৩২০০ মেগাপিক্সেলের বিশ্বের বৃহত্তম ক্যামেরা এখন প্রস্তুত

বিশ্বের সবচেয়ে বড় ক্যামেরা

শেষ হলো দীর্ঘ অপেক্ষা! দুই দশকের অক্লান্ত পরিশ্রমের পর অবশেষে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ও শক্তিশালী ক্যামেরার কাজ শেষ করেছেন বিজ্ঞানীরা। মূলত জ্যোতির্বিদ্যা ও জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানের জন্য এ ডিজিটাল ক্যামেরা তৈরি করা হয়েছে। লিগ্যাসি সার্ভে অব স্পেস অ্যান্ড টাইম বা এলএসএসটি (LSST) নামের অসাধারণ এ যন্ত্র আমাদের মহাবিশ্ব সম্পর্কে জ্ঞান অর্জনে যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করবে।

জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের মতে, এলএসএসটি ক্যামেরার নির্মাণ কেবল একটি প্রযুক্তিগত অগ্রগতি নয়, বরং মহাবিশ্ব অন্বেষণের ক্ষেত্রে যুগান্তকারী এক ঘটনা। যেহেতু এটি মানব ইতিহাসের সবচেয়ে শক্তিশালী ক্যামেরা, তাই এর সাহায্যে মহাকাশের এত দূরের বস্তুও দেখা যাবে, যা আগে কখনো আমরা দেখতে পাইনি।

৩ হাজার ২০০ মেগাপিক্সেল বা ৩.২ গিগাপিক্সেল রেজ্যুলুশনের এই ডিজিটাল ক্যামেরা তৈরি করেছে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার এসএলএসি ন্যাশনাল অ্যাক্সিলারেটর ল্যাবরেটরি। বর্তমানে বাজারে মোটামুটি ৫০ থেকে ১০৮ মেগাপিক্সিলের ক্যামেরা সমৃদ্ধ মোবাইল ফোন পাওয়া যায়। সেখানে এই ক্যামেরাটি ৩ হাজার ২০০ মেগাপিক্সেলের। ভাবুন একবার!

ক্যামেরাটির ওজন ৩ হাজার কেজি বা ৩ মেট্রিক টন। গড়পড়তা এশিয়ান নারী হাতির ওজনের প্রায় সমান। ক্যামেরাটির লেন্সও বিশাল—১.৫৭ মিটার। এর তোলা ছবি এত বড় হবে যে পূর্ণাঙ্গ ছবি প্রদর্শনের জন্য প্রায় ৩৭৮টি আধুনিক টিভি স্ক্রিনের প্রয়োজন হবে।

এটি ব্যবহার করে আকাশের ৩.৫ ডিগ্রিজুড়ে ছবি তুলতে পারবে এলএসএসটি।

সহজ ভাষায় বললে, একটি টেলিস্কোপকে বোঝার জন্য তিনটি জিনিস ভালোভাবে বোঝা লাগবে। এক, মিরর সিস্টেম; দুই, ফিল্ড অব ভিউ এবং তিন, ক্যামেরা।

মোট তিনটি আয়না নিয়ে গড়ে উঠেছে এলএসএসটির সম্পূর্ণ থ্রি-মিরর সিস্টেম। এটা মূলত ‘পল-বেকার থ্রি-মিরর অ্যানাস্টিগম্যাট’ নামে একধরনের ব্যবস্থার ওপর নির্মিত। ফলে এক বা দুই আয়নার টেলিস্কোপের চেয়ে অনেক স্পষ্ট ও অবিকৃত ছবি পাওয়া যাবে। এখানে প্রথম ও তৃতীয় আয়নাটি মূলত একটি কাচ দিয়েই তৈরি। ফলে এর মোট দৈর্ঘ্য আর অযথা বাড়েনি। তারপরও এর আয়নাগুলোর সম্পূর্ণ দৈর্ঘ্য হয়েছে ৮.৩ মিটার। মানে পুরো একটি টেনিস কোর্টের সমান!

এটি ব্যবহার করে আকাশের ৩.৫ ডিগ্রিজুড়ে ছবি তুলতে পারবে এলএসএসটি। এই ফিল্ড অব ভিউটা কত বড়, একটা উদাহরণ দিলে বোঝা যাবে। সূর্য ও চাঁদকে পৃথিবী থেকে ০.৫ ডিগ্রিজুড়ে দেখা যায়। আর মোটামুটি সাধারণ টেলিস্কোপগুলোর ফিল্ড অব ভিউ হয় সাকুল্যে ১ ডিগ্রি। এত বিশাল ফিল্ড অব ভিউর ছবি যে বিজ্ঞানীদের দারুণ কাজে আসবে, তা কি আর আলাদা করে বলার প্রয়োজন আছে?

বিশ্বের সবচেয়ে বড় এ ক্যামেরাটি রাখা হয়েছে চিলিতে

তার ওপরে আছে ৩.২ গিগাপিক্সেল ক্যামেরা! এর কথা তো আগেই বলেছি। এই কৃত্রিম চোখটি ১০ বছর ধরে ৩৭ বিলিয়ন গ্যালাক্সি এবং নক্ষত্রের ওপর চোখ বোলাবে। প্রতি ২০ সেকেন্ডে ১৫ সেকেন্ড এক্সপোজারের একটি করে ছবি তুলবে এটি। ফলে এক রাতের মধ্যেই জমা হবে প্রায় ২০ টেরাবাইটের মতো তথ্য! এই হিসাবে এক বছরে এটি দুই লাখের মতো ছবি তুলতে পারবে।

ক্যামেরাটি স্থাপন করা হয়েছে ভেরা সি. রুবিন অবজারভেটরিতে। এটি দক্ষিণ আমেরিকার দেশ চিলির আন্দিজ পর্বতে অবস্থিত। সমুদ্র থেকে প্রায় ২ হাজার ৭৩৭ মিটার ওপরে টেলিস্কোপটির অবস্থান।

সৌরজগৎ শেষ করে, মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি বা ছায়াপথের আরও পূর্ণাঙ্গ ত্রিমাত্রিক ছবি তৈরিতে বিজ্ঞানীদের এটি সাহায্য করবে।

এই অসাধারণ ক্যামেরার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলোর একটি হলো ডার্ক ম্যাটার সম্পর্কে আরও স্পষ্ট ধারণা পাওয়া। মহাবিশ্বের মোট ভরের প্রায় ৮৫ শতাংশ এই ডার্ক ম্যাটার বা গুপ্ত বস্তু। অর্থাৎ অজানা ভর। যে ভরের কথা আমরা জানি, পরোক্ষভাবে এর প্রমাণ পাওয়া যায়, তবে প্রত্যক্ষভাবে আজও এর সন্ধান মেলেনি। রুবিন অবজারভেটরির প্রকল্পের নির্মাণ পরিচালক জেলকো ইভেজিচ (Željko Ivezić) বলেন, ‘সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র ও রাতের আকাশের সবচেয়ে তথ্যপূর্ণ মানচিত্র তৈরি করতে সক্ষম এই ক্যামেরাটি।’

এলএসএসটির মোট চারটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য-উদ্দেশ্য আছে। ডার্ক ম্যাটার বা গুপ্ত বস্তুর সন্ধানের পাশাপাশি এর দ্বিতীয় কাজ, মহাবিশ্বের বিভিন্ন বস্তুর আরও পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরিতে সাহায্য করা। ৯৬৪ সালে পারস্যের জ্যোতির্বিজ্ঞানী আবদ্-আল-রাহমান আল-সুফির লেখা বুক অব ফিক্সড স্টারস–এর হাত ধরে এ তালিকা তৈরির কাজ শুরু হয়েছিল। তারপর কত শত ভূ-টেলিস্কোপ, নভোটেলিস্কোপ যে এ নিয়ে কাজ করেছে! সেই লম্বা তালিকায় এবার যোগ দিতে যাচ্ছে এলএসএসটি।

এর আরেকটি কাজ, নিয়ত পরিবর্তনশীল আকাশের বিভিন্ন বস্তু আবিষ্কার করা। কী ধরনের পরিবর্তন ঘটছে, সেগুলো খেয়াল রাখা। প্রতিবছর একই জায়গা থেকে আকাশের বিভিন্ন জিনিসের দুই লাখ ছবি তোলার অর্থ, সুপারনোভা বা গামা রশ্মির বিস্ফোরণ কিংবা বিচিত্র সব জিনিস চিহ্নিত করার জন্য এটি একেবারে আদর্শ। সেই সঙ্গে সৌরজগতের সবচেয়ে দূরবর্তী অঞ্চল, কুইপার বেল্টের শত-সহস্র নতুন বস্তুকেও এটি চিহ্নিত করতে পারবে বলেই আশা করা হচ্ছে।

সৌরজগৎ শেষ করে, মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি বা ছায়াপথের আরও পূর্ণাঙ্গ ত্রিমাত্রিক ছবি তৈরিতে বিজ্ঞানীদের এটি সাহায্য করবে। ছোট, ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিভিন্ন বস্তুর যে স্পষ্ট ছবি তোলার ক্ষমতা এলএসএসটির আছে, আগের কোনো টেলিস্কোপেরই তা ছিল না। এ থেকে মিল্কিওয়ের সৃষ্টি ও গঠনের ব্যাপারে বেশ গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যাবে বলে ভাবছেন বিজ্ঞানীরা। এর সাহায্যে পৃথিবী থেকেই মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির আনুমানিক ১৭ বিলিয়ন নক্ষত্রের বিশাল মানচিত্র তৈরি করা সম্ভব হবে।

এর ছবি এত শক্তিশালী হবে যে ২৪ কিলোমিটার দূরে থাকা একটি টেনিস বলের ছবি স্পষ্টভাবে তুলতে পারবে এটি।

২০১৪ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশন (NSF) প্রকল্পটির জন্য তহবিলের অনুমোদন দেওয়ার পর আনুষ্ঠানিকভাবে এর নির্মাণ কাজ শুরু হয়। ইউনাইটেড স্টেটস ডিপার্টমেন্ট অব এনার্জি এ ক্যামেরা নির্মাণে আর্থিকভাবে সহযোগিতা করে। এটি পরিচালিত হবে অ্যাসোসিয়েশন অব ইউনিভার্সিটি ফর রিসার্চ ইন অ্যাস্ট্রোনমির অধীনে। এ ক্যামেরা নির্মাণে মোট ব্যয় হয়েছে প্রায় ৬৮০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। টাকার অঙ্কে হবে প্রায় ৭ হাজার ৪৪২ কোটি ২২ লাখ ৬০ হাজার টাকা!

অনেকে ভাবতে পারেন, মহাবিশ্বের দূরতম ছবি তোলার জন্য তো জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপই আছে, তাহলে আবার এই ক্যামেরা কেন?

সহজ ভাষায় বললে, এই ক্যামেরার সাহায্যে তোলা ছবিগুলো জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের চেয়ে আরও বেশি নিখুঁত হবে। এর ছবি এত শক্তিশালী হবে যে ২৪ কিলোমিটার দূরে থাকা একটি টেনিস বলের ছবি স্পষ্টভাবে তুলতে পারবে এটি। মহাকাশে প্রতি ১৫ সেকেন্ডে চাঁদের চেয়ে ৭ গুণ বড় অংশের ছবি তুলতে পারবে ক্যামেরাটি। আগেই বলেছি, এভাবে টানা ১০ বছর চলবে এর কাজ। এই সময়ের মধ্যে মহাকাশের একটা নির্দিষ্ট স্থানে ঘটে যাওয়া যেকোনো পরিবর্তন সবিস্তারে পর্যবেক্ষণ করা হবে এর মাধ্যমে। নতুন গ্যালাক্সি বা নক্ষত্রের জন্ম-মৃত্যু হলেও এ ক্যামেরার সাহায্যে বোঝা যাবে।

বিজ্ঞানীদের আশা, ২০২৫ সালের শুরুতে ক্যামেরাটি ছবি তোলার কাজ শুরু করবে। তবে সাধারণ মানুষের জন্য তা প্রকাশ করা হবে ২০২৭ সালের দিকে। গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডের তথ্যমতে, এটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় সর্বোচ্চ রেজ্যুলুশন সমৃদ্ধ ক্যামেরা।

লেখক: শিক্ষার্থী, ঢাকা কলেজ, ঢাকা

সূত্র: স্পেস ডটকম, বিবিসি সায়েন্স ফোকাস, বিজ্ঞানিচন্তা ও উইকিপিডিয়া