মহাকাশে উদ্ভিদ উন্মেষ

আমেরিকান লেখক এডওয়ার্ড এভার্ট হাল ১৮৮৯ সালে দ্য ব্রিক মুন নামে একটি কল্পবিজ্ঞান উপন্যাস লেখেন। সে উপন্যাসেই প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ ও মহাকাশ স্টেশনের এক কল্পনাপ্রসূত বর্ণনা পাওয়া যায়। সেই মহাকাশ স্টেশনে পৃথিবীর বাইরে মহাকাশে গাছপালা জন্মানোর ধারণা পাওয়া যায়। এরপর থেকে শুরু হয় মহাকাশে স্টেশন বানানো ও এর ভেতর উদ্ভিদ জন্মানো নিয়ে বিজ্ঞানীদের জল্পনা-কল্পনা ও গবেষণা।

বিশ শতকের শেষ ও একুশ শতকের প্রথম দিকে কিছু বিজ্ঞানীর কৌতূহলের বিষয় হয়ে ওঠে, কী করে পৃথিবীর বাইরে মহাকাশে উদ্ভিদ জন্মানো যায়। এমনকি মঙ্গল গ্রহ ও চাঁদের বুকেও উদ্ভিদ জন্মানো যায় কি না, তা নিয়ে রীতিমতো গবেষণা শুরু হয়। বিশেষ করে মহাকাশ স্টেশনগুলোর ভেতরে যদি এমন কোনো ব্যবস্থায় কিছু উদ্ভিদ জন্মানো যায়, তাহলে সেগুলো মহাকাশচারীদের খাবারের জোগান দিতে ও মহাকাশ স্টেশন বা মহাকাশযানের ভেতরে মহাকাশচারীদের জন্য অনুকূল পরিবেশের সৃষ্টি করতে পারবে। হয়তো সেসব উদ্ভিদ মহাকাশ স্টেশনের ভেতরে দূষিত কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করে বিশুদ্ধ অক্সিজেনে রূপান্তর করতে পারবে। এ ছাড়া দীর্ঘদিন পৃথিবী থেকে দূরে মহাকাশ স্টেশনের ভেতরে থাকা নভোচারীদের হয়তো সেসব উদ্ভিদ কিছুটা মানসিক প্রশান্তি দিতে পারবে, কিন্তু মহাকাশে উদ্ভিদ জন্মানোর এক প্রধান অন্তরায় হলো ওজনহীনতা অথবা দুর্বল মহাকর্ষ বল। পৃথিবীর কাছাকাছি মহাকাশে প্রথমে উদ্ভিদ জন্মানোর চেষ্টা করা হয়। মহাকর্ষ বলের প্রভাবমুক্ত পরিবেশে অনেকটা জোর করে খাঁচার মতো একটা আবদ্ধ স্থানে নিয়ন্ত্রিত পরিবেশ সৃষ্টি করে তার ভেতর উদ্ভিদ জন্মানোর চেষ্টা করা হয়, যার নাম দেওয়া হয় মহাশূন্য উদ্যান বা স্পেস গার্ডেন।

একাধিক গবেষণার মাধ্যমে পর্যবেক্ষণের চেষ্টা করা হয়, কীভাবে পৃথিবীর বাইরে দুর্বল মহাকর্ষ বলে উদ্ভিদের বৃদ্ধি হয়, মহাকাশের পরিবেশ ও পৃথিবীর পরিবেশের প্রভাব কতটুকু উদ্ভিদের বৃদ্ধিকে প্রভাবিত করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ অ্যালেন এইচ ব্রাউনের গবেষণাকে ধরা যেতে পরে। তিনি ১৯৮৩ সালে পৃথিবীর কক্ষপথে পরিভ্রমণরত স্পেস শাটল কলাম্বিয়ায় সূর্যমুখী চারার বৃদ্ধি ও পরিচলনের ওপর পর্যবেক্ষণ করেন। তিনি দেখেছিলেন, নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে উদ্ভিদ তার সহজাত প্রবৃত্তিতেই মাধ্যাকর্ষণ বল ছাড়া বৃদ্ধি ঘটাচ্ছে। এ ঘটনা তাদের আরও গবেষণার জন্য অনুপ্রাণিত করে।

১৯৮২ সালে সোভিয়েত স্যালুট–৭–এর নভোচারীরা মহাকাশ স্টেশনে জনৈক লিথুয়ানিয়ান বিজ্ঞানী আলফনসাস মার্কিসের সহায়তায় মহাকাশে প্রথম একটি মাইক্রো গ্রিনহাউসে অ্যারাবিডপসিস বীজ থেকে উদ্ভিদ জন্মিয়ে তাতে ফুল ফোটাতে ও বীজ উৎপাদন করতে সক্ষম হন। এরপর ১৯৯৭ সালে মহাশূন্য স্টেশন মীরে সফলভাবে বীজ থেকে বীজ উৎপাদন করা সম্ভব হয়।

আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে উদ্ভিদ নিয়ে এরপর থেকে চলতে থাকে বিভন্ন রকমের গবেষণা। আইএসএস এক্সপেডিশন–৪-এ নেওয়া হয় মহাকাশে সবজি উৎপাদনের এক গবেষণা কার্যক্রম। সে গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত হয় লেটুস, সুইস চার্ড, মুলা, চায়নিজ বাঁধাকপি ও মটরশুঁটি। এক্সপেডিশন–৪০ মহাকাশ স্টেশনে লাল লেটুস জন্মিয়ে তা আবার পৃথিবীতে ফেরত এনে পরীক্ষা করা হয়। এক্সপেডিশন–৪৪-এর আমেরিকান নভোচারীরাই প্রথম সৌভাগ্যবান, যাঁরা ২০১৫ সালের ১০ আগস্ট মহাকাশে জন্মানো সেই রেড লেটুসের স্বাদ গ্রহণ করতে পেরেছিলেন। অবশ্য রাশিয়ার নভোচারীরা ২০০৩ সাল থেকেই মহাকাশে জন্মানো সবজির অর্ধেকটা নিজেরা খাওয়া ও অর্ধেকটা গবেষণার জন্য ব্যবহার করে আসছেন।

২০১২ সালে নাসার ডোনাল্ড পেটিট আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে সূর্যমুখী ফুল ফোটাতে সক্ষম হন। এরপর ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে মার্কিন নভোচারীরা আইএসএসে ফোটান জিনিয়া ফুল। মহাকাশে জিনিয়া ফুল ফোটানোর পর নভোচারী স্কট কেলি তাঁর স্পেস স্টেশনের কুপোলা থেকে পৃথিবীর ভূমণ্ডলকে ব্যাকড্রপ করে একগোছা জিনিয়া ফুলের একটি ছবি তুলে ২০১৬ সালের ভ্যালেন্টাইন দিবসে তিনি তাঁর ইনস্টাগ্রামে পোস্ট করেন।

২০১৭ সালে পৃথিবীর অদূরে মহাকাশে শাকসবজি উৎপাদনের এক বিশেষ ডিজাইন অ্যাডভান্সড প্ল্যান্ট হ্যাবিটেট উদ্ভাবন করা হয় এবং সে বছরের ডিসেম্বরে সেখানে শতাধিক শাকসবজির বীজ সরবরাহ করা হয়। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে জার্মান অ্যারোস্পেস সেন্টার পৃথিবীর অনুচ্চ কক্ষপথে ইউক্রপিস স্যাটেলাইট প্রেরণ করে। এই স্যাটেলাইটে দুটি গ্রিনহাউসে টমেটো উৎপাদনের ব্যবস্থা রাখা হয়।

চ্যাং-ই–৪ নামে চীন একটি লুনার ল্যান্ডার চাঁদে পাঠায়। সেই ল্যান্ডারে ৩ কেজি ওজনের একটি ক্ষুদ্র আবদ্ধ জীবমণ্ডল বা বায়োস্ফিয়ার যুক্ত করা হয়, যার নাম দেওয়া হয় লুনার মাইক্রো ইকো সিস্টেম বা সংক্ষেপে এলএমই। ক্ষুদ্র জীবমণ্ডলের ভেতরে পৃথিবীর অনুরূপ পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়। তফাত ছিল শুধু মাধ্যাকর্ষণ বল ও মহাজাগতিক বিকিরণ বা কসমিক রেডিয়েশনের। এর ভেতরে ছিল কিছু ফসলের বীজ ও পোকামাকড়ের ডিম।

গবেষকেরা দেখতে চেয়েছিলেন যে চাঁদে সেসব বীজ অঙ্কুরিত হয় কি না ও পোকার ডিম ফোটে কি না। ফসলের মধ্যে ছিল আলু, শর্ষে, তুলা ও টমেটো। অন্যদিকে ডিম ছিল ফলের মাছি পোকার। এ ছাড়া ছিল ইস্ট ও একটি আগাছার বীজ। ২০১৯ সালের জানুয়ারির ৩ তারিখে চ্যাং-ই–৪ চাঁদের উল্টো পিঠে অবতরণ করে। তুলা ছাড়া আর সবই শুকিয়ে মারা যায়। শুধু তুলার বীজ গজিয়ে দুটি পাতা সৃষ্টি করে। তার মানে, সেটাই চাঁদের বুকে প্রথম জন্মানো উদ্ভিদের ইতিহাস সৃষ্টি করে। ইতিমধ্যে মঙ্গল গ্রহে মানববসতি স্থাপন নিয়ে জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়েছে। বিজ্ঞানীরাও থেমে নেই। মঙ্গল গ্রহে কী করে গ্রিনহাউস তৈরি করে তার ভেতরে ট্রেতে থরে থরে পৃথিবীর মতো শাকসবজি ফলানো যায়। ইতিমধ্যে মডেলের একটি নকশাও প্রকাশ করা হয়েছে। জানি না, অদূর ভবিষ্যতে মানুষ মহাকাশ জয়ের পাশাপাশি সেসব জায়গায় মানুষের আধিপত্য ও উদ্ভিদের প্রতিষ্ঠা করতে পারবে কি না। তবে ভাবতে তো দোষ নেই, গবেষকেরাও নানাভাবে সে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

লেখক : কৃষিবিদ ও প্রকৃতিবিষয়ক লেখক