মহাশূন্যে বুদবুদ

মহাশূন্যে কি বাবল তৈরি করা সম্ভব?ছবি: কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সহায়তায় তৈরি

বাবল বা বুদবুদ খুব মজার জিনিস। হবে নাই-বা কেন? সাবান-পানি, একটুখানি বাতাস আর একটা স্ট্র (নল)! এই তিনটা জিনিস হলেই বুদবুদ বানানো যায়। প্রায় স্বচ্ছ দেখতে এসব বাবল বাতাসে ভেসে বেড়ায়। দেখতে দারুণ লাগে। আবার কিছুর ছোঁয়া লাগলেই—ফটাস! ফেটে আবার মিলিয়ে যায় বাতাসে। কিছু সময় পরে অবশ্য ফেটে যায় এমনিতেও। মোট কথা, বেশি সময় থাকে না। তারপরও বাবল বা বুদবুদ মজার জিনিস। ছোটবেলায় আপনিও হয়তো নানা কায়দায় এই বাবল বানিয়ে খেলেছেন।

নানা কায়দা বলছি, কারণ সাবান-পানি ছাড়াও বাবল বানানো যায়। ছোটবেলায় যাঁরা গ্রামে বড় হয়েছেন, তাঁরা জানেন, ঘাসের কাণ্ড আর বন তুলসী বা বন মরিচ গাছের কষ দিয়ে বাবল তৈরি করা যায়। গুল্মজাতীয় উদ্ভিদ এই বন তুলসী। এর বৈজ্ঞানিক নাম, ক্রোটন বনপ্ল্যান্ডিয়ানাস (Croton bonplandianus)। এর কচি ডাল ভাঙলে একধরনের কষ বেরোয়। এই কষ অনেকটা সাবান-পানির মতো ঘন ও পিচ্ছিল। ঘাসের কাণ্ডে গিঁট দেওয়ার সময় গিঁটের মাঝে কিছুটা ফাঁক রাখতে হয়। তারপর ফাঁকা জায়গাটুকু ভরে ফেলতে হয় বন তুলসীর কষ দিয়ে। এরপর কায়দা করে গিঁটের একপাশ থেকে ফুঁ দিলেই নানারকম বাবল বেরোয় সামনে দিয়ে। এবারে একটু সতর্কবার্তা দিয়ে দিই (ইংরেজিতে যাকে বলে ডিসক্লেইমার)। বন তুলসীর কষ ভীষণ তিতকুটে। সাবান-পানির মতোই, চোখে গেলে প্রচণ্ড জ্বালাপোড়া শুরু হয়। তাই এ নিয়ে খেলার সময় খুব সাবধান থাকা উচিত।

বন তুলসী
ছবি: উইকিমিডিয়া

বন তুলসীর কষ হোক আর সাবানের ফেনা—যা দিয়েই বাবল তৈরি করা হোক না কেন, একই ঘটনা ঘটে। অর্থাৎ পেছনের বিজ্ঞানটা এক।

বিশেষ ধরনের রাসায়নিক গঠনের কারণে এসব উপাদানের মধ্য দিয়ে বাতাস পেরোতে পারে না। ফলে যখন ফুঁ দেওয়া হয়, তখন অল্প পরিমাণ বাতাসের চারপাশে উপাদানগুলো (সাবান-পানি বা বন তুলসীর কষ) একটা পাতলা আবরণ তৈরি করে। বাতাস প্রায় সবদিকে সমান চাপ দেয়। তাই ঘাসের গিঁট বা স্ট্র-এর মুখ গোলাকার হলে বাবলগুলো প্রায় সুষম গোলক হয়। এর পেছনে খুব মজার একটা পদার্থবিজ্ঞানের নীতি কাজ করে। বায়ুচাপ।

বাতাস যে নানা রকম অণু-পরমাণু দিয়ে তৈরি, এটা তো আমরা জানি। শুধু বাতাস কেন, সব গ্যাসই অণু-পরমাণু দিয়ে তৈরি। তবে কঠিন বা তরল পদার্থের মতো অণুগুলো এখানে একে অন্যের খুব একটা কাছে থাকে না। একটু দূরত্ব বজায় রেখে ছোটাছুটি করতে থাকে। একটা অন্যটাকে ক্রমাগত ধাক্কাতে থাকে। ফলে আবদ্ধ জায়গায় একধরনের চাপ তৈরি হয়।

সাবান-পানিতে তৈরি বুদবুদ
ছবি: উইকিমিডিয়া
একেবারে শূন্য মহাকাশে বাবল তৈরি করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। কারণ সেখানে বাতাস নেই। তাই বাইরে বাতাসের চাপও নেই। ফলে, আপনি যতো কায়দা করেই ফুঁ দেন না কেন, বাবল তৈরি হবে না

ওদিকে বায়ুমণ্ডলের নিজস্ব একটা চাপ থাকে। পৃথিবীর মহাকর্ষের কারণে বায়ুমণ্ডল ভূপৃষ্ঠের ওপরের বেশ অনেকটা অঞ্চলজুড়ে আবদ্ধ। বলা যায়, পৃথিবীকে ঘিরে রেখেছে চারপাশ থেকে। মহাকর্ষের কারণেই এটি এ জায়গায় রয়েছে, মহাশূন্যে মিলিয়ে যাচ্ছে না। ফলে বিপুল পরিমাণ বায়ুর একটা চাপ তৈরি হয়। ভূপৃষ্ঠের প্রতি ইঞ্চি জায়গার ওপর এই চাপের পরিমাণ প্রায় সাড়ে ৬ কেজি!

আমরা মুখের বাতাস দিয়ে যে বাবল ফোলাই, তার ভেতরের চাপটাও এমন। আসলে বাবলের ভেতরে বাতাসের অণুর ছোটাছুটি বা চাপ, বাইরের বাতাসের চাপের সমান থাকলেই কেবল বাবল তৈরি হয়। যতক্ষণ চাপ সমান থাকবে, ততক্ষণ পাতলা আবরণ না ভেঙে দিলে ওভাবেই থাকবে। অর্থাৎ বুদবুদ তৈরির জন্য ভেতরের বাতাস যতটা গুরুত্বপূর্ণ, বাইরের বাতাসও তা-ই। দুইয়ের মধ্যে চাপে অসামঞ্জস্যতা হলে আর বাবল তৈরি করা যাবে না। ভেঙে যাবে।

এবার মূল আলোচনায় আসা যাক। মহাকাশে বাবল তৈরি করা যাবে কি না। উত্তরটা একটু জটিল। হ্যাঁ-না দুটোই হবে!

একেবারে শূন্য মহাকাশে বাবল তৈরি করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। কারণ সেখানে বাতাস নেই। তাই বাইরে বাতাসের চাপও নেই। ফলে, আপনি যতো কায়দা করেই ফুঁ দেন না কেন, বাবল তৈরি হবে না। ফুঁ দিতে পারবেন কি না, সেটাও আরেকটা প্রশ্ন। কারণ, মহাশূন্যে কোনোকিছু থেকে বাতাস বেরোনোর সুযোগ পেলে এমনিতেই বেরিয়ে যায়। জোর করে বের করার কোনো সুযোগ নেই।

শূন্য মহাকাশে তৈরি করা না গেলেও, মহাকাশযানের ভেতরে বাতাসময় পরিবেশে কিন্তু বাবল বানানো সম্ভব। শুধু সম্ভবই না, খুব ভালোভাবে সম্ভব

শূন্য মহাকাশে তৈরি করা না গেলেও, মহাকাশযানের ভেতরে বাতাসময় পরিবেশে কিন্তু বাবল বানানো সম্ভব। শুধু সম্ভবই না, খুব ভালোভাবে সম্ভব। কারণ, ওই একটাই। মহাকাশযানের ভেতরে বায়ুচাপ পৃথিবীর মতোই থাকে। তাই বাবল বুঝতেই পারবে না যে মহাশূন্যে আছে, না পৃথিবীতে। ওর শুধু বাইরের চাপ আর ভেতরের চাপ সমান হওয়া দরকার। সেটা মহাকাশযানের ভেতরের পরিবেশে ঠিক থাকে। পাশাপাশি পৃথিবীর মতো শক্তিশালী মহাকর্ষ বল না থাকায় মহাকাশযানের ভেতরে বাবল খুব একটা গতি পাবে না। তা ছাড়া, মহাকর্ষের কারণে বাবলের পর্দার তরল সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিচের অংশে জমা হয়, ওপরের অংশ হালকা হয়ে ফেটে যায়। মহাকাশযানের মাইক্রোগ্র্যাভিটিতে (অর্থাৎ পৃথিবীর মহাকর্ষের অবদান সেখানে নিতান্ত অল্প হওয়ায়) সে ভয়ও প্রায় নেই বললেই চলে। ফলে, একটু বেশি সময় সেটা ঠিক থাকবে। এ জন্যই বলছিলাম, পৃথিবীর চেয়ে মহাশূন্যে বাবল তৈরি করাটা আরও বেশি মজার।

লেখক: প্রদায়ক, বিজ্ঞানচিন্তা

সূত্র: সায়েন্স ফোকাস, উইকিপিডিয়া