কেন্দ্র থেকে দূরে শ্রেষ্ঠত্বের উন্মাদনা থেকে নয়

দ্বিতীয় সহস্রাব্দের শেষার্ধে এসে নিশ্চিতভাবে এ কথা জেনেছি যে আমাদের অবস্থান মহাবিশ্বে খুব সাধারণ অঞ্চলে। আমরা হলাম ধূলিকণার চেয়ে তুচ্ছ আর আকস্মিকতার ফলাফল। আর এ অবস্থান জানতে গিয়ে প্রতিটি পদক্ষেপে বিজ্ঞানের সঙ্গে প্রচলিত সংস্কারের সংঘাত হয়েছে, ঝরেছে অনেক রক্ত। মানুষ সব সময় আঁকড়ে ধরতে চেয়েছে পুরোনো ধারণাকে। তা কখনো সমকালীন শক্তিশালীদের টিকে থাকার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। সৌরকেন্দ্রিক ধারণা প্রচার করতে গিয়ে ১৬০০ সালে জ্যোতির্বিজ্ঞানী জিওর্ডানো ব্রুনোকে যেভাবে ক্রুসে বিদ্ধ করে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল, তা ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যতবার স্মরণ করবে, ততবার শিউরে উঠবে। গ্যালিলিওকে ইনকুইজিশনে বৃদ্ধ বয়সে লাঞ্ছিত হতে হয়েছিল। যদিও তিন শ বছর পরে ভ্যাটিক্যানের পোপ এ ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন। এটা তৃতীয় সহস্রাব্দের মানুষের জন্য আশার কথা।

বিকেন্দ্রীকরণের ইতিহাসটা শুরু হয়েছিল ১৫৪৩ সালে। পোলিশ বিজ্ঞানী নিকোলাস কোপার্নিকাসের হাতে। তিনি বলেছিলেন, পৃথিবী নয়, সূর্যই মহাবিশ্বের কেন্দ্র আর পৃথিবী একটা গ্রহ, যা সূর্যকে কেন্দ্র করে বৃত্তাকার পথে ঘোরে। যদিও ১ হাজার ৮০০ বছর আগে এই ধারণা আয়োনীয় বিজ্ঞানী অ্যারিস্টাকার্স বলেছিলেন যথেষ্ট যুক্তি–প্রমাণসহকারে। কিন্তু গোঁড়ামি আর প্লেটো-অ্যারিস্টটলীয় প্রভাব তা বাড়তে দেয়নি। তাঁদের ধারণাই জ্যোতির্বিজ্ঞানী টলেমি অ্যালামজেস্ট গ্রন্থে গাণিতিকভাবে লিপিবদ্ধ করেছিলেন। ডেনমার্কের জ্যোতির্বিজ্ঞানী টাইকো ব্রাহে টলেমিকল্পিত গ্রহগুলোর গতিপথগুলোর অবস্থান সম্পর্কে গণিতের চমত্কার লেখচিত্র দিতে সক্ষম হন। যদিও সেগুলো ছিল গ্রহগুলো গড়াতে গড়াতে কোথায় যাবে, সে সম্পর্কে সহায়ক নির্দেশাবলি মাত্র। কোপার্নিকাস অবশ্য আগেই বলেছিলেন, এই গতিপথগুলোকে আরও সরল করা যায়, যদি পৃথিবীর পৃষ্ঠ থেকে এগুলোকে না দেখে সূর্যের পৃষ্ঠ থেকে দেখা হয়। কেপলার (১৫৭১-১৬৩০) ব্রাহের সহকারী হিসেবে কিছুদিন কাজ করেছিলেন। কেপলার ব্রাহের নেওয়া পরিমাপগুলোর ফল এবং কোপার্নিকাসের ধারণাগুলো ব্যবহার করে ১৬০৯-১৬১৯ সালের মধ্যে গ্রহগতি–সংক্রান্ত তিনটি সূত্র দেন। তিনি বলেন, প্রতিটি গ্রহ সূর্যকে ফোকাসে রেখে বৃত্তাকার পথে নয়, উপবৃত্তাকার পথে ঘোরে এবং এই ঘোরার গাণিতিক সম্পর্ক প্রকাশ করেন। পর্যবেক্ষণের প্রতি বিশ্বস্ততা ও যথার্থ যুক্তিবোধ, কেপলারকে প্লেটোনিক বিশুদ্ধতার প্রতীক বৃত্তাকার ধারণা থেকে বের হয়ে আসতে সাহায্য করে।

এদিকে ১৫৮৯ সালে বিজ্ঞানী গ্যালিলিও আবিষ্কার করেন, বায়ুশূন্য স্থানে অভিকর্ষের প্রভাবে মুক্তভাবে বিভিন্ন বস্তুকে মুক্তভাবে পড়তে দিলে সব বস্তুই নিশ্চল অবস্থা থেকে যাত্রা শুরু করে সমান ত্বরণে নিচে পড়ে। ভারী, হালকা সব ভরের বস্তুই সমানহারে বেগপ্রাপ্ত হয় অথবা সমান ত্বরণে নিচে পড়বে। অর্থাৎ, ২৪ তলা ভবন থেকে বায়ুশূন্য অবস্থায় যদি একটি মুরগির পালক ও এক টনের একটি লোহার পিণ্ড ফেলা হয়, তাহলে তারা একই সময় মাটিতে এসে আঘাত করবে। এভাবে তিনি পড়ন্ত বস্তুর তিনটি সূত্র আবিষ্কার করেন। এদিকে গ্যালিলিওর দূরবীক্ষণ যন্ত্র আবিষ্কার গ্রহ-নক্ষত্র পর্যবেক্ষণের পথ আরও খুলে দেয়।

গ্রহগতির নিয়মাবলি ও পড়ন্ত বস্তুর সূত্র থেকে এটা পরিষ্কার, সে সময় বেগ পরিবর্তনের দুটো কারণ চিহ্নিত হয়েছিল। একটি হলো পৃথিবীর অভিকর্ষ—পৃথিবীপৃষ্ঠে যে কারণে কোনো বস্তু পতিত হয়। একে মাধ্যাকর্ষণও বলে। যেমন আপেলের পতন। দ্বিতীয়টি হলো মহাজাগতিক অভিকর্ষ—যে কারণে পৃথিবীর চারদিকে চাঁদ ঘোরে এবং সূর্যের চারদিকে পৃথিবী ও গ্রহ-নক্ষত্রগুলো ঘোরে। একে মহাকর্ষ বলে। গ্যালিলিওর আবিষ্কৃত পড়ন্ত বস্তুর সূত্র এবং কেপলারের গ্রহগতিসম্বন্ধীয় সাধারণ সিদ্ধান্ত তিনটির ওপর ভিত্তি করে গবেষণা করেন আইজ্যাক নিউটন। সঙ্গে দেকার্তের বিশ্লেষণধর্মী জ্যামিতি ব্যবহার করেন তিনি। গ্রহগুলোর সঞ্চারণ এবং পড়ন্ত বস্তুর মধ্যে শৃঙ্খলা অনুসন্ধান শুরু করেছিলেন নিউটন। তিনিই প্রথম উপরিউক্ত বিজ্ঞানীদের একটি সাধারণ রূপ দিলেন দারুণভাবে। বিজ্ঞানসংস্কৃতির ব্যাখ্যাকার জ্যাকব ব্রওনস্কির ভাষায়, ‘বস্তুপিণ্ড অথবা সূর্যের পরিপ্রেক্ষিতে গ্রহগুলোই হোক, পারস্পরিক গতি উত্পাদিত হয় তাদের মধ্যকার মহাকর্ষ বলের জন্য, যে বল একটি বস্তুকে অন্য বস্তুর দিকে টানে। সমকালীন বিজ্ঞানীদের মধ্যে একমাত্র তাঁর হাতেই সেই গাণিতিক ক্ষমতা ছিল। ফলে তিনি দেখাতে সক্ষম হয়েছিলেন যে ওই সব বল যথাপার্থিব অভিকর্ষ ও মহাকর্ষকে যদি একটি সূত্রে সাজানো যায়, তাহলে তাদের অধীনে গ্রহগুলো ঘুরতে থাকে ঘড়ির কাঁটার মতো নিয়মিত ছন্দে, জোয়ার–ভাটা ওঠে–নামে নিয়ন্ত্রিত ছন্দে, আর বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সংযুক্ত থাকে একই কারণে।’

এই সূত্র ছিল দুটি বস্তুর মধ্যে মহাকর্ষ বল তাদের ভরের সমানুপাতিক এবং বস্তুদ্বয়ের দূরত্বের বর্গের ব্যস্তানুপাতিক। একে নিউটনের মহাকর্ষ তত্ত্ব বলে। আমরা এই সব তত্ত্ব থেকে জেনেছিলাম, পৃথিবী সূর্যের চারদিকে সেকেন্ডে ১৬ মাইল বেগে ঘুরছে এবং কেন চলমান পৃথিবী থেকে ছিটকে পড়ি না। এদিকে হাইগেনসের সময় থেকে তারা-নক্ষত্রের দূরত্ব নিরূপণ করার চেষ্টা শুরু হয়। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও সংগীতজ্ঞ উইলিয়াম হার্শেল দৃশ্যমান আকাশের অসংখ্য নক্ষত্রের অবস্থান ও দূরত্ব তালিকাভুক্ত করে যথেষ্ট যুক্তিসংগতভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি হলো আমাদের বিশ্ব এবং মানুষের সান্ত্বনা ছিল যে পৃথিবী সূর্যের চারদিকে আবর্তন করা একটি সাধারণ গ্রহ হলেও সূর্য এই গ্যালাক্সির কেন্দ্রে অবস্থিত। কিন্তু ১৯১৫ সালের দিকে বিভিন্ন পর্যবেক্ষণ থেকে হ্যারলো শেপলি বেশ সাহস করে প্রস্তাব করেছিলেন যে সৌরজগতের অবস্থান হলো গ্যালাক্সির প্রান্তে। আজ আমরা পরিষ্কারভাবে জানি, মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির কেন্দ্র থেকে প্রায় ২৮ হাজার আলোকবর্ষ দূর দিয়ে গ্যালাক্সিকে প্রদক্ষিণ করে চলেছে সেকেন্ড ১৪৩ মাইল বা ২৩০ কিলোমিটার গতিতে। সম্পূর্ণ একবার ঘুরে আবার ফিরে আসতে সময় লাগবে ২৫ কোটি বছর। এ–ও জানি, এ গ্যালাক্সিতে প্রায় ৪০ হাজার কোটি সূর্যের মতো নক্ষত্র আছে, যার মধ্যে অন্তত ১০ হাজার কোটিতে আমাদের মতো সৌরজগৎ থাকা সম্ভব। আর ১৯২৪ সালে হাবলের আবিষ্কার থেকে জানা গেল, আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির মতো অসংখ্য গ্যালাক্সি মহাশূন্যে অপরিমেয় দূরত্বে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আছে। সবচেয়ে কাছের গ্যালাক্সি অ্যান্ড্রোমিডাতে আলোর গতিতে ছুটেও যেতে সময় লাগবে ২০ লাখ আলোকবর্ষ।

এদিকে আইনস্টাইন সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্বের মাধ্যমে মহাবিশ্বের চতুর্মাত্রিক গোলকের কথা প্রস্তাব করেছিলেন। যার পৃষ্ঠটা ত্রিমাত্রিক, অনেকটা ত্রিমাত্রিক গোলকের দ্বিমাত্রিক পৃষ্ঠের মতো। ১৯২২ সালের দিকে রুশ গণিতবিদ আলেকজান্ডার ফ্রিডম্যান বলেছিলেন, মহাবিশ্ব প্রসারণশীল মহাবিশ্ব। এই সব ধারণা অনুযায়ী, মহাবিশ্বটা এমন একটা জগৎ, যার প্রতিটি বিন্দু প্রান্ত ও প্রতিটি বিন্দু কেন্দ্র—অর্থাৎ, প্রতিটি স্থানই সাধারণ।

এদিকে ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝিতে আমরা ধারণা পেলাম, মানুষ বুদ্ধিবৃত্তিক সংস্কৃতিমনা একটি প্রাণী। কিন্তু তা–ও বোধ হয় থাকল না, বিংশ শতাব্দীতে যখন দেখা গেল, অন্যান্য অনেক প্রাণীর সাংস্কৃতিক বিকাশ ঘটেছে এবং ঘটছে। কার্ল সাগান ও ফ্রাঙ্ক ড্রেকের মতো বিজ্ঞানীরা সম্ভাবনা আরোপ করেন, লক্ষ–কোটি গ্যালাক্সির মধ্যে শুধু আমাদের গ্যালাক্সিতে এক কোটি গ্রহে বেতার যোগাযোগের ক্ষমতাসম্পন্ন প্রাণ থাকা সম্ভব। তাদের শারীরিক গঠনকাঠামো অকল্পনীয় বৈচিত্র্যময় হতে পারে। সে রকম উন্নত প্রাণের দেখা না পেলেও ধূমভিন্ন ধূমকেতু, উল্কাপিণ্ড এবং মঙ্গল গ্রহেও আমরা যদি এককোষী প্রাণের সন্ধান পাই, তাহলে এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যাবে, মহাজগতে প্রাণ একটা সাধারণ ব্যাপার। অন্যান্য অনেক পরিণতির মতো পদার্থের আরেকটা সাধারণ পরিণতি। আমাদের জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা ও পর্যবেক্ষণ পৃথিবীকে বিশ্বের কেন্দ্র থেকে সরিয়েছে, সরিয়েছে গ্যালাক্সির কেন্দ্র থেকে, সরাসরি প্রেরিত বিশেষ প্রাণের বিশ্বাস থেকে, অনড়তা থেকে; দাঁড় করিয়েছে মহাজাগতিক পথকে এবং বুঝিয়েছে লক্ষ–কোটি গ্রহের একটিতে আমাদের বসবাস। এই বোধ আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি প্রসারিত করেছে, মানবিকতার বিকাশ ঘটিয়েছে—পৌরাণিক গ্রন্থগুলোতে বর্ণিত অনড়তা ও অনন্যতা থেকে আমরা এখন অনেক দূরে, যদিও তার ভয়াবহ উন্মাদনা থেকে নয়।

লেখক: বিজ্ঞানবক্তা