নক্ষত্রের পায়ের ছাপ

১৮৪৫ সালের ঘটনা। নেদারল্যান্ডসের রাজধানী আমস্টারডাম থেকে মাত্র ৪৫ কিলোমিটার দূরের ছোট্ট শহর উট্রেচ। একদিন সকালে সেই শহরে দারুণ একটা পরীক্ষার আয়োজন করলেন উট্রেচ বিশ্ববিদ্যালয়ের খনিজবিদ্যা ও ভূতত্ত্ব বিভাগের লেকচারার ক্রিস্টোফ বাই-ব্যালে। বেশ কয়েকজন ট্রাম্পেট–বাদককে একত্র করলেন শহরটির রেলস্টেশনে। প্রথমেই বাদকদের দুটি আলাদা দলে ভাগ করে নেওয়া হলো। ট্রাম্পেটসহ এক দলকে বসিয়ে দেওয়া হলো স্টেশনে, আরেক দলের জন্য ব্যবস্থা করা হলো ছাদখোলা ক্যারিজ। রেলের এই বগিতে বসিয়ে দেওয়া হলো দ্বিতীয় দলের বাদকদের। কিন্তু এত সব আয়োজনের কারণ কী?

আসলে বিজ্ঞানীদের কাজকারবার এমনই। কোনো বিজ্ঞানী অনেক খেটেখুটে হয়তো একটা তত্ত্ব খাড়া করলেন, কিন্তু সেটা দেখতে বা শুনতে যত সুন্দর তত্ত্বই হোক না কেন, তা এমনি এমনি মেনে নেন না অন্য বিজ্ঞানীরা। তত্ত্বটাকে এ প্লাস পেয়ে পাস করতে হয়। বছর তিনেক আগে খাড়া করা এ রকমই একটা তত্ত্বকে সেদিন চ্যালেঞ্জ জানাতে চাচ্ছিলেন বাই-ব্যালে। তত্ত্বটা ছিল শব্দতরঙ্গ সম্পর্কে। সেটা দিয়েছিলেন অস্ট্রিয়ান বিজ্ঞানী ক্রিস্টিয়ান ডপলার। ১৮৪২ সালে ডপলার বললেন, কোনো তরঙ্গের কম্পাঙ্ক তরঙ্গটির উৎস ও পর্যবেক্ষকের আপেক্ষিক গতির ওপর নির্ভরশীল। মোদ্দা কথায়, কোনো তরঙ্গের উৎস যদি পর্যবেক্ষকের বিপরীত দিকে এগিয়ে যায়, তখন তার তরঙ্গদৈর্ঘ্য বেড়ে যাবে এবং পর্যবেক্ষকের দিকে এগিয়ে গেলে তরঙ্গদৈর্ঘ্য কমে যাবে। এই হাইপোথিসিস ব্যবহার করে বাইনারি স্টারের রঙের ব্যাখ্যা করলেন ডপলার।

তবে তাঁর হাইপোথিসিসটা সঠিক বলে মেনে নিতে পারলেন না কোনো কোনো বিজ্ঞানী। তাঁদেরই একজন ডাচ বিজ্ঞানী ক্রিস্টোফ বাই-ব্যালে। শব্দতরঙ্গের জন্য এই হাইপোথিসিস পরীক্ষা করে দেখতে চাইলেন তিনি। এর মাধ্যমে আসলে হাইপোথিসিসটা ভুল প্রমাণ করতে চাইছিলেন। সে জন্যই ট্রাম্পেট–বাদকদের ডেকে এনে সেদিনের এই মহা আয়োজন।

নির্ধারিত সময়ে দুই বাদক দলকে নিজ নিজ জায়গায় স্থির রেখে ট্রাম্পেটে একই নোট বাজানোর নির্দেশ দেওয়া হলো। কান পেতে সেগুলো শুনলেন অনেকেই। অভিজ্ঞ কানে দুটি বাজনা একই বলে মনে হলো। এরপর ক্যারিজটাকে স্টেশনের দিকে এগিয়ে আনতে আনতে আবারও বাজানোর নির্দেশ দেওয়া হলো। দেখা গেল, বগিটা যতই কাছে এগিয়ে আসছে, ততই যেন বাজনার নোটটা উচ্চ স্বরের হচ্ছে। বগির গতি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই বাজনা আরও উচ্চ স্বরের বলে মনে হতে লাগল। এরপর বগিটা দূরে সরে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাজনাটা গভীর ও নিস্তেজ হতে লাগল। বাজনার এই ওঠানামা আসলে শব্দতরঙ্গের তরঙ্গদৈর্ঘ্যের সঙ্গে সম্পর্কিত। এভাবে বাই-ব্যালের চক্ষু-কর্ণের বিবাদ ঘুচল। দেখা গেল, ডপলারের কথাই ঠিক। সেদিন ডপলারের ধারণাটা মিথ্যা প্রমাণ করতে গিয়ে উল্টো তা সঠিক বলে প্রমাণ করলেন ব্যালে।

আমরা এখন জানি, অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেনেও এই ডপলার ইফেক্ট দেখা যায়। কোনো অ্যাম্বুলেন্স আমাদের দিকে এগিয়ে আসতে থাকলে তার স্বরগ্রাম উচ্চ বা তীক্ষ্ণ বলে মনে হয়। কারণ, তখন তার তরঙ্গদৈর্ঘ্য কমে যায়। আর অ্যাম্বুলেন্স দূরে সরে যাওয়ার সময় তার স্বরগ্রাম নিচু বলে মনে হতে থাকে। কারণ, তরঙ্গদৈর্ঘ্য তখন বেড়ে যায়।

ডপলার ইফেক্ট আসলে সব তরঙ্গের জন্যই সত্য। তাই শব্দের মতো আলোকতরঙ্গেও ডপলার শিফট দেখা যায়। বর্তমানে এই পদ্ধতি ব্যবহার করে হাইওয়ে দিয়ে চলা কোনো গাড়ির গতি মাপে পুলিশ। এ পদ্ধতিতে একটা যন্ত্র দিয়ে গাড়ির ওপর লেজার রশ্মির ঝলক ফেলা হয়, প্রতিফলিত হয়ে সেটি পুলিশের গাড়িতে আবারও ফিরে আসে। এই লেজার রশ্মির ফ্রিকোয়েন্সি বা কম্পাঙ্কের শিফট বা বিচ্যুতি মেপে ওই গাড়ির গতি মাপে পুলিশ।

তবে আমাদের চোখে আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য ও রঙের এই পরিবর্তন ধরা পড়ে না। দৈনন্দিন জীবনে আলোর সঙ্গে সম্পর্কিত কোনো ডপলার ইফেক্ট আমরা দেখতে পাই না। কারণ, আমাদের সবচেয়ে দ্রুতগতির কোনো যানবাহনও আলোর গতির তুলনায় অনেক অনেক ধীরগতির। কিন্তু আলোর এই বিচ্যুতি যে পরিমাপ করা সম্ভব, তা আগেই ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন বিজ্ঞানী ডপলার। অবশ্য সে জন্য যথেষ্ট সংবেদনশীল যন্ত্রপাতির প্রয়োজন বলে অনুমান করেন তিনি।

তাই এই বিশেষ যন্ত্রের সাহায্যে পৃথিবীতে বসেই সূর্যসহ দূর নক্ষত্রের কোনটিতে কী কী মৌল আছে, তা সঠিকভাবে নির্ণয় করতে পারলেন জ্যোতির্বিদেরা। উইলিয়াম হাগিনসও একে মরূদ্যানে ঝরনার সঙ্গে তুলনা করেছেন।

আলোকতরঙ্গ নিয়ে ডপলারের সেই ভবিষ্যদ্বাণী অক্ষরে অক্ষরে সত্য বলে প্রমাণিত হলো মাত্র দুই দশকের মধ্যেই। ডপলারের এই পদার্থবিজ্ঞানের সঙ্গে একটু পর্যবেক্ষণ ব্যবহার করে জ্যোতির্বিজ্ঞানের ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দেন যে ব্যক্তি, তিনি হলেন উইলিয়াম হাগিনস। তাঁর জন্ম ১৮৪২ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি, ইংল্যান্ডের মিডলসেক্সের কর্নহিলে। তাঁর বাবা ছিলেন বস্ত্র ব্যবসায়ী। বাবা চাইতেন, ছেলে বড় হয়ে পারিবারিক ব্যবসার হাল ধরুক। কিন্তু তরুণ হাগিনসের আগ্রহ জ্যোতির্বিজ্ঞানে। একসময় বাবার চাপের কাছে নতি স্বীকার করে তাঁদের পারিবারিক কাপড়ের দোকানে বসতে বাধ্য হন তিনি। কিছুদিন পর ব্যবসাটা বিক্রি করে দিয়ে জ্যোতির্বিজ্ঞানী হওয়ার স্বপ্ন পূরণ করতে মাঠে নামেন।

ঘটনার শুরু ১৮৬৮ সালের দিকে। তখন সবে স্পেকট্রোস্কোপ যন্ত্রটাকে বেশ খানিকটা উন্নত করেছেন জার্মান বিজ্ঞানী রবার্ট বুনসেন ও গুস্তাভ কার্শফ। সেটা পেয়ে অনেক বিজ্ঞানী যেন হাতে চাঁদ পেলেন। কারণ, স্পেকট্রোস্কোপে নক্ষত্র থেকে আসা আলোর যে বর্ণালি পাওয়া যায়, তাকে এককথায় নক্ষত্রের হাতের ছাপ বলা যায়। কারণ, প্রতিটি মৌল বর্ণালিতে সুনির্দিষ্ট রেখার জন্ম দেয়। তাই এই বিশেষ যন্ত্রের সাহায্যে পৃথিবীতে বসেই সূর্যসহ দূর নক্ষত্রের কোনটিতে কী কী মৌল আছে, তা সঠিকভাবে নির্ণয় করতে পারলেন জ্যোতির্বিদেরা। উইলিয়াম হাগিনসও একে মরূদ্যানে ঝরনার সঙ্গে তুলনা করেছেন।

অন্য অনেক বিজ্ঞানীর মতো স্পেকট্রোস্কোপ ব্যবহার করে সূর্যসহ অন্যান্য নক্ষত্র পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করলেন হাগিনস। অন্যান্য নক্ষত্রেও অনুসন্ধান চালিয়ে শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্তে আসেন, মহাবিশ্বজুড়ে পৃথিবীর মতো মৌল রয়েছে। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত মহাকাশ পর্যবেক্ষণ করে গেছেন হাগিনস। সঙ্গী হিসেবে পেয়েছিলেন স্ত্রী মার্গারেট ও কেপলার নামের একটা কুকুরকে। তাঁর বয়স যখন ৮৪ বছর, তখন টেলিস্কোপ অ্যাডজাস্ট করাসহ অন্যান্য কাজে সহযোগিতা করতেন তাঁর ৬০ বছর বয়সী স্ত্রী মার্গারেট। এভাবে এই দম্পতি স্পেকস্ট্রোস্কোপির একেবারে নতুন একটা প্রয়োগ আবিষ্কার করে বসেন। সেটিই মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমাদের চিন্তাভাবনা আমূল বদলে দেয়। অন্য জ্যোতির্বিদেরা যখন স্পেকট্রোস্কোপ ব্যবহার করে বিভিন্ন নক্ষত্রের মৌলিক উপাদান খুঁজতে ব্যস্ত, তখন এই দম্পতি ভাবলেন, যন্ত্রটা দিয়ে কি নক্ষত্রের গতিবেগ মাপা সম্ভব?

মধ্যযুগের প্রভাবশালী বিজ্ঞানী গ্যালিলিওসহ তাঁর পূর্বসূরিদের ধারণা ছিল, নক্ষত্রগুলো হলো স্থির। তাঁর উত্তরসূরিরাও তাঁর কথাই মেনে নিয়েছিলেন। রাতের আকাশে সব কটি নক্ষত্র আপাতভাবে জায়গা বদল করলেও তার জন্য পৃথিবীর ঘূর্ণন দায়ী বলে মনে করতেন জ্যোতির্বিদেরা। তাঁরা মনে করতেন, নক্ষত্রগুলোর পরস্পরের আপেক্ষিক দূরত্ব একই থাকে। তবে বলার অপেক্ষা রাখে না, ধারণাটা ভুল। সেটা প্রথম উল্লেখ করেন জ্যোতির্বিদ এডমন্ড হ্যালি। হ্যালির ধূমকেতুর জন্য যিনি বিখ্যাত। পৃথিবীর ঘূর্ণন আমলে নিয়েও কয়েক শতক আগে জ্যোতির্বিদ টলেমির পরিমাপের চেয়ে সাইরাস, আর্কটুরাস ও প্রোসায়ন নক্ষত্রের আপাত অবস্থানে কিছু অসংগতি দেখতে পান হ্যালি। তিনি বুঝতে পারেন, এ অসংগতির কারণ পরিমাপের ত্রুটি নয়, বরং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এসব নক্ষত্রের অবস্থানের প্রকৃত পরিবর্তনের কারণেই হয়েছে।

নক্ষত্রটা আমাদের কাছ থেকে কত দ্রুত দূরে সরে যাচ্ছে কিংবা আমাদের দিকে কত দ্রুত ছুটে আসছে, তা এ পদ্ধতিতে মাপা সম্ভব নয়। একে বলে রেডিয়াল ভেলোসিটি।

অতি নিখুঁত পরিমাপক যন্ত্র ও অতি শক্তিশালী টেলিস্কোপ ব্যবহার করা হলে প্রতিটি নক্ষত্রের সঠিক গতি মাপা সম্ভব। কিন্তু বাস্তবতা হলো, নক্ষত্রগুলো সেগুলোর অবস্থান এতই ধীরে পরিবর্তন করে যে আধুনিক জ্যোতির্বিদদের পক্ষেও নক্ষত্রগুলোর সরে যাওয়ার পরিমাণ মাপা বেশ কঠিন। আসলে প্রকৃত গতি মাপার জন্য অনেক বছর ধরে কোনো নক্ষত্রকে খুব সতর্কভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হয়। সেটা বেশ শ্রমসাধ্য ও কঠিন কাজ। আবার প্রকৃত গতি মাপার আরেকটা সীমাবদ্ধতা হলো, কোনো নক্ষত্র যদি আকাশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যায়, তাহলেই সেটা মাপতে পারেন জ্যোতির্বিদেরা। নক্ষত্রটা আমাদের কাছ থেকে কত দ্রুত দূরে সরে যাচ্ছে কিংবা আমাদের দিকে কত দ্রুত ছুটে আসছে, তা এ পদ্ধতিতে মাপা সম্ভব নয়। একে বলে রেডিয়াল ভেলোসিটি।

তবে উইলিয়াম হাগিনস ভাবলেন, স্পেকট্রোস্কোপি প্রযুক্তির সঙ্গে ডপলার ইফেক্ট ব্যবহার করে নক্ষত্রের রেডিয়াল বেগ কি সঠিকভাবে মাপা সম্ভব? স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে সেই পরীক্ষাই দীর্ঘদিন ধরে চালিয়ে গেলেন। ডপলারের তত্ত্বমতে, কোনো বস্তু যখন তরঙ্গ নিঃসৃত করতে করতে পর্যবেক্ষকের দিকে এগিয়ে যায়, তখন পর্যবেক্ষক ওই তরঙ্গের তরঙ্গদৈর্ঘ্য কমে গেছে বলে অনুভব করেন। আবার উল্টো দিকে, কোনো বস্তু তরঙ্গ নিঃসৃত করতে করতে পর্যবেক্ষকের কাছ থেকে দূরে সরে গেলে, এই তরঙ্গের তরঙ্গদৈর্ঘ্য বেড়ে গেছে বলে মনে হয় পর্যবেক্ষকের। আবার বস্তুটি গতিশীল না হয়ে স্থির হলে এবং পর্যবেক্ষক যদি গতিশীল হন, তাহলেও একই কথা খাটবে। তাই আলোকতরঙ্গ নিঃসরণ করতে করতে কোনো বস্তু পর্যবেক্ষকের দিকে এগিয়ে যেতে থাকলে, পর্যবেক্ষকের চোখে ওই আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য কমে গেছে বলে মনে হবে। একে বলা হয় ব্লু শিফট। বাংলায় নীল বিচ্যুতি বা নীল সরণ। আর পর্যবেক্ষকের কাছ থেকে দূরে সরে যেতে থাকলে মনে হবে তরঙ্গদৈর্ঘ্য বেড়ে গেছে। একে বলা হয় রেড শিফট। বাংলায় লোহিত বিচ্যুতি বা লাল সরণ। কারণ, দৃশ্যমান বর্ণালিতে লাল হলো সবচেয়ে বড় তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো।

ধরা যাক, কোনো নক্ষত্র আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। তাহলে এর থেকে নিঃসৃত আলোকতরঙ্গ সংকুচিত হয়ে যাবে। অনেকটা অ্যার্কিডিয়ন বাদ্যযন্ত্রের মতো। ফলে স্পেকট্রোস্কোপিতে বিশ্লেষণ করলে বর্ণালিতে যে তরঙ্গদৈর্ঘ্য পাওয়া যাবে, তা আগের চেয়ে ক্ষুদ্রতর। অর্থাৎ দৃশ্যমান বর্ণালির নীল প্রান্তের দিকে সব তরঙ্গ সরে যাবে। তাই কোনো হলুদ নক্ষত্র সে কারণে নীলচে কিংবা হলুদের চেয়ে কম যেকোনো রঙের দেখা যাবে। কারণ, এর রং হলুদের চেয়ে ক্ষুদ্র তরঙ্গদৈর্ঘ্যের। একইভাবে, কোনো নক্ষত্র আমাদের কাছ থেকে দূরে সরে গেলে ঘটনা ঘটবে উল্টোটা। অর্থাৎ তখন তার আলোকতরঙ্গদৈর্ঘ্য প্রসারিত হবে। ফলে তা থেকে দীর্ঘ তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো পাওয়া যায়। তখন দৃশ্যমান বর্ণালির উল্টো দিকের লাল প্রান্তের দিকে সব তরঙ্গ সরে যেতে দেখা যাবে। তাই হলুদ নক্ষত্র থেকে পাওয়া যাবে কিছুটা লালচে আলো (সেটা কমলা বা লাল এ দুইয়ের যেকোনোটি হতে পারে)। সহজ কথায়, তরঙ্গদৈর্ঘ্যের বিচ্যুতি বা বিকৃতি যত বেশি হবে, নক্ষত্রের গতিবেগও হবে তত বেশি। কাজেই কোনো নক্ষত্রের আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্যের বিচ্যুতি (সরণ) জানতে পারলে ওই নক্ষত্রের দূরত্ব জানা সম্ভব। সেই সঙ্গে জানা যাবে, সেটি আমাদের কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে, নাকি কাছে এগিয়ে আসছে।

সাবেক বস্ত্র ব্যবসায়ী উইলিয়াম হাগিনস জ্যোতির্বিজ্ঞানের দিকে ঝুঁকেছিলেন শখের বশে। সেই তিনিই একদিন প্রমাণ করলেন, নক্ষত্রের গতিবেগ মাপা সম্ভব। কারণ, প্রতিটি নক্ষত্রে পৃথিবীর মতোই কিছু পরিচিত মৌল থাকে (যেমন হাইড্রোজেন বা সোডিয়াম), যেগুলোর সুনির্দিষ্ট ও আদর্শ তরঙ্গদৈর্ঘ্য রয়েছে।

কাজেই হাগিনস বুঝতে পারলেন, নক্ষত্র থেকে আসা আলোর বর্ণালি কোন প্রান্তে কতটুকু বিচ্যুত হয়েছে, তা মেপে ওই নক্ষত্রের গতিও মাপা সম্ভব। শুরুতেই সাইরাস নক্ষত্রের গতিবেগ মাপলেন তিনি। তার পরিমাপে দেখা গেল, সাইরাস থেকে আসা আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য ০.১৫ ভাগ বেড়ে গেছে। সেটা ডপলারের সমীকরণে বসিয়ে দেখা গেল, সাইরাস নক্ষত্রটি সেকেন্ডে ৪৫ কিলোমিটার বেগে আমাদের কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।

সাবেক বস্ত্র ব্যবসায়ী উইলিয়াম হাগিনস জ্যোতির্বিজ্ঞানের দিকে ঝুঁকেছিলেন শখের বশে। সেই তিনিই একদিন প্রমাণ করলেন, নক্ষত্রের গতিবেগ মাপা সম্ভব। কারণ, প্রতিটি নক্ষত্রে পৃথিবীর মতোই কিছু পরিচিত মৌল থাকে (যেমন হাইড্রোজেন বা সোডিয়াম), যেগুলোর সুনির্দিষ্ট ও আদর্শ তরঙ্গদৈর্ঘ্য রয়েছে। কিন্তু নক্ষত্রের গতিবেগের (রেডিয়াল ভেলোসিটি) কারণে এই তরঙ্গদৈর্ঘ্যের ডপলার বিচ্যুতি ঘটে। এই বিচ্যুতি মেপে ওই নক্ষত্রের গতিবেগ নির্ণয় করা সম্ভব। তার এই পরিমাপ পদ্ধতির সম্ভাবনা ব্যাপক। কারণ, যেকোনো দৃশ্যমান নক্ষত্র, নেবুলাকে স্পেকট্রোস্কোপি দিয়ে বিশ্লেষণ করা যায়। তাই একই যন্ত্র দিয়ে তাদের ডপলার বিচ্যুতি মেপে সেগুলোর গতিবেগও নির্ণয় করা জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের জন্য অনেক সহজ। আবার এ পদ্ধতিতে নক্ষত্রটির রেডিয়াল গতিবেগও মাপা সম্ভব। মানুষ বা অন্য জীবজন্তুর পায়ের ছাপ দূরত্ব মেপে যেমন তার গতিবেগ মাপা যায়, এ যেন অনেকটা তেমন। মানে নক্ষত্রের পায়ের ছাপের মেপে তার গতি মাপার মতো।

সেকালে ডপলার বিচ্যুতি মাপার কৌশল ব্যবহার করে নক্ষত্রের গতিবেগ মাপার পদ্ধতিটা সিংহভাগ মানুষের কাছেই ছিল একেবারেই অপরিচিত। কিন্তু সেটা বেশ কার্যকর ও বিশ্বাসযোগ্য। তাই বিশ শতকের শুরুর দিকে হাগিনস দম্পতির এই পদ্ধতি আরও গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে। আর সে সময় গড়ে ওঠা বড় বড় টেলিস্কোপে তা ব্যবহৃত হতে থাকে। যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনায় লয়েল অবজারভেটরিতে ছিল ২৪ ইঞ্চি প্রতিফলক টেলিস্কোপ। ১৯১২ সালে সেখানে কাজ করতে শুরু করেন মার্কিন জ্যোতির্বিদ ভেস্টো স্লিফার। ডপলার বিচ্যুতি ব্যবহার করে তিনিই প্রথম সফলভাবে একটা নেবুলা বা নীহারিকার গতিবেগ নির্ণয় করেন। এর এক দশক পর ক্যালিফোর্নিয়ার মাউন্ট উইলসন অবজারভেটরিতে ১০০ ইঞ্চি টেলিস্কোপ ব্যবহার করে আরও কিছু নেবুলার গতিবেগ নির্ণয় করেন সর্বকালের অন্যতম সেরা জ্যোতির্বিদ এডুইন হাবল। আর এর মাধ্যমেই মহাবিশ্বে সম্পর্কে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির খোলনলচে পাল্টে দেন। সেটা অবশ্য আরেক গল্প।

লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, বিজ্ঞানচিন্তা

সূত্র: বিগ ব্যাং/ সাইমন সিং

উইকিপিডিয়া