শব্দকাহন
নোবেলিয়াম নামটি যেভাবে পেলাম
নতুন কিছু আলাদাভাবে চিহ্নিত করাসহ নানা কারণেই নাম দিতে হয়। বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির ক্ষেত্রেও কথাটি সত্য। এসব নামের পেছনেও লুকিয়ে থাকে মজার ইতিহাস। চলুন, আজ জেনে নিই নোবেলিয়াম শব্দটি কীভাবে এল…
পর্যায় সারণির ১০২তম মৌলের নাম নোবেলিয়াম। একে বলা হয় ট্রান্সফার্মিয়াম মৌল। কারণ, পর্যায় সারণিতে এর অবস্থান ফার্মিয়ামের পরে। আবার এটি দশম ট্রান্সইউরেনিক মৌল (ইউরেনিয়ামের পরের মৌলগুলোকে বলা হয় ট্রান্সইউরেনিক মৌল)।
অন্যান্য ট্রান্সফার্মিয়ামের মতো নোবেলিয়াম কৃত্রিমভাবে তৈরি করা হয়েছিল পার্টিকেল অ্যাক্সিলারেটর বা সাইক্লোট্রনে। এই তেজস্ক্রিয় ও বিষাক্ত ধাতব মৌলটি খুব ক্ষণস্থায়ী ও অস্থিতিশীল। এখন পর্যন্ত এর ১২টি আইসোটপের কথা জানা গেছে। সবচেয়ে স্থিতিশীল আইসোটপ নোবেলিয়াম-২৫৯। এর অর্ধায়ু প্রায় এক ঘণ্টা। আর নোবেলিয়াম-২৫৫ আইসোটপের অর্ধায়ু মাত্র তিন মিনিট। এদের স্থায়ীত্ব এত অল্প হওয়ার কারণেই এ সম্পর্কে খুব বেশি পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো সম্ভব হয়নি। তাই রাসায়নিক ধর্ম জানা গেছে একেবারেই অল্প।
এ মৌলটির আবিষ্কারের কৃতিত্ব নিয়ে বেশ একটা বির্তকের জন্ম দিয়েছিল সুইডেন, যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়ার বিজ্ঞানীরা। সেটা ১৯৫৭ সালের কথা। সে বছর মৌলটি আবিষ্কারের প্রথম দাবি করে সুইডেনের নোবেল ইনস্টিটিউট। এর সঙ্গে জড়িত সুইডিশ বিজ্ঞানীরা জানান, কুরিয়াম লক্ষ্য করে কার্বন-১৩ আয়ন ছুড়ে মৌলটি তৈরি করা হয়েছে। স্বাভাবিকভাবে আবিষ্কারের কৃতিত্ব নিজেদের ঝুলিতে টেনে তারা এর নাম প্রস্তাব করল নোবেলিয়াম। সুইডিশ উদ্ভাবক ও নোবেল পুরস্কারের প্রতিষ্ঠাতা আলফ্রেড নোবেলের সম্মানে এ নাম প্রস্তাব করা হলো। এককালে ডায়নামাইট আবিষ্কারের জন্য সারা বিশ্বে পরিচিতি পেয়েছিলেন তিনি।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের হেভি আয়ন লিনিয়ার অ্যাক্সিলারেটরে কুরিয়াম নিউক্লিয়াসে কার্বন আয়ন দিয়ে আঘাত করে একদল মার্কিন বিজ্ঞানী। কিন্তু এতে সুইডেনের বিজ্ঞানীদের মতো একই ফলাফল পেতে ব্যর্থ হয় তারা। সে কারণে সুইডেনের বিজ্ঞানীরা আসলেই মৌলটি তৈরি করতে পেরেছেন কি না, তা নিয়ে শুরু হয় সন্দেহ।
নোবেলিয়ামের প্রতীক No। মৌলটি তৈরি করা যায় খুবই অল্প পরিমাণ। বৈজ্ঞানিক গবেষণা ছাড়া নোবেলিয়ামের আর কোনো ব্যবহার এখনও নেই।
১৯৫৮ ও ১৯৬০ সালের দিকে রাশিয়ার দুবনার জয়েন্ট ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার রিসার্চে এ মৌল তৈরিতে ধারাবাহিক সফলতা অর্জন করেন সোভিয়েত বিজ্ঞানীরা। এখানে প্লুটোনিয়াম-২৩৯ ও প্লুটোনিয়াম-২৪১ মৌলের নিউক্লিয়াস লক্ষ্য করে অক্সিজেন-১৬ আয়ন ছুড়ে মারা হয়। এভাবে পাওয়া গেল ১০২তম মৌলের পরমাণু। সামান্য কয়েকটি পরমাণু। এভাবে মৌলটির আবিষ্কারের কৃতিত্ব চলে গেল রুশদের ঝুলিতে। রুশ বিজ্ঞানীরা মৌলটির নাম প্রস্তাব করলেন মেরি কুরির নোবেলজয়ী কন্যা আইরিন জুলিও কুরির নামে—জুলিওটিয়াম।
কিন্তু মার্কিন বিজ্ঞানীরা তা মেনে নেবেন কেন! রুশ-মার্কিন শীতল যুদ্ধের ঘূর্ণিপাকে পড়ে এই আবিষ্কারে কেউ কারও কৃতিত্ব মানতে নারাজ। মজার ব্যাপার হলো, সারা বিশ্বের বিজ্ঞানীরাও বিভক্ত হয়ে গেলেন দুই শিবিরে। কয়েক দশক ধরে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে দুটি নামেই ডাকা হতে লাগল মৌলটিকে। একদল ডাকেন জুলিওটিয়াম, আরেকদল ডাকেন নোবেলিয়াম।
১৯৯০-এর দশকে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন অব পিওর অ্যান্ড অ্যাপ্লাইড কেমেস্ট্রির এক সভায় আলোচিত হলো ইস্যুটি। সেখানে দুই পক্ষের প্রবল বির্তক শুরু হলো। কেউ কাউকে ছাড় দিতে নারাজ। অনেক তর্ক-বিতর্কের পর শেষ পর্যন্ত স্বীকৃতি পেল নোবেলিয়াম নামটি। কিন্তু এর জন্য সুইডিশ ও মার্কিন বিজ্ঞানীদের প্রস্তাবিত নাম বেছে নেওয়া হলেও মৌলটি আবিষ্কারের কৃতিত্ব পেলেন রুশ বিজ্ঞানীরা। এভাবেই পর্যায় সারণির ১০২তম মৌলের নাম দাঁড়াল নোবেলিয়াম।
নোবেলিয়ামের প্রতীক No। মৌলটি তৈরি করা যায় খুবই অল্প পরিমাণ। বৈজ্ঞানিক গবেষণা ছাড়া নোবেলিয়ামের আর কোনো ব্যবহার এখনও নেই।
