মহাকাশ
পৃথিবী পড়ে যায় না কেন
ছোটদের জন্য সহজ ভাষায় লেখা কঠিন। সহজ কথা যে যায় না বলা সহজে! অথচ একদম সহজ-সাবলীল ভাষায় লেখা এই বই। টেলিস্কোপ কী বলে নামের এ বই সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের রাদুগা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয় ১৯৮৬ সালে। পাভেল ক্লুশান্ৎসেভের লেখা বইটি রুশ থেকে অনুবাদ করেছেন অরুণ সোম। এ বইয়ে প্রচুর ছবি আছে। সেগুলো এঁকেছেন ইয়ে. ভোইশ্ভিল্লো, ব. কালাউশিন, ব.স্তারোদুব্ৎসেভ এবং ইউ. কিসিলিওভ। বিজ্ঞানচিন্তার পাঠকদের জন্য ধারাবাহিকভাবে বইটি প্রকাশিত হচ্ছে…
একটা বল হাতে তুলে হাতের মুঠি ছেড়ে দাও। বলটা সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে এসে পড়বে। বাতাসে তো আর ঝুলে থাকতে পারে না, তাই না? কোনো না কোনো অবলম্বন তার থাকা দরকার। হয় মেঝেতে পড়ে থাকবে, নয় পানিতে ভাসবে, নয়তো সুতোয় ঝুলবে।
পৃথিবীতে সব কিছুই কিছু না কিছু অবলম্বন করে থাকে। যদি অবলম্বনের কিছু না থাকে তাহলে নিচে পড়ে যায়।
তোমরা বলবে, সত্যি নয়। গ্যাস-বেলুন অথবা হালকা ফেঁসো তো মাটিতে নাও পড়তে পারে? ঠিক কথা। শুধু তা-ই নয়, তারা ওপরেও উঠতে পারে। কিন্তু তার একমাত্র কারণ এই যে গ্যাস-বেলুন ও ফেঁসো বাতাসে ভর দিয়ে থাকতে পারে। তারা এতই হালকা যে বাতাসে ভাসে, যেমন কাঠের টুকরো পানি ভর্তি একটা পাত্রে ভাসতে পারে। পাত্র থেকে পানি ফেলেই দেখো না, কাঠের টুকরোটাও সঙ্গে সঙ্গে তলায় এসে ঠেকবে। বাতাসের ক্ষেত্রেও তাই। পৃথিবী থেকে সব বাতাস যদি সরিয়ে নেওয়া সম্ভব হতো তাহলে যে সব বস্তু বাতাসে ভাসে, সেগুলো সব এসে ঠেকত বায়ুসমুদ্রের তলদেশে। সোজা ভাষায় পৃথিবীর বুকে। গ্যাস-বেলুন, ফেঁসো সবই নিচে এসে পড়ত। পাখিরা উড়তে পারত না, অ্যারোপ্লেনও পারত না। এর কারণ তারাও বাতাসে ভর করে আছে।
ভর দেওয়ার মতো কিছু না থাকলে পৃথিবীর যেকোনো জিনিস নিচে পড়ে যায়। কিন্তু মহাকাশে কোনো অবলম্বন নেই। মহাকাশ শূন্য। ভূমণ্ডল সেখানে শায়িত থাকতে পারে না, ভেসে বেড়াতেও পারে না।
কী করে আমাদের পৃথিবীর মতো, চন্দ্র-সূর্য-তারার মতো এত বিশাল ভারী জিনিস কোনো কিছুকে অবলম্বন না করে শূন্যে থাকতে পারে?
ভূমণ্ডল পড়ে না কেন?
পড়ে না? কে তোমাদের এ কথা বলল?
আসল কথা তো এখানেই! পৃথিবী আমাদের নিয়ে সবসময় পড়ছে, উড়ছে, উড়তে উড়তে গিয়ে নেমে যাচ্ছে একটা অতল খাদের ভেতরে।
কিন্তু এ কী রকম কথা? কোথাও পড়ে যাচ্ছে এমন একটা গোলকের ওপর বসে থাকা তো ভয়ের কথা। পড়ে যাওয়া মানেই শেষ পর্যন্ত কিছু একটার গায়ে আছাড় খাওয়া।
আলমারি সোফাকে নিজের দিকে আকর্ষণ করে, কিন্তু সে আকর্ষণ এতই ক্ষীণ যে কস্মিনকালে সোফাকে স্থানচ্যুত করা তার সাধ্য হবে না।
পৃথিবী তাহলে কোথায় পড়ে? কোথায় গিয়ে তার আছড়ে পড়ার কথা? এসো ভেবে দেখা যাক, মোটের ওপর সব জিনিস কোথায় গিয়ে পড়ে।
কোথায় আবার? নিচে! আর নিচ কোথায়?
এ আবার কী অদ্ভুত প্রশ্ন! নিচে, মানে নিচে।
আচ্ছা এসো দেখি, গোটা পৃথিবীটাকে একবার এঁকে দেখা যাক। পৃথিবী কি গোলক? হ্যাঁ, গোলক। এই গোলকটার ওপর সর্বত্র লোকজনের বাস? তা বৈকি।
এখন আমরাও সব দিক থেকে ভূমণ্ডলের ওপর আঁকলাম চারটি ছেলে। ওদের চারজনের প্রত্যেকেরই বল পৃথিবীর বুকে এসে পড়বে। ওরা চারজনই বলবে যে ওদের বল নিচে পড়েছে। কেবল একটা ছেলের বল নিচে পড়েছে। কেবল একটা ছেলের বল ‘নিচে’ পড়ার সময় আমাদের ছবি অনুযায়ী বাস্তবিকই নিচে এসে পড়েছে। দ্বিতীয় ছেলেটির বল আমাদের ছবির পৃষ্ঠায় উড়ে গিয়ে পড়েছে ডান দিকে। তৃতীয়জনের বাঁ দিকে, আর চতুর্থজনের নিচে তো পড়েইনি, উঠে গেছে ওপরে।
আবার পৃষ্ঠাটাকে উল্টে দিলে চতুর্থজনের বল পড়বে নিচে, আর প্রথমজনেরটা উড়ে যাবে ওপরে।
তার মানে ‘নিচ’ হতে পারে নিচ থেকে, পাশ থেকে, ওপর থেকে—যেখানে খুশি।
‘নিচ’ অর্থ পৃথিবী, ভূমণ্ডল।
চুম্বক যেমন লোহার পেরেক আকর্ষণ করে ভূমণ্ডলও তেমনি চারপাশের সবকিছু আকর্ষণ করে নিজের দিকে। সত্যি বলতে, কেবল ভূমণ্ডলই যে এমন লোলুপস্বভাবের তা বলা যায় না। বস্তুমাত্রেই পরস্পরকে আকর্ষণ করে। কিন্তু তাদের শক্তি বড়ই কম।
আলমারি সোফাকে নিজের দিকে আকর্ষণ করে, কিন্তু সে আকর্ষণ এতই ক্ষীণ যে কস্মিনকালে সোফাকে স্থানচ্যুত করা তার সাধ্য হবে না। এমনকি একটা বলকেও নড়ানোর সামর্থ্য তার নেই।
বাড়ি আকর্ষণ করে আলমারিকে। কিন্তু তারও ক্ষমতা নেই আলমারিকে স্থানচ্যুত করে। পাহাড় আকর্ষণ করে বাড়িকে। কিন্তু পাহাড়েরও ক্ষমতা নেই বাড়িকে একচুল নড়ায়।
কিন্তু ভূমণ্ডলে আকর্ষণশক্তি এদের সবকিছুর চেয়ে বেশি, এদের সবকিছুকে সে এত জোরে আকর্ষণ করে যে সঙ্গে সঙ্গে লক্ষ না করে পারা যায় না। ভূমণ্ডল আলমারিকে এত জোরে টেনে ধরে রেখেছে যে আলমারি এক জায়গা আরেক জায়গায় সরানোর চেষ্টা করেই দেখো না কেন! তোমরা বলবে ভারী—তাই তো? আর ‘ভারী’—এর অর্থই হলো ‘পৃথিবী জোরে টেনে রেখেছে’।
হঠাৎ যদি ভূমণ্ডল আর ওপরকার সমস্ত বস্তুর ওপর নিজের টান ছেড়ে দেয় তাহলে আলমারি মেঝে থেকে ওপরে উঠতে থাকত, ঘরের মধ্যে ভেসে বেড়াত, যেমন অ্যাকোয়ারিয়ামের মধ্যে ভেসে বেড়ায় মাছের খাবারের কুচি। আর সে ক্ষেত্রে আলমারি ভারী না হয়ে হতো গ্যাস বেলুনের মতো হালকা।
র্য হলো খুঁটি, আর পৃথিবী মানে তোমরা। পৃথিবী যদি এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকত, তাহলে সোজা পড়তে থাকত সূর্যের দিকে।
এভাবে বস্তুমাত্রই পরস্পরকে আকর্ষণ করে। কিন্তু টানাটানির খেলায় যার শক্তি বেশি, যে বেশি বড়, তারই জিত হয়। আর যে ছোট, তুলনায় দুর্বল, সে উড়ে আসে শক্তিমানের দিকে, বড়র দিকে তার ওপর এসে পড়ে। এই কারণে ছোট সর্বদা বড়র ওপর পড়ে।
এবারে ফিরে আসা যাক সেই প্রশ্নে, মহাকাশে পৃথিবী নিজে কোথায় পড়ছে?
চাঁদের ওপরে? না, চাঁদ পৃথিবীর চেয়ে ছোট। তারার ওপরে? তারারা বড় বেশি দূরে? হ্যাঁ, তা ছাড়া কী? ছোট সব সময় বড়র ওপর পড়ে। আমাদের বিশাল পৃথিবী সূর্যের তুলনায় একদম ছোট।
এই কারণে পৃথিবী সূর্যের ওপর পড়ছে।
কিন্তু এ যে ভয়ানক ব্যাপার! সূর্য হলো একটা অগ্নিপিণ্ড। এর অর্থ, আমাদের পৃথিবী শিগগিরই সূর্যের গায়ে আছড়ে পড়বে, আগুনের সমুদ্রে ডুবে যাবে? আমরা চুল্লির মধ্যে পুড়ে মরব? ভয় পেয়ো না। পড়া মানেই কিছুর গায়ে আছড়ে পড়া নয়। পাশ কাটিয়েও পড়া যায়।
খুঁটির মাথায় ঘুরন্ত চক্রের সঙ্গে বাঁধা দড়ি ধরে দৌড়ানোর এক রকম খেলা আছে। খেলেছ কি? যদি খেলে থাকো তাহলে নিশ্চয়ই জানো যে খুঁটি থেকে খানিকটা দূরে সরে গিয়ে স্রেফ যদি এক জায়গায় দাঁড়িয়ে দুই পা গোটাতে যাও তাহলে কী হবে? ছিটকে গিয়ে সোজা পড়বে খুঁটির গায়ে, যেন খুঁটি তোমাকে টানছে। কিন্তু প্রথমে যদি ছুটে একপাশে সরে গিয়ে তারপর দুই পা গুটাও? তাহলে খুঁটির পাশ কাটিয়ে উড়ে যাবে।
ওভাবে যদি ভন ভন করে ঘুরতে থাকো তোমার কেবলই মনে হতে থাকবে যেন খুঁটিটা তোমাকে তার দিকে টানছে। এই কারণে তোমার ওড়াটা সরলরেখায় হয় না, তুমি বারবার খুঁটির দিকে বাঁক নাও, তার দিকে এসে পড়ো। কিন্তু যেহেতু দ্রুত উড়তে থাকো, তাই বাঁকটা আকস্মিক না হয়ে গড়ানে হয়। সেই কারণেই কখনও খুঁটির গায়ে গিয়ে পড়ো না, তার পাশ কাটিয়ে উড়ে যাও, তাকে প্রদক্ষিণ করে তার চারপাশে ঘুরতে থাকো।
মহাকাশেও অনেকটা এই রকম ঘটে। সূর্য হলো খুঁটি, আর পৃথিবী মানে তোমরা। পৃথিবী যদি এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকত, তাহলে সোজা পড়তে থাকত সূর্যের দিকে।
কিন্তু আসল ঘটনা এখানেই যে পৃথিবী এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে না। পৃথিবী এক পাশে ছুটে যায় ঠিক যেন গতিবেগ অর্জনের উদ্দেশ্যে, যাতে সূর্যের পাশ কাটিয়ে দূরে কোথাও চলে যাওয়া যায়। সূর্য তাকে নিজের দিকে টানে। পৃথিবীও সূর্যের দিকে ঘোরে। কিন্তু ঘোরে আস্তে আস্তে গড়ানোর ভঙ্গিতে, যেহেতু ওড়ে খুব দ্রুত। এই কারণেই সূর্যের কাছাকাছি আসে না, স্রেফ তাকে প্রদক্ষিণ করে তার চারপাশ দিয়ে ঘুরে যায়। ঠিক ওই খুঁটির চারপাশে দড়ি ধরে ঘোরার মতো। কেবল মাঝে মাঝে তোমাকে দুই পায়ে নিচের জমিতে ঠেলা মারতে হবে, যাতে গতি থেমে না যায়। তার কারণ এই যে খুঁটির ওপরকার চাকাটা ভালোমতো ঘোরে না, ঘষটা খায়। মুখে বাতাসের ঝাপটা লাগে, তোমাকে থামিয়ে দেয়। কিন্তু মহাকাশে পৃথিবীর গতি রুদ্ধ করার মতো কিছু নেই। সেখানে প্রতিকূল বায়ুপ্রবাহ নেই, চাকায় বাঁধা দড়ি নেই, নেই খরখরে পথ। মোটকথা, কিছুই নেই সেখানে। কোনো এককালে পৃথিবী ছিটকে এক পাশে সরে যায়, এর বেশি আর কিছু দরকার হয় না। তারপর থেকে আজ কোটি কোটি বছর ধরে পৃথিবী সূর্যের চারপাশে ঘুরছে তো ঘুরছেই, থামতে আর পারে না।
তোমরা কখনও লক্ষ করে দেখেছ কি কোনো জাহাজ যখন আমাদের কাছ থেকে দূরে, দিগন্ত রেখার গায়ে, তখন সমুদ্রের বুকে সেটা কেমন গুটি গুটি এগিয়ে আসতে থাকে?
ওই একইভাবে চাঁদও ঘুরছে মহাকাশে। তবে সে সূর্যের চারধারে ঘুরছে না, ঘুরছে পৃথিবীর চারধারে। পৃথিবী চাঁদের চেয়ে অনেক বড়। তাই চাঁদও পড়ছে তার চেয়ে বড় আমাদের এই পৃথিবীর দিকে, কিন্তু পড়তে পড়তেও পড়ছে না, কেবলই তার পাশ দিয়ে উড়ে যাচ্ছে। কারণ এই যে চাঁদও দ্রুত এক পাশে ছুটে চলে যায়, তাই তার পক্ষেও আকস্মিক বাঁক নেওয়া কঠিন। তাহলে দাঁড়াচ্ছে এই যে মহাকাশে চন্দ্র-সূর্য-গ্রহ-তারা কারোরই কোনো অবলম্বন নেই, সবই কোথাও না কোথাও পড়তে যাচ্ছে, কিন্তু পড়েছে পাশ কাটিয়ে। আর এই কারণে তারা সবাই ঘুরছে, ঘুরছে তো ঘুরছেই। চাঁদ ঘুরছে পৃথিবীর চারপাশে। আর পৃথিবী ঘুরছে সূর্যের চারপাশে।
কিন্তু পৃথিবী ও চাঁদের মতো সূর্যও এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে না। সূর্য তারাদের মধ্য দিয়ে অতল গহ্বরের মধ্যে কোথাও গিয়ে পড়তে যাচ্ছে। এদিকে তারারা নিজেরাও ভাসছে শূন্যতার মধ্যে।
না, মহাকাশে এমন কোনো জ্যোতিষ্কমণ্ডলী নেই, যে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। সকলেই কোথাও না কোথাও ছুটছে। ভাগ্য ভালো বলতে হবে যে মহাকাশে জায়গার কোনো অভাব নেই।
কিন্তু অবাক কাণ্ড! আকাশের দিকে তাকালে মনেই হবে না যে জ্যোতিষ্কমণ্ডলী উড়ছে। চাঁদের কথাই ধরো না কেন? তাকে দেখলে মনে হবে যেন আকাশের গায়ে সাঁটা। এ রকম মনে হওয়ার কারণ এই যে চাঁদ আমাদের কাছ থেকে অনেক দূরে অবস্থান করছে।
তোমরা কখনও লক্ষ করে দেখেছ কি কোনো জাহাজ যখন আমাদের কাছ থেকে দূরে, দিগন্ত রেখার গায়ে, তখন সমুদ্রের বুকে সেটা কেমন গুটি গুটি এগিয়ে আসতে থাকে? অথচ জাহাজ কিন্তু তখন ঢেউ ভেঙে প্রচণ্ড বেগে ছুটছে, এতে বেগে যে তার সঙ্গে ছুটে তুমি পাল্লা দিতে পারবে না। আবার দূর আকাশের গায়ে কোনো অ্যারোপ্লেনকে যখন একটা ছোট্ট বিন্দুর মতো দেখায় তখন তার গতি কী মন্থর বলেই না মনে হয়!
আকাশে চাঁদ উড়ছে অ্যারোপ্লেনের চার গুণ বেগে। ধারণা করতে পারো, আমরা যদি তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতাম, কী প্রচণ্ড বেগে সে আমাদের পাশ দিয়ে ছুটে বেরিয়ে যেত? অথচ দূর থেকে দেখলে মনে হয় কষ্টেসৃষ্টে গুড়ি মেরে চলেছে। এটা লক্ষ করা যায় কেবল তার প্রতিবেশী ছোট ছোট তারাদের দিয়ে।
চাঁদের তুলনায় তারারা আমাদের চেয়ে বহু গুণ বেশি দূরে। এই কারণে তাদের একেবারে স্থির মনে হয়, যদিও আসলে কিন্তু চাঁদের চেয়ে তারা অনেক বেশি দ্রুতগতিতে ওড়ে।