ধারাবাহিক
আকাশ পর্যবেক্ষকের খেরোখাতা-১
মহাবিশ্ব নিয়ে মানুষের বিস্ময়-আগ্রহ পুরকালের। পৌরনিক যুগ থেকেই প্রতিনিয়ত সমৃদ্ধ হয়ে চলেছে জ্যোতির্বিদ্যার জ্ঞানভাণ্ডার। আধুনিক যুগে এসে আমূলে বদলে গেছে মহাকাশ বিজ্ঞান চর্চার ইতিহাস। মানুষ এখন অনন্ত মহাবিশ্বের গভীর থেকে গভীরে ডুব দিতে চায়। কতটুকু সফল সে চেষ্টায়। ইতিহাস আর বিজ্ঞানের খেরোখাতায় চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক।
অতীতে দৈনন্দিন জীবনে আকাশ ছিল গুরুত্বপূর্ণ
এক শ বছর আগেও পৃথিবী কিন্তু বিজলি বাতির চমকানিতে এতখানি আচ্ছন্ন হয়নি। মনে করা যাক, সেই সময় হাঁটছি আমি গ্রামের পথে অমাবস্যার গা-ছমছম রাতে। কিন্তু সঙ্গে আছে আমার বন্ধুরা। হেমন্তের রাত, বর্ষার জলীয় বাষ্প নেই বায়ুমণ্ডলে, আবার জমিঘেঁষা শীতের কুয়াশাও নেই। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি, এক দিগন্ত থেকে আরেক দিগন্ত পর্যন্ত ধনুর মতো এক মেঘের ধারা। সেই অস্পষ্ট কুয়াশার মতো ধনুককে ছায়াপথ বা আকাশগঙ্গা বলে। সেই কবে তিন শ বছর আগে ইতালীয় বিজ্ঞানী গ্যালিলিও গালিলেই ছায়াপথকে দুরবিন দিয়ে দেখে সেখানে আবিষ্কার করেছিলেন অসংখ্য তারা। ছায়াপথ আসলে কোটি কোটি তারার সমষ্টি, এত দূর থেকে আমরা দেখি বলে সেগুলো মিলেমিশে মেঘের মতো দেখায়। ছায়াপথ হলো আমাদের গ্যালাক্সির মূল তল। আজকের দিনে এই ছায়াপথকে দেখতে হলে যেতে হবে নদীর চরে, নয় কোনো প্রত্যন্ত গ্রামে, যেখানে আধুনিক আলোর ঝলকানি প্রকৃতিকে ম্লান করে দেয়নি।
আকাশে সেই রাতে জ্বলজ্বল করছিল স্বাতী, অভিজিত্, রোহিণী। আমি ভাবলাম, আকাশের তারা দেখে কি আমি আজ বছরের কত তারিখ সেটা বলতে পারব, কিংবা সমুদ্র পাড়ি দিতে পারব অতীতের নাবিকের মতো? দীর্ঘশ্বাস ফেলি আমি, আমি জানি সেটা আমি পারব না।
অথচ রাতের আকাশ পৃথিবীর মানুষের দৈনন্দিন কাজের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল। চাষি তাঁর কৃষিকাজ শুরু করতেন পূর্ব দিগন্তে কোনো কোনো তারার প্রথম আবির্ভাবের সঙ্গে, নাবিকেরা সমুদ্র পাড়ি দিতেন নক্ষত্রমণ্ডলীর অবস্থান চিনে, জ্যোতিষীরা সারা বছর ধরে রাশিচক্রে গ্রহের অবস্থান পর্যবেক্ষণ করতেন, অমাবস্যার রাতে মেঘের মতো ছায়াপথ মানুষকে সম্মোহিত করে রাখত, পূর্ণিমার জোছনায় আধো আলোকিত গ্রামপথ হয়ে উঠত রহস্যময়, উজ্জ্বল নক্ষত্রদের একে অপরের পাশে সাজিয়ে পৃথিবীর কিংবদন্তিকে মানুষ আকাশে অমর করে রাখতে চাইত।
বর্তমানের শহরে রাতের আকাশ ম্রিয়মাণ
কিন্তু আজকের পৃথিবীর শহরে রাতের আকাশ বলতে কিছু নেই। সেখানে রাতের আকাশ লাল-হলুদ আলোয় উজ্জ্বল থাকে, বায়ুদূষণের ধোঁয়া মুছে দিয়েছে পেছনের উজ্জ্বল তারাখচিত মহাশ–ন্যকে। শহরের মানুষেরা ভুলে গেছে তাদের মাথার ওপর রয়েছে এক বিশাল মহাবিশ্ব, তারা সেই মহাবিশ্বের এক খুবই ক্ষুদ্র অংশ। শহরবাসীর সময় নেই ওপরের দিকে তাকানোর, রুজি-রোজগারের তাগিদে নাগরিকেরা গাদাগাদি করে চড়ে ভিড় বাসে, রাতে ফেরে বাসায় ক্লান্ত হয়ে। তবু ক্ষণিকের জন্য অনেকটা ভুলবশতই যখন তারা আকাশের দিকে চায়, তখন তাদের চোখে ধরা পড়ে দু-একটা তারা, যেমন লুব্ধক বা স্বাতী বা কোনো একটা গ্রহ, যেমন শুক্র বা বৃহস্পতি। কিন্তু সেই জ্যোতিষ্কদের ম্লান আলো জমকালো নিয়নের আলোর সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে না। তাই তারা মুহূর্তেই চোখ ফিরিয়ে নেয়, তারা চিন্তা করে না আকাশের গায়ে ম্রিয়মাণ প্রদীপরা আসলেই কী জিনিস।
আমাদের দৈনন্দিন জীবন এমনই যেন আকাশের প্রতি কৌতূহল মনে হবে বিলাসিতা: সেই শহরবাসী মনে করে আকাশের তারা চেনা যেন নেহাতই অকাজ, সাময়িক খেয়াল, দৈনন্দিন জীবিকার সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই। অথচ আমাদের জীবনের সঙ্গে মহাবিশ্বের এই জ্যোতিষ্কদের যোগসূত্র খুবই নিবিড়, আকাশের নক্ষত্ররা পৃথিবীতে জীবন বিকাশের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত, তাদের মাঝেই সৃষ্টি হয়েছিল পৃথিবীর সব ভারী মৌলিক পদার্থ—কার্বন, অক্সিজেন, লোহা, ইউরেনিয়াম। সেই পদার্থ দিয়েই মানবদেহ গঠিত। সৌরজগতের গঠন সন্ধান করতে গিয়ে আমরা সৃষ্টি করেছি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি, আকাশের গায়ে ম্লান আলোর বিন্দুর ওপর গবেষণা করেই আমরা জানতে পেরেছি আমাদের এই মহাবিশ্বের অতীত উত্স, বর্তমানের গঠন, ভবিষ্যতের প্রসারণ।
মহাবিশ্বের মাঝে আমাদের পাড়া
রাতের আকাশ মানুষকে কেন এত আকর্ষণ করে? যেখানে যাওয়া যায় না বা যাকে ছোঁয়া যায় না, স্বাভাবিকভাবেই তার মাঝে এক রহস্য থাকবে। আর আকাশের সেই নিকষ কালো অন্ধকার যেন অতল, তার শেষ নেই। সেই অসীম অতল মানুষকে ভাবায়, অনেকের মাথা যেন খারাপ করে দেয়।
কিন্তু রাতের আকাশে আমরা যা দেখি—চাঁদ, গ্রহমণ্ডলী, তারা, ছায়াপথ—সেগুলো আমাদের মহাবিশ্বের এক অতিসামান্য অংশ। তারা সবাই এই বিশাল মহাবিশ্বের এক কোনায় কয়েক হাজার আলোকবর্ষজুড়ে অবস্থিত। এই হচ্ছে আমাদের মহাজাগতিক পাড়া। আমরা কল্পনা করে নিতে পারি আকাশের ওই প্রতিবেশীদের মধ্যে হয়তো কোনো স্বজ্ঞান প্রাণী একইভাবে তার অন্ধকার আকাশের দিকে চাইছে, ভাবছে নক্ষত্র কণিকাদের প্রকৃত পরিচয় কী, ভাবছে তাদের মতোই চেতনাসম্পন্ন প্রাণী ওই অন্ধকার আকাশে আছে কি না।
আমি ভাবি, আমার মতো আর কেউ কি আছে এই মহাবিশ্বে?
কিন্তু আমাদের এই মহাজাগতিক পাড়াটা কি ইন্টারেস্টিং?
পৃথিবী আমাদের গ্যালাক্সির যে কোনায় অবস্থিত, সেই কোনাটা যে খুব আকর্ষণীয়, তা বলা যাবে না। আমাদের কাছাকাছি কোনো লাল দানব তারা নেই, উজ্জ্বল নীহারিকা নেই, খালি চোখে দেখার মতো উজ্জ্বল গ্যালাক্সি নেই। এন্ড্রোমিডা গ্যালাক্সি কিছুটা হয়তো দেখা যায় (তা-ও না দেখার মতোই)। এমনকি গ্রহগুলোও এমন দ–রে যে তারা দুরবিনেও কেমন যেন অধরা থাকে। রাতের আকাশে কালপুরুষ, সপ্তর্ষি, দক্ষিণের ক্রস এ রকম কিছু তারামণ্ডলী বাদ দিলে সে রকম চোখে পড়ার মতো কিছু নেই। [তবু আমাদের এই পাড়ার আকাশ হয়তো এত বোরিং ছিল না এক শ বছর আগেও। গত এক শ বছরে, বৈদ্যুতিক বাতির ব্যাপক ব্যবহারের সঙ্গে সঙ্গে, আলোদূষণের কারণে আকাশের যে নক্ষত্র ও নীহারিকা আমরা সহজেই দেখতে পেতাম, তা বিক্ষিপ্ত আলোর কণিকার পেছনে হারিয়ে গেছে। কিন্তু শুধু আলোদূষণই নয়, এর সঙ্গে যোগ হয়েছে বায়ুদূষণ। বায়ুদূষণের ভারী অণু ও যৌগ পদার্থও রাতের আকাশকে করেছে অস্বচ্ছ। আজ রাতের আকাশের সৌন্দর্য শুধু লোকালয় থেকে বহু দূরে বা উঁচু পাহাড়ের ওপর থেকে মাত্র পুনরুদ্ধার করা সম্ভব।]
আমাদের মহাজাগতিক পাড়া বোরিং কিন্তু বোরিং জিনিসটা খারাপ নয়: আমাদের মহাজাগতিক পাড়াটা তেমন ইন্টারেস্টিং নয়। কিন্তু এটা যে ইন্টারেস্টিং নয় কিংবা খুবই বোরিং, তার কিন্তু কয়েকটা ভালো দিক আছে। পৃথিবীতে প্রাণের উদ্ভব ও বিকাশকে সাহায্য করেছে মহাবিশ্বের এই কোনার শান্ত পরিবেশ। এখানে কাছাকাছি বাড়তি দু-একটা নক্ষত্র থাকলে সৌরজগতের ওপর তার মহাকর্ষীয় প্রভাব থাকত, আমাদের পৃথিবী হয়তো আরও উল্কাপাতের সম্মুখীন হতো। সেই উল্কাপাত জটিল জীবনের উদ্ভবে সাহায্য করত না। আমাদের আকাশ তখন ‘ইন্টারেস্টিং’ হতো, কিন্তু সেই পৃথিবীতে মানুষের আবির্ভাব হতো না। সেই ক্ষেত্রে আমাদের বোরিং আকাশ আমাদের বাঁচতে সাহায্য করছে।
এ ছাড়া আমাদের মহাজাগতিক পাড়া যদি এত বোরিং না হতো, তবে মহাবিশ্বের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত আমরা দেখতে পেতাম না। আমরা যদি ছায়াপথের কেন্দ্রের কাছাকাছি থাকতাম, তাহলে প্রচুর তারার আলোয় আকাশ উদ্ভাসিত থাকত, আমরা ছায়াপথের বাইরের মহাবিশ্বকে দেখতে পেতাম না।
লেখক: যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ায় রিভারসাইড কলেজের অধ্যাপক, নাসার সাবেক গবেষক
*লেখাটি ২০১৬ সালে বিজ্ঞানচিন্তার নভেম্বর সংখ্যায় প্রথম প্রকাশিত