টাইটান: ধোঁয়ায় মোড়া এক অদ্ভুত জগৎ
টাইটান শনি গ্রহের সবচেয়ে বড় উপগ্রহ। টাইটান আসলে গ্রিক উপকথার এক নায়ক। তাঁর নামেই এ উপগ্রহের নাম। ১৬৫৫ সালে ডাচ জ্যোতির্বিজ্ঞানী ক্রিশ্চিয়ান হাইগেনস এটি আবিস্কার করেন৷ সৌরজগতে ১৫০টির মতো উপগ্রহ আছে। প্রশ্ন হলো, টাইটানকে তাহলে আলাদা করে এত গুরুত্ব দেওয়ার কী আছে?
গুরুত্ব দেওয়ার কারণ, টাইটান একমাত্র উপগ্রহ, যেটা অনেকটা পৃথিবীর মতো। বলা যায়, পৃথিবীর ছোট ভাই। পৃথিবীর পর সৌরজগতে একমাত্র টাইটানেই আছে তরল উপাদান। তরল মানে কিন্তু পানি নয়, মিথেন। তাছাড়া টাইটানে পৃথিবীর মতো পাহাড়, পর্বত, নদী, হ্রদ, সমুদ্র রয়েছে।
টাইটানের বায়ুমণ্ডল অনেক ঘন। বায়ুমণ্ডলের ৯৭% হলো নাইট্রোজেন। অর্থাৎ পৃথিবীর পর টাইটানের বায়ুমণ্ডলই কেবল এত বেশি নাইট্রোজেন দিয়ে গঠিত।
টাইটান শনিকে ঘিরে একবার ঘুরে আসে ১৫ দিন ২২ ঘন্টায়। সূর্যের আলো অবশ্য খুব সামান্যই পায়। এর তাপমাত্রা ৯৪ কেলভিন বা -১৭৯.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তবে টাইটানের মজাটা হচ্ছে এর পৃষ্ঠ বা সারফেস। টাইটানের পৃষ্ঠে আছে মিথেনের সমুদ্র। এমনকী টাইটানে মিথেনের হ্রদ, নদীও আছে! এখানে পৃথিবীর পানি চক্রের মতো রয়েছে মিথেন চক্র। মানে, এখানে মিথেনের বৃষ্টি নামে। ভাবতে পারছেন? আপনি বৃষ্টিতে ভেজেন আর হ্রদে সাঁতার কাটেন, সবই মিথেনের। এখানে যে শুধু মিথেন রয়েছে, তা নয়। প্রোপেন, বিউটেন, হাইড্রোজেনসহ আরো অনেক হাইড্রোকার্বনও আছে। এই হাইড্রোকার্বনগুলো পৃথিবীর পর আর কোথাও এভাবে একসঙ্গে পাওয়া যায়নি। এই হাইড্রোকার্বনগুলো থাকে সাধারণত আন্তঃনাক্ষত্রিক গ্যাসের মধ্যে। ২০০৩ সালে বেনজিন আবিস্কৃত হয়, আর অতিসম্প্রতি ২০২০ সালে আবিস্কৃত হয় সাইক্লোপ্রোপিনিলিডিন। প্রাণের জন্য এগুলো অত্যন্ত
টাইটানের পৃষ্ঠ বড় অদ্ভুত। এখানে রয়েছে পৃথিবীর মতো পাহাড়। যেগুলোর উচ্চতা ১ থেকে ১.৫ কিলোমিটার পর্যন্ত হতে পারে। পাহাড়গুলো আবার বরফে আবৃত। তার ওপর টাইটানে পৃথিবীর মতো টেকটনিক একটিভিটিও দেখা যায়। এখানে অদ্ভুত এক ধরনের আগ্নেয়গিরি দেখা যায়, যার নাম ক্রায়োভলকানো। অদ্ভুত বলার কারণ, এ থেকে যে লাভা নিঃসৃত হয় তা রয়েছে জমাট অক্সিজেন আর অ্যামোনিয়া।
আগেই বলা হয়েছে, টাইটানে আছে মিথেনের সমুদ্র। লাইজিয়া মেয়ার টাইটানের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমুদ্র। টাইটানের বায়ুমণ্ডল জুড়ে মিথেন থাকার ফলে চলে গ্রিনহাউজ প্রক্রিয়া। তাই এর তাপমাত্রা আর নামতে পারে না।
প্রশ্ন হলো, পৃথিবীর মতো এত কিছু আছে, তাহলে কি পৃথিবীর মতো প্রাণও থাকতে পারে? টাইটানে প্রাণ থকার সম্ভাবনা অনেক বেশি। কারণ এর পরিবেশ অনেকটা পৃথিবীর মতো। প্রয়োজনীয় বায়ুমণ্ডল আর আবহাওয়াও বিদ্যমান। আর প্রাণ সৃষ্টির জন্য প্রয়োজনীয় হাইড্রোকার্বনও রয়েছে। তাছাড়া টাইটানে আছে আমোনিয়া, যা প্রাণ সৃষ্টির অনন্য উপাদান। পৃথিবীর জীবন কার্বননির্ভর, তবে এর কেন্দ্রীয় উপাদান পানি। টাইটানে এর বদলে আছে মিথেন। তার মানে, এখানে মিথেনকেন্দ্রীক জীবন গড়ে ওঠা অসম্ভব নয়।
টাইটান সম্পর্কে জানা খুব সহজ নয়। কারণ, এর বায়ুমণ্ডল এত ঘন যে, এ সম্পর্কে পৃথিবী থেকে তেমন কিছু জানা যায় না। এ কারণে ভয়েজার-১ কে পাঠানোর সময় এর যাত্রাপথ নির্ধারণ করা হয় টাইটানের পাশ ঘেঁষে৷ তাছাড়া ২০০৪ সালে শনিগ্রহের জন্য যে ক্যাসিনি অভিযান পরিচালনা করা হয়, তাতে হাইগেনস নামে একটা প্রোব ছিল। সেটাই টাইটানের পৃষ্ঠের কাছে যাওয়া একমাত্র মানবনির্মিত যান। টাইটানের পৃষ্ঠে যে পাহাড়, নদী আর হ্রদ আছে, এসব নিয়ে অনেকটাই জানা গেছে এই হাইগেনস প্রোবের হাত ধরে। তাছাড়া ক্যাসিনি তার অনেকদিনের পর্যবেক্ষণে আরও অনেক তথ্য বের করেছে। তবে টাইটানের গুরুত্ব বিবেচনা করে ভবিষ্যতে ড্রাগনফ্লাই নামে একটি মিশন পাঠানোর পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এটি যাত্রা করবে ২০২৭ সালে। পৌঁছাবে আনুমানিক ২০৩৪ সালে৷ অভিযানটির পরিকল্পনা করাই হচ্ছে টাইটানের কথা মাথায় রেখে। এটা থেকে এ ব্যাপারে আরও তথ্য পাওয়া যাবে।
টাইটানকে বিজ্ঞানীরা আদিম পৃথিবীর সঙ্গে তুলনা করছেন। কারণ, পৃথিবীর জন্মের সময়কার অবস্থা অনেকটা এমনই ছিল। তাই টাইটানকে বুঝতে পারলে আদিম পৃথিবীর অবস্থা আরও ভালোভাবে বোঝা যাবে।
লেখক : শিক্ষার্থী, প্রথম বর্ষ, সিরাজগঞ্জ সরকারী কলেজ
সূত্র : উইকিপিডিয়া, নাসা