ভবঘুরে গ্রহের কথা

পৃথিবী বছরে একবার সূর্যকে চক্কর দিচ্ছে। শুধু পৃথিবী নয়, সৌরজগতের বাকি ৭টা গ্রহও সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরছে অবিরত। অন্যান্য নক্ষত্র সিস্টেমের বেলাতেও এমনটা দেখা যায়। মনে হতে পারে গ্রহের কাজই হয়ত তার নক্ষত্রকে কেন্দ্র করে ঘুরপাক খাওয়া। কিন্তু সেটা সত্য নয়।

সাম্প্রতিক গবেষণায় বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, নক্ষত্রের বাঁধনমুক্ত অসংখ্য গ্রহ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মহাকাশের আনাচে কানাচে। কাগজকলমে এসব গ্রহের নাম, ফ্রি-ফ্লোটিং প্লানেট (FFP) বা ভবঘুরে গ্রহ।

নক্ষত্র জন্মের সময় এর চারপাশে ঘুরতে থাকা ধূলিকণা ও গ্যাস মহাকর্ষের টানে জড়ো হয়ে তৈরি হয় গ্রহ। সাধারণত সূর্যের সমান বা কাছাকাছি আকারের নক্ষত্রের চারপাশে ৮-১০টি করে স্থিতিশীল গ্রহ ঘুরপাক খায়। তবে, প্রাথমিক অবস্থায় সদ্য তৈরি হওয়া গ্রহের সংখ্যা প্রায় ১০ গুণ বেশি হতে পারে। এসময় বেশিরভাগ গ্রহই একটি আরেকটির সাথে সংঘর্ষ জড়ায়। এতে করে গ্রহের আকার বাড়ে। কমে যায় গ্রহের সংখ্যা। এর মাঝেই কিছু কিছু গ্রহ হারিয়ে যায় নক্ষত্র সিস্টেম থেকে।

নক্ষত্রের শক্তিশালী মহাকর্ষ বল ছিন্ন করে গ্রহগুলো কীভাবে ভবঘুরে হয় সে সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা এখনও পুরোপুরি নিশ্চিত নন। ধারণা করা হয়, নক্ষত্রকে প্রদক্ষিণ করার সময় তীব্র গতির কারণে কিছু গ্রহ নক্ষত্র সিস্টেমের বাইরে চলে যেতে পারে। জ্যোতির্বিজ্ঞানের ভাষায় এই ব্যাপারটিকে বলা হয় স্লিংশট।

আবার, দুইটি গ্রহের মাঝে সংঘর্ষের কারণেও একটি গ্রহ ছিটকে যেতে পারে নক্ষত্র সিস্টেমের বাইরে। নক্ষত্রের বাঁধনমুক্ত হয়ে ভেসে বেড়ায় অন্ধকার মহাশূন্যে। তাপের উৎস না থাকায় ভবঘুরে গ্রহগুলো হয় প্রচণ্ড শীতল।

কীভাবে আবিষ্কার করা হয় ভবঘুরে গ্রহ?

গ্রহ নিজে কোন আলো বিকিরণ করে না। এজন্য এদের শনাক্ত করা কঠিন। ভবঘুরে গ্রহের বেলায় সেটি আরও কঠিন। সাধারণ গ্রহ শনাক্তের পদ্ধতিগুলো এদের বেলায় কাজে লাগানো যায় না। মহাকর্ষীয় মাইক্রোলেন্সিং পদ্ধতি ব্যবহার করে এসব গ্রহ শনাক্ত করা হয়।

দানবীয় নক্ষত্র বা গ্যালাক্সির ভরের কারণে স্থান বেঁকে যায়। ফলে এর পিছনে থাকা বস্তু থেকে নির্গত হওয়া আলোর গতিপথও যায় বেঁকে। এই ঘটনাকে বলা হয় মহাকর্ষীয় লেন্সিং। এই বক্রতা ও আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারেন, ওই নক্ষত্র বা গ্যালাক্সির ভরের পরিমাণ।

মাইক্রোলেন্সিং-এর বেলাতেও একই ঘটনা ঘটে। পার্থক্য শুধু এক্ষেত্রে আলো বেঁকে যাওয়ার পরিমাণ খুবই কম হয়। অদৃশ্য কোন কিছুর কারণে সামান্য পরিমাণে আলো বেঁকে গেলে বোঝা যায় সেখানে ভবঘুরে গ্রহের অস্তিত্ব আছে। এভাবেই মূলত ভবঘুরে গ্রহ আবিষ্কার করা হয়। সর্বপ্রথম ভবঘুরে গ্রহের অস্তিত্ব শনাক্ত হয় ২০১১ সালে। যদিও তার প্রায় কয়েক দশক আগে এর অস্তিত্ব তাত্ত্বিকভাবে প্রমাণ করেছিলেন জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা।

মিল্কিওয় গ্যালাক্সিতে প্রতিটি নক্ষত্রের বিপরীতে বৃহস্পতির দ্বিগুণ আকারের কমপক্ষে একটি করে ভবঘুরে গ্রহ আছে বলে ধারণা করেন বিজ্ঞানীরা। সেই হিসেবে প্রায় ২০ হাজার কোটি গ্যাসীয় দৈত্যাকার ভবঘুরে গ্রহ থাকতে পারে শুধু মিল্কিওয়েতেই। ছোট-বড় মিলিয়ে হিসেব করলে সংখ্যাটি প্রায় ১ লাখ কোটি ছাড়িয়ে যাবে।

লেখক: শিক্ষার্থী, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা

সূত্র: দ্য কনভার্সেশন