ইতিহাসের উজ্জ্বলতম সুপারনোভা, ডার্ক ম্যাটার পাওয়ার সম্ভাবনা

২০২২ সালের অক্টোবরে ইতিহাসের সবচেয়ে উজ্জ্বল সুপারনোভা বিস্ফোরণ ঘটে। এই বিস্ফোরণকে ইংরেজিতে বলা হচ্ছে ‘ব্রাইটেস্ট অব অল টাইম’, সংক্ষেপে বোট (BOAT)। বিস্ফোরণে সৃষ্ট প্রচণ্ড গামা রশ্মি বিকিরণে উচ্চ শক্তির নতুন একধরনের কণার সন্ধান পাওয়া গেছে। কেউ কেউ বলছেন, এটা ডার্ক ম্যাটার কণা হতে পারে।

অক্টোবর ৯, ২০২২। জুডিথ র‍্যাকুসিন তখন ভূপৃষ্ট থেকে ৩৫ হাজার ফুট ওপরে। উড়োজাহাজে করে যাচ্ছেন এক জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞান কনফারেন্সে। ঠিক সে সময় মহাকাশে ঘটছে আরেক ঘটনা। ইতিহাসের সবচেয়ে উজ্জ্বল সুপারনোভা বিস্ফোরণ ঘটছে মহাকাশে।

যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ডে অবস্থিত নাসার গডার্ড স্পেসফ্লাইট সেন্টারের এই জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানী তাই বিমান থেকে নেমে চমকে গেলেন। ঘটনা অবশ্য চমকে যাওয়ার মতোই। তাঁর ভাষাতেই শুনুন, ‘নেমে দেখি, কয়েক ডজন খুদে বার্তা!’

দীর্ঘ এই গামা রশ্মি বিস্ফোরণ মূলত একটি নক্ষত্রের মৃত্যুবার্তা। সুপারনোভা বিস্ফোরণ, বাংলায় যাকে বলে অতিনবতারা বিস্ফোরণ—নক্ষত্রের মৃত্যুর কথাই বলে। হয় নক্ষত্রটি এ বিস্ফোরণে পুরো ধ্বংস হয়ে যায়, নয়তো পরিণত হয় কৃষ্ণগহ্বর বা নিউট্রন তারায়। প্রচণ্ড সেই বিস্ফোরণের পরিণতি অবশ্য এখনো নিশ্চিতভাবে জানা যায়নি। তবে প্রাথমিক বিশ্লেষণ বলছে, নক্ষত্রটি সম্ভবত কৃষ্ণগহ্বরে পরিণত হবে।

সেই বিস্ফোরণের তীব্রতা, উজ্জ্বলতায় ঝলসে গিয়েছিল ফার্মি গামা-রে স্পেস টেলিস্কোপ। ঝলসে মানে, পুড়ে যাওয়া না। ধাঁধা লেগে যাওয়া। ইংরেজিতে বলে, ওভারস্যাচুরেটেড। অথচ এই নভোদুরবিনটির কাজই মূলত এ ধরনের ঘটনাগুলো পর্যবেক্ষণ করা। নেদারল্যান্ডের র‍্যাডবড বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানী অ্যান্ড্রু লেভানের ভাষায়, ‘প্রতি সেকেন্ডে এত বেশি ফোটন এসে পড়ছিল যে এটি কুলিয়ে উঠতে পারেনি।’

এই বিস্ফোরণে ফুলে-ফেঁপে ওঠে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের ওপরের স্তর—আয়নোস্ফিয়ার। মহাজাগতিক কণায় ভরে ওঠে। এ অবস্থা স্থায়ী হয় কয়েক ঘণ্টা। এত দূর থেকে কোনো বিস্ফোরণ যে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে এ ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে, সেটাও এক বিস্ময়কর ব্যাপার।

সব মিলে জ্যোতির্বিদরা এটাকে বলছেন বোট—ব্রাইটেস্ট অব অল টাইম। প্রাথমিক বিশ্লেষণ বলছে, এই উজ্জ্বলতার কারণ দুটো। এক, এই বিস্ফোরণ ঘটেছে পৃথিবী থেকে ২.৪ বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরে। আমাদের গ্যালাক্সির বাইরে হলেও মহাবিশ্বের বিশাল ক্যানভাসে এই দূরত্বকে খুব, খুব বেশি বলা যায় না। আর দুই, বিস্ফোরণের জেট বা বিকিরণ মূলত পৃথিবীমুখী ছিল। দুইয়ে মিলে এমন ঘটনা ঘটে কয়েক শ বছরে একবার। তবে এত উজ্জ্বল যে আগে কখনো দেখা যায়নি, সে কথা তো আগেই বলেছি। এত তথ্য পেয়েছেন এ থেকে বিজ্ঞানীরা যে বিশ্লেষণ করতে হয়তো ১০ বছরও পেরিয়ে যেতে পারে।

এটা তো এক ঘটনা। ঘটনার পেটে আরও এক ঘটনা আছে। সেখানেই আছে সম্ভাব্য ডার্ক ম্যাটার বা গুপ্তবস্তু।

চিনের সিচুয়ান প্রদেশে অবস্থিত লার্জ হাই অলটিচ্যুড এয়ার শাওয়ার অবজারভেটরি। উচ্চ শক্তির মহাজাগতিক কণা শনাক্ত করা এর অন্যতম কাজ। সাধারণত এ ধরনের গামা রশ্মি বিস্ফোরণে তারা কয়েক শ উচ্চ শক্তির ফোটন শনাক্ত করেন। আর এই ঘটনায় তারা শনাক্ত করেছে ৫ হাজারের মতো উচ্চ শক্তির ফোটন! এগুলোর মধ্যে ছিল ১৮ টেরাইলেকট্রন ভোল্টের ফোটন—গামা রশ্মিতে সাধারণত যে ধরনের শক্তিসম্পন্ন কণা পাওয়া যায়, এর শক্তি তার চার গুণ!

এ ধরনের উচ্চ শক্তির ফোটন পৃথিবীতে এসে পৌঁছানোর কথাই নয়। আসার পথে শক্তি হারানোর কথা। মহাজাগতিক পটভূমি বিকিরণের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ায় পুরোপুরি হারিয়ে যাওয়াই এ ধরনের কণার জন্য স্বাভাবিক। কারণটা তো বুঝতেই পারছেন। উচ্চ শক্তির কণা যত পথ পাড়ি দেবে, আর এ সময় যত ধরনের কণার সঙ্গে সংঘর্ষ ঘটবে—সব ধরনের মিথস্ক্রিয়ায় এটির নিম্ন শক্তির কণাদের শক্তি দিয়ে দেওয়ার কথা।

তাহলে, এই কণা পৃথিবীতে পৌঁছাল কীভাবে? একদল বিজ্ঞানীর ধারণা, এরকম গামা রশ্মি বিস্ফোরণের ফলে সৃষ্ট উচ্চ শক্তির ফোটন অ্যাক্সিওনের মতো কণায় পরিণত হতে পারে। অ্যাক্সিওন একধরনের হাইপোথেটিক্যাল কণা। অত্যল্প ভরের এসব কণারা ডার্ক ম্যাটার হওয়ার অন্যতম দাবীদার। আর অ্যাক্সিওন-এর মতো কণারা এদের তুলনায় সামান্য ভারী। উচ্চ শক্তির ফোটনরা এ ধরনের নক্ষত্র বিস্ফোরণের সময়, নক্ষত্রের চারপাশে সৃষ্ট চৌম্বকক্ষেত্রের প্রভাবে এরকম কণায় পরিণত হতে পারে। সেক্ষেত্রে মহাকাশের বিশাল দূরত্ব তারা পাড়ি দেবে কারো সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া না করে। পরে আমাদের গ্যালাক্সিতে এসে পৌঁছালে, চৌম্বকক্ষেত্রের প্রভাবে এটি আবার পরিণত হবে ফোটনে। এই ফোটন এসে পৌঁছাবে পৃথিবীতে, আমরা দেখতে পাব ডিটেকটরে।

প্রাথমিকভাবে এই উচ্চ শক্তির ফোটন শনাক্ত হওয়ার পরে প্রিপ্রিন্ট ওয়েবসাইটগুলোতে এ ধরনের বেশ কয়েকটি গবেষণাপত্র দেখা গেছে। প্রিপ্রিন্ট মানে, এখনো প্রকাশিত হয়নি, এ ধরনের গবেষণাপত্র। বা বলা যায়, প্রকাশের অপেক্ষায়। বেশ কয়েকটি মানে, একাধিক দলের গবেষকরা এমনটাই মনে করছেন। ভাবনাটাকে তাই উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।

অবশ্যই, হতে পারে লার্জ হাই অলটিচ্যুড এয়ার শাওয়ার অবজারভেটরির হিসাবে ভুল হয়েছে। অথবা বিষয়টা শুধুই কাকতাল। বিজ্ঞানীরা এসব নিয়ে এখন খুব সাবধানী। তাঁরা তাই খতিয়ে দেখছেন এই কণার বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য, বিশ্লেষণ করছেন; বোঝার চেষ্টা করছেন। লার্জ হাই অলটিচ্যুড এয়ার শাওয়ার অবজারভেটরিও এখনো এ বিষয়ক বিস্তারিত তথ্য-উপাত্ত প্রকাশ করেনি। বিজ্ঞানীদের আশা, তারা সেটা করবে শিগগিরই।

তবে ডার্ক ম্যাটার কণা পাওয়া না গেলেও এত পরিমাণ উজ্জ্বলতা বা আলো বিজ্ঞানীদের অনেক জিজ্ঞাসার জবাব দেবে। যেমন এই জেট কীভাবে বেরিয়ে আসে কোনো নক্ষত্র থেকে? মহাকাশের মহাশূন্যতায় এই জেট বা বিকিরণ ছড়িয়ে পড়ার সময় জেটের ভেতরে, কণাদের মধ্যে ঠিক কী ধরনের মিথস্ক্রিয়া ঘটে? আরেকটি বিষয় হলো, সব নক্ষত্র সুপারনোভা বিস্ফোরণে গামা রশ্মি এরকম প্রবলভাবে বিকিরণ করে না। প্রশ্ন হলো, কেন? এটাও একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।

গবেষণার ফলাফল শেষ পর্যন্ত যা-ই দাঁড়াক, একটা বড় কথা হলো, এরকম বিস্ফোরণ হয়তো দেখা যাবে না আরও কয়েক শ বছর। এটি নিজেই যে বড় একটি ঘটনা, এমন কিছুর স্বাক্ষী হওয়াটাও যে বড় ব্যাপার, তা আর বলতে!

ডার্ক ম্যাটার কণার সম্ভাবনার বিষয়টি নিয়ে অবশ্য আরেকটি কথাও বলা প্রয়োজন। বিজ্ঞান চেষ্টা করে যায়, বিভিন্ন সম্ভাবনা খতিয়ে দেখতে থাকে। হয় না, হয় না, তারপর যখন হয়ে যায়, মনে হয় মিরাকল। যেমন কৃষ্ণগহ্বরের নতুন ছবি। কিংবা মহাবিশ্বের সবচেয়ে অতীতের নক্ষত্র আগে যেটা দেখা যেত, এখন তারচেয়েও দূরবর্তী ও অতীতের নক্ষত্র শনাক্ত করা। কিংবা হিগস বোসন—যে কণার খবর শিরোনাম হয়েছিল সব কয়টা পত্রিকায়। এরকম সম্ভাবনাগুলো নিয়ে তাই আলোচনা করতে হবে। কারণ, কোনো আবিষ্কার একদিনে হয়ে যায় না। হাজারো বিজ্ঞানীর এরকম দীর্ঘকালের সাধনাই বিজ্ঞানকে এগিয়ে নেয়।

এ গবেষণায় না হোক, কোনোদিন নিশ্চয়ই ডার্ক ম্যাটার কণার সন্ধান পাওয়া যাবে। অন্তত নিশ্চিতভাবে জানা যাবে, ডার্ক ম্যাটার আসলে কী, নাকি আদৌ এর অস্তিত্ব নেই। এটুকু আস্থা বিজ্ঞানীদের ওপর রাখাই যায়।

লেখক: সহসম্পাদক, বিজ্ঞানচিন্তা

সূত্র: কোয়ান্টা ম্যাগাজিন, উইকিপিডিয়া