যে চাঁদের কলঙ্ক নেই!

শনি গ্রহকে বলা হয়ে থাকে সৌরজগতের অঘোষিত মাসকট। সৌরজগৎ কল্পনা করতে গেলে বিচিত্র বলয় দ্বারা বেষ্টিত শনির কথাই সবার আগে মাথায় আসে। শনির ৬৩টা চাঁদ আছে! ভাবা যায়! একটা চাঁদ পেয়েই যেখানে আমাদের কবি-সাহিত্যিকেরা পাগল হয়ে যাচ্ছেন, সেখানে ৬৩টা চাঁদ থাকলে পৃথিবীর সব মানুষেরই হয়তো একটা করে কবিতার বই প্রকাশিত হতো! শনি গ্রহ বসবাসের উপযুক্ত নয়, কোনো দিন মানুষ সেখানে যাবে, বসতি গড়ে তুলবে আর কবিতার বই লিখবে, তা আশাও করা যায় না। তবে শনিতে বসে কবি-সাহিত্যিকদের কবিতা লেখার সুযোগ না হলেও শনির এই ৬৩টা চাঁদের মধ্যে একটি চাঁদ আছে, যাতে প্রাণের বিকাশ অসম্ভব নয়। কোনো একদিন হয়তো পৃথিবীরই কোনো এক কবি গ্রীষ্মের ছুটিতে সেই চাঁদে বেড়াতে যাবে আর কঠিন কঠিন শব্দে কবিতা লিখবে (সেখানে পৌঁছাতে পৌঁছাতে যে কত গ্রীষ্ম আসবে-যাবে, সেটা না হয় আলোচনার বাইরে থাকুক!) তার আগে বরং আমরা শনির বৃহত্তম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই চাঁদ ‘টাইটান’ বসবাসের জন্য আদৌ উপযুক্ত হবে কি না, সে গল্প শুনি।

১৬১০ সালে গ্যালিলিও বৃহস্পতির বৃহত্তম চারটা উপগ্রহ আবিষ্কার করেন। এগুলো গ্যালিলিয়ান মুন হিসেবে পরিচিত। গ্যালিলিওর গ্যালিলিয়ান মুন আবিষ্কারের আরও ১৮ বছর পর জন্ম ডাচ বিজ্ঞানী ক্রিস্টিয়ান হাইগেন্সের। গ্যালিলিয়ান মুন হাইগেন্সকে আগ্রহী করে তোলে। নিজের ভেতরে যেন শুনতে পান অনন্ত অসীম মহাবিশ্বের ডাক। খালি চোখে তো আর বেশি দূর দেখা সম্ভব নয়, তাই ভাইকে সঙ্গে নিয়ে টেলিস্কোপ তৈরি করা শুরু করেন। মহাবিশ্ব যাকে ডাক দিয়েছে, তাকে আটকায় কার সাধ্য! নিজের তৈরি টেলিস্কোপে ১৬৫৫ সালে শনিকে কেন্দ্র করে ঘুরতে থাকা একটি চাঁদ আবিষ্কার করেন। পৃথিবীর একটি চাঁদ আর চারটি গ্যালিলিয়ানের পর এটি ছিল মানব আবিষ্কৃত ষষ্ঠ চাঁদ। ১৬৫৫ প্রকাশিত আ নিউ অবজাভেশন অব স্যাটার্ন বইয়ে তিনি এর নাম দেন Saturni Luna VI—অর্থ শনির চাঁদ।

পরবর্তী সময়ে জন হার্সেল এর নাম দেন ‘টাইটান’। টাইটান উপগ্রহ হিসেবে বেশ আকর্ষণীয়। সাধারণ মানুষ হয়তো টাইটান নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামায় না, তবে বিজ্ঞানীদের কাছে কিন্তু এর গুরুত্ব অনেক। প্রশ্ন হচ্ছে, কেন এই গুরুত্ব? এর কারণ টাইটান হচ্ছে এখন পর্যন্ত পৃথিবীর বাইরে আবিষ্কৃত একমাত্র স্থান, যেখানে রয়েছে পৃথিবীর মতো পুরু নাইট্রোজেন গ্যাসের বায়ুমণ্ডল (টাইটানের বায়ুমণ্ডলের ৯৫ শতাংশ নাইট্রোজেন এবং ৫ শতাংশ মিথেন)। এখানেই শেষ নয়, টাইটানের পৃষ্ঠেও রয়েছে সাগর। টাইটানের সাগরগুলো মূলত তরল হাইড্রোকার্বনের। আবার টাইটানেও বৃষ্টি হয়! বজ্রপাত ঘটে ভয়ংকর শব্দে! তবে সে বৃষ্টি পানির নয়, মিথেনের। আমাদের যেমন আছে পানি চক্র, ঠিক তেমনি টাইটানে আছে মিথেন চক্র। তাহলে প্রাণের বিকাশ অসম্ভব নয় কেন বলছি? যেখানে পানিই নেই, সেখানে আবার প্রাণের বিকাশের প্রশ্ন উঠছে কেন? কারণ, প্রাণের প্রথম শর্ত হচ্ছে জৈব যৌগ। আর তা বেশ ভালো পরিমাণেই আছে টাইটানে! টাইটানের সঙ্গে পৃথিবীর একটা বড় পার্থক্য হচ্ছে, পৃথিবী টাইটানের তুলনায় সূর্যের বেশ কাছে। সূর্য থেকে আসা তাপ পৃথিবীকে গরম রাখে, যা বসবাসের জন্য আবশ্যক। অন্যদিকে টাইটান সূর্য থেকে বেশ দূরে। তবে টাইটানের মিথেন গ্রিন হাউস গ্যাস হিসেবে কাজ করে। ভবিষ্যৎ এ টাইটান বসবাসের যোগ্য হলেও হতে পারে। সূর্যের তাপমাত্রা যদি বেড়ে যায় এবং আমাদের সূর্য যদি একটা রেড জায়েন্টে পরিণত হয়, তাহলেই টাইটান পৃষ্ঠের তাপমাত্রা যথেষ্ট বেড়ে বসবাসের উপযুক্ত হবে। তবে সেটি ঘটতে অপেক্ষা করতে হবে আরও ৬ বিলিয়ন বছর। তখন হয়তো প্রাণের বিকাশও ঘটতে পারে। তাহলেও মনে হয় না বিশেষ কিছু আসে-যায়। প্রযুক্তির মহা উন্নতির কারণে তত দিনে মানবজাতি হয়তো অন্য এক উচ্চতায় পৌঁছে যাবে।

লেখক: শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ল্যাবরেটরি স্কুল অ্যান্ড কলেজ

*লেখাটি ২০১৭ সালে বিজ্ঞানচিন্তার ডিসেম্বর সংখ্যায় প্রকাশিত