনিয়াম-২৩৮ মৌলের নিউক্লিয়াস নিউট্রন কণা শোষণ করে মৌলগুলো গঠিত হয়েছিল। পরমাণুর নিউক্লিয়াসে নিউট্রন শোষণ সাধারণত ধীর প্রক্রিয়া। কিন্তু হাইড্রোজেন বোমার মতো ফিউশন প্রক্রিয়ায় ঘটা পারমাণবিক বিস্ফোরণে এ শোষণ ঘটে খুবই দ্রুতবেগে। হিসেবে দেখা গেছে, এ বিস্ফোরণে প্রতি বর্গ সেন্টিমিটারে প্রতি মাইক্রোসেকেন্ডে ১০২৯টি নিউট্রন নিঃসৃত হয়। তাই একটা ইউরেনিয়াম নিউক্লিয়াসের পক্ষে একবারে ১৫টি নিউট্রন শোষণ করা সম্ভব। এরপর শুরু হয় স্বতস্ফূর্ত বিটা ক্ষয় প্রক্রিয়া। এ প্রক্রিয়ায় ৮টি নিউট্রন ক্ষয় হয়ে পরিণত হয় ৮টি প্রোটনে। ফলে ইউরেনিয়াম নিউক্লিয়াসে প্রোটনের সংখ্যা ৯২ থেকে বেড়ে দাঁড়ায় ১০০টিতে। ফলে ইউরেনিয়াম রূপান্তরিত হয় নতুন মৌলে। 

এভাবে হাইড্রোজেন বোমার ধ্বংসাবশেষ থেকে দুটি নতুন মৌল পাওয়া গিয়েছিল। এদের একটির প্রোটন সংখ্যা ছিল ৯৯, যার নাম দেওয়া হল আইনস্টাইনিয়াম। আর ১০০ প্রোটন সংখ্যার মৌলটির নাম রাখা হয় ফার্মিয়ন। এর সংকেত Fm। ইতালিয়ান পদার্থবিজ্ঞানী এনরিকো ফার্মির সম্মানে এ নামকরণ করা হয়। ফার্মিকে বলা হয় নিউক্লিয়ার ফিজিকসের অগ্রদূত। কারণ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্রের ম্যানহাটন প্রকল্পের আওতায় প্রথম নিউক্লিয়ার ফিশন রিঅ্যাক্টর তৈরি করেন তিনি। এছাড়া পারমাণবিক পদার্থবিজ্ঞানে তাঁর আরও গুরুত্বপূর্ণ অবদান আছে। 

ফার্মিয়ন অতি তেজস্ক্রিয় মৌল। সে কারণে পৃথিবীর প্রায় সব ফার্মিয়ন অন্য কোনো মৌলে রূপান্তরিত হয়ে গেছে বলে ধারণা করা হয়।

মজার ব্যাপার হল, ফার্মিয়ন নাম স্বীকৃতি পাওয়ার আগে এর আরও কয়েকটি নাম প্রস্তাব করা হয়েছিল। এর মধ্যে রয়েছে ফনিসিয়া, সেন্টুরিয়াম, ইউক্লাসিয়াম, আরকোনিয়াম।

যাই হোক, এখন পর্যন্ত ফার্মিয়নের ১৯টি আইসোটপ সম্পর্কে জানা গেছে। এদের ভর সংখ্যা ২৪২ থেকে ২৬০। সবচেয়ে স্থিতিশীল আইসোটপ হল ফার্মিয়ন-২৫৭, যার অর্ধায়ু ১০০ দিন। ফার্মিয়নের অন্য আইসোটপগুলোর অর্ধায়ু মিলিসেকেন্ডেরও কম। যেমন ফার্মিয়ন-২৫৮-এর অর্ধায়ু মাত্র ০.৩৭ মিলিসেকেন্ড। এ কারণেই ২৫৭ পারমাণবিক ভর সংখ্যার চেয়ে বেশি ভরের মৌল নিউট্রন কণা ছুড়ে তৈরি করা কঠিন বা অসম্ভব। পরীক্ষায় দেখা গেছে, ফার্মিয়ন-২৫৭-এর সঙ্গে যদি একটা নিউট্রন যুক্ত করা হয়, তাহলে পাওয়া যাবে ফার্মিয়ন-২৫৮-এর নিউক্লিয়াস। এর স্থায়ীত্ব খুবই কম। তাই এর সঙ্গে আরেকটি নিউট্রন কণা যুক্ত করার আগেই সেটি ক্ষয় হয়ে অন্য মৌলে পরিণত হয়ে যায়।

ফার্মিয়ন অতি তেজস্ক্রিয় মৌল। সে কারণে পৃথিবীর প্রায় সব ফার্মিয়ন অন্য কোনো মৌলে রূপান্তরিত হয়ে গেছে বলে ধারণা করা হয়। মৌলটি শুধু পারমাণবিক চুল্লিতেই সংশ্লেষণ হওয়া সম্ভব। তবে সেখানেও এর উৎপাদনের পরিমাণ অতি অল্প। বছরে এক গ্রামের ১০ লাখ ভাগের এক ভাগ তৈরি হয় যুক্তরাষ্ট্রে। খালি চোখে দেখার জন্য যে পরিমাণ ফার্মিয়ন দরকার, তা এখনও তৈরি করা সম্ভব হয়নি। তবু এর কিছু ধর্ম নির্ধারণ করতে পেরেছেন বিজ্ঞানীরা। যেমন এর রং রূপালি। এটি বাষ্প, অক্সিজেন ও অ্যাসিডের সঙ্গে বিক্রিয়া করে। বৈজ্ঞানিক গবেষণার বাইরে এখন পর্যন্ত এর কোনো প্রয়োগের কথা শোনা যায়নি।

সূত্র: পল পারসনস অ্যান্ড গেইল ডিক্সন/ দ্য পিরিয়ডিক টেবল; ড্যান গ্রিন/ দ্য পিরিওডিক টেবল ইন মিনিটস; উইকিপিডিয়া