সৌরজগতের প্রান্তে নতুন বামন গ্রহের সন্ধান

সৌরজগতের একদম শেষ প্রান্তে, নেপচুনেরও পরে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা নতুন এক বামন গ্রহ খুঁজে পেয়েছেন। এর নাম দেওয়া হয়েছে ২০১৭ ওএফ২০১। জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের কাছে এটা সাধারণ আবিষ্কারের চেয়েও একটু বেশি। কারণ, এই সম্ভাব্য বামন গ্রহ যে শুধু মহাকাশের মানচিত্রে আরেকটি নতুন বস্তু যোগ করেছে, তা-ই নয়; বরং এটি বহুল আলোচিত ‘প্ল্যানেট নাইন’ বা ‘প্ল্যানেট এক্স’-এর অস্তিত্ব নিয়ে নতুনভাবে প্রশ্ন তুলছে। বিজ্ঞানীরা অনেকদিন ধরে সৌরজগতের নবম গ্রহটি খুঁজছেন। প্রশ্ন উঠছে, আসলেই কি সৌরজগতে নবম গ্রহ থাকা সম্ভব? 

যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সির প্রিন্সটনের ইনস্টিটিউট ফর অ্যাডভান্সড স্টাডির গবেষক সিহাও চেং ও তাঁর সহকর্মীরা প্রথম এই বস্তুর অস্তিত্ব খুঁজে পান চিলির ভিক্টর এম. ব্লাঙ্কো টেলিস্কোপের ডেটাবেস ঘেঁটে। ছবিতে উজ্জ্বল একটি বিন্দু নজরে আসে তাঁদের। সেই ছবি বিশ্লেষণ করে বোঝা যায়, এটি একটি বিশাল বরফঘেরা বস্তু।

এখানে জানিয়ে রাখি, আমাদের সৌরজগতে সূর্যকে ঘিরে অনেক গ্রহ, উপগ্রহ, গ্রহাণু, ধূমকেতু ঘোরে। গ্রহগুলো হলো বুধ, শুক্র, পৃথিবী, মঙ্গল, বৃহস্পতি, শনি, ইউরেনাস আর নেপচুন। নেপচুনের পরেই রয়েছে কুইপার বেল্ট নামে এক বরফরাজ্য। আসলে বরফ আর পাথরে তৈরি ছোট ছোট বিভিন্ন বস্তুর সমাবেশ এই অঞ্চলে। নতুন বামন গ্রহটিও এই কুইপার বেল্টের মধ্যেই আছে। 

বর্তমানে এটি পৃথিবী থেকে প্রায় ৯০.৫ অ্যাস্ট্রোনমিকাল ইউনিট দূরে আছে। পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্ব, অর্থাৎ ১৫ কোটি কিলোমিটার দূরত্বকে বলা হয় এক অ্যাস্ট্রোনমিকাল ইউনিট। সে হিসেবে, সূর্য থেকে পৃথিবীর যে দূরত্ব, নতুন আবিষ্কৃত বস্তুটি আছে তারচেয়ে প্রায় ৯০ গুণ দূরে! বস্তুটি প্রায় ৭০০ কিলোমিটার চওড়া। বামন গ্রহ প্লুটোর চেয়ে এটি ছোট হলেও বামন গ্রহের তকমা পাওয়ার মতো যথেষ্ট বড়। 

এই বামন গ্রহ ২৫ হাজার বছরে সূর্যকে একবার ঘুরে আসে। ফলে আমাদের দৃষ্টির নাগালে আসে খুব অল্প সময়ের জন্য।

তবে এই বামন গ্রহের কক্ষপথ একটু বেশি অদ্ভুত। বিজ্ঞানীরা কানাডা-ফ্রান্স-হাওয়াই টেলিস্কোপে গত ৭ বছরে তোলা ১৯টি ছবি বিশ্লেষণ করে দেখেছেন, এটি যখন সূর্যের সবচেয়ে কাছাকাছি আসে, তখন সূর্য থেকে এর দূরত্ব থাকে ৪৪.৫ অ্যাস্ট্রোনমিকাল ইউনিট বা সৌরজাগতিক একক। প্লুটোও প্রায় এই দূরত্বে থেকে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে। কিন্তু নতুন এই বামন গ্রহটি যখন সূর্যের সবচেয়ে দূরে থাকে, তখন সৌরজগতের বাইরে চলে যায়। তখন সূর্য থেকে এর দূরত্ব হয় প্রায় ১৬০০ অ্যাস্ট্রোনমিকাল ইউনিট। গবেষকদের ধারণা, হয়তো বড় কোনো গ্রহের সঙ্গে ধাক্কা লাগায় এর কক্ষপথ এমন অদ্ভুত হয়েছে।

অবশ্য এরকম অনেক দূরবর্তী বামন গ্রহ বা মহাকাশীয় বস্তুর কক্ষপথ প্রায়ই একদিকে ঝুঁকে থাকতে দেখা যায়। হয়তো এগুলোর আশপাশে লুকিয়ে আছে প্ল্যানেট এক্স। আর সেই অদৃশ্য গ্রহের প্রভাবে এসব বস্তুর কক্ষপথ এমন বাঁকানো। কিন্তু নতুন এই বামন গ্রহের জন্য সে কথাও খাটে না। এর কক্ষপথ একেবারেই আলাদা। এ ধরনের কক্ষপথকে বলে ব্যতিক্রম কক্ষপথ। যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক এরিতাস ইয়াং জানিয়েছেন, ‘এই বস্তুটি অন্যদের মতো একই দিকে বিন্যস্ত নয়। ফলে এর অস্তিত্ব প্ল্যানেট এক্সের অস্তিত্বকে আরও প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে।’

প্লুটোকে কেন্দ্র করে ২০১৭ ওএফ২০১ এবং সেডনার কক্ষপথ
উইকিপিডিয়া

গবেষকরা ২০১৭ ওএফ২০১ বামন গ্রহের কক্ষপথ নিয়ে কম্পিউটার সিমুলেশন চালিয়েছেন। যদি প্ল্যানেট ৯ সত্যিই থেকে থাকে, তাহলে ওই বস্তুটি কয়েক শ মিলিয়ন বছর পর সৌরজগৎ থেকে ছিটকে পড়বে। কিন্তু যদি প্ল্যানেট ৯ না থাকে, তাহলে এটি সৌরজগতেই রয়ে যাবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত সেসব তথ্য পাওয়া গেছে, তা মোটেও প্ল্যানেট এক্সের পক্ষে যায় না।

তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এখনো আসেনি। এ জন্য প্রয়োজন আরও অনেক তথ্য। এ ব্যাপারে সিহাও চেং বলেন, ‘আমি এখনো আশা করি প্ল্যানেট ৯ আছে। কারণ, সেটা আরও বেশি রোমাঞ্চকর হবে।’

এই বামন গ্রহ ২৫ হাজার বছরে সূর্যকে একবার ঘুরে আসে। ফলে আমাদের দৃষ্টির নাগালে আসে খুব অল্প সময়ের জন্য। আর যখন পৃথিবীর সবচেয়ে কাছে আসে, তখনো বস্তুটি এত অস্পষ্ট থাকে যে তা শনাক্ত করা বেশ কঠিন। 

এই কারণে বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন, এরকম আরও শত শত বস্তু হয়তো সৌরজগতের কিনারায় লুকিয়ে আছে। সেগুলো হয়তো এখনো আমাদের চোখে পড়েনি। তবে খুব শিগগিরই চালু হতে চলেছে ভেরা সি. রুবিন অবজারভেটরি। এই টেলিস্কোপ আরও গভীরভাবে মহাকাশ পর্যবেক্ষণ করবে। এতে হয়তো আরও  এমন অনেক অজানা বস্তু ধরা পড়বে। প্ল্যানেট নাইন বা প্ল্যানেট এক্স আদৌ আছে কি না, সে রহস্য ভবিষ্যতের জন্যই তোলা থাক।

সূত্র: নিউ সায়েন্টিস্ট