অন্য মহাবিশ্ব থেকে ওয়ার্মহোলের সংকেত পাওয়ার দাবি করেছেন একদল চীনা বিজ্ঞানী

কাল্পনিক ওয়ার্মহোলমিডজার্নির সাহায্যে তৈরি

২০১৯ সালের কথা। লাইগো এবং ভার্গো নামে দুটি অবজারভেটরি স্থান-কালের বুকে এক বিশাল ঢেউ শনাক্ত করল। এই ঢেউয়ের প্রচলিত নাম মহাকর্ষীয় তরঙ্গ। আর শনাক্তকৃত সেই সংকেতের নাম দেওয়া হয় GW190521। নামটা একটু জটিল বটে! বিজ্ঞানীরা এ ব্যাপারে একমত যে এই সংকেত দুটি কৃষ্ণগহ্বরের সংঘর্ষের ফলে সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু সম্প্রতি চীনের একদল গবেষক এই ঘটনার ভিন্ন এক ব্যাখ্যা নিয়ে হাজির হয়েছেন। সেই ব্যাখ্যা কল্পবিজ্ঞানকেও হার মানায়!

চীনের বিজ্ঞান একাডেমির একদল গবেষকের মতে, ওই সংকেত আমাদের মহাবিশ্বের কোনো ঘটনা নয়। এটি অন্য এক মহাবিশ্বে ঘটা দুটি ব্ল্যাকহোলের সংঘর্ষের প্রতিধ্বনি! তাঁদের তত্ত্ব অনুযায়ী, সেই সংঘর্ষ এত শক্তিশালী ছিল যে তা ক্ষণিকের জন্য দুটি মহাবিশ্বের মধ্যে একটি ওয়ার্মহোল বা মহাজাগতিক সুড়ঙ্গ তৈরি করে দিয়েছিল। আর সেই পথেই সংকেতটি প্রতিধ্বনি হিসেবে এসে ধরা পড়েছে আমাদের যন্ত্রে।

এই গবেষণা করেছেন চীনের ইউনিভার্সিটি অব চাইনিজ একাডেমি অব সায়েন্সের পদার্থবিদ কি লাই (Qi Lai) এবং তাঁর দল। সম্প্রতি প্রিপ্রিন্ট সার্ভার আরজিভে (arXiv) এসেছে এই গবেষণাপত্র। তবে এখনো এটি পিয়ার রিভিউ হয়নি। অর্থাৎ অন্য বিজ্ঞানীরা এখনো এটি পর্যালোচনা করে দেখেননি।

কাল্পনিক ওয়ার্মহোল
মিডজার্নির সাহায্যে তৈরি

কিন্তু এমন অদ্ভুত কথা কেন বলছেন এই বিজ্ঞানীরা? কারণ, ২০১৯ সালের সেই সংকেত ছিল অস্বাভাবিক রকম সংক্ষিপ্ত। সাধারণত, দুটি ব্ল্যাকহোল পরস্পরের দিকে সর্পিল গতিতে ছুটে আসার সময় ওগুলোর মহাকর্ষীয় তরঙ্গের শক্তি বাড়তে থাকে এবং বিশেষ বাঁশির মতো জোরালো শব্দ তৈরি করে, ইংরেজিতে যাকে বলা হয় ‘চার্প’ (Chirp)। বিজ্ঞানীরা একে বলেন ‘ইনস্পাইরাল পর্যায়’। কিন্তু GW190521 সংকেতটিতে সেই প্রাথমিক বাঁশির মতো শব্দটিই রহস্যজনকভাবে অনুপস্থিত ছিল। তা ছাড়া এ সংঘর্ষের পর তৈরি হওয়া ১৪২ সৌরভরের কোনো কৃষ্ণগহ্বরের ক্ষেত্রে এই ইনস্পাইরাল পর্যায়টি শনাক্তযোগ্য হওয়ার কথা।

এই অদ্ভুত ঘটনা (ইনস্পাইরাল পর্যায় শনাক্তযোগ্য না হওয়ার) ব্যাখ্যা দিতেই চীনা গবেষকেরা নতুন এই গাণিতিক মডেল তৈরি করেছেন। তাঁদের মডেলে দেখিয়েছেন, অন্য মহাবিশ্বের সংঘর্ষের প্রতিধ্বনি যদি একটি ওয়ার্মহোলের মধ্য দিয়ে আসে এবং ওয়ার্মহোলটি যদি সংঘর্ষের পরপরই ভেঙে পড়ে, তাহলে ঠিক কীরকম সংকেত তৈরি হবে। তাঁদের দাবি, এই মডেল থেকে পাওয়া তরঙ্গটি লাইগো-ভার্গো থেকে পাওয়া সংকেতের সঙ্গে ভালোভাবে মিলে যায়।

তবে গবেষকরা নিজেরাই স্বীকার করেছেন, তাঁদের মডেলটির চেয়ে প্রচলিত বাইনারি ব্ল্যাকহোলের সংঘর্ষের মডেলটিই ডেটার সঙ্গে সামান্য ভালোভাবে মিলে যায়। সেই মডেল অনুসারে, দুটি অতিভারী মহাজাগতিক বস্তুর সংঘর্ষে কেমন করে স্থান-কালে ঢেউ ওঠে তথা মহাজাগতিক তরঙ্গ তৈরি হয়, তা বিস্তারিত জানতে পড়ুন: আইনস্টাইন, মহাকর্ষ তরঙ্গ এবং লাইগো। বলা বাহুল্য, এই মডেলটিই এখনো সর্বজনগৃহীত। কিন্তু দুই মডেলের ব্যবধান এত কম যে এই চীনা বিজ্ঞানীদের ওয়ার্মহোল সংক্রান্ত ধারণাটিকে একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। বিষয়টি নিয়ে তাই আরও অনেক গবেষণা প্রয়োজন। আগেই যেমন বলেছি, চীনা গবেষকদের এই গবেষণাপত্র এবং দাবি এখনো অন্য বিজ্ঞানীদের হাতে পর্যালোচিত বা পিয়ার-রিভিউড হয়নি।

কিন্তু উত্তেজনার পারদ আরও চড়ছে, কারণ ২০২৩ সালে শনাক্ত হওয়া আরও একটি বিশাল ব্ল্যাকহোল সংঘর্ষের সংকেতও ঠিক একইরকম সংক্ষিপ্ত। সেই সংকেতের নাম দেওয়া হয়েছে GW231123। এটি কি তবে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি? ভবিষ্যতে হয়তো এই রহস্যের জট খুলবে। আমরা কি সত্যিই অন্য কোনো মহাবিশ্বের উঁকিঝুঁকি দেখতে শুরু করেছি কিনা, তা তখনই বোঝা যাবে।

সূত্র: সায়েন্স অ্যালার্ট ও ফিউচারিসম

সংশোধনী: লেখায় ভুলভাবে এসেছিল, ‘তবে গবেষকরা নিজেরাই স্বীকার করেছেন যে, তাঁদের মডেলটি প্রচলিত ধারণার চেয়ে ‘সামান্য’ ভালো। মানে আগের সম্ভাবনাকে এই মডলের সাহায্যে একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।’ কথাটি উল্টো হবে, ‘তবে গবেষকরা নিজেরাই স্বীকার করেছেন, তাঁদের মডেলটির চেয়ে প্রচলিত বাইনারি ব্ল্যাকহোলের সংঘর্ষের মডেলটিই ডেটার সঙ্গে সামান্য ভালোভাবে মিলে যায়।’ তা ছাড়া শিরোনামে ‘দাবি’ কথাটি বোঝাতে বিস্ময়চিহ্ন (!) ব্যবহার করা হয়েছিল, যা হয়তো ভুল বোঝাবুঝির জন্ম দিয়েছে। এই অনাকাঙ্ক্ষিত ভুলের জন্য আমরা আন্তরিকভাবে দুঃখিত।