পৃথিবী সদৃশ ১০টি এক্সোপ্ল্যানেট

পৃথিবী কখনো বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠলে বিকল্প হিসাবে নিচের গ্রহগুলো থাকবে। আমাদের যানবাহন প্রযুক্তি আরো উন্নতি হলে হয়ত পাশের কোনো গ্রহে ঠাঁই মিলবে, বেঁচে যাবে মানবজাতি।

বিজ্ঞানীরা প্রায় ৪ হাজার এক্সোপ্ল্যানেট আবিষ্কার করেছে। ১৯৯৫ সালে প্রথম এক্সোপ্ল্যানেট আবিষ্কার করেন বিজ্ঞানীরা। তাঁরা সূর্যের মতো একটি নক্ষত্রকে প্রদক্ষিণ করতে দেখে এক্সোপ্ল্যানেটের বিষয়টি নিশ্চিত হয়। এক্সোপ্ল্যানেট বলতে সৌরজগতের বাইরের গ্রহকে বুঝায়। এখন পর্যন্ত আবিস্কৃত এক্সোপ্ল্যানেটের মধ্যে অর্ধেকের বেশি খুঁজে পেয়েছে নাসার কেপলার স্পেস টেলিস্কোপ। টেলিস্কোপটি ২০০৯ সালে যাত্রা শুরু করে। মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতে ঘুরে ঘুরে টেলিস্কোপটি খুঁজে বের করেছে এমন সব গ্রহ যেগুলো হতে পারে পৃথিবীর বিকল্প গ্রহ। পৃথিবীর মতো ছোট এবং পাথুরে গ্রহ মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতে প্রচুর রয়েছে। তবে সেই সব গ্রহতে প্রাণ টিকে থাকার সম্ভাবনা নেই। আজ আমরা এমন ১০টি গ্রহ নিয়ে আলোচনা করবো যেগুলো দেখতে অনেকটা পৃথিবীর মতো। গ্রহগুলোতে প্রাণ না থাকলেও গ্রহগুলো অন্তত প্রাণ টিকে থাকার উপযোগী। কোনো গ্রহ প্রাণ থাকার উপযোগী হতে হলে সেই গ্রহের অবশ্যই কিছু বৈশিষ্ট্য থাকতে হবে। যেমন:

ক. গ্রহগুলোকে ছোট হতে হবে।

খ. অবশ্যই পাথুরে গ্রহ হতে হবে।

গ. জীবন ধারনের উপযোগী হতে হবে।

ঘ. সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, গ্রহটিকে তার মাতৃনক্ষত্রের এমন কক্ষপথে থাকতে হবে যাতে সেখানে পানি থাকে।

এখন আমাদের প্রযুক্তি আরও উন্নত হয়েছে। তাই এই চারটি বৈশিষ্ট্যের সাথে ওই গ্রহের বায়ুমণ্ডলীয় গঠন এবং গ্রহের নক্ষত্র কতটা সক্রিয় সেটাও বিবেচনা করতে হবে। পৃথিবী কখনো বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠলে বিকল্প হিসাবে নিচের গ্রহগুলো থাকবে। আমাদের যানবাহন প্রযুক্তি আরো উন্নতি হলে হয়ত পাশের কোনো গ্রহে ঠাঁই মিলবে, বেঁচে যাবে মানবজাতি।

শিল্পীর কল্পনায় গ্লিস ৬৬৭সিসি গ্রহের পৃষ্ঠ

১. গ্লিস ৬৬৭সিসি (Gliese 667Cc)

এই গ্রহটি পৃথিবী থেকে মাত্র ২২ আলোকবর্ষ দূরে। তবে গ্রহটি পৃথিবীর তুলনায় প্রায় ৪.৫ গুণ বড়। গ্লিস ৬৬৭সিসি গ্রহটি তার নিজস্ব নক্ষত্রকে একবার প্রদক্ষিণ করে ২৮ দিনে। কিন্তু নক্ষত্রটি যথেষ্ট শীতল এবং এটি একটি লাল বামন তারা। তাই বলাই যায়, এক্সোপ্ল্যানেটটি বসবাসযোগ্য অঞ্চলে অবস্থিত। এ ধরণের বসবাসযোগ্য অঞ্চলকে হ্যাবিটেবল জোন বলে।

যাইহোক, গ্লিস ৬৬৭সিসি এক্সোপ্ল্যানেটটি আবিষ্কৃত হয়ে চিলিতে অবস্থিত ইউরোপিয়ান সাউদার্ন অবজারভেটরির ৩.৬ মিটার টেলিস্কোপের মাধ্যমে।

২. কেপলার-২২বি (KEPLER-22B)

কেপলার-২২বি প্রায় ৬০০ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত। হ্যাবিটাবেল জোনে পাওয়া এইটাই প্রথম কেপলার গ্রহ। তবে এটি পৃথিবীর তুলনায় প্রায় ২.৪ গুণ বড়। গ্রহটি তরল, গ্যাসীয় নাকি পাথুরে তা এখনো নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। গ্রহটি ২৯০ দিনে একবার তার মাতৃনক্ষত্রকে প্রদক্ষিণ করে। অনেকটা পৃথিবীর ৩৬৫ দিনের মতোই। গ্রহটি আমাদের সূর্যের মতো একটি জি শ্রেণির নক্ষত্রকে প্রদক্ষিণ করে। যেসব নক্ষত্রের তাপমাত্রা ৫ হাজার ৩০০ থেকে ৬ হাজার কেলভিন বা নিউক্লিয়ার ফিউশনের মাধ্যমে হিলিয়ামকে হাইড্রজেনে পরিণত করে তাকে জি শ্রেণির নক্ষত্র বলে। আমাদের সূর্যও একটি জি শ্রেণির নক্ষত্র। তবে কেপলার-২২ মাতৃনক্ষত্রটি আমাদের সূর্যের তুলনায় ছোট এবং ঠান্ডা।

কেপলার-২২বি গ্রহ
কেপলার-৬৯সি গ্রহ

৩. কেপলার-৬৯সি (KEPLER-69C)

কেপলার-৬৯সি গ্রহটি পৃথিবীর থেকে ২ হাজার ৭০০ আলোকবর্ষ দূরে এবং প্রায় ৭০ শতাংশ বড়। সুতরাং, গবেষকেরা এই গ্রহের গঠন সম্পর্কে অনিশ্চিত। গ্রহটি প্রতি ২৪২ দিনে একবার কক্ষপথ সম্পূর্ণ করে। এ কারণে গ্রহটিকে আমাদের সৌরজগতের শুক্র গ্রহের সাথে তুলনা করা যায়। কেপলার-৬৯সি গ্রহের নক্ষত্রটি ৮০ শতাংশ উজ্জ্বল। এজন্য বলা যায়, কেপলার-৬৯সি গ্রহটি বসবাসযোগ্য গ্রহের উপযোগী।

৪. কেপলার-৬২এফ (KEPLER-62F)

এই গ্রহটি পৃথিবী থেকে প্রায় ৪০ শতাংশ বড়। গ্রহটি ২৬৭ দিনে তার মাতৃনক্ষত্রকে প্রদক্ষিণ করে। নক্ষত্রটি আমাদের সূর্যের চেয়ে ঠান্ডা। এ কারণে গ্রহটিকে হ্যাবিটেবল জোনে রাখা হয়েছে। কেপলার-৬২এফ নক্ষত্রের সবচেয়ে কাছে থাকে, তখন নক্ষত্রটি অনেক কম আলো উৎপন্ন করে।

কেপলার-৬২এফ পৃথিবী থেকে ১ হাজার ২০০ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত। গ্রহটি আকারে অনেক বড়। তাই এটি পাথুরে গ্রহ হওয়ার সম্ভাবনা আছে এবং গ্রহের পৃষ্ঠে পানিও থাকতে পারে।

কেপলার-৬২এফ গ্রহ
কেপলার-১৮৬এফ গ্রহ

৫. কেপলার-১৮৬এফ (KEPLER-186F)

গ্রহটি পৃথিবীর তুলনায় ১০ শতাংশ বড় এবং গ্রহটি তার নক্ষত্রের বসবাসযোগ্য অবস্থানে রয়েছে। যদিও আমাদের সূর্য থেকে পৃথিবী যে পরিমাণ শক্তি পায় কেপলার-১৮৬এফ তার মাতৃনক্ষত্র থেকে তার মাত্র এক-তৃতীয়াংশ শক্তি পায়। গ্রহটির মূল নক্ষত্র একটি লাল বামন নক্ষত্র। এটি পৃথিবী থেকে প্রায় ৫০০ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত।

৬. কেপলার-৪৪২বি (KEPLER-442B)

কেপলার-৪৪২বি পৃথিবী থেকে ৩৩ ভাগ বড় এবং ১১২ দিনে তার সূর্যকে একবার প্রদক্ষিণ করে। ২০১৫ সালে নাসা ঘোষণা করে, গ্রহটি পৃথিবী থেকে ১ হাজার ১৯৪ আলোকবর্ষ দূরে।

২০২১ সালে রয়্যাল অ্যাস্ট্রোনোমিক্যাল সোসাইটির মাসিক বিজ্ঞপ্তিতে প্রকাশিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে, এই এক্সোপ্ল্যানেটটি একটি বড় জীবজগৎ টিকিয়ে রাখার মতো যথেষ্ট আলো পায়। গবেষকেরা বিভিন্ন গ্রহের সালোকসংশ্লেষণের সক্ষমতা বিশ্লেষণ করেছেন। তাঁরা দেখেছেন, কেপলার-৪৪২বি তার নিজস্ব নক্ষত্র থেকে পর্যাপ্ত বিকিরণ গ্রহণ করে।

কেপলার-৪৪২বি গ্রহের সাথে পৃথিবীর তুলনা।
কেপলার-৪৫২বি গ্রহ

৭. কেপলার-৪৫২বি (KEPLER-452B)

২০১৫ সালে কেপলার-৪৫২বি গ্রহটি আবিষ্কার করে নাসা। এটিই পৃথিবীর কাছাকাছি প্রথম গ্রহ, যা সূর্যের সমান একটি নক্ষত্রের চারপাশে প্রদক্ষিণ করে। গ্রহটি পৃথিবী থেকে ৬০ শতাংশ বড় এবং এর নক্ষত্রটি (কেপলার-৪৫২) আমাদের সূর্যের চেয়ে ১০ শতাংশ বড়। কেপলার-৪৫২ অনেকটা সূর্যের মতোই। কেপলার-৪৫২বি তার মাতৃনক্ষত্রকে হ্যাবিটেবল জোনে থেকেই প্রদক্ষিণ করছে।

গ্রহটির আবিষ্কারকেরা বলেছেন, এটি পৃথিবীর আকারের চেয়ে প্রায় ১.৬ গুণ এবং গ্রহটি পাথুরে হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। এটি পৃথিবী থেকে ১ হাজার ৪০০ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত। কেপলার-৪৫২বি তার নক্ষত্রকে প্রদক্ষিণ করতে পৃথিবীর চেয়ে মাত্র ২০ দিন বেশি সময় নেয়।

৮. কেপলার-১৬৪৯সি (KEPLER-1649C)

নাসার বিজ্ঞানীরা কেপলার স্পেস টেলিস্কোপ থেকে ডাটা বিশ্লেষণ করার সময় কেপলার-১৬৪৯সি এক্সোপ্ল্যানেটটি আবিষ্কার করে। নাসার বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, এই এক্সোপ্ল্যানেটটি পৃথিবীর আকৃতির এবং গ্রহটি তার মাতৃনক্ষত্রের হ্যাবিটেবল জোনে রয়েছে।

টেলিস্কোপ থেকে প্রাথমিক ডেটা সংগ্রহের সময় কম্পিউটার অ্যালগরিদমে একটি ভুল থেকে যায়। পরে ২০২০ সালে সেই ভুল ধরা পরে এবং কেপলার-১৬৪৯সি গ্রহ হিসাবে স্বীকৃতি পায়।

এক্সোপ্ল্যানেটটি পৃথিবী থেকে ৩০০ আলোকবর্ষ দূরে এবং ১.০৬ গুণ বড়। গ্রহটির মূল নক্ষত্র কেপলার-১৬৪৯ থেকে দুটি গ্রহ আলো পায়। তবে কেপলার-১৬৪৯সি আলো পায় প্রায় ৭৫ ভাগ।

শিল্পীর কল্পনায় কেপলার-১৬৪৯সি গ্রহ
শিল্পীর কল্পনায় প্রক্সিমা সেন্টাউরি বি গ্রহ

৯. প্রক্সিমা সেন্টাউরি বি (PROXIMA CENTAURI B)

প্রক্সিমা সেন্টাউরি বি পৃথিবী থেকে মাত্র ৪ আলোকবর্ষ দূরে আবস্থিত। দূরত্বের কারণে এই গ্রহটিই পৃথিবীর সবচেয়ে কাছের এক্সোপ্ল্যানেট। ২০১৬ সালে আবিষ্কৃত এক্সোপ্ল্যানেটটির ভর পৃথিবী থেকে ১.২৭ গুণ। গ্রহটি হ্যাবিটেবেল জোনের মধ্যেই আছে। তবে এই গ্রহে প্রচুর অতিবেগুনি রশ্মি বিকিরিত হয়। কারণ গ্রহটি তার মূল নক্ষত্র প্রক্সিমা সেন্টাউরির খুব কাছে অবস্থান করে। গ্রহটি মাত্র ১১.২ দিনে নক্ষত্রের চারপাশে প্রদক্ষিণ করে।

শিল্পীর কল্পনায় ট্রাপিস্ট-১ই গ্রহ।

১০. ট্রাপিস্ট-১ই (TRAPPIST-1E)

বসবাসযোগ্য অঞ্চলে আবিষ্কৃত এক্সোপ্ল্যানেটগুলোর মধ্যে ট্রাপিস্ট-১ই পৃথিবীর সবচেয়ে বিকল্প এক্সোপ্ল্যানেট। এটি তার মাতৃনক্ষত্রের একমাত্র গ্রহ।

এ ধরনের গ্রহগুলোতে প্রথমদিকে পানি ছিল। তবে এখন সেগুলো বাষ্পীভূত হয়ে গেছে। ২০১৮ সালে স্পেস ডট কমের এক গবেষণায় দেখা গেছে, এ ধরনের কয়েকটি গ্রহে পৃথিবীর মহাসাগরের চেয়েও বেশি পানি ধারণ ক্ষমতা রয়েছে। ট্রাপিস্ট-১ই আমাদের জানা সবচেয়ে সম্ভাবনাময় স্থান, যেখানে জীবনধারণ সম্ভব।

লেখক: শিক্ষার্থী, গণিত বিভাগ, সরকারি তিতুমীর কলেজ, ঢাকা

সূত্র: স্পেস ডট কম ও নাসা