পঞ্চাশ বছর পর চাঁদের দুয়ারে

১৯৭২ সালের ১৯ ডিসেম্বর। মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার অ্যাপোলো ১৭ মিশনের নভোচারীরা ফিরে আসেন পৃথিবীতে। এর মাধ্যমে আপাত পর্দা নামে মানুষের চন্দ্রজয়ের গল্পের। ১৯৬৯ থেকে ১৯৭২ সালের মাঝের কয়েক বছরে চাঁদে নেমেছে ৬টি নভোযান, চাঁদের মাটিতে পা রেখেছেন ১২ জন মানুষ।

তারপর অতলান্তিক সাগর পাড়ি দিয়েছে অনেক জাহাজ। মানুষ মহাকাশ স্টেশন বানিয়েছে। ভয়েজার ১ ও ২ পেরিয়ে গেছে সৌরজগতের সীমানা। সূর্যের করোনা অঞ্চলে পৌঁছে গেছে পার্কার সোলার প্রোব। কৃষ্ণগহ্বরের ছবি তুলে ফেলেছে মানুষ। আর হালের জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ খুঁজে ফিরছে মহাবিশ্বের প্রথম আলো। অথচ গত ৫০ বছর আর কোনো মানুষের পা পড়েনি চাঁদে। কেন? এরকম একটি প্রশ্ন রয়েছে অনেকের-ই। আর্টেমিস ১-এর মহাকাশযাত্রার এ সময় প্রশ্নটি ফিরে আসছে আবারও, নতুন করে, নতুনভাবে। অথচ প্রশ্নটির উত্তর তেমন জটিল নয়। একটু ভাবলেই বোঝা যায় বিষয়টা।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর অসুস্থ এক স্নায়ুযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে মানবজাতি। একদিকে সমাজতান্ত্রিক রাশিয়া, অন্যদিকে পুঁজিবাদী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র—প্রযুক্তির যুদ্ধে কে কতদ্রুত এগিয়ে যেতে পারে, তা নিয়ে শুরু হয় প্রচণ্ড লড়াই। যে এগিয়ে যাবে, গোটা পৃথিবীর নেতৃত্ব চলে যাবে তার হাতে, এমনই ছিল সে সময়ের অবস্থা। যুক্তরাষ্ট্রকে টেক্কা দিয়ে ১৯৬১ সালের ১২ এপ্রিল প্রথম মানুষ হিসেবে পৃথিবীর বাইরে থেকে ঘুরে আসেন রাশান নভোচারী ইউরি গ্যাগারিন। ঠিক সেই মুহূর্তে রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র চন্দ্রজয়ের জন্য উঠে-পড়ে নামে। একের পর এক নভোযান পাঠাতে থাকে দেশদুটি। এই অসুস্থ স্নায়ুযুদ্ধে অবশেষে জিতে যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ১৯৬৯ সালে। সে বছরের ২০ জুলাই চাঁদের মাটিতে প্রথম মানুষ হিসেবে পা রাখেন মার্কিন নভোচারী নীল আর্মস্ট্রং।

পরের তিন বছরও এই উত্তেজনা টিকে ছিল। রাশিয়া অনেক চেষ্টা করেছে চাঁদে নভোচারী পাঠাতে। পারেনি। যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে তখন আরও পাঁচটি নভোযানে মোট দশজন নভোচারী পাঠিয়েছিল চাঁদে। তারপর স্তিমিত হয়ে আসে এই উত্তেজনা। তাছাড়া চাঁদে মানুষ পাঠাতে যে পরিমাণ খরচ পড়ে, সেই বাজেট মার্কিন সরকার অন্যান্য খাতে বিনিয়োগ করতে উৎসাহী হয়ে ওঠে। বিজ্ঞানীরাও কিছুদিন পর স্বয়ংক্রিয় রোবটিক নভোযান পাঠাতে শিখে ফেলেন। ফলে মানুষের নাজুক দেহ চাঁদের মাটিতে বয়ে নেওয়ার আর কোনো দরকার রইল না। সেজন্যই গত ৫০ বছরে আর কোনো মানুষ চাঁদে যাননি। নমুনা আনার জন্য রোবটিক নভোযান পাঠানো হয়েছে অনেকবার। সুস্পষ্ট ছবির জন্য আছে দারুণ সব কৃত্রিম উপগ্রহ। তাহলে প্রশ্ন আসে, এত বছর পরে আবার কেন?

আসলে, আর্টেমিস মিশনের মূল লক্ষ্য চাঁদে মানুষ পাঠানো নয়। বরং চাঁদের বুকে নভোচারী ও গবেষকদের ছোট কলোনি গড়ে তোলা, চাঁদের কক্ষপথে লুনার গেটওয়ে স্থাপন এবং এর সাহায্যে মঙ্গলে মানুষ পাঠানোই এই গবেষণা সংস্থার আসল উদ্দেশ্য। সেজন্যই নাসার সঙ্গে এক হয়েছে ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি (ইসা), জাপান অ্যারোস্পেস এক্সপ্লোরেশন এজেন্সিসহ (জাক্সা) পৃথিবীর ২১টি দেশের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর পাশাপাশি এলন মাস্কের স্পেস-এক্সের মতো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও কাজ করছে এই মিশনে।

সেই ২০০৫ সাল থেকে এ উদ্যোগ নিয়ে কাজ শুরু করে নাসা। নানা বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে অবশেষে আর্টেমিস ১ সত্যিই পৃথিবী ছেড়ে যাচ্ছে।

আর্টেমিস প্রোগ্রাম এ দশকের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মহাকাশ মিশন। এটি সফল হলে মানুষের পা পড়বে মঙ্গলে। এরকম রোমাঞ্চকর এক সময়ে আমরা বেঁচে আছি, ভাবলেই তো ভালো লাগে!

লেখক: সম্পাদনা দলের সদস্য, বিজ্ঞানচিন্তা

সূত্র: নাসা, উইকিপিডিয়া