চাঁদের অন্ধকার পাশ থেকে নমুনা নিয়ে ফিরল চীনের চাঙ-ই ৬

ক্যাপসুলটি নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বেইজিং শহরে

সম্প্রতি চাঁদের অন্ধকার অঞ্চল বা উল্টো পাশ থেকে নমুনা নিয়ে ফিরেছে চীনের নভোযান চাঙ-ই ৬। এখন পর্যন্ত এটাই চাঁদের সবচেয়ে দূরবর্তী অঞ্চল থেকে নমুনা নিয়ে ফেরার রেকর্ড। গত ২৫ জুন, মঙ্গলবার চাঙ-ই ৬ মিশনের চাঁদের নমুনা সংবলিত ক্যাপসুলটি মঙ্গোলিয়ার মরুভূমিতে অবতরণ করে। সেখান থেকে নমুনা পরীক্ষার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছে চীনের বেইজিংয়ে। 

চীনই একমাত্র দেশ, যারা চাঁদের এতটা দূরে মহাকাশযান পাঠিয়ে নমুনা সংগ্রহ করছে। তবে এটা প্রথম নয়। এর আগেও রাশিয়া (সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন), যুক্তরাষ্ট্র, এমনকি চীনও মহাকাশযান পাঠিয়ে নমুনা সংগ্রহ করেছে। ১৯৬৯-১৯৭২ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ৬টি অ্যাপোলো মিশনে চাঁদে পাঠিয়েছে ১২ নভোচারীকে। তারা চাঁদ থেকে অনেক নমুনা সংগ্রহ করে পৃথিবীতে নিয়ে এসেছেন। তবে সেগুলো সবই চাঁদের আলোকিত অংশের। অর্থাৎ চাঁদের যে দিকটি আমাদের দিকে রয়েছে, সে দিকের নমুনা। এই প্রথমবার চীন মানুষবিহীন নভোযানের সাহায্যে চাঁদের অন্ধকার অংশ থেকে নমুনা নিয়ে ফিরল পৃথিবীতে। সবচেয়ে বড় কথা, চাঁদের এত দূর থেকে এর আগে কোনো দেশই নমুনা আনতে পারেনি।

মঙ্গোলিয়ার মরুভূমিতে এসে অবতরণ করেছে চাঙ-ই ৬-এর ক্যাপসুল

চাঁদের যে পাশ থেকে চীন এই নমুনা সংগ্রহ করেছে, তা পৃথিবী থেকে দেখা যায় না। আসলে, আমরা সব সময় চাঁদের শুধু একটা পাশ দেখি। কারণ, চাঁদ ও পৃথিবী ‘টাইডাল লক’-এ আবদ্ধ। সহজ করে বলা যায়, চাঁদ পৃথিবীর চারপাশে একবার ঘুরে আসতে যে সময় নেয়, নিজ অক্ষরেখার চারদিকে একপাক দিতেও ঠিক একই সময় নেয়। সে জন্যই পৃথিবী থেকে সব সময় চাঁদের শুধু একপাশ দেখা যায়। অন্যপাশটি আমরা কখনোই দেখতে পাই না। 

চীনের এই নমুনা পরীক্ষায় কী পাওয়া যায়, তা নিয়ে জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের কৌতুহল বাড়ছে। বিজ্ঞানীদের ধারণা, চাঁদের উল্টো পাশে থাকতে পারে বরফের চিহ্ন। সত্যিই যদি সেখানে বরফ থাকে, তাহলে তা থেকে পাওয়া যাবে পানি, অক্সিজেন ও হাইড্রোজেন। মানুষের বসবাসের জন্য যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি এই নমুনা পরীক্ষা করে পৃথিবীসহ বাকি গ্রহগুলোর সৃষ্টি রহস্য জানা যাবে বলেও আশাবাদী বিজ্ঞানীরা। 

এর আগে ৩ মে, শুক্রবার চীনের হাইনান থেকে চাঙ-ই ৬ উৎক্ষেপণ করা হয়। ১ জুন এটি চাঁদের অ্যাপোলো ক্রেটার বা খাদে অবতরণ করে। রোবটিক হাতের সাহায্যে ওই খাদ থেকে নমুনা সংগ্রহ করে এটি। একটি স্কুপ ও ড্রিলের সাহায্যে চাঁদ থেকে প্রায় ২ কেজি নমুনা সংগ্রহ করেছে ল্যান্ডারটি। চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে অবস্থিত এই খাদ প্রায় ২ হাজার ৫০০ কিলোমিটার প্রশস্ত। 

চাঙ-ই ৬-এর নমুনা মডেল

চাঙ-ই ৬ চারটি মডিউল নিয়ে গঠিত। একটি চন্দ্রল্যান্ডার, একটি রিটার্ন ক্যাপসুল, একটি অরবিটার ও একটি আরোহী (ল্যান্ডার দিয়ে বহন করা একটা ছোট রকেট)। এই রিটার্ন ক্যাপসুল ২১ জুন সংগৃহীত নমুনা নিয়ে পৃথিবীতে যাত্রা শুরু করে, ২৫ জুন ফিরে আসে পৃথিবীতে।

প্ল্যানেটারি সোসাইটির মতে, এই নমুনা গবেষণা করে পৃথিবীতে প্রাণের উৎপত্তি ও বিকাশ সম্পর্কে আরও ভালোভাবে বোঝা যাবে। হয়তো পৃথিবী গঠনকালে যে গ্রহাণুগুলো পৃথিবীতে আছড়ে পড়েছিল, সেগুলোই পানি বহন করে এনেছিল পৃথিবীতে। 

চীনের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রও চাঁদ নিয়ে গবেষণা করছে। এ জন্য আর্টেমিস প্রোগ্রাম চালু করেছে তারা। ইতিমধ্যে এ প্রোগ্রামের ৩টি মিশনের প্রথমটি সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে।

চাঙ-ই ৬ চাঁদের উল্টো পাশে চীনের দ্বিতীয় মিশন। ২০১৯ সালে চাঙ-ই ৪ ছিল চাঁদের ওই অংশে চীনের প্রথম মিশন। সেই মিশনে চাঁদে একটা রোভার অবতরণ করেছিল, যা আজও সক্রিয় রয়েছে চাঁদের মাটিতে। তবে চাঁদের দূরবর্তী বা অন্ধকার অঞ্চলে এই মিশনই চীনের শেষ মিশন নয়। এরপর ২০২৬ ও ২০২৮ সালে যথাক্রমে চাঙ-ই ৭ ও চাঙ-ই ৮ পাঠানোর পরিকল্পনা রয়েছে দেশটির। চাঁদে ঘাঁটি স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় প্রযুক্তিগুলো ওই মিশনে পরীক্ষা করে দেখা হবে। ভবিষ্যতে হয়তো চীন চাঁদে বসতি স্থাপনের কথা ভাবছে। 

এখানে জানিয়ে রাখি, চীনের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রও চাঁদ নিয়ে গবেষণা করছে। এ জন্য আর্টেমিস প্রোগ্রাম চালু করেছে তারা। ইতিমধ্যে এ প্রোগ্রামের ৩টি মিশনের প্রথমটি সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে। আর্টেমিস ২ মিশন এই বছরের শেষদিকে বা ২০২৫ সালের শুরুতে চাঁদের কক্ষপথের উদ্দেশে যাত্রা করবে। আর আর্টেমিস ৩ মিশনে সরাসরি চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে অবতরণ করবে মানুষ। সেই মিশনে পুরুষ নভোচারীর পাশাপাশি থাকবেন একজন নারী নভোচারীও। 

দেখা যাচ্ছে, চাঁদে ঘাঁটি তৈরির জন্য অনেক দেশই তোড়জোড় শুরু করেছে। চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি ভারত ও রাশিয়াও রয়েছে এই কাতারে।

সূত্র: স্পেস ডট কম, বিবিসি ডট কম