বর্তমানে মহাকাশ গবেষণা ও স্যাটেলাইট প্রযুক্তির অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে পৃথিবীর কক্ষপথে ছড়িয়ে থাকা বিপুল পরিমাণ অচল স্যাটেলাইট ও মহাকাশ বর্জ্য। ইংরেজিতে বলা হয় স্পেস জাঙ্ক। এসব পুরোনো স্পেস জাঙ্ক বা বর্জ্য সব সময় অতি দ্রুত গতিতে পৃথিবীর চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এতে ক্ষতি হতে পারে বর্তমানে সচল থাকা স্যাটেলাইট, মহাকাশযান এমনকি আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনেরও।
পৃথিবীর নিম্ন ও উচ্চ কক্ষপথে এমন অনেক অচল স্যাটেলাইট, রকেটের ধ্বংসাবশেষ, ধাতব খণ্ড কিংবা অতি ক্ষুদ্র কণা আছে। সেগুলোর আকার ১ মিলিমিটার থেকে ১০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হয়। এর চেয়ে বড় কিছুও আছে। অনেক কণার মতো ক্ষুদ্র হলেও দ্রুত ছুটে চলার কারণে সেগুলোও ডেকে আনতে পারে মারাত্মক বিপদ।
ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি ইসার মতে, ২০২৫ সালের সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বর্তমানে পৃথিবীর কক্ষপথে ১২৮ মিলিয়নেরও বেশি স্পেস জাঙ্ক আছে। এর মধ্যে প্রায় ৩৬ হাজার ৫০০টি ১০ সেন্টিমিটারের চেয়ে বড়, ১০ লাখের বেশি মাঝারি আকারের এবং অতিক্ষুদ্র কণা রয়েছে ১২ কোটির বেশি। ভবিষ্যতের মহাকাশ মিশন পরিচালনায় এগুলো মারাত্মক প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে পারে।
কখন থেকে মহাকাশে এসব বর্জ্য জমতে শুরু করল? ১৯৫৭ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের স্পুটনিক-১ উৎক্ষেপণের মাধ্যমে সূচনা হয় মহাকাশ যুগের। এরপর ২০২৫ সাল পর্যন্ত পৃথিবীর কক্ষপথে প্রায় ১৪ হাজার ৯০০টি স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ১১ হাজার ৭০০টি স্যাটেলাইট সক্রিয়, কিন্তু বাকিগুলো অচল হয়ে পরিণত হয়েছে স্পেস জাঙ্কে। পুরোনো স্যাটেলাইটের নিয়ন্ত্রণ হারানো, সংঘর্ষ, বিস্ফোরণ, কিংবা যান্ত্রিক অংশ বিচ্ছিন্ন হওয়ার কারণে পৃথিবীর কক্ষপথে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন বর্জ্য তৈরি হচ্ছে।
এসব স্যাটেলাইটের বেশির ভাগই ইলন মাস্ক পরিচালিত স্পেসএক্সের স্টারলিংক প্রোগ্রামের আওতাভুক্ত। ২০২৫ সালের মে মাস পর্যন্ত সক্রিয় মোট স্যাটেলাইটের মধ্যে প্রায় ৭ হাজার ৪০০ স্যাটেলাইট রয়েছে স্টারলিংক প্রকল্পের। সক্রিয় মোট স্যাটেলাইটের প্রায় ৬০ শতাংশই এই প্রকল্পের আওতায়। যদিও একই সময়ে চীন, ভারত, রাশিয়া এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন অনেক স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করেছে, তবে এগুলোর বেশির ভাগই রয়েছে পৃথিবীর নিম্ন কক্ষপথে।
স্পেস জাঙ্কের সবচেয়ে বড় অসুবিধা হলো, এর বেগ। ২০১৬ সালে একটি ক্ষুদ্র কণা আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে আঘাত করে জানালায় ফাটল ধরিয়েছিল। তার আগে, ২০১৩ সালে, রাশিয়ার কসমস ও যুক্তরাষ্ট্রের ইরিডিয়াম স্যাটেলাইটের সংঘর্ষে শত শত নতুন স্পেস জাঙ্ক তৈরি হয়েছিল।
তবে সব অচল স্যাটেলাইট যে মহাকাশে রয়ে যায়, তা নয়। কিছু স্যাটেলাইটের আয়ু শেষ হলে সেগুলো পরিকল্পিতভাবে পৃথিবীতে ফিরিয়ে এনে প্রশান্ত মহাসাগরের নির্জন অঞ্চলে ফেলা হয়। একে বলা হয় স্যাটেলাইটের কবরস্থান বা পয়েন্ট নেমো। নাসার তথ্যমতে, ইতিমধ্যে এই অঞ্চলে শতাধিক স্যাটেলাইট ধ্বংস করা হয়েছে। তবে জানিয়ে রাখি, সব অচল স্যাটেলাইট এবং ক্ষতিকর স্পেস জাঙ্ক এভাবে নিয়ন্ত্রিতভাবে নামানো সম্ভব নয়।
বিজ্ঞানীরা হুঁশিয়ার করেছেন, যদি স্পেস জাঙ্কের পরিমাণ এভাবে বাড়তে থাকে, তাহলে পৃথিবীর কক্ষপথ একসময় ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়বে। এতে অদূর ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক যোগাযোগ, আবহাওয়া পূর্বাভাস, জিপিএস সিস্টেমসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ সেবা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হতে পারে।
তবে আশার কথা হলো, বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন মহাকাশ সংস্থা ও কোম্পানি স্পেস জাঙ্ক সমস্যা সমাধানে কাজ শুরু করেছে। ইসার ক্লিয়ারস্পেস-১ মিশনের মাধ্যমে ২০২৬ সালে প্রথমবারের মতো মহাকাশ থেকে পরীক্ষামূলকভাবে স্পেস জাঙ্ক সরানোর পরিকল্পনা রয়েছে। পাশাপাশি চীন রোবোটিক আর্ম ও জাল ব্যবহারের মাধ্যমে বর্জ্য সংগ্রহ প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছে। জাপান, ভারত এবং যুক্তরাষ্ট্রও এই সমস্যা সমাধানে প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনের পথে এগোচ্ছে।
অর্থাৎ, মহাকাশ এখন প্রযুক্তির বিস্ময় হলেও এর নিরাপদ ব্যবহার দিন দিন হুমকির মুখে পড়ছে। পৃথিবীর কক্ষপথ দ্রুত এক বিপজ্জনক বর্জ্যভাণ্ডারে পরিণত হচ্ছে। তাই প্রযুক্তি সমৃদ্ধ দেশগুলোকে সম্মিলিতভাবে কার্যকর নীতিমালা, আন্তঃরাষ্ট্রীয় সহযোগিতা এবং পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহার করে এই সংকট মোকাবিলায় কাজ করে যেতে হবে।