হকিং রেডিয়েশন ও ব্ল্যাকহোলের মৃত্যু

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার চোখে কৃষ্ণগহ্বর

মহাবিশ্বের রহস্যময় বস্তুগুলোর তালিকায় ব্ল্যাকহোলের অবস্থান নিঃসন্দেহে প্রথম সারিতে। এগুলোতে চলে অমিত শক্তিশালী গ্র্যাভিটি বা মহাকর্ষের রাজত্ব। ফলে আশপাশের সবকিছুর শেষ ঠিকানা হয় এদের গহীনে। এমনকি এদের ফাঁক গলে পালাতে পারে না মহাবিশ্বের সর্বোচ্চ গতিবেগের মুকুটধারী আলোও।

আসলে প্রতিটি ব্ল্যাকহোল বা কৃষ্ণগহ্বরের চারপাশে একটি সীমারেখা থাকে। এর নাম ইভেন্ট হরাইজন বা ঘটনা দিগন্ত। একে অতিক্রম করলেই আলোসহ অন্য কোনো কিছু আর ফিরে যেতে পারে না। এভাবেই বাকি মহাবিশ্ব থেকে নিজেদের পুরোপুরি আড়াল করে রাখে রহস্যময় ব্ল্যাকহোলেরা।

ব্ল্যাকহোল হরেক রকম ভরের হতে পারে। সাধারণত এদের ভর আমাদের সূর্যের পাঁচ গুণ থেকে শুরু করে একশ গুণ পর্যন্ত হয়। তবে মহাবিশ্বে দানবাকৃতির ব্ল্যাকহোলেরও অস্তিত্ব রয়েছে। এদের দেখা মেলে প্রতিটি গ্যালাক্সির কেন্দ্রে। এগুলোর ভর হতে পারে সূর্যের বিলিয়ন গুণেরও বেশি। মহাজাগতিক বস্তুদের গ্রাস করার মাধ্যমে ব্ল্যাকহোলের আকার ক্রমাগত বৃদ্ধি পায়। এগুলো যদি সূর্যের সমান ভরের কোনো বস্তু গ্রাস করে, তাহলে ঘটনা দিগন্তের ব্যাসার্ধ বেড়ে যায় প্রায় তিন কিলোমিটার পর্যন্ত। তবে শুনে যেমনই মনে হোক, ব্ল্যাকহোল কিন্তু যা ইচ্ছে, তাই গ্রাস করতে পারে না। ঘটনা দিগন্তের একদম কাছের বস্তুদের হয়তো টেনে নিতে পারে প্রবল মহাকর্ষীয় সাড়াশি দিয়ে। তবে নিরাপদ দূরত্বের বস্তুদের কিছুই করতে পারে না।

আরও পড়ুন

সে যাই হোক, ব্ল্যাকহোলের গ্রাস করার মতো অফুরন্ত বস্তু রয়েছে মহাবিশ্বে। সেই সঙ্গে মহাবিশ্বে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন নক্ষত্রের জন্ম হচ্ছে। কালের বিবর্তনে এদের প্রায় সবারই ঠাঁই হবে ব্ল্যাকহোলের অতল গহীনে। বিশাল ভরের নক্ষত্ররা পর্যন্ত মহাকর্ষের সর্বগ্রাসী আকর্ষণ বলের কাছে নতি স্বীকার করতে বাধ্য। অন্তত অনেক বিজ্ঞানীর তাই ধারণা। ওদিকে বিশাল ভরের নক্ষত্ররা জীবন চক্রের শেষ পর্যায়ে নিজেরাই পরিণত হয় ব্ল্যাকহোলে। অর্থাৎ, বর্তমান মহাবিশ্বে খাবারের অভাব নেই ব্ল্যাকহোলদের। তবে সব সময় অবস্থা এক রকম থাকবে না। এক সময় ফুরিয়ে যাবে নতুন নক্ষত্র তৈরির উপাদান। ফলে মহাবিশ্বে দেখা যাবে না আর কোনো নতুন নক্ষত্রের আলো। অন্যদিকে, অবশিষ্ট নক্ষত্ররাও একে একে নিভে যাবে। শেষ পর্যন্ত মহাবিশ্বে টিকে থাকবে কেবল দানবাকৃতির ব্ল্যাকহোল বা কৃষ্ণগহ্বর। যদি গ্রাস করার মতো কোনো বস্তুর অস্তিত্ব না থাকে, তাহলে কী ঘটবে ব্ল্যাকহোলদের ভাগ্যে? এরা কি অনন্তকাল ধরে নিঃসঙ্গ পথিকের মতো মহাশূন্যে ভেসে বেড়াবে? নাকি অন্য সব মহাজাগতিক বস্তুর মতো অজানা উপায়ে জীবনাবসান হবে তাদেরও?

২.

ব্ল্যাকহোলদের সরাসরি দেখা সম্ভব নয়। পরোক্ষভাবে আশপাশের বস্তুদের আচরণ থেকে এদের খোঁজ পাওয়া যায়। বস্তুগুলো প্রবল মহাকর্ষের প্রভাবে ভেঙ্গেচুরে দুমড়ে-মুচড়ে গিয়ে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এই অংশগুলোকে ব্ল্যাকহোল ক্রমান্বয়ে নিজেদের দিকে টেনে নিতে থাকে। এগুলো যত নিকটবর্তী হয়, তত বাড়তে থাকে গতিবেগ। তীব্র গতিতে চলমান অংশগুলোর মধ্যে ঘটতে থাকে তুমুল সংঘর্ষ, উৎপন্ন হয় তাপশক্তি। ফলে ব্ল্যাকহোলে গিয়ে পড়ার আগে বস্তুগুলো আলোকিত হয়ে উঠে। এভাবে ব্ল্যাকহোল ঘিরে তৈরি হয় ডিস্ক আকৃতির একটি আলোকিত অঞ্চল। বিজ্ঞানীরা এর নাম দিয়েছেন অ্যাক্রেশন ডিস্ক। এটি মূলত নির্দেশ করে ঘটনা দিগন্তের সীমা। ২০১৯ সালে ইভেন্ট হরাইজন টেলিস্কোপ দিয়ে তোলা ব্ল্যাকহোলের প্রথম ছবিটি দেখতে পারেন। এতে স্পষ্ট দৃশ্যমান অ্যাক্রেশন ডিস্ক।

প্রসঙ্গত ইভেন্ট হরাইজন টেলিস্কোপের ব্যাপারে দু-কথা বলা প্রয়োজন। এটি একক কোনো টেলিস্কোপ নয়। পুরো পৃথিবীর নানা প্রান্তে বসানো আটটি টেলিস্কোপের সমন্বয়ে এই টেলিস্কোপ গড়ে উঠেছে। বৈশ্বিক এক দুরবিন বলা চলে। ব্ল্যাকহোলের মতো মহাজাগতিক বস্তুর ছবি তোলার জন্য এ ধরনের টেলিস্কোপ আবশ্যক। যাহোক, প্রসঙ্গে ফিরি।

ব্ল্যাকহোলের প্রথম ছবি

পয়েন্ট অব নো রিটার্ন-খ্যাত ঘটনা দিগন্তকে ঘিরে অদ্ভুত এক কোয়ান্টাম মেকানিক্যাল ইফেক্ট আবিষ্কার করেন বিখ্যাত ব্রিটিশ তাত্ত্বিক পদার্থবিদ স্টিফেন হকিং। ১৯৭৪ সালে তিনি দাবি করেন, কোয়ান্টাম মেকানিকসের দৃষ্টিতে ব্ল্যাকহোল থেকেও পালানো সম্ভব! আরও সঠিকভাবে বললে, পালানো সম্ভব ব্ল্যাকহোলের ঘটনা দিগন্ত থেকে। বিষয়টি তিনি তাত্ত্বিকভাবে প্রমাণও করেন। চলুন জেনে নিই, কীভাবে ঘটতে পারে এই আপাত অসম্ভব ঘটনা। 

কার্টুনে হকিং রেডিয়েশন

কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যা অনুসারে, মহাবিশ্বের কোথাও প্রকৃত শূন্যস্থানের অস্তিত্ব নেই। আপাতদৃষ্টে মনে হওয়া সব শূন্যস্থানে ক্রমাগত আবির্ভূত হচ্ছে ভার্চ্যুয়াল কণারা। এগুলো সব সময় কণা-প্রতিকণা জোড় হিসেবে আবির্ভূত হয়। ইংরেজিতে বলে ম্যাটার-অ্যান্টিম্যাটার পেয়ার। পরমুহূর্তেই এরা ধ্বংস করে দেয় পরস্পরকে। এই ঘটনার নাম কোয়ান্টাম ফ্ল্যাকচুয়েশন। এভাবে আবির্ভূত কণা-প্রতিকণা জোড়ের একটি হয় ধনাত্মক শক্তিবিশিষ্ট, অন্যটি হয় ঋণাত্মক শক্তির। ফলে এমন অদ্ভুত ঘটনার পরেও ঠিকই মোটা দাগে অটুট থাকে শক্তির নিত্যতা সূত্র।

ব্ল্যাকহোলের প্রান্ত সীমানা ঘটনা দিগন্তের কাছেও সমান তালে ঘটতে থাকে কোয়ান্টাম ফ্ল্যাকচুয়েশন। এর প্রভাবে অনেক সময় সেখানে এমনভাবে কণা-প্রতিকণা জোড় আবির্ভূত হতে পারে যে ঋণাত্মক শক্তির কণাটি ব্ল্যাকহোলের মহাকর্ষের প্রভাবে বাঁধা পড়ে যায়। কিন্তু ধনাত্মক শক্তির কণাটি ঠিক বেরিয়ে পড়ে ফাঁক গলে। অর্থাৎ, এমন হতে হলে ঋণাত্মক শক্তির কণার আবির্ভাব ঘটবে ঘটনা দিগন্তের ঠিক ভেতরের অংশে, আর ধনাত্মক শক্তির কণার আবির্ভাব ঘটবে ঠিক বাইরে। বাইরে থেকে এই ঘটনা দেখলে মনে হবে যেন ব্ল্যাকহোল কণা বিকিরণ করছে। এর নাম দেওয়া হয়েছে হকিং রেডিয়েশন।

আইনস্টাইনের বিখ্যাত E=mc2 সমীকরণ অনুসারে ভর ও শক্তি একে অন্যের সমতুল্য। তাই ঋণাত্মক শক্তির কণা ভেতরে পড়ে যাওয়ার দরুন ব্ল্যাকহোলের ভর খুব সামান্য পরিমাণ হ্রাস পাবে। ফলে কৃষ্ণগহ্বরটি খুব সামান্য হলেও সংকুচিত হবে। প্রায় অনন্তকাল ধরে এই প্রক্রিয়া চলতে থাকলে সংকুচিত হয়ে এক সময় বিস্ফোরিত হবে দানবাকৃতির ব্ল্যাকহোলগুলোও। অর্থাৎ, মহাজাগতিক অন্য সব বস্তুর মতো এরাও অমর নয়।

হকিং বিকিরণ

৩.

হকিং রেডিয়েশনের মাধ্যমে ব্ল্যাকহোলদের সংকুচিত হতে প্রয়োজন সুদীর্ঘ সময়। যে ব্ল্যাকহোলের আকার যত বড়, তার মৃত্যুঘণ্টা বাজতে সময় লাগবে তত বেশি। তবে যতক্ষণ পর্যন্ত মহাজাগতিক বস্তুদের গ্রাস করা অব্যাহত থাকবে, ততক্ষণ পর্যন্ত বহাল তবিয়তেই টিকে থাকতে পারবে এগুলো। যখন মহাবিশ্বে গ্রাস করার মতো আর কোনো বস্তু অবশিষ্ট থাকবে না, তখন থেকেই বাজতে শুরু করবে এদের মৃত্যুঘণ্টা। হকিং রেডিয়েশনের মাধ্যমে এরা সংকুচিত হতে শুরু করবে। এভাবে আমাদের সূর্যের সমান ভরের ব্ল্যাকহোলের অন্তিম সময় উপস্থিত হতে প্রয়োজন পড়বে আনুমানিক ১০৬৭ (১-এর পর ৬৭টা শূন্য!) বছর। অন্যদিকে, সুপারম্যাসিভ বা অতিভারী কৃষ্ণগহ্বরদের ক্ষেত্রে এই সময়কাল হতে পারে ১০১০০ (১-এর পর ১০০টা শূন্য) বছরেরও বেশি!

সংকুচিত হওয়ার একদম শেষ পর্যায়ে এসে সব ব্ল্যাকহোলই বিস্ফোরিত হবে। অবমুক্ত হবে বিপুল পরিমাণ আলো ও শক্তি। খুব ছোট জায়গায় আমরা যদি একসঙ্গে এক মিলিয়ন ফিউশন বোমা বিস্ফোরণ ঘটাই, তাহলে এর সমপরিমাণ শক্তি অবমুক্ত হবে। পৃথিবীর বিচারে একে প্রলয়ংকরী বিস্ফোরণ বলা যায়। তবে মহাজাগতিক স্কেলে এটা খুব একটা শক্তিশালী নয়। এখন পর্যন্ত রেকর্ড করা সবচেয়ে শক্তিশালী সুপারনোভায় এর চেয়েও ২২ ট্রিলিয়ন গুণ বেশি শক্তিশালী বিস্ফোরণের দেখা মিলেছে।

যাহোক, ছোট-বড় সব ব্ল্যাকহোলই শেষ পর্যন্ত একইভাবে বিস্ফোরিত হবে। পার্থক্য কেবল, কত সময় লাগবে, তাতে। বড় ব্ল্যাকহোলগুলো সংকোচনের মাধ্যমে বিস্ফোরণের পর্যায়ে আসতে অপেক্ষাকৃত বেশি সময় নেবে। ছোটদের বেলায় এই সময়কাল অপেক্ষাকৃত কম। তবে যত যাই হোক, মৃত্যুর হাত থেকে নিস্তার পাবে না কেউই।

তবু ‘কিন্তু’ রয়ে যায়। সবচেয়ে বড় কিন্তুটি হলো, তাত্ত্বিকভাবে এসবই হওয়ার কথা। তবে হকিং বিকিরণের নিশ্চিত প্রমাণ মেলেনি এখনো। ল্যাবে সিমুলেশন করে দেখা হয়েছে, এমনটিই হয়। বাস্তবেও হয়তো এর প্রমাণ মিলবে শিগগিরই। অবশ্য এ ব্যাপারে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত, কৃষ্ণগহ্বরেরও মৃত্যু হয়। ধীরে ধীরে ব্ল্যাকহোল মিলিয়ে যায় মহাকাশের নিঃসীম অন্ধকারে।

লেখক: অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার, নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড (এনপিসিবিএল)    

 

সূত্র:

১. দ্য বিগিনিং টু দ্য এন্ড অব দ্য ইউনিভার্স: হাউ ব্ল্যাকহোলস ডাই, নোলা টেইলর রেড/ অ্যাস্ট্রোনমি ডট কম, ২০২১

২. এ কার্টুন গাইড টু দ্য ফ্যাসিনেটিং রেলম অব ফিজিকস, ড. বেঞ্জামিন ভার, ড. বরিস লেমার, রিনা পিকলো