সৌরগ্রহেরা আকারে কে কেমন

ছোটবেলায় বারের নামের সঙ্গে সৌরজগতের অধিবাসীদের নাম মিলে যাওয়া দেখে আনন্দ হতো বেশ। রবি-সোম বাদ দিলে বাকি পাঁচটা-ই তো গ্রহ! রবি মানে যে সূর্য, সে কথাও নিশ্চয়ই সবাই জানেন। হয়তো এ-ও জানেন, সোম মানে চাঁদ। বড় হয়ে জেনেছি এর পেছনের রহস্য। ইংরেজিতে সপ্তাহের বারের নামগুলো এসেছে আসলে গ্রহের নাম থেকেই। এসব গ্রহের নাম আবার এসেছে রোমান কিংবদন্তীর বিভিন্ন দেবতার নামের সঙ্গে মিল রেখে। সে যা-ই হোক, বেচারা প্লুটোর গ্রহত্ব বাতিল হয়ে যাওয়ার পর সৌরজগতের গ্রহের সংখ্যা বর্তমানে আট। পাঁচটা পাঁচ বারের নামে, বাকি তিনটা হলো ইউরেনাস, নেপচুন…আর? হ্যাঁ ঠিক ধরেছেন, পৃথিবী! নিজেকেও গোণায় ধরতে হবে তো!

মহাজাগতিক স্কেলে পৃথিবীকে বলা হয় ‘ম্লান নীল বিন্দু’। কার্ল সাগানের একটি উক্তি থেকে খ্যাতি পেয়ে যাওয়া ইংরেজি শব্দাংশটুকু হলো ‘পেইল ব্লু ডট’। যার সরল বাংলা ওটা। অথচ সৌরজগতের অন্যান্য গ্রহদের তুলনায় পৃথিবী কিন্তু এত ক্ষুদ্র নয়। অতি বড়ও নয়। ঠিক মধ্যমপন্থার! 

পৃথিবীর তুলনায় বুধ গ্রহের আকার
পৃথিবীর তুলনায় শুক্র গ্রহের আকার

সৌরজগতের ৮টা গ্রহের মধ্যে ৪টা পাথুরে। ইংরেজিতে বলে টেরেস্ট্রিয়াল প্ল্যানেট। পাথুরে মানে, এর কেন্দ্র বা মাঝের মূল অংশটা পাথুরে। আপনি জানেন, তবু আবারও বলে রাখি, আমরা থাকি পৃথিবীর ওপরে। আর এর ভেতরটা মূলত পাথুরে—সেজন্যই অমন নাম। বাকি তিনটা পাথুরে গ্রহ হলো বুধ, শুক্র আর মঙ্গল।

মঙ্গল থেকেই শুরু করা যাক। লাল এই গ্রহটির ব্যাস ৬ হাজার ৭৭৯ কিলোমিটার। আর পৃথিবীর ব্যাস ১২ হাজার ৭৪২ কিলোমিটার। তার মানে, মঙ্গল আসলে পৃথিবীর অর্ধেক। শুধু ব্যাস নয়, ভরের দিক থেকেও এটি অনেক ছোট। এর ভর পৃথিবীর ভরের মাত্র ১১ শতাংশ। আপনি যদি মঙ্গলপ্রেমী হন, দুঃখ পাবেন না। অন্তত একটি দিকে এগিয়ে আছে এটি। পৃথিবীর উপগ্রহ কেবল একটি—চাঁদ। মঙ্গলের উপগ্রহ এর দ্বিগুণ, মানে ২টি! ফোবোস আর ডিমোস (না, ডিম না। ডিমের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্কও নেই!)।

বুধের কথা যদি বলি, ৪ হাজার ৮৭৯ কিলোমিটার ব্যাসের এই গ্রহটির প্রস্থ মোটামুটি অতলান্তিক মহাসাগরের মতো। মেগামাইন্ডের মতো কোনো ভিলেন যদি একে অতলান্তিকের বুকে টাইটানিকের মতো ঠেসে দিতে চায়, তাহলে খুব অবাক হওয়ার কিছু নেই। পৃথিবীর সঙ্গে যদি তুলনা করি, তাহলে ১৮টা বুধ এঁটে যাবে আমাদের ম্লান নীল বিন্দুর মতো এই গ্রহের ভেতরে। সৌরজগতের গ্রহ পরিবারের সবার ছোট হিসেবে বুধের অবস্থান তাই সূর্যের সবচেয়ে কাছে। ঠিক এর পরেই শুক্রের অবস্থান। ব্যাস মঙ্গলের মতোই, ৬ হাজার ৫১ কিলোমিটার। তবে ভর কিন্তু বেশ। পৃথিবীর ভরের প্রায় ৯০ শতাংশের মতো।

পৃথিবীর তুলনায় মঙ্গল গ্রহের আকার
শনি গ্রহের তুলনায় পৃথিবীর আকার

পাথুরে ৪টি গ্রহ ছাড়া বাকি যে ৪টি আছে, তাদেরকে বলে দানবীয় গ্রহ। শনি, ইউরেনাস, নেপচুন আর বৃহষ্পতি। আসলেই এরা আকারে দানবের মতো। শয়ে শয়ে পৃথিবীর মতো গ্রহকে গিলে নিতে পারবে চট করে।

যেমন শনির কথাই ধরুন। ১ লাখ ২০ হাজার ৫৩৬ কিলোমিটার ব্যাসের এই দানব পৃথিবীর প্রায় ৯৬ গুণ ভারী। এর মাঝে এঁটে যাবে প্রায় ৭০০ পৃথিবী। আর শনির বিশাল বলয়ের কথা যদি ধরি, বিলিয়নের বেশি পৃথিবীকে অনায়াসে বসিয়ে দেওয়া যাবে এর মাঝের জায়গাটুকুতে।

বৃহষ্পতির আরেক নাম গ্যাসদানব। ১ লাখ ৪২ হাজার ৯৮৪ কিলোমিটার ব্যাসের এই দানব সূর্যের পরে সৌরজগতে সবার বড়। পরিবারের বড় ভাই। এই ব্যাসটা অবশ্য বিষুবরেখা বরাবর। মেরুতে ব্যাস একটু কম, সে-ও ১ লাখ ৩৩ হাজার কিলোমিটারের বেশি! বেশি না, মাত্র ১৩শ পৃথিবীকে আঁটানো যাবে এর মাঝে।

বৃহপ্সতি গ্রহের তুলনায় পৃথিবীর আকার
নেপচুন গ্রহের তুলনায় পৃথিবীর আকার

গ্যাসদানব যেমন আছে, তেমনি বরফদানোও আছে সূর্যের এই ৮ গ্রহের পরিবারে। ইউরেনাস ও নেপচুন—দুটোই বরফদানো। ইউরেনাসের ব্যাস ৫১ হাজার ১১৮ কিলোমিটার। আর নেপচুনের ব্যাস ২৪ হাজার ৭৬৪ কিলোমিটার। এই দুই বরফদানো অবশ্য শত শত পৃথিবীকে গিলে নিতে পারবে না। তবু চাইলে গিলে নিতে পারবে যথাক্রমে ৬৩ এবং ৫৭টি করে পৃথিবীকে।

সবমিলে পৃথিবী সৌরজগতে অনন্য। বেশি বড়ও না, আবার অনেক ছোটও নয়। এর অবস্থানও খুব সুবিধাজনক জায়গায়। যাকে বলে গোল্ডিলকস জোন। সূর্যের খুব কাছেও না, অনেক দূরেও নয়। একটু কাছে হলেই সূর্যের তাপে বাষ্প হয়ে যেত এর সব সমুদ্রের পানি। একটু দূরে হলেই জমে যেত সব। পৃথিবী তখন বরফদানো হয়ত হতে পারত না, হয়ে যেত বরফ-বামন। আর বামন হলে কি পৃথিবী আর চাঁদকে ধরতে পারত?

এই লেখাটা লেখা বা পড়ার জন্য আমি-আপনিও তখন হয়তো এখানে থাকতাম না। সব মিলে বিষয়টা আমাদের জন্য ভালোই হলো, কী বলেন?

সূত্র: নাইন প্ল্যানেটস ডট অর্গ, উইকিপিডিয়া

লেখক: সহসম্পাদক, বিজ্ঞানচিন্তা