ইউক্লিডের প্রথম পাঠানো ছবিতে কী দেখা গেল

ইউরোপীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থার (ইসা) ডার্ক ইউনিভার্স সন্ধানী টেলিস্কোপ ইউক্লিড পুরোদমে কাজ শুরু করেছে। সম্প্রতি প্রকাশ পেয়েছে নভোদুরবিনটির প্রথম পাঠানো বেশ কিছু ছবি। এর মধ্যে যেমন নীহারিকার অসম্ভব সুন্দর ছবি আছে, তেমনি আছে দূরের নানা গ্যালাক্সি, গ্লোবুলার ক্লাস্টারের হাজারও তারা।

ইউক্লিড নভোদুরবিনছবি: উইকিপিডিয়া

সম্প্রতি ইউক্লিড স্পেস টেলিস্কোপের প্রথম ছবি প্রকাশিত হয়েছে। ইউরোপীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ইসার তৈরি এ নভোদুরবিন গত ১ জুলাই মহাকাশে পাঠানো হয়। উদ্দেশ্য, ডার্ক ইউনিভার্স, অর্থাৎ ডার্ক ম্যাটার ও ডার্ক এনার্জির গঠন ও বিবর্তন সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা। অর্থাৎ মহাকাশে ডার্ক ম্যাটার ও ডার্ক এনার্জির প্রমাণ খোঁজা হচ্ছে টেলিস্কোপটির সাহায্যে।

জ্যোতির্বিজ্ঞানে ডার্ক ইউনিভার্স এক বড় রহস্য। ডার্ক ম্যাটার মানে অজানা বা গুপ্তবস্তু। আর ডার্ক এনার্জি মানে গুপ্তশক্তি। এখানে ‘অজানা’ অর্থে ‘ডার্ক’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। অর্থাৎ মহাবিশ্বের বিপুল যে অংশটি আমরা কোনোভাবেই শনাক্ত করতে পারি না, সেটাই ডার্ক ম্যাটার ও ডার্ক এনার্জি।

বিপুল মানে কত বিপুল? বিজ্ঞানীরা মনে করেন, মহাবিশ্বের ৯৫ ভাগ জুড়ে রয়েছে এই ডার্ক ম্যাটার ও ডার্ক এনার্জি। বাকি ৫ ভাগ আমাদের দৃশ্যমান মহাবিশ্ব। গ্রহ, নক্ষত্র, গ্যালাক্সি, এমনকি আমাদের দেহ—সবই এই দৃশ্যমান মহাবিশ্বের অংশ। দৃশ্যমান মানে, খালি চোখে দেখা না। আমাদের সব ধরনের প্রযুক্তি—বিভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্য শনাক্তকারী টেলিস্কোপ, কণাত্বরক যন্ত্রসহ যা কিছু আছে, এই সব কিছু দিয়ে মহাবিশ্বের গাঠনিক উপাদানগুলোর মাত্র ৫ ভাগ শনাক্ত করেছেন বিজ্ঞানীরা। বাকি ৯৫ ভাগের ব্যাপারে বিজ্ঞানীরা শুধু জানেন, এগুলোর অস্তিত্ব আছে। তা ছাড়া এ সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা এখনও খুব বেশি কিছু জানেন না। বিভিন্ন সময় মহাকাশ পর্যবেক্ষণে মহাবিশ্বের প্রসারণ, মহাকর্ষীয় আকর্ষণ, গ্যালাক্সির বিন্যাসসহ নানা ভাবে এগুলোর অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া গেছে। ডার্ক ম্যাটার বা ডার্ক এনার্জি ছাড়া এসব ঘটনা ব্যাখ্যা করা যায় না। বিজ্ঞানীদের মতে, দৃশ্যমান ৫ ভাগ মহাবিশ্বের গঠন ও বিবর্তনের পেছনে ডার্ক ম্যাটার ও ডার্ক এনার্জির বড় ভূমিকা রয়েছে।

ইসার গবেষক ক্যারোল মানডেল এক বিবৃতিতে বলেন, ‘ডার্ক ম্যাটার গ্যালাক্সিগুলোকে একে অন্যের কাছে টানে। ফলে গ্যালাক্সিগুলো যে গতিতে ঘোরার কথা, ঘুরছে তার চেয়ে অনেক বেশি গতিতে। আর ডার্ক এনার্জি বাড়াচ্ছে মহাবিশ্বের প্রসারণের গতি।

ইউক্লিডের মাধ্যমে প্রথমবারের মতো জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা একসঙ্গে দুটি বিষয় নিয়ে গবেষণার সুযোগ পাবেন। ফলে মহাবিশ্বকে আরও ভালোভাবে বোঝা যাবে। আমরা এখন আধুনিক পদার্থবিদ্যার সবচেয়ে বড় রহস্যভেদ করতে প্রস্তুত। ইউক্লিডের প্রথম পাঠানো ছবিগুলো সে কথাই বলছে।’

নভোদুরবিনটি বর্তমানে পৃথিবী থেকে ১ কোটি ৫০ লাখ কিলোমিটার দূরে, পৃথিবী-সূর্যের ২য় ল্যাগ্রাঞ্জ পয়েন্টে অবস্থান করছে। জেমস ওয়েব নভোদুরবিন এবং গায়া মহাকাশ মানমন্দিরও অবস্থান করছে এখানে। মহাকাশে বিভিন্ন পর্যবেক্ষণ পরিচালনার জন্য ল্যাগ্রাঞ্জ পয়েন্টগুলো বেশ কাজের। ল্যাগ্রাঞ্জ পয়েন্ট নিয়ে বিস্তারিত জানতে এই লেখাটা পড়ুন

সব ঠিক থাকলে আগামী ৬ বছর সচল থাকবে ইউক্লিড। দৃশ্যমান আলো দেখার জন্য এতে রয়েছে ৬০০ মেগাপিক্সেলের ওয়াইড-অ্যাঙ্গেল ক্যামেরা। পাশাপাশি আরও আছে অবলাল আলো দেখার জন্য নিয়ার-ইনফ্রারেড বর্ণালিবীক্ষণ যন্ত্র, গ্যালাক্সির গতি বোঝার জন্য ফটোমিটার। এ নভোদুরবিন সার্বিকভাবে পরিচালনা করছে ইসা।

আরও পড়ুন
দ্য পারসাস গ্যালাক্সিপুঞ্জ
ছবি: ইসা

দ্য পারসাস গ্যালাক্সিপুঞ্জ

ইউক্লিড নভোদুরবিনের তোলা প্রথম প্রকাশিত ছবি এটি। পারপাস গ্যালাক্সিপুঞ্জের এক হাজার গ্যালাক্সি দেখা যাচ্ছে এতে। পৃথিবী থেকে প্রায় ২৪ কোটি আলোকবর্ষ দূরে গ্যালাক্সিপুঞ্জটির অবস্থান। ছবির ব্যাকগ্রাউন্ডে বহুদূরের আরও প্রায় ১ লাখ গ্যালাক্সি দেখা যাচ্ছে।

এই ছবির বেশির ভাগ গ্যালাক্সি এর আগে দেখা যায়নি কখনো। কিছু গ্যালাক্সি এত দূরে যে সেখান থেকে আলো আসতে সময় লাগে প্রায় ১ হাজার কোটি বছর। এই প্রথম কোনো ছবিতে এত পরিষ্কারভাবে পারসাস গ্যালাক্সিপুঞ্জ দেখা যাচ্ছে। এসব গ্যালাক্সির অবস্থান ও আকৃতি হিসাব করে বিজ্ঞানীরা ডার্ক ম্যাটারের ভূমিকা বোঝার চেষ্টা করবেন।

দ্য হিডেন স্পাইরাল গ্যালাক্সি আইসি ৩৪২
ছবি: ইসা

দ্য হিডেন স্পাইরাল গ্যালাক্সি আইসি ৩৪২

এটি সর্পিল আকারের গ্যালাক্সি আইসি ৩৪২। হিডেন গ্যালাক্সি বা কাডওয়েল ৫ নামেও পরিচিত এটি। পৃথিবী থেকে গ্যালাক্সিটির দূরত্ব প্রায় ১ কোটি ৮ লাখ আলোকবর্ষ। মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির নক্ষত্র, গ্যাস ও ধুলার পেছনে থাকার কারণে আইসি ৩৪২ গ্যালাক্সিটি সচরাচর দেখা যায় না। ইউক্লিডের নিয়ার-ইনফ্রারেড যন্ত্র ব্যবহার করে গ্যালাক্সিটির ছবি তোলা হয়েছে।

দ্য ইরেগুলার গ্যালাক্সি এনজিসি ৬৮২২
ছবি: ইসা

দ্য ইরেগুলার গ্যালাক্সি এনজিসি ৬৮২২

মহাবিশ্বের শুরতে মিল্কিওয়ের মতো সর্পিলাকার গ্যালাক্সি দেখা যেত না। কিন্তু এই ছবিতে এমন এক গ্যালাক্সি ধরা পড়েছে। বিষম আকৃতির এ গ্যালাক্সির নাম এনজিসি ৬৮২২। পৃথিবীর থেকে এর দূরত্ব প্রায় ১ কোটি ৬০ লাখ আলোকবর্ষ।

দ্য গ্লোবুলার ক্লাস্টার এনজিসি ৬৩৯৭
ছবি: ইসা

দ্য গ্লোবুলার ক্লাস্টার এনজিসি ৬৩৯৭

এ নভোদুরবিনের তোলা আরেকটি অবিশ্বাস্য ছবি। এতে গ্লোবুলার ক্লাস্টার—হাজারও নক্ষত্রের শক্তিশালী মহাকর্ষ মিলে তৈরি মহাকাঠামো নিখুঁতভাবে দেখা যাচ্ছে। ক্লাস্টারটির আরেক নাম এনজিসি ৬৩৯৭। পৃথিবী থেকে প্রায় ৭ হাজার ৮০০ আলোকবর্ষ দূরের এ ক্লাস্টার আমাদের দ্বিতীয় নিকটতম গ্যালাক্সিপুঞ্জ। বর্তমানে ইউক্লিডই একমাত্র দুরবিন, যার সাহায্যে এত পরিষ্কারভাবে ক্লাস্টারটির সব নক্ষত্র দেখা যাচ্ছে। মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতে ডার্ক ম্যাটার কীভাবে বিন্যস্ত রয়েছে, সেই মানচিত্র তৈরি করতে এ ধরনের পর্যবেক্ষণ বেশ কাজে আসবে বলেই বিজ্ঞানীদের ধারণা।

দ্য হর্সহেড নেবুলা
ছবি: ইসা

দ্য হর্সহেড নেবুলা

এটি ইউক্লিডের তোলা সবচেয়ে রঙিন ছবি। বার্নাড ৩৩ বা হর্সহেড নামের এই নীহারিকার অবস্থান পৃথিবী থেকে ১,৫০০ থেকে ১,৩৫০ আলোকবর্ষের মধ্যে। অরিয়ন নক্ষত্রপুঞ্জের এ অঞ্চলে প্রতিনিয়ত জন্ম নিচ্ছে নতুন নক্ষত্র। এটি পৃথিবীর সবচেয়ে কাছের নক্ষত্রের জন্মস্থান।

লেখক: প্রদায়ক, বিজ্ঞানচিন্তা

সূত্র: ইসা, লাইভসায়েন্স